এক মুঠো প্রেম রঙ্গনা পর্ব-৩৫

0
996

#এক_মুঠো_প্রেম_রঙ্গনা
[২য় পরিচ্ছেদ]

৩৫.
ইরা’দকে দেখতেই নিদ্র ছুটে চলে গেলো ইরা’দের নিকট। ইরা’দের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে,
–“ফটকি বেগম ভালো না। আমার নৌরি ফুলকে নিয়ে বাজে কথা বলে!”
ইরা’দ রক্তচক্ষু চাহনি নিক্ষেপ করে আছে লতিফার দিকে। লতিফার তো ভয়ে থুঁতনি গলায় গিয়ে ঠেকেছে। নূরজাহান অবাক নয়নে চেয়ে বলে,
–“আমাদের বিশ্বাসের এই প্রতিদান দিলে লতিফা?”

হঠাৎ ইরা’দ ক্ষিপ্ত স্বরে বলে ওঠে,
–“শুধুই বিশ্বাস না চাচী, কথার গোপনীয়তা ভঙ্গ করেছে উনি। ওনার সাহস কী করে হয় নওরির নামে মিথ্যে ছড়ানোর? সাহস কে দিয়েছে তোমাকে? হাউ ডেয়ার ইয়্যু!”

শেষোক্ত ধমকে লতিফার অন্তর কেঁপে উঠলো। হঠাৎ কেঁদে উঠে বলে,
–“মাফ কইরা দেন। আর কখনোই এমন হইবো না!”
–“তোমার মাফ তোমার কাছেই রাখো। আর জীবনেও যদি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় দেখেছি তোমাকে! একটা মিথ্যে ছড়ানোর শা!স্তি হিসেবে তোমার রোজকার শেষ। এখন তোমার ছেলে-মেয়েকে মিথ্যে দিয়েই পেট ভরিও। ডাফার!”

ইরা’দ হনহন করে বেরিয়ে গেলো। লতিফা নূরজাহানের হাত-পা ধরে মাফ চাইলো। কিন্তু নূরজাহান লতিফাকে এড়িয়ে চললো। সেও ভীষণ ক্ষিপ্ত। তবে ইরা’দের মতোন সে ক্ষিপ্ততা দেখাতে চাচ্ছে না বলেই এড়িয়ে চলাকেই শ্রেয় মনে করছে।

———————–
–“হ্যালো, মাহি আপু?”
–“কে? নওরি? উফফ, থ্যাঙ্ক গড তোর খোঁজ আমি পেয়েছি। কেমন আছিস বোন আমার? তোর নাম্বার অফ দেখে কতটা ভয় পেয়ে গেছিলাম জানিস?”

নওরি বারান্দায় বসে আনমনে বাইরে চেয়ে আছে। মাহির প্রত্যেকটি কথা কানে প্রবেশ করতেই বলে উঠলো,
–“তুমি নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলে। আর আমিও ভালো আছি!”
–“যাক, তাহলে ভালো। কিন্তু এই নাম্বার কার? আগের নাম্বার কোথায়?”
নওরি সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,
–“আমি বিয়ে করেছি আপু!”
মাহি যেন আকাশ থেকে পরলো। ফোনটা কান থেকে পরতে পরতে বেঁচে গেলো। চোখ বড়ো বড়ো বিস্মিত স্বরে বলে,
–“মজা করছিস?”
–“কেন করব?”

থমকালো মাহি। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকলো সে। অপ্রত্যাশিত খবরে তাঁর মস্তিষ্ক যেন কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। কী বলবে, কী বলা উচিত বুঝে উঠতে পারলো না। ক্ষণিক সময় পর নিজেকে সামলে বললো,
–“কার সাথে হয়েছে?”
–“নেতা সাহেবের সাথে।”
মাহি আবারও বিষম খেলো।
–“মানেহ?”
নওরি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে একে একে সবটা খুলে বললো। সব শুনে কীরকম পতিক্রিয়া জানানো উচিত তা মাহি বুঝে পেলো না। নওরি আবার বলে ওঠে,
–“সিদ্ধান্তহীনতা কাটাতে তোমায় অসংখ্যবার কল করেছিলাম মাহি আপু। কিন্তু তুমি নেটওয়ার্কের বাইরে ছিলে!”
–“দুঃখিত বোন। আসলে আমার দাদু মা!রা গেছে। তাই গ্রাম থেকে ফিরতে চেয়েও পারিনি!”
মাহির মুখ থেকে এরকম দুঃসংবাদ পেয়ে নওরির মন বিষণ্ণ হলো। নিচু স্বরে বলে ওঠে,
–“স্যরি!!”
–“আরে ইট’স ওকে। তোর কথা বল, ইরা’দ কী ভালোবাসে তোকে?”

এই একটা প্রশ্নে নওরি হঠাৎ লজ্জায় নুইয়ে পরলো। আমতা আমতা করে বললো, “হুম!”
–“এমা! লজ্জা পাচ্ছিস? বাসর টাসর করে ফেললি নাকি?”
–“মাহি আপু প্লিজ! এসব কিছুই না। তুমি বেশি বুঝছো!”
মাহি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসি বজায় রেখে বলে,
–“অল ক্রেডিট গোস টু মি। আমার জন্যেই তো ওই শহরে গেলি, ভালোবাসার মানুষ পেলি। আমি না থাকলে জীবনভর প্রিতমকে সহ্য করতে হতো তোকে।”

—————
রআতে হঠাৎ কল এলো নওরির। নওরির সবে চোখ লেগেছিলো। রিংটোনের শব্দে সে উঠে বসলো। ঘুমের ঘোরে এদিক ওদিক তাকিয়ে ফোন খুঁজলো। ফোনটি হাতে নিয়ে দেখলো ইরা’দ কল করেছে। ইরা’দকে দেখে নওরির ঘুমের রেশ কিছুটা কমে এলো। তৎক্ষণাৎ কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইরা’দ বলে ওঠে,
–“ডিস্টার্ব করলাম?”
নওরি চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
–“না, বলুন।”
–“খুব খিদে পেয়েছে। কিছু রেঁধে আনো তো। বউয়ের হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে করছে!”
ইরা’দের আবদার শুনে নওরির ঘুমের রেশ এবার পুরোপুরি কেটে গেলো। ফোনে সময় দেখে বললো,
–“এই মাঝরাতে?”
–“ইচ্ছের উপর তো আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। যদি মাঝরাত হয় তাহলে মাঝরাতেই‌! এছাড়া আমাদের হালাল প্রেম তো মানুষদের আড়ালে এই আঁধার রাতেই করতে হবে। তাই যা বলছি দ্রুত তা করে আনো!”
–“শুনুন…”
ইরা’দ কোনো কথা শোনার আগেই কল কেটে দিলো। এবার নওরি পরলো মুসিবতে। এই মাঝরাতে সে কী রান্না করবে? আগে ওয়াশরুমে ছুটলো ফ্রেশ হতে।

ইরা’দ বারবার হাতের ঘড়ি দেখছে এবং নওরির বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে। ইরা’দ বর্তমানে তাদের ছোড় বাগানের এক কোণায় বসে আছে। তাঁর মাথা উপরে আম গাছ। যার ডাল-পালা অনেকটা জুড়ে বিস্তৃত। গাছের ফাঁকফোকর দিয়েই নওরির বারান্দাটা দেখা যাচ্ছে। এখানে বসার কারণ তাঁর মা। তাদের বাসা থেকে আম গাছের নিচে দেখাটা বেশ টাফ। এছাড়া ইরা’দের বেলকনি থেকে অবশ্য নিচটুকু দেখা যায়। কিন্তু ইরা’দ রুমের দরজা লকড করে বারান্দা দিয়ে বাগানে নেমেছে। তাই মৌসুমির তাঁর ঘরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই।

কিছুক্ষণ পরই নওরি আসলো। হাতে তাঁর প্লেট দিয়ে ঢাকা খাবার। এক বোতল পানি আনতেও ভুলেনি। বউয়ের এরকম যত্ন দেখে ইরা’দ মৃদু হাসলো। নওরি সেই হাসি দেখে নজর ঘুরিয়ে ফেললো। ধীরে ধীরে ইরা’দের কাছে এসে দাঁড়ালো। নওরিকে ঠাই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরা’দ তাঁর পাশে বসার জায়গা করে দিলো। কিন্তু নওরি সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।
–“কী হলো? বসো!”

নওরি ইতঃস্ততা নিয়ে ইরা’দের পাশে বসলো। ইরা’দ অনিমেষ চেয়ে রয় তাঁর নৌরি ফুলের দিকে। নিজেকে সামলে বলে,
–“কী রান্না করেছো দেখি?”

নওরি খাবারের উপর থেকে প্লেট উঠালো। সাদা ভাত এবং পাশে দুই টুকরো ফ্রাইড চিকেন। চিকেন থেকে আলাদা ঘ্রাণ ইরা’দের নাকে এসে বিঁধছে। নওরি চাপা স্বরে বললো,
–“আসলে, এই মাঝরাতে এই রেসিপি ছাড়া আর কোনো রেসিপি মাথায় আসেনি। ভাত রান্না করাই ছিলো, তাই চটপট..”

ইরা’দ হাসলো। সাদা ভাত থেকে নজর উঠিয়ে বলে,
–“তোমায় জানানোর জন্যে বলে দেই তোমার বর শুকনো ভাত খেতে পারে না। তাঁর মাস্ট ঝোল বা অন্যকিছু লাগবেই!”
নওরির এই পর্যায়ে এসে অনুশোচনা বোধ হতে লাগলো। মুহূর্তে-ই মুখ ঘুচে নিচু গলায় বললো,
–“স্যরি!”
–“ইট’স ওকে। তবে আজ অন্যকিছু ট্রাই করতে দ্বিধা নেই। দাও দেখি, খাইয়ে দাও। ডিনার করিনি।”

—————-
ইরা’দ কোনো কাজে বাসায় আসলে দেখতে পায় তাঁর মায়ের পায়ের কাছে লতিফা বসে আছে। লতিফাকে দেখে ইরা’দের মেজাজ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। থমথমে সুরে বলে,
–“লতিফা খালা এখানে কী করছেন? আমি মানা করা সত্ত্বেও আপনি আমার বাসায় আসার স্পর্ধা দেখিয়েছেন! সাহস তো কম না!”

ইরা’দের এরূপ গম্ভীর কথাবার্তা শুনে মৌসুমি চোখে-মুখে ভীষণ রাগ ফুটিয়ে তুলে বলে,
–“আমার বুয়াকে তুই বের করার কে ইরা’দ? নিজের কাজে যা। লতিফা যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ থাকবে। আমার ইচ্ছাতেই থাকবে!”
ইরা’দ হাত মুঠো করে বলে,”মা..!”
বেশি কিছু বলার পূর্বে সে নিজের রাগ সংবরণ করে নেয়। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এমতাবস্থায় লতিফা ঘাবড়ে গিয়ে মৌসুমির হাত ধরে বলতে লাগে,
–“মেডাম, আমারে তিন তলার ওই মেয়ের লেইগা সাহেব আমারে কাজ থেকে বাইর কইরা দিছে৷ সে পালাইছে আর আমি তা কইছি দেইখা সাহেবের কী রাগ। আমার কী দোষ কন তো! উলোট পালোট কিছু হইলে তো আমি কমুই!”
লতিফার এই কথাগুলোই যেন যথেষ্ট ছিলো আগুনে ঘি ঢালার মতো। ইরা’দ চেঁচালো,
–“লতিফা!!!”
মৌসুমি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে। যেই মেয়েকে দুই চক্ষে সহ্য করতে পারে না সেই মেয়ের জন্যে লতিফাকে তাঁর ছেলে বের করে দিয়েছে? এ তো পুরোই সহ্য সীমানার বাইরে। মৌসুমি হুংকার ছেড়ে বললো,
–“গলা নিচে নামিয়ে কথা বল ইরা’দ। ভুলে যাস না তোর মা তোর সম্মুখে দাঁড়িয়ে। তুই পরের মেয়ের জন্যে এভাবে চেঁচাবি তাও আমার বাড়িতে! আমি তো কখনো ভাবতেই পারিনি। কে হয় ওই মেয়ে তোর? কিসের এত জ্বালা? হ্যাঁ? সব আজ তুই আমাকে বলবি। কী সম্পর্ক তোর ওই চরিত্রহীনা মেয়ের সাথে!”
–“মা, তুমি কিন্তু এবার সীমা অতিক্রম করছো। নওরি কী তাঁর বাবার বাড়িতেও যেতে পারবে না? তাঁর পরিবারের কাছে যাওয়া মানে-ই কী অন্য ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া? এ কেমন বিবেচনা তোমার মা?”
–“আমি সেসবের ধার ধারি না। এমনকি জানতেও চাই না। সেই মেয়ে আমার পছন্দ না। তাঁর মানে তোর সাথেও কোনো সম্পর্ক থেকে থাকলে তা আজ, এই মুহূর্তে-ই শেষ। আর যদি দেখেছি তোকে তিন তলায় যেতে অথবা মেয়েটার আশেপাশে।”

ইরা’দ মুখ বুজে নীরবে সব শুনে গেলো। তাঁর মা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। ইরা’দ এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো লতিফার দিকে। এই দৃষ্টির মানে হচ্ছে এই, সে লতিফাকে গোড়ায় গোড়ায় দেখে নিবে। তাঁর আগে তাঁর মায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ভেবেই ইরা’দ হনহনিয়ে চলে গেলো বাইরে। সামান্য এক গ্লাস পানি পর্যন্ত পান করলো না সে। লতিফা ইরা’দের সেই দৃষ্টি দেখে আতঙ্কিত স্বরে মৌসুমির উদ্দেশ্যে বললো,
–“মেডাম! ছোট সাহেব আমাকে যেমনে দেখলো যেন চোখ দিয়েই গিলে খাইবে।”
–“চিন্তা নিও না লতিফা। আমিও দেখি আমি থাকতে ইরা’দ তোমার কী করে? এখন এসব না ভেবে নিজের কাজ করো যাও।”

—————–
–“এই বাসাতে কতদিন ধরে আছো?”
আফিফার এহেম কথাতে নওরি কিছুটা চমকালো। চমকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আফিফার দিকে। নওরি ধীরগলায় বললো,
–“কেন?”
–“তুষার তোমার খুব প্রসংশা করে। তুই এই, তুমি সেই। জানো তো তুষার কে? আমার ফিয়ন্সে হয়। তাঁর মুখে তোমার নাম শোনাটা আমার কাছে ভীষণ অস্বাভাবিক লাগবে তাই না?”

নওরি চেয়ে রইলো আফিফার দিকে। আফিফার চোখে-মুখে কেমন রাগ এবং বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। নওরি বেশ শান্ত স্বরে বলে,
–“আমি তো জানি আপনি তুষার ভাইয়ার ফিয়ন্সে। এছাড়া তুষার ভাইয়ার মুখে আমার প্রসংশা থাকবে কেন?”
–“হ্যাঁ, আমারও একই প্রশ্ন। এতদিন যা হয়েছে তাঁর জন্যে তোমাকে সাবধান করতে আসলাম। আগামীকাল তুষার আসবে। তাই ওর থেকে দূরে থাকাটাই তোমার মঙ্গল!”

বলেই আফিফা রান্নাঘর থেকে চলে গেলো। এদিকে নওরি আফিফার কথার আগা – গোড়া কিছুই বুঝলো না। সে বো!কার মতো চেয়ে রইলো আফিফার যাওয়ার পানে!

®লাবিবা ওয়াহিদ
—————————–
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে