অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-৩৪+৩৫

0
513

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩৪.

ঘন মেঘের আস্তরণে আকাশের আলো নিঃশেষ প্রায়। তুমুল বেগে বর্ষণ তখন আনন্দ লীলা বর্ণনা করছে। কিসের আনন্দ তার? নন্দার কলঙ্ক ধুয়ে মিছে নেওয়ার আনন্দ কী? প্রকৃতি কথা বলতে পারে না, তাই হয়তো আনন্দ প্রকাশ করছে অন্য ধারায়। “অলকানন্দার নির্বাসন” মহলের চারপাশে রঙবেরঙের কাপড় টানানো হয়েছে। যেন বৃষ্টি না পড়ে কারণ আজ নির্বাসন মহলে বিরাট ভোজ হবে। স্টিফেনের পরিচালনায় ভোজের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো গ্রামবাসীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এমনকি সকলের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা এবং বস্ত্রেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্টিফেনের ভাষ্যমতে, তার ভালো সময়কে উদযাপন করতে তার সাথে যারা যুক্ত হবে তারা যেন সকলে আনন্দে আত্মহারা হয়। আর বর্তমান সময়ে কৃষকের ঘরে একটি স্বর্ণমুদ্রাই আনন্দের জন্য যথেষ্ট। আর বরাবরই যার যেটার অভাব সেটা দিলেই তার আনন্দ।

নন্দা দুচোখ ভরে দেখলো সেই আনন্দ। তার কলঙ্কের মৃত্যুতে কেউ এতটা খুশি হবে সে ভাবতেও পারেনি। পৃথিবীতে সবাইতো স্বার্থের জন্যেই ভালবাসলো, কাছে আসলো, আবার দূরে চলে গেল। অথচ এই একটা মানুষ যে নন্দাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে গেছে, পাশে ছিল শক্ত ভিত্তি হয়ে। অথচ নন্দা কখনোই মানুষটাকে তেমন মূল্য দেয়নি। কেন দেয়নি? কারণ সে একটি বিশ্বাসঘাতকের জন্য পথ চেয়ে বসেছিল, তার সবটুকু ভালোবাসা সেই আঙিনায় ঢেলেছিল– যে আঙ্গিনা আসলে সেই ভালোবাসার যোগ্যই না। নন্দা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বিবশ চোখে তাকিয়ে রইল বারান্দা দিয়ে আনন্দে আত্মহারা মানুষটার দিকে। মানুষটার এত আনন্দ, এত আয়োজন কেবল নন্দার জন্য। মানুষের মুখে হাসি ঝলমল করছে। সুখী সুখী একটি আবহাওয়া যেন তার চারপাশ জুড়ে।

নন্দা বারান্দা থেকে সরে বিশাল এক স্বস্তির শ্বাস ফেললো। বুকের ভেতর থেকে যেন বিরাট এক পাথর নেমে গেল। সব নিয়ে বাঁচা গেলেও চরিত্রে দাঁগ দিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়ে একজন নারীর জন্য। আর নন্দা এতদিন যাবত এই কঠিন কাজটাই করে আসছিল। বেঁচে অবশ্য ছিল কিন্তু মৃত্যুর মতো এই বেঁচে থাকা। যে বেঁচে থাকায় মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায় না, মানুষের থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় সেই বেঁচে থাকায় আসলে মহত্ব কোথায়? এমন বেঁচে থাকা মৃত্যুর সমান। আর নন্দা এই জীবিত মৃত্যু নিয়ে বেঁচে ছিল। একটি অভিশপ্ত জীবন বহন করে বেঁচে ছিল। অবশেষে আজ থেকে তার সত্যিকার অর্থে বেঁচে থাকার দিন শুরু। আর সে বাঁচবে। অন্তত যে মানুষটা তাকে এতটা ভালবাসে, যে মানুষটা তার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিতেও রাজি নন্দা সেই মানুষটার জন্য বাঁচবে। বাঁচতে যে হবেই। না হয় বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।

নন্দার চোখে ভেসে উঠলো গত দিনের দৃশ্য। যে গ্রাম একদিন নন্দাকে মেরে ফেলতেও দু’বার ভাবেনি, কলঙ্ক ছেটাতেও দু’বার ভাবিনি সে গ্রাম কালকে নন্দার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়েছিল একটু ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে। যে গ্রাম থেকে একদিন মাথা নত করে বের হয়ে এসেছিল , কাল সেই গ্রামই সে মাথা উঁচু করে ক্ষমা ভিক্ষা দিয়ে এসেছে। জীবনে এর চেয়ে বড় কোন মহিমা হয় না। আর এই মহিমার পুরো কৃতিত্ব একজনের। কেবল আর কেবলমাত্র তার স্বামীর। গতকালের একটা দৃশ্যই নন্দা ভুলতে পারছে না। স্টিফেন কেমন গর্জন দিয়ে উঠেছিল গ্রামবাসীর বিপরীতে! আর নন্দাকে সেই গ্রামের কর্তৃত্ব অর্পণ করেছিল। সকলের সামনে যে মেয়েটা একদিন দুশ্চরিত্রার তকমা লাগিয়ে গ্রাম ছেড়েছিল সেই মেয়েটাই আজ গ্রাম চালাবে! এরকম একটা মহৎ ব্যাপার একমাত্র স্টিফেনের জন্যই সম্ভব হয়েছে। মায়ের মতন যেই শাশুড়ি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেই শাশুড়ি কাল নন্দার জন্য হাউ মাউ করে কেঁদেছে। নন্দার এই জীবনে আর কিছু চাওয়ার নেই। যা পেয়েছে তাই তার সারা জীবনের জন্য যথেষ্ট। এতেই সে আমরণ কৃতজ্ঞ থাকবে।

বেশ সময় নিয়ে সে স্নান করল। লাল টুকটুকে একটি শাড়ি জড়ালো শরীরে। সোনার ভারী গহনা গুলো দিয়ে সাজালো তার কোমল অঙ্গ খানি। শরীরের সুগন্ধি মাখতেও ভুললো না। নিজেকে রানীর মতো সাজালো। এতদিন পর স্টিফেনের বলা কথাটার মাধুর্যতা সে বুঝলো। সে আসলেই রানী। যার এমন একটা রাজা আছে সে রানী না হয়ে পারে!

“বড়ো সাজছো যে! কলঙ্ক ঘুচানোর আনন্দে নাকি অন্যকিছু?”

হুট করে নারী কণ্ঠ শুনতেই চমকে গেল নন্দা। পিছু ফিরে তাকাতেই দেখল বিহারিণী দাঁড়িয়ে আছে হাসি হাসি মুখ করে। চোখে মুখে তার প্রগাঢ় স্নিগ্ধতা। নন্দাও হাসল কিঞ্চিৎ। রহস্য করে বলল,
“তোমার কী মনেহয় বলো দেখি?”

“মনে তো কিছুই হচ্ছে না। তাই তো আমি জিজ্ঞেস করলাম।”

“হবেই একটা কারণ। তবে তুমি খুশি কেন?”

“যদি বলি তোমার খুশিতে?”

বিহারিণীর উত্তরে হাসল নন্দা। চোখে গাঢ় কাঁজল লাগাতে লাগাতে বলল,
“অনেক তো হলো লুকোচুরি। ধরা দিবে না এখন?”

নন্দার এহেন প্রশ্নের মানে বুঝল না বিহারিণী। অবাক কণ্ঠে বলল,
“কিসের ধরা দিব?”

“বিহারিণী মহলের তোমাকে প্রয়োজন এখন। মানুষ গুলো কেমন ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। তাদের তুমিই পারে গুছিয়ে নিতে। নিবে না?”

বিহারিণী চমকালো। বি স্ফো রি ত নয়নে চাইল নন্দার পানে। আমতা-আমতা করে বলল,
“বিহারিণী মহলে আমার কে আছে? কিছু না। কেউ না।”

“অথচ মহলের নামটায় অব্দি তোমার অস্তিত্ব। তবুও অভিমান কমবে না?”

“অভিমান না তো। কলঙ্ক। যে কলঙ্ক নিয়ে তুমি গ্রাম ছাড়া হয়েছ সে কলঙ্কের ভাগিদার তো আমিও হয়েছিলাম। তোমার কলঙ্ক মুছে গিয়েছে। এটা ক্ষণিকের আর আমারটা আজন্মের। এই কলঙ্ক নিয়ে আবার সেখানে যাওয়া যাবে না।”

নন্দা বুঝল, আন্দাজে ঢিল মারলেও যে সঠিক জায়গায় ঢিলটা পরেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে আগ্রহী হলো। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কিসের কলঙ্ক? কে লাগিয়ে ছিল?”

“যে তোমাকে স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, সে-ই আমাকে স্বাধীন হতে বলে কলঙ্কিনী করে গিয়েছে। পার্থক্য একটাই, তুমি বেঁচে ফিরেছ আর আমাকে মরতে হয়েছিল।”

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩৪ এর বর্ধিতাংশ:

বাহিরে মৃদু ছন্দে বৃষ্টি পড়ছে। নন্দা বসে আছে আরাম কেদারায়। তার দৃষ্টি স্থির, অনুভূতি স্তম্ভিত। তার সামনেই বিছানাতে বসে আছে বিহারিণী। যার চোখে অশ্রু। ভাষারা মৃত। ক্ষানিক সময় পার হতেই নন্দা প্রশ্ন করল,
“তোমার সাথে ও বাড়ির সম্পর্কটা কিসের?”

বিহারিণী হাসল। মৃদু মন্দ বাতাসে তখন উড়ছিল বাতায়নের কোল ঘেঁষে থাকা মহা মূল্যবান পর্দা খানা। বিহারিণী সেইদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মেঘমন্দ কণ্ঠে বলল,
“তোমার সাথে যে সম্পর্ক ছিল ঐ বাড়ির, আমার সাথেও তাই ছিল।”

নন্দা বিস্মিত হল। বিস্ময়ে বিস্ময়ে টই টুম্বুর হলো তার চারপাশ। সে হাতড়ে বেড়ালো কণ্ঠ ধ্বনির ভাষাদের, অথচ তার ভাষারা আজ নির্বাক। কন্ঠে তার দেখা দিল ক্ষীণ কম্পন। সেই কম্পন যুক্ত কন্ঠ নিয়ে সে বললো,
“হেয়ালি করোনা, কৌতুহল বাড়ছে। আমাকে সবটা জানাও। আমি জানতে চাচ্ছি।”

বিহারিণী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সেই দীর্ঘশ্বাসে যেন ভেসে এলো তার অতীতের দীর্ঘ যন্ত্রণার গান। আকাশ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে সে বলল,
“সইতে পারবে না যে!”

“এমন একটা জীবন সয়ে বেঁচে ছিলাম আর তুমি বলছো সইতে পারবো না! হাসালে। আজকাল আমি সবই সইতে পারি। ভাগ্য শিখিয়ে দিয়েছে। সে আমার বেলা বড্ড নিষ্ঠুর কিনা!”

“আমি যদি বলি– আমি তোমার স্বামীর প্রথম ভাগিদার ছিলাম তাহলে তোমার অনুভূতি কেমন হবে? তুমি মানবে সেই কথা? বিশ্বাস করবে আমাকে? কষ্ট হবে না স্বামীর ভাগীদার ছিল জেনে?”

নন্দা বিস্ফোরিত নয়নে বিহারিণীর পানে চাইল। তার আকাশ-পাতাল উজাড় করে নিঃস্ব মনে হল নিজেকে। যেন মনে হলো সবটুকু ভ্রম। সবটুকু মিথ্যে কোনো মরীচিকা। এই বুঝি তার সকল ভ্রম কেটে যাবে। এই বুঝি সকল সত্য মুহূর্তেই মিথ্যে হয়ে যাবে এবং নন্দা বিশ্বাসঘাতকতার তোপ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নেবে। অথচ না, তেমন কিছুই হলো না। সবটুকু ভ্রম বের হলো না। নন্দার ও আর কষ্ট কমলো না। বিশ্বাসঘাতকতায় ঘাতকতায় মেয়েটা ক্লান্ত। কন্ঠনালীর ভাষা ফুরিয়েছে। ফুরিয়েছে নন্দার সকল বিস্ময়। সে বিবশ কণ্ঠে শুধালো,
“তুমি কি সত্যি বলছো? মজা করছ না তো?”

“এমন একটা ব্যাপার নিয়ে কে মজা করে? যেখানে মেয়েরা স্বামীর ভাগ কাউকে দিতে পারেনা, সেখানে আমি স্বামী নিয়ে এমন ঠাট্টা করব? এত অবুঝ আমাকে ভেবোনা, আমি এতটাও বোকা না। আমি এতটাও ভারসাম্যহীন না।”

“কিন্তু তোমার কথা তো কখনো শুনিনি ওদের মুখে! এমনকি তিনিও তো বলেননি! শুধু জানতাম তার প্রেমিকা আছে। অথচ তার বউও আছে বা ছিল তা তো কখনো বলেননি! তুমিও কী কেবল তার বিছানার সঙ্গী হিসেবে ছিলে?”

“না নন্দা, না। আমি তার ভালোবাসার সঙ্গী ছিলাম। সে আমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। কিন্তু শেষ অব্দি তার ভালোবাসা টিকেনি এটাও আমার দুর্ভাগ্য।”

“ভালোবাসা স্থায়ী না হওয়ার কারণ কী? আর তুমি সাহেবদের কাছে এসে পড়লে কীভাবে? আর এসেছ মানলাম কিন্তু আর ফিরে যাওনি কেন?”

নন্দার অনবরত প্রশ্নে বুক ভারী হলো বিহারিণীর। চোখের সামনে ভেসে উঠল সোনালী অতীত। আনমনেই বলতে লাগল,
“আমার সাথে তোমার গত হওয়া স্বামী সুদর্শনের বিয়ে হয়েছিল বহু বছর আগে। তখন সে সদ্য তরুণ আর আমি সদ্য কিশোরী। আমাদের বাড়ি ছিল কলকাতা। আমার বাবার আমন্ত্রণে একবার সুদর্শন কলকাতা যান এবং সেখানেই তিনি আমাকে পছন্দ করেন। এবং অতঃপর খুব গোপনে আমাদের পত্র আদান-প্রদান চলে। প্রণয় জমে গিয়েছিল দারুণ ভাবে। তারপর আরও প্রায় ছয়বছর আগে তার সাথে আমার বিবাহ কার্য সম্পাদিত হয় বেশ জমজমাট ভাবেই। বউ হয়ে এলাম ‘সোহাগচড়ে’। সোহাগচড় হলো বিহারিণী মহলের পূর্ব নাম। আমাকে তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে আমার নামের সাথে মিলিয়ে এই বিশাল বাড়িটার নামকরণ করেছিল। আমাদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সংসার ছিল। কোনো কিছুর ছিলনা অভাব। যদিও খুঁড়ো শ্বশুর একটু অন্য ধাঁচের ছিল কিন্তু বাকিরা ছিল দারুণ। কাটছিল সুখের দিন। কিন্তু হঠাৎ কালো নজর পড়ল সংসারটায় এবং সব এক মুহূর্তে শেষ। সব শেষ। আমার সংসার, আমার ভালোবাসা এমনকি আমিও।”

বাহিরের প্রকৃতি এতক্ষণ ভালো থাকলেও এখন কিছুটা আঁধার হয়ে এসেছে। আবার নন্দাদের নির্বাসন মহলে আজ একটা আনন্দ অনুষ্ঠান আছে। সেটার জন্য চলছে তুমুল আয়োজন। ঘন হয়ে আসা আকাশটার পানে চাইল নন্দা। গগন বক্ষ যেন তারই অন্তস্থলের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। নন্দা হতাশার শ্বাস ফেলল। বিহারিণী মহলের মানুষগুলো নিখুঁত অভিনয় জানে। তা না হলে কি আর এমনভাবে একটা জলজ্যান্ত মানুষের অস্তিত্ব লুকিয়ে রাখতে পারতো! নন্দা বিশাল এক শ্বাস ফেলল। বলল,
“কী ঝড় এসেছিল?”

বিহারিণী সুদূরে তাকিয়ে করুণ স্বরে জবাব দিল,
“নবনীল নামক ঝড়। যে ঝড়কে আমি বন্ধু ভেবে ছিলাম। যেমন তুমি ভেবেছিলে। ওর সাথে আমার বন্ধুর মতন সম্পর্ক ছিল। আমি যেহেতু কলকাতা থাকতাম তাই অন্যান্যদের চেয়ে একটু বেশি স্বাধীনচেতা ছিলাম। নবনীল আর আমার সেজন্য প্রচুর ভাব হয়েছিল। আমার স্বাধীনচেতা ভাব আরেকটু বাড়াতে সে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সেটাই আমার কাল হয়। একবার তোমার স্বামী শহরে গেলেন বাড়িতে কেউ নেই। আমিই ঘুমিয়ে ছিলাম। এত ঘুম সেদিন কোথা থেকে এলো নিজেও জানিনা। আমার যখন ঘুম ভাঙে তখন দেখি মধ্যরাত। আমাকে বাগানে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখের উপর অনবরত জল ছেটানো হচ্ছে। চোখ মেলে তাকাতেই দেখি সকলে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শরীরে বস্ত্রের আবরণ খুব ক্ষীণ ছিল। লজ্জা নিবারণের জন্য ঠিক যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। তার আগেই আমার শরীরে চাবুকের আঘাত পড়ল। আমি আৎকে উঠলাম। ব্যাথাটা শরীরে পৌঁছালেও উপস্থিত ঘটনা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছালো না। তখন আমার খুঁড়ো শ্বশুর একদলা থুতু ফেলে কেমন ঘৃণিত স্বরে বলল, ‘আমরা বাড়িতে নেই আর তুমি পুরুষমানুষ নিয়ে এসে রেখেছিল! ছিহ্! শহুরে মেয়ে কি-না! বেলাল্লাপনা শুরু করে দিয়েছে।’ আমি তখন বুঝলাম আমার অগোচরে আমার সাথে অন্যকিছু হয়ে গিয়েছে। যার তাৎপর্য এমন— আমার কোনো প্রেমিক আছে যাকে আমি বাড়িতে এনেছিলাম এবং নবনীল সেটা সবাইকে খবর দিয়ে এনে জানিয়েছে। এবং সবাই লোকটাকে বের হতে দেখেছে। সেদিন নবনীলও বাড়িতে ছিল কিন্তু সে এমন মিথ্যা কেন বলল! আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। যদিও আমি বিশ্লেষণ করতাম কিন্তু সুদর্শনের চোখে আমি আমার জন্য সেদিন যে ঘৃণা দেখেছি তারপর আর বিশ্লেষণ করার ভাষা পাইনি। ভালোবাসার মানুষের কাছে নিচু হয়ে যাওয়াটা মৃত্যুর চেয়ে কষ্টকর। এটা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়! তারপর উনার আদেশেই আমার শরীরে বেত্রাঘাত চলে এবং আমাকে নদীতে ফেলে দেওয়ার হুকুম সে-ই দেন। এরপর আর ব্যাখ্যা করিনি কাউকে কিছু। কেবল মেনে নিলাম সবটা। ভেবেছিলাম মরেই যাবে। হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়। আমিও আমার মৃত্যু বরণ করে নেই। কিন্তু কোন ভাগ্যে এ গ্রামে এসে পৌঁছাই এবং তোমার বর্তমান স্বামী আমাকে রক্ষা করেন। এরপর অনেকদিন কাউকে চিনিনি। উন্মাদ হয়ে ছিলাম। পরে সুস্থ হলেও আর ফিরে যাইনি। কোথায় ফিরে যাব? যে সংসার আমাকে ত্যাজ্য করেছে সে সংসারে! আর যাই হোক, বিতাড়িত জায়গায় ফের যাওয়া হলো নিজের প্রতি নিজের করা সবচেয়ে বড়ো অপমান। তোমার বর্তমান স্বামী পর্যাপ্ত সময় ও সাহায্য দিয়েছে আমাকে। আমি সুস্থ হলেও তা আর প্রকাশ করিনি। সেও জানতে চায়নি। আসলে তুমি ভাগ্যবতী নন্দা, তাই এমন একটা স্বামী পেয়েছ। সামলে রেখ। ভালো যা কিছু আছে পৃথিবীতে, তার দিকে খারাপ দৃষ্টি সকলেরই পরে। হোক সেটা বস্তু, মানুষ কিংবা সম্পর্ক। যার যেটার অভাব, সে সেটা পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। সময় থাকতে ভালোবাসার মানুষটাকে আগলে নিও।”

কথা থামতেই বিহারিণী ছুটে বেরিয়ে গেল। নন্দা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিহারিণীর বলা গল্পে তার মায়া হলো। অথচ একবারও সে ভেবে দেখল না, এ গল্পের পেছনে আদৌও কোনো গল্প আছে কি-না!

#চলবে…….

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩৫.

আনন্দ অনুষ্ঠানে চারপাশ মুখরিত। নন্দার নামে জয়ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারপাশ জুড়ে। গ্রামের মানুষ মহা খুশি। আজ থেকে তাদের সকল দায়িত্ব সাহেব বধূর উপর নিয়োজিত হয়েছে। দু গ্রামের দায়িত্ব এখন অলকানন্দার উপর। ছোট মেয়েটা এখন শাসন চালাবে দু-দুটো গ্রামে। প্রশংসায় আলোড়িত চারপাশ। নন্দা কেবল দুচোখ ভোরে দেখল সব। ভেতর ভেতর তার অসীম আনন্দ তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। এত কিছু তার পাওয়ার কথা ছিল না। তবু সে পাচ্ছে। যে সম্মান স্রোতের বেগে হারিয়ে গিয়েছিল, সেই সম্মানই আবার দ্বিগুণ হয়ে ফিরে এসেছে। সবকিছুর কর্তৃত্ব কেবল একজনের। যে মানুষটাকে নন্দা একসময় সহ্য করতে পারত না।

অলকানন্দার নির্বাসন মহলে সুখের সীমা নেই। সকলের মুখে আনন্দের হাসি। হাসছে তার শাশুড়ি কাদম্বরী দেবীও। বুক ফুলিয়ে নিজের আনন্দ প্রকাশ করছে। মহিলাটি বারংবার নন্দার প্রশংসায় আত্মহারা হচ্ছেন। অথচ একবারও সে মুখ ফুটে বলেনি যে এসব কিছুর পিছনে সবটুকুই তার ছেলের অবদান। নন্দা কেমন মুগ্ধ চোখে দেখলো মানুষটিকে। একটা মানুষ কতটুকু ভালো হতে পারে! কতটুকু ভালো হলে তার ভিতরে কেবল মায়ের ছোঁয়াই থাকে?

সবাই যখন আনন্দে আত্মহারা, খুব গোপনে কেউ একজন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। যা আড়াল হয়নি নন্দার কাছে। কিন্তু মানুষটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার কথা ছিলনা। তবে কোন কারণে এই অস্থিরতা! নন্দা প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না। এই বুঝি অনাধিকাযর চর্চা হয়ে গেল।

আকাশের বুকে ভারী হলো রাত। স্টিফেন উপস্থিত হল নিজের কক্ষে। এখন আর বাহিরে বৃষ্টি নেই। তবে, মৃদু বাতাসে উড়ছে জানালার পর্দা গুলো। ঘরে জ্বালিয়ে রাখা ছোট ছোট প্রদীপের অগ্নি শিখা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। স্টিফেনকে দেখেই আজ হাসল নন্দা, কোমল স্বরে বলল,
“চির জীবনের মতন ঋণী না করলেও তো পারতেন!”

”চির জীবনের মতন, ভালোবাসিলেও তো পারো!”

মিষ্টি মধুর হাসি জড়ানো স্টিফেনের ঠেঁটি জুড়ে। কথার ধাঁধায় নন্দাকে আটকাতে পেরে সে যেন বেশি খুশিই হয়েছে। নন্দাও চমকে গেল। চোখের মনি অনবরত ঘুরাতে লাগল। কিঞ্চিৎ লজ্জা লুকানোর প্রচেষ্টা আরকি। স্টিফেন এবার শব্দ করে হাসল, মিহি স্বরে বলল,
”লজ্জা পাইতেছ কেন, সানশাইন? তুমি লজ্জা পাইলে যে পৃথিবীর সমগ্র সৌন্দর্য তোমার পদতলে এসে মূর্ছা যায়। তুুমি এমন অন্যায় করিও না কন্যা, এত সুন্দর হইও না। স্টিফেন যে বারে বারে তোমারও প্রেমে নিজেকে নিঃশেষ করিতে চায়।”

নন্দার কথা ফুরালো। কাঠখোট্টা লোকটা তার কাছে এলেই যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নরম মানুষ হয়ে যায়। কী তার পরিবর্তন! অথচ সুদর্শন কখনো নন্দাকে নিজের ভাবেইনি। কখনো নন্দাকে জিজ্ঞেস করেনি, সে আদৌও ভালো আছে কি-না রীতিমতো পুরুষ জাতির উপর তার ঘৃণা জন্মে গিয়েছিল অথচ স্টিফেনকে কোনো নারী ফেরাতে পারবে না। ভালোবাসতে বাধ্য হবেই। এমন একটা মানুষকে ভালো না বাসলে ক্ষতিটা প্রকৃতপক্ষে নিজেরই হবে। আর নন্দা সেই ক্ষতিই করেছে এতদিন।

খুব গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল নন্দা। কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে বলল,
“আমি আপনার কাছে আমরণ কৃতজ্ঞ থাকব।”

“আমরণ কৃতজ্ঞ থাকার প্রয়োজন নেই, সানশাইন। আমরণ তুমি আমার হয়ে থাকলেই হবে।”

চারপাশে প্রবল বেগে বাতাস বইতে লাগলো। শীতল হয়ে উঠলো উপস্থিত মানব মানবীর শরীর। এ বাতাস যেন কেবল প্রকৃতির বাতাস নয়, এটি ভালোবাসার নতুন শুভারম্ভর লক্ষণ, এটি ভালোবাসার একটি রাতের চিহ্ন, যেই রাত আকাশের বুকে লিখেছে কেবল মুগ্ধতা।

নন্দার অপছন্দের এই সংসার জীবনে, পছন্দ নামক শব্দ যুক্ত হয়েছে। হ্যাঁ সে বোধহয় এখন স্টিফেন কে ধীরে ধীরে খুব আপনজন ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। যার উপর ভরসা করে কাটানো যায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ এমনকি সারাটি জীবনও। যাক, এ পৃথিবীতে নন্দারও কোনো আপন মানুষ হলো। যে তাকে ছায়া দেবে, সাহস দেবে এবং নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেবে।

_

কলকাতার বিখ্যাত ছোটো একটি নদীর পাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দর দালান। লাল রঙের বহুতালা বিশিষ্ট বিলাসবহুল দালানটি বাহির থেকেই যেন মানুষের আর্কষণ কাঁড়তে যথেষ্ট। সেই দালানটির সামনেই দাঁড়িয়ে আছে নন্দা, শতাব্দ ও ললিতা। নন্দার কৌতূহলী দৃষ্টি বার বার চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছে সব। ললিতার মুখ শুকনো আজ বড়ো। নন্দা বারংবার জিজ্ঞেস করেও এই শুকনো মুখের কারণ উদঘাটন করতে পারেনি। ললিতাকে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শতাব্দই অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
“যাবি ভেতরে নাকি! সময় হয়ে যাচ্ছে।”

ললিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভারিক্কি কণ্ঠে বলল,
“মাঝে মাঝে এত কঠিন সময় আসে কেন রে? এত ছোটো জীবনে এত কঠিন সময় গুলো পার করা কঠিন হয়ে উঠে।”

শতাব্দ ভরসা দিল। নিজের ডান হাত ললিতার বাহুতে রেখে আশ্বাসের বুলি আওড়ালো,
“তুই পারবি। যেই কাজে নিজেকে ব্রত করেছিস, সেটা যে পারতেই হবে।”

শতাব্দ এবং ললিতার কথা সম্পূর্ণ নন্দার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কী এমন কাজ আছে যার জন্য ওদের চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে! নন্দা ঝামেলা কমতেই কলেজে এসেছে। কলেজে আসতেই তাকে নিয়ে দু’জন ট্রামে চড়ে এখানে এলো। এরপর গত কয়েক মিনিট যাবত একটা বাড়ির সামনে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। কেন দাঁড়িয়ে আছে, কার বাড়ি কিছুই সে জানেনা।

নন্দার ভাবনার মাঝেই ললিতা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“চল নন্দু, যাওয়া যাক।”

“কোথায়?”

নন্দার প্রশ্নে ফিক করে হেসে উঠল ললিতা। আলগোছে তার গাল টেনে বলল,
“আমার বাড়িতে। চল।”

নন্দা যেন মোটেও এমন কথা আশা করেনি। অবাক কণ্ঠে বলল,
“এটা তোমার বাড়ি?”

“হ্যাঁ।”

নন্দা আর ভাষা খুঁজে পেলনা। ললিতার বাড়ি এত সুন্দর হতে পারে তা ললিতাকে দেখে বুঝার উপায় নেই। মেয়েটা সবসময় এতই সাদামাটা থাকে যে তার বিলাসবহুল বাড়ির পরিচয় সেই সাদামাটা আস্তরণের নিচে ঢাকা পড়ে গিয়েছে।

নন্দাকে হতভম্বের ন্যায় তাকিয়ে থাকতে দেখে ললিতা ফিচলে হেসে শুধাল,
“তোর সাহেবের বাড়ির মতন আলিশান বাড়ি নয় বলে কি যাবি না ভেতরে?”

নন্দার ঘোর কাটে, ধ্যান ভাঙে। সে অস্ফুটস্বরে বলে,
“তোমার বাড়ি তো তার চেয়েও সুন্দর।”

“অথচ সকল সুন্দর নহে দারুণ। সুন্দরের নিচে থাকে কালো আঁধার।”

ললিতার কণ্ঠে রহস্যের রেষ। নন্দা প্রশ্ন করার আগেই তাকে টেনে বাড়িতে প্রবেশ করল ললিতা। মার্বেল পাথরে খোদাই করে তৈরী করা হয়েছে বাড়িটার ভেতরের আস্তরণ। বিশাল এক ঝাড়বাতি জ্বলছে বৈঠকখানার কক্ষটিতে। চারপাশে যেন আলোর খেলা। এমন বিরাট বাড়িটা ফাঁকা, শূন্য। কোথাও কেউ নেই যেন! নন্দা অবাক হলো, অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“বাড়িতে কেউ নেই?”

“বাবা আছেন আপাতত।”

ললিতার উত্তরে বিশেষ ধ্যান দিলো না নন্দা। সে চারপাশ দেখতেই ব্যস্ত। হুট করে তার মাথায় প্রশ্ন এলো, ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোমার মা কোথায়?”

ললিতা তখন জলের গ্লাস নিয়ে উপস্থিত হয়েছে কেবল। নন্দার দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে মুচকি হাসি বজায় রেখেই বলল,
“চলে গিয়েছে।”

“চলে গিয়েছে! কোথায়?”

“কোথাও একটা চলে গিয়েছে। আমার জানা নেই। তবে এদেশের কারো সাথে যায়নি এতটুকু জানি।”

কথা শেষ হওয়ার পর পরই ললিতার দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো। নন্দা বুঝল, সেই দীর্ঘশ্বাসে ভেসে গিয়েছে কত অব্যক্ত কথা। যাদের ভাষা নেই, প্রকাশ করার অধিকার নেই। নন্দার খুব করে স্টিফেনের কথা মনো পড়ল। লোকটার মা-ও তো অন্য এক পুরুষকে ভালোবেসে সংসার বিমুখী হয়ে ছিলেন। একটা সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের এই আচরণ কতটা না কষ্টকর! আপনমনেই নন্দা বিড়বিড় করল,
“উনারেও উনার মা ছেড়ে গিয়েছিল জানো!”

“তাই নাকি? আমাদের খুব মিল তাই না নন্দু?”

নন্দার ধ্যান ভাঙলো। সে চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। হুট করে অনুমান করল, তার এটা বলা উচিত হয়নি। স্টিফেন তাকে বিশ্বাস করেই তো এই গোপন কথা গুলো বলেছিল। এই কথা সবার সামনে উপস্থাপন করাটা ভালো কাজ হয়নি। কিছু গোপন কথা থাকে যা মানুষ কেবল নিজের খুব ভরসার জায়গাতেই ব্যক্ত করতে পারে। সেই ভরসার জায়গা যদি বিশ্বাস রাখতে সক্ষম নাহয়, এরচেয়ে বেশি নিন্দা বোধকরি আর কিছুতেই নেই।

নন্দার ভাবনার মাঝেই বিশাল বাড়িটার উত্তর দিকে একটি কক্ষের দরজা ঠেলে একজন পেশিবহুল, দীর্ঘদেহী পুরুষ বেরিয়ে এলো। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি তার পড়ণে। চুল গুলোও আধো সাদা-কালো মিশেলে। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের স্বচ্ছ কাচের চশমা। ঠোঁটে ঝুলানো হাসি। বেশ মিষ্টি হেসেই এগিয়ে এলেন তিনি। আন্তরিকতার সঙ্গে বললেন,
“আমাদের লিলির বন্ধুরা এলো নাকি?”

ভদ্রলোকের হাসির বিস্তৃতি, মুখাবয়বের সাথে ললিতার দারুণ মিল পেতেই নন্দার বুঝতে বাকি রইল না ইনি কে। সাথে সাথেই সে উঠে দাঁড়াল, দু-হাত জোর করে নমস্কার দিলো। ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। নমস্কারের বিপরীতে তিনিও নমস্কার ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি কি লিলির নতুন বন্ধু? আগে কখনো দেখিনি যে!”

নন্দা উপর-নীচ মাথা নাড়াল। কিন্তু মুখ ফুটে উত্তর দিল ললিতা,
“হ্যাঁ বাবা, ও নতুন। ওর নাম অলকানন্দা। আমার সাথেই পড়াশোনা করছে।”

“বেশ তো! অসাধারণ নাম। তা তুমি বন্ধু নিয়ে এসেছ অথচ আজ একজন সার্ভেন্টও নেই, কী রান্না করে খাওয়াবে শুনি?”

শতাব্দ ভদ্রতার সাথে উত্তর দিল, “না না, সমস্যা নেই।”

ভদ্রলোক থামলেন না। বরং ব্যস্ত পায়ে উঠে গেলেন। মিনিট কয়েক পেরুতেই বিশাল নাস্তার আয়োজন নিয়ে উপস্থিত হলেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী। নন্দা মুগ্ধ নয়নে অপলক তাকিয়ে রইলো সেদিকে। ললিতার বাবা কতটা ভালো, অথচ তার বাবা…… ভাবতেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। এটাও ভদ্রলোকের দৃষ্টি গোচর হলো না। সে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করল,
“অলকানন্দা, তুমি কী কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

নন্দা সাথে সাথে মাথা নাড়াল। মিহি স্বরে বলল, “না।”

মুহূর্তেই নন্দার সাথে ভদ্রলোকের ভাব জমে গেলো। মানুষটার কথাবার্তার ধরণ এতই মুগ্ধতা মেশানো যে নন্দা আপন করে নিল তাকে। অন্যদিকে শতাব্দ এবং ললিতার মুখ কেবল শুকিয়ে যাচ্ছে। আড্ডা দিতে দিতে একসময় নন্দার দৃষ্টি যায় ললিতা ও শতাব্দের উপর। আড্ডায় ভাঁটা পড়ে। শুধায়,
“কী হয়েছে তোমাদের?”

ললিতা আর শতাব্দ যেন এই প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিল। ভদ্রলোকও যখন ওদের দিকে দৃষ্টি দিল তখন ললিতা উঠে দাঁড়াল। চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,
“বাবা, কোম্পানি একটা জমি নিয়ে ঝামেলা করছে। আমরা জানি, সে জমির খোঁজ তুমিই তাদের দিয়েছিলে। যা উচিত করোনি। সে জমির উপর অনেক গুলো পরিবার নির্ভরশীল। তুমি কী কোম্পানিকে বলবে যে সে জমিটা যেন ছেড়ে দেয়।”

ললিতার বাবা শেখর ঘোষের ঠোঁটে হাসি। তিনি চায়ের কাপে আরামদায়ক চুমুক দিয়ে পা দুলাতে দুলাতে বললেন,
“লিলি, এই যে তুমি কত রকমের কিছুতে যোগ দিয়েছ, দেশের জন্য কতকিছু করছ, আমি কী তোমায় বাঁধা দিয়েছি কখনো? আমি নিজে কোম্পানির হয়ে কাজ করছি আর আমার মেয়ে হয়ে তুমি কোম্পানির বিপরীতে কাজ করছ, কখনো বাধা-নিষেধ করেছি তোমার কাজে? তাহলে তুমি কেন এই অযাচিত হস্তক্ষেপ করছ?”

ললিতা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো হতাশ কণ্ঠে বললো, “দেশ তো মায়ের মতো, বাবা। নিজের মায়ের অপমান করবে তুমি? বুক কাঁপবে না তোমার?”

“কাঁপছে না তো! কাঁপলে কি আর এমন কাজ করতে পারতাম? আর তোর কি মনে হয় লিলি, কোম্পানি আমার কথায় জমির অধিকার ছেড়ে দিবে? এতই সোজা! আমি কেবল তাদের একজন কর্মচারী বলা যায়, তারা হলো মালিক। কখনো শুনেছিস কর্মচারীর কথাই মালিক উঠ-বস করে? তোর কিছু দিন দিন বুদ্ধি-শুদ্ধি সব লোপ পাচ্ছে!”

শেখর ঘোষের ঠোঁটে হাসি থাকলেও হাসি নেই উপস্থিত বাকি তিন জনের ঠোঁটে। নন্দা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এখানে হচ্ছেটা কি! সে তো এমনি এসেছিল, তাহলে হুট করে এমন ঝামেলার কারণ কি? নাকি এইজন্যই ললিতা ও শতাব্দীর মন এতক্ষণ খারাপ ছিল! তারা কি কোন উদ্দেশ্যে এসেছে? কি উদ্দেশ্য সেটা? আর ললিতার মতো মেয়ে কিনা এমন ভাবে কথা বলছে? যেখানে তার বাবা এতটা ভালো!

কথা কাটাকাটি তুমুল পর্যায়ে চলে গিয়েছে। হইচই হাঙ্গামায় পুরো বাড়ি যেন ললিতা মাথায় তুলে ফেলেছে। নন্দা কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে দেখছে সেটা। শেখর ঘোষের কণ্ঠ তখনও শীতল। সে মেয়েকে বুঝানোর কণ্ঠে বলল,
“দেখ মা, কাজটা তুই যতটা সহজ ভাবছিস ততটা সহজ না। এত বছর কোম্পানির সাথে তো ছিলাম তাদের হয়ে কাজ করেছি, আজ যদি আমি তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি তাহলে তারা কি আমাদের ছেড়ে দেবে মনে করছিস?”

“ওই জমির মূল কাগজপত্র তোমার কাছে আছে, বাবা। সে কাগজপত্র যদি সেই দরিদ্র মানুষ গুলো দেখাতে পারে তাহলে এই জমি কোম্পানির হাতে যাবে না। তুমি আমাদের কাগজ-পত্র গুলো দিয়ে দাও তাহলেই তো হল। মানুষ গুলোর মুখের ভাত কেড়ে নিও না। এমনিতেই বিভিন্ন উর্বর জমিতে নীল চাষ করে সকল জমির উর্বরতা তারা নষ্ট করেছে। তার ওপর করের বোঝা চাপিয়ে কৃষকদের, নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের একবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। মানুষগুলো ভালো করে খেতে অব্দি পারছে না। ভালো করে বাঁচতে পারছে না। তুমি এগুলো দেখছো না? যারা এত সুন্দর দেশটাকে পায়ের নিচে দাবিয়ে রাখছে তাদের হয়ে তুমি কেন কাজ করছ!”

“কারণ তাদের সাথে কাজ না করলে যে আমরাও তাদের পায়ের নিচে পড়ে শেষ হয়ে যাব, মা।”

“প্লিজ বাবা, কাগজপত্র গুলো আমাকে দিয়ে দাও। না হয় আমি শক্ত কোন কাজ করতে বাধ্য হবো।”

মেয়ের হুমকিতে যেন তাজ্জব বনে গেল শেখর ঘোষ। অবাক নয়নে তাকালো মেয়ের পানে। বাবার জন্য মুখের বুলি ফুরিয়ে গিয়েছে। সন্তানের এই আচরণ যেকোনো বাবার কাছেই যে বড্ড কষ্টের! শেখর ঘোষ কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“শক্ত কোনো কাজ করবি, লিলি? কি কাজ করবি? কতটা শক্ত কাজ করবি? বাবার মন ভাঙ্গার মত শক্ত কাজ! নাকি তার চেয়েও ভয়ংকর কিছু?”

পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাহিরে চলে যেতে নন্দা মুখ খুললো, বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
“একটু আস্তে ধীরে কথা বলো। চেঁচাচ্ছ কেন? আর ললিতা, তোমার বাবা তো খুব ভালো মানুষ, তার সাথে এমন ব্যবহার করো না। অন্তত আমাদের সামনে।”

নন্দার কথা থামতেই তুমুল শব্দে চারপাশটা কেমন নীরব হয়ে গেল। কেবল দেখা গেল রক্তের স্রোত।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে