#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
অন্তিম কাল [প্রথম খন্ড]
অম্বরের লাল সূর্যের দেখা নেই প্রায় অনেকদিন। কুহেলীর চাদরে ঢেকে গেছে সে। যেমন করে সুখ ঢেকে যায় দুঃখের নোনা জলে! বেদনার তৃষ্ণার্ত অস্বচ্ছতার রঙ পুরো আকাশ জুড়ে। শীতের হিমেল রিক্ততা ছুঁয়ে যায় বক্ষদেশ। ছাঁদের কার্ণিশে যেন ঘুমিয়ে আছে শান্তির বাজ পাখি। কেমন এক গমগমে ভয় নিয়ে নন্দার বেঁচে থাকা।
“বৌঠান, আমার কার্য আমি সম্পাদন করিয়াছি আপনার কথা মতোই।”
নন্দার ভাবনার সুতো ঢিলে হলো। কেমন অস্ফুটস্বরে গোঙানির মতন করে বলল, “হু!”
অ্যালেন কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো। দু-পা সামনে এসে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনি কী চিন্তিত?”
এবার ঢিলে হয়ে থাকা ভাবনার সুতো পুরোপুরি ছিঁড়ল। নন্দা পরিষ্কার স্বরে জবাব দিল,
“না, তেমন কিছু নয়। মা-কে কাশী পৌঁছানো হয়েছে?”
“হ্যাঁ, হইয়াছে।”
“অন্নপূর্ণাকে শহরে পাঠানো গিয়েছে?”
“ইয়েস, তা-ও হইয়াছে।”
নন্দা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচাল। পরমুহূর্তেই তার চোখ জোড়ায় বিষণ্ণতা নামল। কেমন অসহায় কণ্ঠে বলল,
“আপনি আর উনিও কয়েকটা দিনের জন্য এদেশ থেকে চলে যান, দয়া করে।”
অ্যালেনের সদা সম্মান প্রদর্শিত নিচু ঘাড় আজ প্রথম উঁচু হলো, পূর্ণদৃষ্টিতে চাইল সে নন্দার পানে। কিন্তু সেকেন্ডের মাথায় তার চক্ষুদ্বয় ফিরিয়ে নিল নিজের অসংযতা। বহুদিন… প্রায় বহুদিন পর সেই ধ্বংসাত্মক রূপে অ্যালেনের হৃদয় যেন থমকে গেল। নারীর এমন সৌন্দর্য যেন সব পুরুষেরই সংযতচিত্ত মুহূর্তেই অসংযত করে দিতে বাধ্য। মেয়েটার কী রূপ! কী দীপ্তি! কী শোভা! অ্যালেনের মনে হলো, সে যেন সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল সেকেন্ডের জন্য। লাল টকটকে শাড়ির সাথে জড়োয়া গয়নাতে সে যেন কোনো দেবীকে দেখে ফেলেছে। অ্যালেন চোখ বন্ধ করল, তবুও শান্তি মিলল না। বন্ধ চোখের আড়ালেও যেন সেই নারীর উঁকিঝুঁকি দেওয়া। অ্যালেন মাথা আরও নত করল, ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“মার্জনা করিবেন, বৌঠান। আমার একটি কার্য সম্পাদন করিতে হইবে। আমাকে এখন প্রস্থানের অনুমতি প্রদান করুন।”
নন্দা ভ্রু কুঁচকালো, অ্যালেনের ঘর্মাক্ত শরীর দেখে সে কিঞ্চিৎ অবাকও হলো। তবুও সে অনুমতি দিল,
“আচ্ছা, আসুন এখন।”
অনুমতি পেতেই যেন অ্যালেন বেঁচে গেল। দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার পা কাঁপছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। এত সুন্দর মানুষটাকে তার দেখা উচিত হয়নি। একদম উচিত হয়নি। এটা পাপ। এই অসংযত দৃষ্টি ঐ পবিত্র মানুষের জন্য নয়। অ্যালেন নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ হলো। সজোরে আঘাত করল তার সামনের দরজাটায়। সশব্দে কেঁপে উঠল কাঠের ভারী দরজা। অথচ অ্যালেনের চোখে নন্দার মুখ সদা উজ্জ্বল, জ্বলজ্বলে অংশুমালীর মতন যেন।
অ্যালেন বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই স্টিফেনের প্রবেশ। নন্দা তখন আবারও ধ্যানে মগ্ন। স্টিফেনের মুখে হাসি, ধ্যানমগ্ন স্ত্রীর পানে তাকিয়ে শুধাল,
“তোমার দহনে কেন সবাই পুড়িয়া যায়, সানশাইন?”
নন্দা আকস্মিক প্রশ্নে প্রায় বেশ ভালো করেই চমকে গেল। চক্ষুদ্বয় তার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“কী?”
স্টিফেন হাসল, তীব্র এক বুক ভরা বিষণ্ণতা নিয়ে বলল, “তোমার এত সুন্দর হওয়া উচিত হয় নাই, সানশাইন। উচিত হয় নাই।”
নন্দা যেন স্টিফেনের কথার কূল-কিনারা পেল না। তার চোখে প্রশ্নের জোয়ার। জিজ্ঞেস করল ভাবুক স্বরে,
“এমন বলছেন কেন?”
“বলিবার কারণ কিছু তো নিশ্চয় আছে। সেই কারণটা আছে বলিয়াই আমি অসুখী, সানশাইন। কত ভালোই না হইতো, যদি আমি তোমার সৌন্দর্যের প্রশংসা কোনো কারণ ছাড়াই করিতে পারিতাম!”
“আমি আপনার এমন কথার কোনো কারণ বুঝে পাচ্ছি না!”
“কারণ খুঁজিও না, সানশাইন। কিছু কথার কারণ না থাকিলেই বোধকরি ভালো হতো। সব কারণ যে সবসময় সুখের হয় না। আচ্ছা সানশাইন, তুমি আমায় কখনো হারাইয়া ফেলিলে কষ্ট পাইবে? হয়তো পাইবে না। কারণ আমি তোমার কেহ হইতে পারি নাই কখনো। তবে, আমি হারাইয়া গেলে, নতুন করিয়া তোমার জীবন শুরু করিবে, কেমন? পড়াশোনাও করিবে। গ্রামবাসীর অভিভাবক হইবে। তোমার সকল অসম্মানের জবাব তুমি সফলতা দিয়ে দেখাইও। আমি না থাকিলেও তোমার সফলতার গল্পে আমি নিবিড় ভাবে থাকিয়া যাইবো। তুমি চাইলেও আমারে মুছিয়া ফেলিতে পারিবে না আর।”
অলকানন্দার বুকের উপর অমলিন হয়ে থাকা ভালোবাসার নক্ষত্রটা যেন ভয়ঙ্কর ভাবে কাঁপতে শুরু করল। একসময় যে মানুষটার থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলতে তার ইচ্ছে হয়েছিল, আজ যেন সে মানুষটার সাথে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে চাচ্ছে সে। কিন্তু সংশয়ের দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ টুকু রয়ে যাওয়ায় নন্দা ছুটে গিয়ে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরতে পারল না। স্টিফেন দু’হাত মেলে এগিয়ে গেল। হয়তো নন্দার তুমুল আবরণী ইচ্ছেটা সে পড়ে ফেলেছে। কিন্তু এগিয়ে গিয়েও সে শেষ অব্দি ইচ্ছে পূরণ করল না। হাতটা নামিয়ে ফেলল কি যেন এক গোপন ভাবনায়। সুঠাম দেহী, শুভ্র রাঙা শক্ত পুরুষটার আজ কঠিন চোখে টলমলে স্রোত। সে নন্দার থেকে চোখ ফিরিয়ে কিছুটা অন্যদিকে তাকিয়ে, বাঁকা হেসে বলল,
“আমি যখন থাকিব না, তখন তোমার জীবনে আমি গাঢ় হইয়া থাকিবো সানশাইন, দেখে নিও। তোমায় আমি অনুমতি দিলাম, আমার অবর্তমানে তুমি অন্য কাউকে নিয়া সংসার আরম্ভ করিতে পারো। আমার কোনো আপত্তি থাকিবে না। তোমার ভালো থাকায় আমি, আমায় খুঁজিয়া নিব।”
নন্দা কথা বলতে চাইল কিন্তু হৃৎপিণ্ডের তুমুল ব্যাথায় যেন তার বাক্য লোপ পেল। স্টিফেন জবাবের আশায় কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করল। অবশেষে এক বুক হতাশা নিয়ে সে বেরিয়ে গেল। চলে গিয়েও ফিরে দাঁড়াল সে। তার বিষণ্ণ সুন্দর কণ্ঠে বলল,
“যেদিন তোমার শরীরে অন্য কেউ স্পর্শ করিবে, মনে রেখো সানশাইন, সেদিনই আমি পৃথিবী থেকে মুছিয়া যাইব চিরতরে। এর আগে আমি মরিয়া গেলেও মরিবো না।”
নন্দার বুকের তীব্র যন্ত্রণা গাঢ় হলো। এতদিনে সে উপলব্ধি করছে, ভালোবাসা শব্দটার আসলে তীক্ষ্ণতা কেমন হতে পারে। প্রেমের উচ্ছল ঢেউ ঠিক কতটা বিষাদ পূর্ণ হয়।
_
সুখের সময় ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। তার ফুরিয়ে আসার ধ্বনি বাজছে চারপাশে। নন্দা তা বেশ ভালো করেই অনুভব করতে পারছে। সেই বিষণ্ণ, বিষাদ সুর ভেসে বেড়াচ্ছে নির্বাসন মহলের আনাচে-কানাচেতে।
সময়টা প্রায় গাঢ় রাত। মহলের বড়ো রুমটায় বসে আছে নন্দা। তার চোখে ঘুম নেই। ক্রমশই উত্তেজনায় কাঁপছে তার শরীর। শতাব্দ তাকে টেলিফোন করেছিল সন্ধ্যাবেলা। জানিয়েছিল— তারা আসছে। তারপর থেকে নন্দার শরীর অসাড় হয়ে আসছে। সে জানে, তাদের আসাটা ঠিক কতটুকু ভয়ঙ্কর। কিন্তু সে অসহায়। অ্যালেনের সাহায্য নিয়েও স্টিফেনকে আজ বাড়ি থেকে বের করতে পারেনি সে। লোকটা কেমন নাছোড়বান্দা! আজ সে বাড়ি থেকে না বেরোনোর পণ করেছে যেন। নন্দা বলতেও পারছে না আগাম বিপদসংকেতের কথা। মানুষটার চোখে তাহলে সে নিচু হয়ে যাবে। আর যাই হোক, ভালোবাসার মানুষের কাছে নিচু হয়ে নন্দা বাঁচতে পারবে না।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই নন্দার অবশিষ্ট সুখের সময়টুকু নিঃশেষ হলো। পদশব্দ শুনতে পেল তার আশেপাশে। নন্দা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখল শতাব্দ, দীপকদাসহ তাদের দলের অনেকেই পুরো ঘর জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নন্দা তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। এতক্ষণ যে বিপদের আশংকা করেছিল তা ঘটে গেছে৷ কথাটা নন্দার মস্তিষ্কে প্রচার হতেই তার শ্বাস থেমে গেল। সে রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল,
“আপনারা প্রবেশ করলেন কীভাবে?”
“কেন? প্রবেশ করা নিষেধ ছিল নাকি?”
দীপক’দা এর ঠোঁটে বাঁকা হাসি। নন্দা থমকে গেল। শতাব্দের দিকে তাকাতেই দেখল তার মাথা নত। তীব্র শীতের মাঝেও নন্দা তুমুল ঘামছে। চারপাশে ললিতাকে খুঁজে গেল সে কিন্তু না, মেয়েটা আজ আসেনি। নাকি এসেছে? বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে কী!নন্দার ভাবুক স্বত্তার অন্তস্থল কাঁপিয়ে দীপকদা শুধাল,
“অলকানন্দা, তুমি তোমার প্রতিশ্রুতি রাখতে প্রস্তুত তো?”
নন্দা তোতলানো স্বরে বলল, “কি…কিসের প্রতিশ্রুতি?”
“দেশরক্ষার।”
নন্দা আঁচল দিয়ে ঘাম মুছলো। তার পা কাঁপছে। ভীতু গলায় বলল,
“না, না, ভুলিনি।”
“তবে চলো, আজকে নিজের সংসার চিতায় তুলে দেশের আঁধার দূর করবে। পারবে তো?”
নন্দার পিলে চমকে উঠল। সে দু-কদম পিছিয়ে গেল। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল স্টিফেনের হাস্যোজ্জ্বল মুখটি। আবার সেই আকুতি মাখা কণ্ঠ। ‘তুমি কেবল আমার হইয়া থাকিও’ কথাটা বারবার প্রতিধ্বনিত হলো তার চারপাশে। কী আকাঙ্খা লোকটার! ভালোবাসার হাহাকারে ভারী তার বুক। নন্দার কাছে সেই বুক-ই তো পেতে দিয়েছিল মানুষটা। নন্দা জেনেশুনে কীভাবে ক্ষত করবে সেই বুকে?
“আমার মনে হচ্ছে অলকানন্দা তার প্রতিশ্রুতি ভুলতে চাচ্ছে?”
নন্দার কণ্ঠ শুকিয়ে এলো। তার কানে তার প্রতিশ্রুতি বাজছে। সে দেশের জন্য নিজের সব জলাঞ্জলি দিবে বলেছিল। কানে বাজছে দেশের মন্ত্র বুকে প্রেমের সুর। কোনটা বেছে নিবে সে?
“অলকানন্দা, ইংরেজরা আমাদের সাথে কী কী করছে তৎকালীন সময়ে, তা তোমার অজানা নয় নিশ্চয়? কত কৃষকের পেট কেড়েছে, কত মানুষের জান! আজ সব মিথ্যে হয়ে গেলো তোমার কাছে? কেবল সংসারই তোমার আপন রইলো?”
নন্দার দৃষ্টি নত হলো। কারো সাথে সে দৃষ্টি মেলাতে পারছে না লজ্জায়। এমন অগ্নিপরীক্ষায় সে দিকভ্রান্ত। হাতড়ে সমাধান খুঁজতে চাইল। দেশের অসহায়ত্ব না একটি অসহায় হৃদয়ের প্রেম, কাকে বেছে নেবে নন্দা? আজ যদি সে দেশের সাথে বেইমানী করে, কাল কীভাবে চোখ মেলাবে তাদের সাথে!
“তুমি তবে সংসার চাচ্ছো?”
নন্দা নিশ্চুপ। দীপকদা নন্দার হাতে একটি সাইলেন্স গান ধরিয়ে দিলেন। ফিসফিস করে বললেন,
“দেশ তো মা, মায়ের চোখে নিচে নেমো না, নন্দা।”
নন্দার চোখে টলমলে অশ্রু। দীপকদা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে স্টিফেনের রুমের দিকে। নন্দা পুতুলের মতন যাচ্ছে। মনে মনে বার বার ঈশ্বরকে ডাকছে। স্টিফেন যেন না থাকে ঘরে। কোনো এক দৈবচক্রে মানুষটা আজ অদৃশ্য হয়ে যাক। নন্দা তাকে এরপর পৃথিবীর বুক থেকে খুব গোপনে লুকিয়ে রাখবে। আর কখনো সে জানাবে না, তার একটি ভালোবাসার মানুষ আছে। শুধু একটিবারের জন্য আজ মানুষটা বেঁচে যাক!
রুমে দরজা খুলতে নন্দা হতভম্ব। পুরো রুমের কোথাও স্টিফেন নেই। দীপদা’র সরু ভ্রুও কুঁচকে এলো। নন্দার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল, “দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে নন্দা!”
বারান্দা দিয়ে নিচে নামতে নামতে নন্দার হাতের যন্ত্রটা দৃষ্টিগোচর হলো স্টিফেনের। সে ফিসফিস করে বলল,
“আমার প্রেমের সাথে বেইমানী করিলে, সানশাইন! তবে তা-ই হোক, আজ থেকে তুমি, আমি বিহীন ভালো থাকিবে। প্রেমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে তোমার জীবন প্রেমহীন কাটুক। তুমি নির্দয়, সানশাইন। তুমি বড়োই পাষাণ। তুমি ভালোবাসিলে না আমায় সানশাইন, ভালোবাসিলে না! আমাকে আর বন্দুক দিয়ে গুলিবিদ্ধ করিতে হইবে না, সানশাইন। আজ থেকে আমি মারা গিয়াছি। তোমার হাতে আমার জন্য থাকা মরণ বাণ দেখাটাই আমার মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। তুমি ভালো থাকিও, সানশাইন। তোমার নির্বাসিত জীবন সুখের হউক। আমি ভালোবাসিতে-বাসিতে ভালোবাসার দাবী ছাড়িয়া দিলাম, যাও।”
নন্দা অন্ধকারে একটি ব্যাথিত দৃষ্টি দেখে চমকে উঠল। সে দৃষ্টির কোণ ঘেঁষে সে ঘৃণা দেখল কী! হয়তো দেখল। ভালোবাসার আঁখি যুগলে ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে নন্দা ভালো থাকতে পারবে?
_
স্টিফেন আর অ্যালেন বাড়ি থেকে বেশ দূরে আসতেই হাঁপিয়ে উঠল। খানিক জিরিয়ে পাশ ফিরতেই দেখে ললিতা দাঁড়িয়ে আছে ক্ষীণ হেসে।
অন্যদিকে “অলকানন্দার নির্বাসন” মহলে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। নন্দা দৌড়াচ্ছে না, বাঁচতে চাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে তার আসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। তার আর কোনো ভয় নেই। ঘৃণার জীবনের সমাপ্তিতে তার আসন্ন, অনাকাঙ্খিত নির্বাসনও যেন মুক্তি পায়। হয়তো অন্য কোনো গল্পে, অন্য কোনো গদ্যে আবার মিলন হবে তাদের। সেদিন কল্পনা, ভ্রম, চতুরতা, ঘৃণা কিছুই থাকবে না তাদের মাঝে। সেদিন দেশ-জাতির ভেদাভেদও থাকবে না তাদের মধ্যে। সেদিন নন্দা স্বীকার করবে, এই শুভ্র রাঙা পুরুষকে ভালোবেসে সে ধন্য হয়েছে, সে ইতিহাস হয়েছে।
#চলবে
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
অন্তিমকাল [শেষ খন্ড]
সময়ের নামতায় ভেসে গিয়েছে পনেরো বসন্ত। গাছের সজীবতা চির যৌবনা আজও, নদীর উচ্ছ্বাসিত তরঙ্গ- চিরস্থায়ী। সময়ের বদলে প্রকৃতি বদলে যায় না। কেবল বদলে যায় মানুষ, সভ্যতা এবং সংস্কৃতি।
ভারতবর্ষে তখন ইংরেজদের দিন শেষ। দু-একজন আনাচে-কানাচে রয়ে গেলেও তাদের নিয়ে আর কোনো ভয় নেই। দেশ এবার নিজের হাল ধরেছে শক্ত হাতে। তবে বহু কষ্ট পোহাতে হয়েছে এ বিচ্ছিন্ন হাল ধরতে। অভাব, অনটনও দেশে অভিশাপ হয়ে এসেছিল। সেটাও মানুষ কাটিয়ে উঠেছে। তার জন্য গুনতে হয়েছে বিরাট মাশুল। আপন মানুষ হারিয়ে, বহু ত্যাগ তিতিক্ষার পর আজকের দেশের চিত্র স্বস্তির। শান্তির।
গান বাজানো যন্ত্রটায় সকাল হতেই বাজছে ‘আমারও পরানে যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো…..’ গানের তালে-তালে নন্দার ঠোঁট নড়ছে। ব্যস্ত হাতে শাড়ির আঁচল সাজাচ্ছে আর অলস কণ্ঠে সুর মেলাচ্ছে গানের। হাঁটু অব্দি তার লম্বা চুল পিঠ জুড়ে দোল খাচ্ছে। চোখে গাঢ় কাজল। কপালে গাঢ় করে সিঁদুর লেপটানো। আজও তার রূপ আগের মতনই তেজস্বিনী। প্রাপ্তবয়স্ক মুখমন্ডলে এখন বোধ করি মুগ্ধতা আরও দ্বিগুণ হয়েছে।
“সাহেব বধু, আপনার জন্য নিচে লোক এসেছে। বোধহয় গ্রামে কোনো সমস্যা হয়েছে।”
দরজার বাহিরে দাঁড়ানো গৃহভৃত্যের কথায় নন্দার ভ্রু কুঁচকালো। ঘাড় ফিরিয়ে শুধাল,
“কারা এসেছে?”
“আপনার ইস্কুলের মাস্টারমশাই আসছে। তাড়াতাড়ি আসেন, সাহেব বধূ।”
নন্দ চমকে গেল। সাথে সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামতেই দেখল তাদের বিদ্যালয়ের নরেন্দ্রবাবু এবং তপন স্যার দাঁড়িয়ে আছে। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো, বিনীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আপনারা এখানে! কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হ্যাঁ বিরাট সমস্যা হয়ে গিয়েছে। আমাদের স্কুলের একটা মেয়ের জীবন বিপন্ন। আপনি ছাড়া কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। তাড়াতাড়ি চলুন।”
“কেন কি হয়েছে?”
“আপনি আসুন। আসলেই জানতে পারবেন।”
নন্দা আর অপেক্ষা করলো না। সাথে সাথে ছুট লাগালো।
–
একটি বাড়ির সামনে এসে নন্দাদের গাড়ি থামলো। বাড়িটির চারপাশে আহাজারি। আপন মানুষ হারানোর শোক পালিত হচ্ছে প্রকৃতি জুড়ে। নন্দা থমকাল। বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো সুপ্ত ব্যাথা। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। আগরবাতির ঘ্রাণে চারপাশের বাতাস কেমন ভারি ভারি ঠেকল নন্দার কাছে। তার কাছে আগরবাতির ঘ্রাণটা কেমন শোকের ঘ্রাণ মনেহয়। আদৌও শোকের কোনো ঘ্রাণ আছে? হয়তো আছে। সেজন্যই তো নন্দার বুক ভার হয় এই ঘ্রাণে। বুক কাঁপে মৃদু কম্পনে। হারিয়ে ফেলার ব্যাথা তীক্ষ্ণ ভাবে আঘাত করে তাকে।
নন্দা বাড়িটির ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল বাড়িটির উঠোন জুড়ে সাদা কাপড়ে একটি মানুষ চির নিদ্রায় নিদ্রায়মাণ হয়েছে। সেই মৃত ব্যাক্তির সামনেই একটি মধ্য বয়স্ক নারী কাঁদছেন। আহাজারি করছেন। বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইষ্টি-কুটুমেরা। হয়তো গত হওয়া মানুষটার শেষ যাত্রায় উপস্থিত হয়েছেন সকলে।
নন্দাকে দেখেই স্বাস্থ্যসম্মত একটি লোক এগিয়ে এলো। পড়নে তার সাদা পাঞ্জাবি। হাব-ভাবে বলা যায় তিনি বাড়ির কর্তা। বয়োজ্যেষ্ঠ একজন মানুষ। নন্দাকে দেখেই তিনি বিনীত কণ্ঠে হাত জোর করে বলল,
“নমস্কার, সাহেব বধূ। আপনি আমার বাড়িতে পদধূলি দিয়েছেন, আমার পরম সৌভাগ্য। আসুন, ভেতরের ঘরে আসুন। এমন একটা দিনে এলেন…..”
লোকটা কথা বাড়াতে পারলেন না। চোখের জল মুছলেন নিরবে নিভৃতে। নন্দা ধীর কণ্ঠে বলল,
“ব্যস্ত হবেন না। আপনাদের শোকের সময় এখন। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না।”
নন্দার কথা লোকটা তেমন গা করলেন না বোধহয়। তিনি ব্যস্ত হলেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বাড়ির কয়েকজন মেয়ে-বউকে ডাকলেন। নন্দাকে অন্দরমহলে নিয়ে যাওয়ার আদেশ করলেন। নন্দাও অবশ্য অন্দরমহলে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে ছিল। তপন স্যারের কথা অনুযায়ী এই বাড়ির লোকেরা একশ বছর আগের ভাবনাচিন্তা বহন করা মানুষ। তাদের বাড়ির ছেলে মারা গিয়েছে মানেই বধূর উপর অত্যাচার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই খোঁজ নিতেই নন্দার এখানে আসা।
অন্দরমহলে গিয়ে দাঁড়াতেই নন্দার কানে হৈচৈ ভেসে এলো। বাড়ির পূর্বদিকের একটি কক্ষ থেকেই এই হৈচৈ ভেসে আসছে। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। সেদিকে পা বাড়াতেই বাড়ির সম্ভবত বউ তাকে ডাকল, আমতা-আমতা করে বলল,
“সাহেব বধূ, ওখানে কিসের জন্য যাচ্ছেন?”
নন্দা কপালে ভাঁজ ফেলে সরু চোখে তাকাল বউটির দিকে। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“কে যেন চেঁচাচ্ছে মনে হলো!”
“মেয়েলি আচার-আচরণ হচ্ছে তো, তাই শোরগোল।”
নন্দা আর অপেক্ষা করল না এক মুহুর্ত। মেয়েটার কথা শেষ হতেই ছুটে গেল সেই ঘরটায়। দরজার সামনে আসতেই তার পা থেমে গেল। অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী একটি সদ্য স্বামীহারা মেয়ে সাদা ধবধবে একটি কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার রূপে খা খা করছে যেন সারাটা ঘর। কী সুন্দর সেই রূপ! মেয়েটিকে কেন্দ্র করেই আরও কয়েকজন সধবা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। নন্দা বোঝার চেষ্টা করল, এখানে হচ্ছেটা কী! তন্মধ্যেই কক্ষে উপস্থিত একজন নারীর কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তুই চুল কাটবি না কেন? চুলে কী আছে তোর? স্বামী মারা গেছে তোর। কোনো শোক তাপ তোর ভেতরে নাই। কেমন মেয়ে-ছেলে তুই!”
কথাটা নন্দার কানে বার বার প্রতিধ্বনিত হলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল তার বহু পুরানো স্মৃতি। এই কথা গুলোর সাথে সে পরিচিত। এই ক্রোধ, ক্ষোভের সাথে তার বহু যুগ যাবত সম্পর্ক। এই অনুভূতি অচেনা নয় তার। চোখের সামনে নিজের বৈধব্যের কটুক্তি, ভয়ঙ্কর স্মৃতি জ্বলজ্বল করে উঠল। নন্দা তার সামনের মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটির বয়সও বেশি নয়। পনেরো কিংবা ষোলো হবে। তেমনই রূপ, তেমনই সাহস তার অঙ্গ জুড়ে। নন্দা থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। তন্মধ্যে মেয়েটির একরোখা জবাব ভেসে এলো,
“আমি কাটবো না আমার চুল। বড়ো শখের এগুলো।”
নন্দা মেয়েটির মাঝে যেন নিজেকে খুঁজে পেল। বহু পুরোনো সেই ছোট্ট নন্দাকে। যার চোখে ছিল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। সাহসের অগ্নিসম দীপ্তি। এ যেন পুরোনো ইতিহাস নতুন করে খোদাই করার গল্প।
ঘরে আরও বাক-বিতন্ডা চলল। মেয়েটিকে শুনতে হলো কুরুচিপুর্ণ কথাও। গায়ে তকমা লাগল চরিত্রহীনার। তবুও মেয়েটি অটল। নন্দা মুখে ক্ষীণ হাসি। আরেকটি অলকানন্দার জন্ম যেন এখানেই।
এই শোরগোল ঠেলে, ভেসে এলো নন্দার কণ্ঠ,
“এখানে কী হচ্ছে?”
নন্দার বজ্রকণ্ঠে থেমে গেল সকল কণ্ঠ ধ্বনি। সকলে ড্যাব ড্যাব করে চাইল নন্দার পানে। নন্দাকে দেখেই যেন সকলে তটস্থ হয়ে গেলো। সেখানে উপস্থিত, সবার থেকে বয়স্ক মহিলাটি যেন উপস্থিত ঘটনাকে ঢাকতে চাইলেন। আমতা-আমতা করে বললেন,
“সাহেব বধূ যে! আপনি এঘরে কেন! দেখছেন কান্ড! বিনী আপনাকে বসার জায়গা দেয়নি? ছিঃ ছিঃ। বিনী, এই বিনী…..”
“বসার জায়গার কথা তো আমি এখানে জিজ্ঞেস করিনি। আমি জিজ্ঞেস করেছি, এখানে কী হচ্ছে?”
নন্দার কথা থামতেই কিশোরী, সদ্য স্বামীহারা মেয়েটা এগিয়ে এলো। নন্দার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে আকুতি-মিনতি করতে করতে বলল,
“আমি চুল কাটবো না। আমি এসব করবো না। আপনি একটু ওদের বুঝিয়ে বলেন না।”
নন্দা যেন মেয়েটার ভেতর বর্ষ পুরোনো নিজেকে পেল। সেদিন নন্দাও তো এমন করেছিল! নন্দা কিছু বলার আগে সেই বয়স্ক মহিলার হুঙ্কার শোনা গেল,
“ওরে ধর তোরা। সাহেব বধূকে অশৌচ নিয়ে ধরল। ধূর। কী কান্ড! ধর। কেমন মেয়ে-ছেলে তুই বাপু! লজ্জা বলতে বস্তু নাই তোর। ছেহ্।”
মহিলার আদেশ পেতেই কয়েকজন এগিয়ে এলো। কিন্তু ছুঁতে পারল না মেয়েটাকে। তার আগেই তার সামনে ঢাল হলো নন্দা। গম্ভীর তবে শক্ত কণ্ঠে বলল,
“কেউ ওকে ধরবেন না। ভুল করেও ওর শরীরে কেউ হাত দিবে না।”
নন্দার শক্ত কণ্ঠে ছুটে এলেন বাড়ির কর্তা। থেমে গেল আহাজারিও। কর্তা যেন দিশেহারা হলেন। দিগবিদিক ভুলে বিনীত স্বরে শুধালেন,
“কী হয়েছে, সাহেব বধু? কী হয়েছে? কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলুন।”
নন্দা তার সামনের মহিলাদের দিকে এক পলক চাইল। অতঃপর তার পায়ের কাছে বসা মেয়েটাকে আলতো হাতে তুলল। শান্ত অথচ ধারালো কণ্ঠে লোকটার উদ্দেশ্যে বলল,
“এই গ্রামের নিয়ম-নীতি আপনার নিশ্চয় অজানা নয়? তবে কেন সেই নিয়ম-নীতির এমন বিদ্রুপ হচ্ছে? এটা করছেন কীভাবে?”
কর্তা মাথা নত করলেন। হাত জোর করে বললেন,
“ক্ষমা করবেন, সাহেব বধূ। মেয়ে লোক অন্য মেয়ে লোকের ভালো সহ্য করতে পারেনা সেটাই স্বাভাবিক। আমি এই ব্যাপারে অবগত ছিলাম না। আমি না করে ছিলাম ওদের। ক্ষমা করবেন।”
নন্দার সাথে বিনীতভাবে কথা থামিয়েই ভদ্রলোক বাকি মহিলাদের উদ্দেশ্যে হুংকার দিয়ে উঠলেন। তার হুঙ্কারে ভীত হলো চারপাশ। ভদ্রলোক নিজের সদ্যবিধবা পুত্র বধূকে আগলে নিয়ে বললেন,
“ও আমার মেয়ের সমান। ওর সাথে অন্যায় কিছু যেন না হয়। ও যদি কোন নিয়ম-নীতি না মানতে চায় তাহলে না মানবে। ওকে কেউ জোর করবে না। আমার পুত্র মারা গিয়েছে, তাই বলে আমি এই মেয়েটার উপর কোন কিছু চাপিয়ে দিতে চাই না। মনে থাকবে সকলের?”
ভদ্রলোকের কথা থামতে উপস্থিত সকলে ঘাড় নাড়ালো। নন্দা বাঁকা হাসলো। সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
“শুধু ও না, এই গ্রামের কোনো নারীর উপর যেন জোর জবরদস্তি না করা হয়। যদি কেউ আদেশ লঙ্ঘন করে তবে তার জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অপেক্ষা করছে।”
সকলে নন্দার আদেশ মাথা নত করে মেনে নিল। আর যাই হোক, সাহেব বধূর উপরে কথা বলার ক্ষমতা কারো হয়নি। কারো না। যার নির্দেশে দু’টো গ্রাম চলে এমনকি বড়ো বড়ো মানুষও তার উপর কথা বলেনা তার সিদ্ধান্ত না মানার ক্ষমতা কারো নেই। নন্দা মেয়েটাকে ভরসা দিয়ে বেরিয়ে এলো সেই বাড়ি থেকে। যতবার তার শক্ত সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নেয় ততবার স্টিফেনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তার মাথা নুইয়ে আসে। চোখ বুজে আসে। আজকে নন্দার পেছনে সে মানুষটার অবদান বেশি।
_
নন্দা আরামকেদারায় শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ তার অথচ মস্তিষ্ক সজাগ। পুরোনো ব্যাথার ক্ষত অন্তরে। ক্ষণে ক্ষণে তা জ্বালা করে।
“বৌঠান, আসবো?”
অ্যালেনের অনুমতি প্রত্যাশা নন্দার বন্ধ চোখ খুলে দিল। সে সাথে সাথে শাড়ির আঁচল ঠিক করে বলল,
“ঠাকুরপো, আসুন।”
অ্যালেন মাথা নত করে কক্ষে প্রবেশ করল। ক্ষীণ স্বরে বলল,
“ডাকিয়া ছিলেন?”
“হ্যাঁ। আজ তো মাসের শেষদিন। আর প্রতি মাসের শেষদিন আমি আপনাকে একটা জিনিস দেই। মনে আছে?”
অ্যালেন মাথা নাড়াল। জবাব দিল, “হ্যাঁ, মনে আছে। পত্র কী তৈরী?”
“হ্যাঁ, তৈরী। চিঠি গুলো টেবিলের উপর। কষ্ট করে নিয়ে যাবেন?”
অ্যালেন মাথা নাড়াল। টেবিল থেকে চিঠি গুলো তুলতেই নন্দা উঠে দাঁড়াল। নিবিড় কণ্ঠে শুধাল,
“উনি কবে আসবে ফিরে? অভিমান কবে শেষ হবে?”
অ্যালেন থেমে গেল। চমকে গেল কিঞ্চিৎ। নন্দার দিকে ফিরতে গিয়েও ফিরল না। মাথা নত করেই জবাব দিল,
“আসিবে হয়তো, খুব শীগ্রই।”
“খুব শীগ্রই হতে আর কত যুগ লাগবে? পনেরোটা রিক্ত শীত কী অল্প সময় ছিল!”
অ্যালেন স্তব্ধ হয়ে রইল নন্দার কাতর স্বরে। চারপাশ হাতড়ে উত্তর খুঁজে পেল না। নন্দা মিনতি করে বলল,
“একটিবার আপনি বলুন না আসতে। আমি আর কখনো তাকে ফেরাবো না। আপনি বললে সে শুনবে। একটু বলুন না। সেদিন তো আমি বাধ্য হয়ে ছিলাম। কিন্তু আমি আপনাকে আগেই জানিয়ে ছিলাম। তাকে জানাতে পারিনি। কীভাবে জানাবো বলুন! চক্ষু লজ্জাও তো আছে। উনাকে একটু বলুন না ফিরে আসতে। আমি আমার ভুল শুধরে নিব।”
অ্যালেন আর কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। নন্দার চোখ অভিযোগের অশ্রুতে ভারি হলো। একবার সে স্টিফেনকে পেলে আর ছাড়বে না। মানুষটাকে সে আগলে রাখবে বড়ো যত্ন করে। আর হারাতে দিবে না। একবার হারাতে দিয়ে পনেরোটা বছর যাবত অপেক্ষা করে যাচ্ছে। নিশ্চয় মানুষটার অনেক অভিমান হয়েছে। না-হয় সে নন্দাকে এভাবে কষ্ট দিত না।
_
নিস্তব্ধ বারান্দায় নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে অ্যালেন। তাকে পেছন থেকে কেউ ডাকল। অ্যালেন ঘুরে তাকাতেই অন্নপূর্ণার হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী চোখে পড়ল। মেয়েটা ডায়রিতে লিখল,
“বড়দির আজ চিঠি দেওয়ার কথা, দিয়েছিল?”
অ্যালেন লিখাটি পড়ল। মেয়েটার জিহ্বা হারানোর ফলে এখন আর কথা বলতে পারে না। তাই এই পন্থা অবলম্বন করেছে। অ্যালেন হাসল, জবাব দিল,
“দিয়েছে। মায়েরটা এবং বৌঠানের আগের শাশুড়ি সুরবালা দেবীরটা পাঠানো হয়ে গিয়েছে।”
অন্নপূর্ণা ডায়েরিতে আবার লিখল, “আর বড়দির স্বামীরটা?”
অ্যালেন অম্বরে আলোকিত অর্ধচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসল। জবাব দিল,
“একশত উনআশি নাম্বার চিঠি খানা জমিলো আমার ডাকবাক্সে। অথচ প্রাপকের ঠিকানায় কখনো এই চিঠি গুলো আমি প্রেরণ করিতে পারিব না। এই ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা নিয়া বাঁচিয়া থাকা অনেক কষ্টের অন্নপূর্ণা।”
অন্নপূর্ণা আবার ডায়েরিতে লিখল,
“বড়দিকে বলে দিলেই তো হয়?”
“না, হইবে না অন্নপূর্ণা। হইবে না। সেইদিন গুলোর সাক্ষী আমি। আমি জানি আমার চোখ কী দেখিয়াছে। সেদিন ললিতা না এলে হয়তো আমিও আর এখানে থাকিতাম না। বৌঠানের জীবন বাঁচিতো কি-না সন্দেহ। ললিতা সেদিন স্টিফেনকে নিয়ে পৌছে দিবে বলিয়াছিল দেশের শেষ প্রান্তে। আমাকে পাঠাইয়া ছিল বৌঠানের কাছে। আমি আসিয়া দেখি এই নির্বাসন মহলে আগুন জ্বলিতেছে। দাউ দাউ করে পুড়িতেছে সব। ভাগ্যিস ছুটিয়া আসিয়া বৌঠানকে পাইয়া ছিলাম! মানুষটার জ্ঞান ছিল না। আরেকটু দেরি হইলে বাঁচিত না মানুষটা।”
অ্যালেন থামল। অন্নপূর্ণা এসব-ই জানে। তবুও শুনছে। অ্যালেনের মন খারাপ হলে সে এই স্মৃতিচারণ বার বার করে। করাটাই স্বাভাবিক। এমন স্মৃতি বুকে চেপে সবসময় বাঁচা যায় না। মাঝে মাঝে হাফ ছেড়ে বাঁচতে ইচ্ছে তো তারও হয়।
অ্যালেন খসে পড়া তারাটির দিকে তাকিয়ে কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“আমি এই সত্য বুকে লুকাইয়া বাঁচিতে পারিতেছি না, অন্নপূর্ণা। তবে আমার বাঁচিতে হইবে। আমি যে স্টিফেনকে কথা দিয়াছি, তার সানশাইনের ঢাল হইয়া থাকিব। সে কথা কীভাবে লঙ্ঘন করিব বলো! তবে আমার কষ্ট হয়। স্টিফেন বৌঠানকে বড়ো ভালোবাসিত। বৌঠান তখন তা বুঝেনি। ছেলেটার এত ভালোবাসাই তার জীবনের কাল হইল। সে বৌঠানের মন রাখতেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গেল যার জন্য এই পৃথিবী হারাইয়া ফেলল একটি নিঃস্বার্থবান প্রেমিক। অথচ কেউ জানিল না তা, কেউ জানিল না। সেদিন ললিতা স্টিফেনকে নিয়া পালাইয়া যাইতে পারে নাই। তাদেরকে ব্রিটিশীয়ানরা ধরিয়া ফেলে এবং টানা এক সপ্তাহের নির্মম অত্যাচার করার পর তাদেরকে মৃত্যু ভিক্ষা দেয়। ললিতা মেয়েটাকে তো শেষ অব্দি জীবিত পাইনি তবে স্টিফেনকে পাইয়া ছিলাম। হয়তো ছেলেটা শেষ ইচ্ছা জানাইবার জন্যই বাঁচিয়া ছিল। যখন আমি তার এমন ক্ষত-বিক্ষত শরীর পাই, তার প্রাণ প্রায় আসে যায়। কথা বলিতে পারিতেছিল না ও, তবুও আমাকে বলে গিয়াছে ওর মৃত্যুর খবর যেন তার সানশাইন কখনো না জানিতে পারে। সানশাইনের নাকি লাল রঙ খুব প্রিয়। স্টিফেন চায়নি, যেই প্রিয় রঙ সে সানশাইনকে নতুন করিয়া উপহার দিয়াছিল, তা আবার দ্বিতীয়বার কাড়িয়া নিতে। শেষ নিঃশ্বাস অব্দি ছেলেটা ভালোবাসিয়া গিয়াছিল। অথচ তার ভালোবাসার মানুষ তার মৃত্যুর খবর অব্দি জানিতে পারিল না। কত দুর্ভাগা সে! আজকের দিনে পনেরো বছর হইল মানুষটা নাই অথচ কেউ শোক পালন করিবে না এই দুঃখে। কেউ কাঁদিবে না এই ব্যাথায়। হাহ্!”
অন্নপূর্ণার চোখের কোণে অশ্রুর মেলা। যতবার অ্যালেন এই স্মৃতি কাতরতায় কাঁদে, তার সঙ্গী হয় অন্নপূর্ণা। তার বড়ো আফসোস হয় নন্দার জন্য। ইশ্, বড়দিটা কত বোকাই না ছিল! স্বর্গ পেয়েও সে পায়ে ঠেলে দিয়েছে।
_
রাত হতেই নন্দার তুমুল জ্বর বাড়ল। জ্বরের ঘোরেই সে উঠে স্নান করল। কেবল আজ নয়, প্রতিবছর এই দিনটায় তার জ্বর উঠে, ভীষণ জ্বর। সেই জ্বরে সে আবোল-তাবোল কাজ করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। সেই মাঝ রাতে উঠে নন্দা স্নান করল। লাল টুকটুকে শাড়ি জড়িয়ে চুল ছড়িয়ে দিল কোমড় অব্দি। চোখে কাঁজল, পায়ে আলতা লেপে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। হাঁটতে হাঁটতে বাগানটার পেছনে গিয়ে বসল। তার কিয়ৎক্ষণ পরই লম্বাচওড়া, সুঠাম দেহী শুভ্র রঙের একটি পুরুষ উপস্থিত হলো সেখানে। নন্দাকে ফিসফিস করে বলল,
“সানশাইন, ভালোবাসার দাবী ছাড়িয়া দেওয়ার পর তোমার নির্বাসন কেমন কাটিতেছে? অলকানন্দার নির্বাসন, স্টিফেন বিহীন নিশ্চয় দারুণ কাটিতেছে?”
নন্দা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। শরীরের তাপমাত্রা তার তড়তড় করে বাড়ছে। চোখ ঝাপসা হতেই সুঠাম দেহী পুরুষ মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। নন্দার চোখ বেয়ে মুক্তোর মতো অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে কেমন ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
“একদিন নির্বাসিত জনম আমার শেষ হবে। আপনাকে ভালো না বাসার জন্য আমার এই কঠোর নির্বাসন শেষ হবে একদিন। সেদিন আপনি আমার হবেন। আমার হবেন।”
পরপরই তার কণ্ঠে গান ভেসে এলো,
“আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে,
দেখতে আমি পাইনি তোমায়,
দেখতে আমি পাইনি….”
(সমাপ্ত)