#কলঙ্ক
#২১তমো_পর্ব
#অনন্য_শফিক
‘
‘
‘
পিয়া সোইসাইড করেছে।সিলিং ফ্যানে ঝুলছে তার মরদেহ।মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে।আর জিভটা কামড়ে পড়ে আছে।কী বীভৎস যে দেখা যাচ্ছে ওকে!
সবাই হৈচৈ করছে। প্রভোস্ট ম্যাম প্রক্টোরিয়্যাল বডিকে ফোন করেছেন।তারা পুলিশকে খবর দিবে। এরপর পুলিশ আসবে। এসে তার লাশ নামাবে।
আমার ওকে এভাবে দেখে খুব মায়া হচ্ছে। খুব করে জানতে ইচ্ছে করছে কেন এমন করলো পিয়া! কিন্তু কোন ভাবেই জানতে পারছি না।কেউ কিছুই জানে না!
‘
ঘন্টা খানেক পর সবকিছু জানা গেল। পিয়ার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।ঢাকার এক ধনকুবেরের ছেলের সাথে তার প্রেম ছিল। সেই ছেলের ডাকে মাঝে মধ্যে সে ছেলের বাসায় গিয়ে রাত্রীযাপন করতো।ছেলে কথা দিয়েছিল তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু বিয়ে তো দূরের কথা ওকে একেবারে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্যই ওদের একান্ত মুহূর্তে করা একটা ভিডিওই আপলোড দিয়ে ফেললো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।পিয়া বুঝতে পারেনি হয়তোবা কোনদিন যে এমন দুর্দিন তার আসবে!
পিয়ার দিকে তাকিয়ে আছি আমি।ওর বিকৃত মুখটার দিকে তাকিয়ে বারবার মনে হচ্ছে আমার নিজের কথা।মনে হচ্ছে আমাদের মতো ভুক্তভোগী অনেক অনেক মেয়ের কথা।যারা ছেলেদের অল্প কথায় গলে গিয়ে যা তা করতে রাজি হয়ে পড়ে।তার প্রেমিক একটু আদর করে যদি বলে,সোনা, তোমায় নিয়ে একটা ভিডিও বানাতে চাই!
মেয়েটা প্রথম প্রথম রাজি হয় না।বলে,ভিডিও করতে হবে কেন?কী প্রয়োজন এসবের?
ছেলেটার কাছে কিন্তু যুক্তি আছে।সে বলে’এই ভিডিওর মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রেমের স্মৃতি ধরে রাখতে চাই। একদিন যখন আমরা বৃদ্ধ হয়ে যাবো তখন এই ভিডিও দেখে আফশোস করে বলবো,কী রঙিন দিন ছিল আমাদের!
মেয়েটা তখন তার প্রেমিকের কথায় গলে গিয়ে নিজের জীবনটা তুলে দেয় প্রেমিকের হাতে।সে তখন বুঝতেও পারে না এই ভিডিওটাই তার মৃত্যুর কারণ হবে একদিন।
আসলে আমাদের স্বতর্ক হওয়া উচিৎ।যে প্রেমিক প্রেমিকার ন্যুড চায়,ভিডিও ধারণ করতে চায় একান্ত মুহূর্তের সেই প্রেমিক সত্যিকার প্রেমিক নয়। সেই প্রেমিক ভন্ড। সেই প্রেমিক প্রতারক!
‘
পিয়া হয়তোবা মৃত্যুর আগে কাউকে বিষয়টা বলতেও পারেনি। বন্ধুর অভাব।ওর যদি একটা ভালো বন্ধু থাকতো যে কিনা তাকে সুন্দর সমাধান দিতে পারতো, তাকে বুঝিয়ে বলতে পারতো, এরজন্য মৃত্যু সমাধান নয়। বেঁচে থাকাই বরং সমাধান। তবে কিন্তু সে মরে যাওয়ার আগে ভাবতো। হয়তোবা আজ সে এভাবে ঝুলে থাকতো না!
আমার নিজের খুব খারাপ লাগছে। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে।মনে হচ্ছে ওইদিন রাতে ওর সাথে যে খারাপ ব্যবহার করেছি আমি তা করা একদমই উচিৎ হয়নি।ওর সাথে যদি আমার ভালো বন্ধুত্ব থাকতো তবে কী আর সে এভাবে সোইসাইড করতে পারতো?পারতো না।আমি তাকে বুঝাতাম। বলতাম, মৃত্যু কেন সমাধান নয়। বেঁচে থাকাই কেন সমাধান।
‘
পুলিশ এসে গেছে।লাশ নামানো হচ্ছে। আমার চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ইশ্!একটা তরতাজা মেয়ে,যে ছিল চতুর,যাকে ঠকানো ছিল দূরুহ ব্যপার। সেই মেয়ে কীভাবে নিজেকেই নিজে এভাবে ঠকিয়ে ফেললো!
আমি কাঁদছি।দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছি।
হঠাৎ আমার পিঠে কারোর হাতের কোমল স্পর্শে চমকে তাকাই।ম্যাম।ম্যাম আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,’খুব খারাপ লাগছে ওর জন্য তাই না?’
আমি কান্নাভেজা গলায় বললাম,’হুম। খারাপ লাগছে!’
ম্যাম নিজেও টিস্যু দিয়ে নিজের চোখ মুছলেন। তারপর বললেন,’আমাদের মেয়েগুলো কেন যে এতো বোকা!একটা ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেছে আর এই জন্য সোইসাইড করে ফেলতে হবে!হ্যা জানি এটা খুব ভয়ংকর। কিন্তু এই ভয়ংকর সময়টা যে কাটিয়ে উঠতে পারে সেই মহান হয়! মেয়েটা ইচ্ছে করলেই মহিয়সি হতে পারতো!ভুল করলো। অনেক বড় ভুল করলো মেয়েটা!’
ম্যাম বললেন,’আসো। এখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসবে আমাদের!’
ম্যাম আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বাইরের দিকে। তারপর হেঁটে হেঁটে আমায় নিয়ে গেলেন ভার্সিটি ক্যাম্পাসে।আমরা গিয়ে সেদিনের মতো বসলাম ক্যাম্পাসের সবুজ দূর্বাঘাসের উপর।
ম্যাম এবার আমায় জিজ্ঞেস করলেন,’পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?’
আমি বললাম,’হচ্ছে ম্যাম। এখন আমি খুব আগ্রহ ভরে পড়ি। আমার ভেতর খুব জেদ কাজ করে।’
‘বাহ্ ভালো তো। এভাবেই পড়তে হবে। এখন থেকে মনে করতে হবে এই পড়াশোনাটাই তোমার যোদ্ধাস্ত্র।বুঝেছো?’
‘জ্বি ম্যাম।’
‘তো মেহরাবের কী খবর? ফোন টোন করে নাকি?’
ম্যামের মুখ থেকে মেহরাবের নামটা শুনে ভেতরটা কেমন মুছড়ে উঠলো। বুকের ভেতরটা কেমন খা খা করতে লাগলো।
আমি আবেগ জড়ানো গলায় বললাম,’ম্যাম,সব ছেলেরাই প্রতারক।এমনকি মেহরাবও।’
ম্যাম অবাক হওয়া চোখে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,’কেন কী করেছে ও?’
আমি বললাম,’মা ফোন করে বললেন,ওর নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’
ম্যাম বললেন,’মেহরাব ফোন করে কিছু জানিয়েছে?’
আমি বললাম,’না।’
ম্যাম মৃদু হেসে এবার বললেন,’ওর প্রতি তোমার কেমন বিশ্বাস আছে?’
আমি বললাম,’অনেক!’
‘তবে তুমি সে পর্যন্ত অপেক্ষা করো যতোক্ষণ না তুমি প্রতিষ্ঠিত হতে পারছো! তারপর দেখো মেহরাব তার কথা রাখে কি না!কথা না রাখলে ওকে আচ্ছা মতো লজ্জা দিবে।প্রয়োজনে আমায় খবর দিয়ে নিবে। তারপর দুজন মিলে ওকে আচ্ছামতো বকে দিবো!’
ম্যামের কথা শুনে এই কষ্টের মাঝেও আমি হেসে ফেললাম।
——————————————————————-
পরীক্ষা এসে গেছে। পরীক্ষার জন্য খুব ভালো প্রস্তুতিও আছে এবার।আশা করা যায় পরীক্ষা অনেক ভালো হবে।হতেই হবে ভালো!
পরীক্ষার হলে যাওয়ার আগে ম্যামের সাথে একবার দেখা করে গেলাম।ম্যাম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া পড়লেন। তারপর বললেন,’সাহস রাখবে।আর রিল্যাক্স মুডে পরীক্ষা দিবে।মনে করবে তুমি সব পারো। তোমার মতো এই হলে আর কেউ পারে না!’
আমি খুশি মনে ম্যামের পা ছুঁয়ে সালাম করে ইউনিভার্সিটি চলে যাই। পরীক্ষা দেই। খুব ভালো পরীক্ষা হয় আমার। শুধু একটি নয়। সবকটি পরীক্ষায় ভালো হয়। কিন্তু মার্কস নিয়ে আমার ভয় হয়!না জানি স্যার ম্যামরা ঠিক মার্কস দেন কি না!
ম্যাম আমায় আশ্বস্ত করেন।বলেন, তুমি সবচেয়ে বেশি ভালো করবে দেখো! এখন রিল্যাক্স থাকো!
‘
রমজান মাস এসে গেছে। ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে গেছে।আমি তো বাড়ি যাবো না। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আগ অবধি কিছুতেই বাড়ি যাবো না।মা গতকাল ফোন করে কেঁদেছে।বাবাও আহাজারি করেছে।ভাইয়াও বলেছিল যাওয়ার জন্য।আমি না করে দিয়েছি।বলেছি, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ অবধি বাড়ির কারোর সাথে দেখাও করবো না!
‘
রমজানের পনেরো তারিখ। হোস্টেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।আমি ভয় পাচ্ছিলাম কোথায় থাকবো এই দিনগুলো। সেদিন বিকেলেই ম্যাম গাড়ি নিয়ে এলেন। বললেন, তোমার জিনিস পত্র নিয়ে গাড়িতে উঠো।’
আমি অবাক হই।বলি,’গাড়িতে উঠে কোথায় যাবো ম্যাম?’
ম্যাম বলেন,’মায়ের বাড়িতে।’
আমি ভেজা গলায় বলি,’না ম্যাম আমি তো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কিছুতেই গ্রামে ফিরে যাবো না!’
ম্যাম আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,’বোকা মেয়ে। তোমার গ্রামের মায়ের বাড়িতে না। শহরের মায়ের বাড়িতে যাবে। আমার বাড়ি যাবে। এখন থেকে আমার বাড়িই তোমার বাড়ি। পড়াশোনা থাকা খাওয়া সব আমার এখানে।বুঝেছো?’
আমি আর কথা বলতে পারি না।ম্যামকে জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠি!
‘
‘
চলবে