#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
লাবিবা ওয়াহিদ
৩৬.
আজ তুষার সুদূর প্রবাস থেকে স্বদেশে ফিরবে। এজন্যে বাসাতে লেগেছে উৎসব। নূরজাহান একা হাতে ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করছে। খাবারের ঘ্রাণে পুরো বাসা মৌ মৌ করছে। নওরি বসে বসে নূরজাহানের কান্ড দেখছে। ঠোঁট থেকে যেন হাসি সরছেই না তাঁর। নওরি আজ ভার্সিটি যেতে পারেনি। বরং নূরজাহান-ই যেতে দেয়নি। তুষার বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে দুপুর একটায়। এরপর ইমিগ্রেশন-সহ বাকি সব কাজ শেষ হতে হতে কত সময় লাগবে তাঁর কোনো ধারণা নেই। তবে নূরজাহান’রা দেড়টার মধ্যে এয়ারপোর্টে থাকবে। আফিফা নূরজাহানের সাথে কাজে হাত লাগানোর চেষ্টা করছে। নওরি হাতে ফোন নিয়ে চেক করছে বারবার। গতকাল থেকে ইরা’দকে নওরি দেখতে পায়নি। নিদ্র’র থেকে শুনেছে, ইরা’দ কী কাজে নাকি চট্টগ্রাম গিয়েছে। কতদিনের জন্যে তা জানা নেই। নওরি ভীষণ চিন্তিত। একটাবারের জন্যেও কেন ইরা’দ তাকে জানালো না? নওরি ফোন করলেও ফোন বারবার সুইচড অফ বলছে। চাপা নিঃশ্বাস ফেললো সে। নওরিকে একা বসে থাকতে দেখে আফিফা এগিয়ে এলো।
–“ফোনে এত কী দেখছো?”
নওরি হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“এক আপুর কল করার কথা ছিলো।”
আফিফা সরু চোখে নওরিকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
–“ওহ!”
নিদ্র এবং ফ্রিশা সারা বাসায় ছুটাছুটি করছে। নিদ্র তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে বারবার একই বাক্য উচ্চারণ করছে,
–“আমার তুষার ভাইয়া আসবে।”
ফ্রিশা কেন দৌড়াচ্ছে সে নিজেই বলতে পারে না। তবে নিদ্রকে দৌড়াতে দেখে সে নিজেও ছুটছে। আজ বৈঠকঘরে সৈকত সাহেবের সাথে সিদ্দিক সাহেব আড্ডা জমিয়েছে। দুই ভাই অনেকদিন পর সব কাজ ফেলে নিজেদের জন্যে সময় পেয়েছে। দুই ভাইয়ের মধ্যেই উচ্ছাস লক্ষণীয়। সকালের দিকে মৌসুমি এসেছিলো নূরজাহানের রান্নায় সাহায্য করতে। যাওয়ার পথে হঠাৎ-ই নওরির সাথে মৌসুমির দেখা হয়ে গিয়েছিলো। নওরিকে দেখে মৌসুমির মুখশ্রী জুড়ে রাগের আভাস ছড়িয়ে গেছিলো। নওরি অবশ্য সেই রাগের কারণ বুঝতে পারেনি তবে সে ভীষণ ভয় পেয়েছে। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছিলো যেন তাঁর। মৌসুমিকে নওরি ভীষণ ভয় পায়। সেই সময়ে মৌসুমি কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলো।
অবশেষে যোহরের আযানের পরপর সকলে রওনা হয় তুষারকে আনতে। নওরি, মৌসুমি এবং মাজেদা বেগম বাদে সবাই গিয়েছে এয়ারপোর্টে থেকে তুষারকে রিসিভ করতে। ইরা’দ চট্টগ্রামে আছে বিধায় সে যেতে পারেনি। তুষার আসবে, তা জানে কী না সন্দেহ। তুষার ইরা’দের চেয়ে দুই বছরের ছোট। তাও তাদের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। নূরজাহান নওরিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু নওরি রাজি হয়নি কোনোভাবেই। কারণ, সে বুঝতে পেরেছে আফিফা তাকে কোনো কারণে সন্দেহ করছে। তাই সন্দেহ থেকে বাঁচতে নওরি যায়নি। এছাড়া ইরা’দ নেই। ইরা’দের জন্যে তাঁর হৃদয় বিষণ্ণ। এই বিষণ্ণতায় তাঁর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। সকলে চলে গেলে নওরি তাঁর বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। যার ফলে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি।
ফ্রিশাও নওরির সাথে থেকে গেছে। নওরিকে ঘুমোতে দেখে ফ্রিশাও রুমের এক কোণে চোখ বুজে শুয়ে পরেছে।
নওরির ঘুম ভাঙলো সারিফার ফোনকলে। নওরি ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে কল রিসিভ করলো। ধীরগলায় বললো,
–“হ্যালো!”
–“আপু, আমরা কাছাকাছি চলে এসেছি। তুমি ঠিক আছো তো?”
নওরি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। আশেপাশে তাকিয়ে ঘড়িতে নজর পরলে দেখে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। নওরির এ-ও মনে পরলো আজ তুষার আসতে চলেছে। সকলে তাকেই রিসিভ করত্র গিয়েছে। নওরি উঠে বসতে বসতে বললো,
–“ঠিকাছে। সাবধানে এসো!”
কল কেটে নওরি ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে বারান্দায় চলে গেলো। বারান্দায় কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ইরা’দের বারান্দাটা দেখলো। মনমরা হয়ে কিছুক্ষণ বারান্দায় কাটিয়েই ভেতরে চলে আসলো। ভেতরে এসে শুনতে পায় অনেকের সড়গোলের শব্দ। নওরির বুঝতে বাকি নেই যে ওরা সবাই চলে এসেছে। মাথায় ভালোমতোন কাপড় মুড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে। বেরিয়ে এসে দেখলো সকলের মাঝে মধ্যমণি তুষারকে ভেতরে প্রবেশ করতে। তুষার দেখতে খুব একটা খারাপ না। বরং সুপুরুষই। তাঁর গা ঘেঁষেই আছে আফিফা। তুষারের হঠাৎ নওরির দিকে চোখ পরতেই নওরি অস্বস্তিবোধ করলো। তুষার কোনোরকমে পায়ের জুতো খুলে সবার আগে এগিয়ে এলো নওরির দিকে। তুষারকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে নওরি বিস্মিত হলো। বাকিরা ওদের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। নওরির দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে তুষার বললো,
–“ফাইনালি আমি তোমার দেখা পেয়েছি। এয়ারপোর্টে আসোনি কেন আমায় রিসিভ করতে?”
নওরি হতভম্ব হয়ে একবার তুষারের দিকে তো আরেকবারে বাকিদের দিকে তাকাচ্ছে। আফিফার চেহারার রং পালটে গেছে। সারা রাস্তা তুষার নওরির কথা-ই বলে গিয়েছে, যা শুনে আফিফা মহা বিরক্ত।
সারিফা হাসি-মুখে এগিয়ে এসে বলে,
–“নওরি আপু কিছুটা অসুস্থ ভাইয়া, তাই যেতে পারেনি!”
অসুস্থতার কথা শুনে তুষার নওরির কপালে হাত রাখতে গেলে নওরি জড়তায়, অস্বস্তিতে পিছিয়ে গেলো। বড়ো বড়ো চোখে তুষারকে দেখে হন্তদন্ত পায়ে নিজের রুমে চলে গেলো।
রাতে সারিফা এসেছে নওরির ঘরে গিফট নিয়ে। তুষার তাঁর হাত দিয়ে পাঠিয়েছে। তুষার আসার পর থেকে নওরি ঘর থেকেই বের হয়নি৷ যেই রুম থেকে বের করতে চেয়েছে নওরি অসুস্থতার বাহানা দিয়েছে। সারিফার হাতে কয়েকটা রঙিন কাগজে মোড়ানো গিফট দেখে অবাক হয়ে বলে,
–“এগুলো কী সারিফা?”
–“ভাইয়া আসার সময় সকলের জন্যেই গিফট নিয়ে এসেছে। এগুলো তোমায় দিয়েছে ভাইয়া। তুমি তো রুম থেকে বের হওনি তাই আমাকেই এসে দিতে হলো।”
নওরি বিব্রতবোধ করলো। তাঁর ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ওদের মাঝে থাকতে। উপরওয়ালা তাকে কোন পরীক্ষায় ফেললো কে জানে? এমন সময়ে ইরা’দও শহরের বাইরে! কী করবে নওরি বুঝে উঠতে পারছে না। নওরি নিচ্ছে না দেখে সারিফা কিছু বলতে নিবে তখনই রুমে প্রবেশ করলো আফিফা। আফিফাকে দেখে সারিফা গিফট রেখে রুমের বাইরে চলে গেলো। আফিফা হঠাৎ বলে ওঠে,
–“গিফট নেয়া হচ্ছে বুঝি? নাও, তুমি তো এখন খুব খুশি আমার ভালোবাসায় আ!গুন লাগিয়ে। ভেরি গুড!”
আফিফা এই বলে নওরির রুম থেকে চলে যেতে নিলে নওরি থামালো তাকে। আফিফা নওরির পিছুডাক শুনে ফিরে তাকালো। নওরির চোখের ইশারায় বললো,
–“এদিকে আসো!”
আফিফা তাচ্ছিল্যের সাথে নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এসে নওরির বিছানায় বসলো। নওরি আফিফার দিকে শান্ত নয়নে চেয়ে বলে,
–“কেউ তোমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নেয়নি আপু!”
–“মজা নিচ্ছো? আমি কিন্তু বলে রাখছি..”
নওরি হঠাৎ আফিফার দুই হাত নিজের মুঠোজোড়ায় আগলে নিয়ে ধীরগলায় বললো,
–“তুমি যেরকম ভাবছো ওরকম কিছুই না আপু। তোমার ভুল ধারণা সব।”
–“তাহলে ঠিক ধারণাটা কোনটা?”
–“তুষার ভাইয়ার সাথে আমার ওরকম কোনো সম্পর্ক নেই যেমনটা তুমি ভাবছো। এখানে আমি পড়তে এসেছি, নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে এসেছি। তুষার ভাইয়ার সাথে ফোনালাপে হাতে গোণা কয়েকবার কথা হয়েছে। এছাড়া সরাসরি কখনোই আমাদের দেখা হয়নি আর…”
নওরির কথার মাঝে ফোড়ন কেটে আফিফা বললো, –“এক্সকিউজ শুনতে চাইনি আমি। মনে রাখবে এক হাতে তালি বাজে না। তাই নিজেকে সাধুও ভেবো না।”
এমন পর্যায়ে এসে নওরি কী করবে ভেবে পেল না। অসহায় অনুভব হলো। আলতো স্বরে বললো,
–“আমি বিবাহিত আপু!”
নওরির মুখে এমন কথা শুনে আফিফা আকাশ ভেঙে পরলো। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে রইলো নওরির পানে। ততক্ষণে নওরি নজর নিচে নামিয়ে ফেলেছে। আফিফা অবাকমিশ্রিত কন্ঠে বললো,
–“মানে? সত্যি? কী বলছো?”
নওরি মাথা নিচু করে বলে,
–“সত্যি বলছি। জীবনের প্রথম ভালোবাসাই আমার স্বামী। তাই তুষার ভাইয়াকে নিয়ে অন্যকিছুর প্রশ্ন-ই আসে না। তুমি বিশ্বাস করছিলে না তাই জানালাম তোমায়। দয়া করে এই খবর কারো সাথে শেয়ার করিও না। আমি কখনোই তোমাদের মাঝে আসিনি!”
———————-
রাতের বেলায় নওরি ব্যতীত ছোট-বড়ো সকলেই আডড্ডায় বসলো। আড্ডার এক সময়ে নূরজাহান তুষারের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“তোর জন্যে সুসংবাদ আছে তুষার!”
তুষার নূরজাহানের দিকে ফিরে হাসি দিয়ে বলে,
–“কী সুসংবাদ মা?”
নূরজাহান মুচকি হেসে একপলক আফিফার দিকে চাইলো। আফিফা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে! নূরজাহান আফিফার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে,
–“আফিফার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছি!”
এরকম একটি খবর শুনে তুষার বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। চোখ থেকে যেন ফুলকি বেরোচ্ছে। সকলে তুষারের এভাবে উঠে যাওয়া দেখে ভীষণ অবাক হলো। তখনই নওরি খাবারের জন্যে রুম থেকে বেরিয়েছে। তুষার নওরির দিকে তর্জনী তাক করে থমথমে সুরে বলে,
–“আমি নওরিকে ছেড়ে কাউকে বিয়ে করবো না মা। আমার নওরিকে পছন্দ। তুমি তাকেই আমার পাত্রী হিসেবে গ্রহণ করো।”
®লাবিবা ওয়াহিদ
——————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।