অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব-৩২+৩৩

0
511

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩২.

ঝলমলে বিহারিণী মহলে আজ আর আগের মতন শাসন শোসনের সেই উজ্জ্বলতা নেই। সাজিয়ে রাখা শখের বাগানে আজ আগাছায় ভোরে গেছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল টুকটুকে ফুল গুলো অযন্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে মাটিতে। মালি কী আর রোজ এগুলো পরিষ্কার করে না! বিহারিণী মহলের সকলেই তো প্রচুর বাগান বিলাসী অথচ তাদের প্রিয় বাগানের এই দূরাবস্থা! বাগানের কাহিল অবস্থা দেখেই আঁচ করা যায় বাড়ির ভেতরের মানুষ গুলো ঠিক কেমন ভাবে দিন কাটাচ্ছে। বাগানের মতনই বোধহয় মলিন অবস্থা মানুষ গুলোর! নন্দার বড়ো মায়া হলো মানুষ গুলোর কথা ভেবে। বুক ভার হলো। সবসময় বিলাসবহুল জীবন পার করা মানুষ গুলো এখন কীভাবে দিন কাটাচ্ছে! নিশ্চয় ভীষণ কষ্ট হয়! মানুষ গুলো যে বড্ড আরামপ্রিয়। নন্দা হতাশায় শ্বাস ফেলে বড় গেটটা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। আজ আর অনেকগুলো গৃহরক্ষী লোহার গেটটি খুলে দেয়নি।

নিরিবিলি বাড়িটাতে প্রবেশ করতেই নন্দার শরীর সুনশান নীরবতায় শিরশির করে উঠলো। মনে হলো বহুবছর এই বাড়িটাতে কেউ থাকেনা। অযত্নে ঘুণে ধরেছে আঙিনায়। নন্দা অন্দরমহলে প্রবেশ করলো, দেখলো চারপাশে কেউ নেই। অন্যান্য সময় হলে এই অন্দরমহল জুড়ে কত দাস দাসীর আনাগোনা থাকতো! নন্দার উপস্থিত হওয়ার খবরটা মুহূর্তে ছড়িয়ে যেত পুরো বাড়িটাতে। কিন্তু আজ খবর ছড়ানোর কেউ নেই। অর্থ না থাকলে কেউ থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবুও দু একজন মায়ার টানে রয়ে গিয়েছে। অর্থের থেকেও মায়া যাদের বড়ো মনে হয়েছে কেবল তারাই।

রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে টুকটাক শব্দ। নন্দা সেদিকেই পা বাড়াল। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই দেখল মলিন একটি সাদা থান পরিহিতা নারী রান্না করছে। মাথা অব্দি যার ঘোমটা টানা। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো। এই বাড়িতে কোনো বিধবা রান্নার বউ তো ছিল না। তবে কী নিযুক্ত করা হয়েছে নতুন! কেই-বা নিযুক্ত করবে! তার খুঁড়ো শ্বশুর! লোকটা তো বিধবা মানুষ দেখতেই পারেন না, তাহলে! নন্দার আকাশ-পাতাল ভাবনা তখন চারপাশে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়েছে। মহিলাটি কে হতে পারে জানার জন্য নন্দার কৌতূহলরা হামাগুড়ি দিয়ে পড়ছে। নন্দা তাই গলা পরিষ্কারের ভান করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল এবং পরিশেষে সে সফলও হলো। তার কণ্ঠের শব্দ পেতেই মহিলাটি ফিরে তাকাল। মহিলাটির মুখ স্পষ্ট চোখের সামনে ফুটে উঠতেই নন্দা চমকে উঠল। সদা পরিস্ফুটিত থাকা সুরবালা দেবীর পড়ণে আজ মলিন বস্ত্র! মুখের মাঝেও ক্লেশ যাতনা। সেই যাতনাকে ছোটো বলে ভাবাও যাবে না। সেই যন্ত্রণার ভার বোধহয় দীর্ঘ। যতটা দীর্ঘ হয় মাথার উপরের আকাশ, ততটা দীর্ঘ।

নন্দাকে দেখে যে তার সামনে দাঁড়ানো মহিলাও বেশ চমকেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“অলকানন্দা!”

একটি ডাকেই নন্দার প্রাণ জুড়িয়ে এলো। মনে হলো বহুদিন এই নামে কেউ তাকে ডাকে না। কালের গহ্বরে যেন হারিয়ে গেছে নামখানা। নিজের হারিয়ে যাওয়া নামখানাকে বহুদিন পর শুনতে পেয়ে নন্দার অনুভূতিরা যেন আনন্দ, উন্মাদনায় ঝলমল করে উঠলো। আটকে রাখতে পারল না নিজের অসংযত অনুভূতিকে। সে ছুটে গেল। মুহূর্তেই সকল বাধা, ব্যবধান, নিষেধ ভুলে জড়িয়ে ধরল তার এককালীন আশ্রয়কে। যে ছিল বলে আজ নন্দা জীবিত আছে। যে ছিল বলেই নন্দা আরেকবার বাঁচতে চাওয়ার সাহস করেছিল। যেখানে নিজের মা-বাবা তার দিকে দু’বার ফিরে তাকায়নি সেখানেই এই পাহাড়ের মতন সুউচ্চ নারীটি তাকে বটবৃক্ষের মতন ছায়া দিয়ে গিয়েছিল সর্বক্ষণ।

নন্দার চোখে অশ্রু টলমলে। হাসল সুরবালা। শুধাল,
“ভালো আছো?”

নন্দা কথা বলতে পারল না। ওষ্ঠযুগল প্রতিধ্বনিত করতে পারল না কোনো শব্দ। মায়ের আদুরে স্নেহেয় ভাষারাও নিরেট আহ্লাদে ঝিমিয়ে গেল। সুরবালা দেবী সকল নিরবতা ভেঙে বললেন,
“কথা বলবে না?”

গলাটা কী তার কাঁপলো! বোধহয় কাঁপলো। শব্দরা কেমন নড়বড়ে শোনাল। নন্দা উত্তর দিল,
“মা, আমাকে মনে পড়েছিল?”

“মনে পড়বে না? তোমার দুর্দিনে সাথে ছিলাম না, তাই তোমার ছায়া হারাতে না হারাতেই আমার দুর্দিন শুরু। তোমায় ভুলবো কেমন করে? তোমায় ভুললে যে আমার পাপের ক্ষমা হবে না কভু।”

নন্দা ফ্যালফ্যাল করে চাইল শাশুড়ির পানে। তার বেঁচে থাকার আদর্শ যে মানুষটা, সেই মানুষটার মলিন মুখ, ক্লান্ত কণ্ঠস্বর তাকে বড্ড পীড়া দিচ্ছে। সে আবদারের কণ্ঠে বলল,
“আমার সাথে চলুন, মা। আমার সাথে থাকবেন। আপনার এই অবস্থা যে আমার মোটেও ভালো লাগছে না।”

“আমায় নিয়ে যাবে? কই নিয়ে যাবে! এই সংসারেই যে আমার খুঁটি। এই শিকড় ছিন্ন করে কোথায় যাব বলো তো!”

নন্দা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বলার ভাষা খুঁজে পেল না। নারীরা সব সময় সংসার প্রেমি। তারা সবসময়ই চায় এই সংসারে তাদের নিবিড় বসবাসটা যেন দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই সংসারের মায়া তারা ছিন্ন করতে পারেনা এত সহজে। এই যে, এই মানুষটার স্বামী মারা গিয়েছে প্রায় বছর বিশ হবে। তারপর বহু গঞ্জনা, লাঞ্ছনা সহ্য করে সে এ সংসারে নিজের বাকিটা জীবন রেখে গেল। যত্নে কিংবা অযত্নে! কিন্তু কখনোই এই সংসার ছাড়ার ভাবনা ভাবেননি। নারী জাত সংসার ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারেন না। দিনশেষে সংসারই তাদের সবটুকু ভালো থাকা। অথচ পুরুষ! স্ত্রী মারা যেতে যেতে তারা ভেবে নেয় তাদের সংসার বুঝি নারী হীনতায় উচ্ছন্নে যাবে। আর সেই ভাবনাতেই তারা ঘরে তোলে নতুন স্ত্রী। আসলে পৃথিবীর বেশিরভাগ পুরুষ সংসার বলতে স্ত্রীর সান্নিধ্যে থাকাকেই বুঝে। তারা ভাবে স্ত্রী ছাড়া বা নারীসঙ্গ ছাড়া বুঝি কোন সংসারই হয় না। আর তাদের এই ভাবনার জন্য তারা খুব অকপটেই নিজেদের ভালোবাসা, মায়া সবকিছু ভুলে যেতে পারে। অথচ যদি কোন পুরুষ নারী ছাড়া থাকে তাদের বিশেষ কোনো লাঞ্ছনার স্বীকার হতে হয় বলে আমার মনে হয় না। নারী ছাড়া পুরুষকে সমাজ ছোট চোখেও দেখেনা কিংবা অসহায় ভেবে অত্যাচারও করে না। এত সুবিধা থাকা স্বত্তেও সেই পুরুষ নারী ছাড়া থাকতে পারেনা। কিন্তু একই সমাজে একটি নারী যদি পুরুষ ছাড়া থাকতে চায় বা থাকে, তাহলে তাকে কত ধরনের বাজে পরিস্থিতি, অসহায়ত্ব পার করে যে বাঁচতে হয়, তা যেকোনো মানুষের ধারনার বাহিরে। তবুও নারীরা স্বামীর স্মৃতিকে অবলম্বন করে হাজারো অত্যাচার সহ্য করে কাটিয়ে দিতে চায়। আর সেই নারীকেই সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। সমাজ সব বুঝে কেবল প্রেম, ভালোবাসা কিংবা আবেগ বুঝে না।

নন্দা হতাশার শ্বাস ফেলে বলল
“মা, আপনাদের এই বিহারিণী মহল তো নিলামে উঠবে, তাহলে আপনারা যাবেনও বা কোথায়? কোথাও তো একটা যেতে হবে, তাই না? তাহলে আমার বাড়িতে নয় কেন? কি দোষ করেছি আমি?”

“দোষ তুমি করনি তো নন্দা, দোষ করেছি আমি। তোমাকে চিনেও, জেনেও শেষ পর্যন্ত না জানতে পারার পাপ করেছি। তোমার সবচেয়ে অসহায় সময়ে, তোমার ভয়ংকর ভবিষ্যতের কথা জেনেও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম সেই অত্যাচারের মুখে। সেদিন তুমি কতটা অসহায় হয়ে প্রাণ ভিক্ষা করছিলে।অথচ আমাদের বিন্দুমাত্র মায়া হয়নি। আমরা কতটা পাষাণ তাই না! অথচ তুমি আমদের অসহায়ত্ব দেখে পাশে দাঁড়াতে চাইছো? এত ভালো হইওনা নন্দা। ঠকে যাবে, ব্যথা পাবে আর দাঁড়াতে পারবে না। যারা তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিও না। এত মহৎ হলে যে তোমার ভাগ্য তোমার সাথে প্রতারণা করবে। আমি চাই তুমি ভালো থাকো। সে ভালো থাকায় আমাদের মত কারো ছায়াও যেন না পড়ে।”

সুরবালা দেবীর চোখ-মুখ জুড়ে সেই এক দীপ্তি যেন ছড়িয়ে আছে যা বরাবর থাকতো। নন্দা আর কিছু বলতে পারল না বলার ভাষা ও খুঁজে পেল না। কেবল আফসোসে আফসোসে ভারী হলো বুক। দীর্ঘশ্বাসেরা দিল উঁকিঝুঁকি।

_

শহুরের একটি আলিশান বাড়িতেই অন্নপূর্ণার বসবাস। নন্দা আজ তাকেও দেখতে এসেছে। সে ভেবেছিল তার বোনটা হয়তো ভালো নেই। হয়তো গুমরে মরছে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিল অন্নপূর্ণার চাঞ্চল্য। নন্দা বাড়িতে ঢুকলেই দেখল অন্নপূর্ণা নাচ করছে। পায়ের ঘুঙুরের শব্দ তালে তালে বাজছে।

নন্দাকে দেখে অবাক অন্নপূর্ণা। ছুটে এলো খুব দ্রুত। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বোনকে বসতেও দিল। কথা বলতে পারে না সে, তবে তার হাবভাব বুঝিয়ে দিল তার খুশির পরিমাণ। নন্দা হাসল, শুধাল,
“ভালো আছিস?”

অন্নপূর্ণা ইশারা করল, বুঝাল তার ভালো থাকার পরিমাণ কতটুকু। নন্দা বোনকে জড়িয়ে ধরল। প্রস্তাব রাখল সে এখুনি বোনকে বাড়ি নিয়ে যাবে। নিজের কাছে রাখব। অন্নপূর্ণা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। অবশেষে শহুরে এক একাকীত্ব জীবন থেকে অন্নপূর্ণার ছুটি মিলল। ছুটলো সে শিকড়ের টানে।

_

একটি মায়াবিনী নারীর হাতে দীর্ঘ চিঠি যা অযত্নে ভাঁজ হয়ে আছে। সে তাদের বাড়ির পেছনের ঘন আঁধারিয়া সেই মোহনীয় জঙ্গলে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ-মুখে কিসের যেন একটা হিংস্রতা খেলা করছে। তার সামনেই পুকুরটার জলের রঙ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। পুকুরের ভেতর মানুষ খেঁকো মাগুর মাছ গুলো আজ মহা আনন্দে নাচছে। কত গুলো দিন পর মানুষের মাংস তাদের পেটের ক্ষুধা মনের তৃষ্ণা মেটালো। মানুষ খেঁকো মাছ গুলোর সাথে সাথে খুশি নারীটিও। সেও তো বেইমান খেঁকো মানুষ। বেইমানদের এই পৃথিবীতে কোনো ঠাঁই সে পেতে দিবে না। অসম্ভব। আকাশে-বাতাসে গম্ভীর বজ্রপাত হলো। একটি কোমল নারীর নৃশংসতায় যেন হতভম্ব সে।

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩৩.
খুব ধীর গতিতে ঘরের মিউজিক যন্ত্রটায় গান বাজছে। কোমল, মিহি সেই গানের সুর। গানের সাথে সাথে একটি মেয়েলি কণ্ঠও তাল মেলাচ্ছে,
“আমারও পরাণে যাহা চায়, তুমি তাই,
তুমি তাই গো…….”

প্রকৃতিতে তখন হিমশীতল বাতাস। গগনে নৃত্য করছে ঘন কালো নভশ্চর। ক্ষণে ক্ষণে অশনির নিখাঁদ আলোয় মর্তধাম উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে তারার ন্যায়। অম্বরের উচ্চনাদ মনুষ্য জাতির জন্য কিছুটা হলেও ভীতিকর। অলকানন্দাও তার বাহিরে নয়। গগন গহ্বর থেকে আশা বিরাট শব্দের কারণে তার মাঝে মাঝে গানের সুর কেটে যাচ্ছে, তাল গুলিয়ে যাচ্ছে। তবুও সে যন্ত্রের তালে তালে গেয়ে যাচ্ছে।

“তোমারও পরাণে কোন সেই মহৎ পুরুষকে চায়, সানশাইন? আমি কী তাহা জানিতে পারি?”

অলকানন্দার গান থেমে গেল। সাথে থেমে গেল তার কাজ করতে থাকা ব্যস্ত হাত। সে কিছুটা চমকে পিছে তাকাতেই দেখল ভিনদেশী পুরুষের সিক্ত দেহখানা। নন্দা একবার উপর থেকে নীচ অব্দি খুব ক্ষীণ ভাবে চোখের মনি ঘুরিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল। শ্বাস গুলো তার নিরবতায় গল্প শুনিয়ে গেল এক নৃশংসতার। স্টিফেন হয়তো পুরো গল্প বুঝল না তবে দীর্ঘশ্বাসের সারমর্ম বুঝল। শুধাল,
“কে সে মানুষ? যার কথা শুনিলে সানশাইনের বুক ভারী হইয়া যায় দীর্ঘশ্বাসে?”

“নেই তেমন কেউ।”

নন্দার কাঠ কাঠ জবাবে হাসল স্টিফেন। চুলের সরু ধারা বেয়ে বৃষ্টির জল নতুন রঙের কবিতায় টুপটাপ ছন্দে গড়িয়ে পড়ছে। তার হাসির ভাষারা বড়ো অর্থবহ তা আর বুঝতে বাকি রইল না নন্দার। নন্দা ভ্রু কুঁচকালো, কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছেন কেন? অদ্ভুত!”

“হাসিবো না? যাহার সানশাইনের মতন অমন সুন্দর প্রেমিকা কিংবা স্ত্রী আছে তার তো দিন-রাত হাসির মাঝেই থাকা উচিত বলিয়াই আমি মনে করি।”

কথা থামতেই অলকানন্দা চোখ বড়ো বড়ো করে চাইল। স্টিফেনের মুখের কোণে বাঁকা হাসিরা খেলা করছে। নন্দাকে নিয়ে খুব তীক্ষ্ণ একটি ঠাট্টা যে সে অকপটেই করে ফেলেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই নন্দার। সে কিছু বলতে গিয়েও লোকটার হাসি দেখে বলতে পারল না। বরং নিজেও ফিক করে হেসে দিল। নন্দার হাসির শব্দে মুগ্ধতারা ঝমঝমিয়ে যেন পড়তে শুরু করল। মেয়েটার হাসি সুন্দর, যেমন করে সুন্দর আকাশ কিংবা সমুদ্র ঠিক তেমন সুন্দর।

তন্মধ্যেই অ্যালেন ছুটে এলো তাদের ব্যাক্তিগত কক্ষে। হয়তো প্রয়োজনেই এসেছিল। কিন্তু কপোত-কপোতীর এহেন হাস্যোজ্জ্বল দৃশ্যে সে নিজের প্রয়োজন ভুলে গেলো। কেবল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিল সেই দৃশ্য দেখে। স্টিফেন খুব সহজে হাসে না। তাকে খুব হাসতেও দেখা যায় না। নন্দাও তেমন। খুব কমই হাসি থাকে তার মুখে। অথচ কম হাসা দু’জন ব্যাক্তি যখন হাসে তখন পুরো পৃথিবীর মুগ্ধ দৃষ্টি হয়তো তাদের উপরই থাকে।

অ্যালেনের ভ্রম কাটলো। দরকারী কাজটা একটু বেশিই গুরুতর বলেই তার এমন সুন্দর দৃশ্যে না চাইতেও হস্তক্ষেপ করতে হলো। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তাই বলল,
“স্টিফেন, বৌঠান, মে আই কামিং?”

আরেকটি পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে আসতেই নন্দা থেমে গেল। তার হাসির প্রশস্তও কমে এলো। দরজার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল,
“আসুন, ঠাকুরপো।”

অ্যালেন সাথে সাথেই ঘরে প্রবেশ করল। খুব ব্যস্ত গতিতে স্টিফেনের উদ্দেশ্যে বলল,
“স্টিফেন, তুমি যাহা বলিয়াছ তাহা করিয়া ফেলিয়াছি। সকলে আসিয়া ভীড় করিয়াছে। বাহিরের আবহাওয়া মোটেও উপযুক্ত নহে। কাজটা দ্রুত সারিয়া ফেললে বোধকরি ভালো হইতো। তারপর নাহয় আবার হাসিও।”

শেষের বাক্যে অবশ্য মশকরার ছাপ। নন্দাও বেশ লজ্জা পেল। দ্রুত অন্যদিকে চলে গেল। কাজের বাহানায় লজ্জা লুকানোর প্রচেষ্টা আরকি। স্টিফেন মাথা দুলিয়ে বলল,
“আসিতেছি। এত সুন্দর দৃশ্যে তোমার বা’হাত খানা প্রবেশ করিয়া দিয়া এখন আর মহৎ হইতে হইবে না। তোমারও ব্যবস্থা করিতেছি খুব শীগ্রই।”

এবার অ্যালেন লজ্জা পেল। দ্রুতই সে সেখান থেকে প্রস্থান নিল। এর আগে অবশ্য বৌঠানের থেকে অনুমতি নিতে ভুললো না। নন্দা বরাবরই এই লোকটার আচরণে মুগ্ধ হয়। ছেলেটার সাথে কমপক্ষে হলেও নন্দার বয়সের পার্থক্য দশ-বারো বছর। অথচ অ্যালেন সবসময় নন্দার সাথে কথা বলার সময় মাথা নিচু করে কথা বলে এবং সেই মুহূর্তে তার কণ্ঠস্বর থাকে একবারে কোমল। আর এতটা সম্মানের সঙ্গে কথা বলে যে নন্দার তার প্রতি ভক্তিতে মন ভোরে উঠে।

অ্যালেন চলে যেতেই স্টিফেন নন্দার পাশে এসে দাঁড়াল। নন্দার এলোমেলো থাকা শাড়ির আঁচল কিছুটা ভাঁজ করে দিয়ে বলল,
“তৈরী হও সানশাইন। আজ তোমার সকল কলঙ্ক মুছিয়া ফেলিবার দিন। তবে সানশাইন, এ পৃথিবীতে তোমাকে কেন এই জনমেই আমার হইতে হইল। এই বিষে ভোরা জনমে তোমার মতন অমৃত কেন পাইতে হইলো? যাকে দীর্ঘস্থায়ী ধরিয়া রাখিবার সাধ্য আমার নাই।”

কথা থামতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্টিফেন। নন্দা অবশ্য কথার মানে না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। স্টিফেন তাড়া দিল। কিন্তু নন্দার মাথায় স্টিফেনের বলা বাক্যই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। কিসের কলঙ্ক মুছবে স্টিফেন!

_

বাহিরের ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকানোর খেলায় অন্নপূর্ণা কেবল নিশ্চুপ দর্শক। গবাক্ষের কোল ঘেঁষে সে আফসোস পুষে রাখে রোজ। জীবনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। এক লহমায় তার সুন্দর, গুছানো জীবন এলোমেলো হয়ে গেলো। তার পবিত্র জীবনে লাগল কলঙ্কের কালি। যে কালি কোনো কিছুর বিনিময়ে আর কখনো উঠবে না। তার গানের কণ্ঠ বরাবরই দারুণ ছিল। সকলের কতো প্রশংসা কুড়িয়েছে সে কণ্ঠ দিয়ে! আজ গান দূরে থাক, কথাও বের হয় না। আফসোসের এক কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় মন-জমিন।

তার ধ্যান ভাঙে দরজার ঠকঠক শব্দে। সে চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই অ্যালেনের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখতে পেল। সাদা ধবধবে চামড়ায় হাসিটা একটু বেশিই সুন্দর লাগে অন্নপূর্ণার পানে। অন্নপূর্ণার ধ্যান ভাঙে অ্যালেনের কণ্ঠে,
“আসিতে পারি?”

অন্নপূর্ণা মাথা নাড়ায়। ইশারায় ভেতরে আসার অনুমতি দেয়। অনুমতি পেতেই অ্যালেন ভেতরে প্রবেশ করে। হাসি মুখেই প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“ভালো আছেন?”

অন্নপূর্ণা ঘাড় কাঁত করে উত্তর দিল। জানালো তার সবটুকু ভালো না থাকার পৃথিবীতে সে ভালো আছে। কিন্তু ইশারা মিথ্যা বলতে জানলেও চোখ যে কখনো মিথ্যা বলে না। তার ভালো না থাকার বহিঃপ্রকাশে চোখ গুলো যে জ্বলজ্বল করছে। অশ্রু লুকানোর ভয়াবহ চেষ্টা চট করেই ধরে ফেলল অ্যালেন। ফিক করে হেসেও দিল সে। বলল,
“মিথ্যেও বলিতে পারেন আপনি! পারিলেও মিথ্যে বলায় বড়োই কাঁচা আপনি। আগে শিখিতে হইবে ভালো করে মিথ্যা কীভাবে বলিতে হয়। তারপর বলিবেন, কেমন?”

অন্নপূর্ণা ভাবেনি এমন ভাবে হাতে-নাতে সে ধরা পরে যাবে। তাই কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেল সে। চোখ ঘুরিয়ে নিল সাথে সাথে। তা দেখে অ্যালেন আবার হাসল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“আর চোখ ঘুরাইতে হইবে না। শীগ্রই তৈরী হইয়া নিন, আমরা এক স্থানে যাইব। ভয় নেই, কেবল আমি আর আপনি না, বৌঠানও যাইবে। তাড়াতাগি তৈরী হোন।”

অন্নপূর্ণা আর জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না কোথায় যাবে আর কেনই বা যাবে। যেমন হুট করে অ্যালেন এসেছিল ঠিক তেমন করেই সে প্রস্থান নিল৷

_

বাহিরে তখন ঝড়ের জন্য প্রস্তুত প্রকৃতি। এই হয়তো আকাশ-পাতাল উজাড় করে ঝড় নামবে। চারপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। যদিও রাত নয় সময়টা কিন্তু দেখতে রাতের চেয়েও যেন আঁধার। নন্দাদের গাড়িটি তাদের গ্রাম পেরিয়ে তার এককালীন শ্বশুর বাড়ির গ্রামে চলে এসেছে। নন্দা প্রশ্ন করার আগেই গাড়িটি তার নিজ স্থানে থামল। নন্দা গাড়ি থেকে নামতেই চারপাশের পরিচিত সেই দৃশ্য দেখতেই চমকে উঠলো। এটা সেই জায়গা যেখানে নন্দাকে বেঁধে রেখে বেধড়ক মারধর করা হয়েছিল। নন্দার লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল। সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি বারবার উঁকিঝুঁকি দেওয়া আরম্ভ করল তার মস্তিষ্কে। সে ঘটনার অনেকদিন হয়ে গেলেও নন্দার যেন আজ খুব করে শরীর যন্ত্রণায় ফেটে পড়ছে। কী মার! কী নৃশংসতা! হুট করেই নন্দা যেন স্থান, কাল, পাত্র ভুলে গেলো। স্টিফেনের হাত জাপটে ধরে কেমন আকুতি-মিনতি ভরা কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান। এখান থেকে নিয়ে চলুন এক্ষুনি। আমাকে বাঁচান।”

নন্দার অস্থির উত্তেজনা সাথে আহাজারিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার শাশুড়ি কাদম্বরী দেবীসহ অন্নপূর্ণাও। অ্যালেনের কণ্ঠেও ভীত ভাব। মেয়েটার হুট করে এমন পরিবর্তনেই সকলে অবাক হলো কেবল নির্বাক রইল স্টিফেন। আলতো হাতে নন্দার বাহু জড়িয়ে ধরে ভরসা দিল। শান্ত কণ্ঠে বলল,
“তোমার কিছু হইবে না, সানশাইন। যার আস্ত একটা স্টিফেন আছে তার চিন্তা কিসের? তোমার জন্য আমি আছি তো! চোখ খুলো।”

নন্দা তবুও ভয় পেল। চোখ না খোলার যেন পণ করেছে সে। অতঃপর স্টিফেন কণ্ঠ গাঢ় করল,
“চোখ খুলিতে বলিয়াছি তোমায়। চোখ খুলিবে এক্ষুণি।”

নন্দা সাথে সাথে চোখ খুলল। সামনে দৃষ্টি পড়তেই তার চক্ষু যেন চড়কগাছ হয়ে গেলো। সেদিনের মতন জায়গাটা ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে গ্রামবাসী। তাদের হাতে মশালের উত্তপ্ত আগুন। তাদের সামনেই সেদিন নন্দাকে যেই বৃক্ষের সাথে বেঁধে রেখেছিল সেই বৃক্ষের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে একটি লোককে। যাকে নন্দা চেনে। বা বলা যায়, যে নন্দার সর্বনাশের কারণ।

#চলবে

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩৩ এর বর্ধিতাংশ:

সন্ধ্যার আকাশে তখন কালো মেঘপুঞ্জ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। তুমুল ঝড় আশার আশঙ্কা অথচ এক ফোঁটা বাতাস নেই চারপাশে। কিছুক্ষণ আগ অব্দিও বাতাসের বেগে চোখ মেলে রাখা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছিল কিন্তু এখন সব থম মেরে গিয়েছে যেন। ভয়ঙ্কর ঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ বলা যায়। গ্রাম বাসীদের হাতে হাতে মশালের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। চোখে উপচে পড়া কৌতূহল। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই তাদের বোধগম্য নয়। তবে উপভোগ্য কিছু যে হবে তা তাদের ভালো করেই অবগত। নন্দা চারপাশে ভালো করে খেয়াল করতেই দেখল বিহারিণী মহলের মোটামুটি সকল সদস্যই এখানে উপস্থিত। তার শাশুড়ি সুরবালা হতে শুরু করে তার দেবর মনোহর অব্দি উপস্থিত। নন্দা গাছে ঝুলিয়ে রাখা লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। ধীর পায়ে খুব নিকটে গেল লোকটার। তার গা কাঁপচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটাও যেন ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। একটা শক্ত ভিত্তি চাচ্ছে সে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য। চোখ-মুখ আঁধার করে আসছে। এই যেন পৃথিবী অন্ধকার করে সে লুটিয়ে পড়বে মাটিতে৷ কিন্তু আজ নন্দা ভিত্তি হারা হয়ে গড়াগড়ি খেল না মাটিতে কারণ তার সাথে তার স্টিফেন আছে। যে মানুষটা দিন-রাত তাকে কেবল আগলে রাখছে। স্টিফেনের শক্ত হাতই হলো নন্দার ভরসা। লোকটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তুমি হইলে ঝড়ে অটল দাঁড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষ। তোমার অস্থির ব্যাক্তিত্ব বড়োই দৃষ্টিকটু৷ বলিয়া ছিলাম না? যেখানেই থাকিবে, তোমার অবস্থা যেন হয় রাণীর মতন। তবেই না লোকে সম্মান দিবে!”

নন্দা দু-চোখ ভোরে স্টিফেনকে দেখল, প্রতিনিয়ত যে মানুষটা তার শক্ত খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশে। রাণী হতে আসলে রাজপ্রাসাদ লাগে না, এমন একটা প্রিয় মানুষ থাকলেই যথেষ্ট। নন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল এবং সফলও হল। দীর্ঘশ্বাসে বেরিয়ে গেল তার সকল ভীতি ভাব। হুট করেই যেন সে চরম সাহসী হয়ে উঠলো। নিজের কলঙ্ক ঘুচানোর জন্য মরিয়া হয়ে গেল। ছুটে গেল গাছের ঝুলন্ত অবস্থায় থাকার লোকটার দিকে। যে লোকটার চোখে একদিন নন্দা কাম দেখেছিল আজ সেই চোখেই বাঁচতে চাওয়ার আকুতি। যে আকুতি একদিন নন্দার চোখে ছিল অথচ লোকটা মূল্যায়ন করেনি। নন্দা স্টিফেনকে উদ্দেশ্য করে বারংবার বলতে লাগল,
“সেদিন রাতে ও-ই আমার সাথে খারাপ আচরণ করতে চেয়েছিল। আমাকে নষ্ট করতে চেয়েছিল। ওর জন্য আমার সব সম্মান, মর্যাদা এক নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়েছিল। যাদের চোখের মনি ছিলাম তারাই আমাকে ছুঁড়ে মেরেছিল। যে গ্রামবাসী সম্মানের স্থান দিয়েছিল একদিন, সে গ্রামবাসীই আমাকে মেরে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। কেউ আমাকে সেদিন বিশ্বাস করেনি। আমাকে শেষ করে দিয়েছিল মানুষের অবিশ্বাস।”

স্টিফেন গাঢ় চোখে আশেপাশে চাইল। গ্রামবাসীদের চোখের ভাষা বুঝার চেষ্টা করল হয়তো। তাদের চোখে অগাধ আগ্রহ। অনাকাঙ্খিত কিছু জানতে চাওয়ার তৃষ্ণা। স্টিফেন ভরাট কণ্ঠে বলে উঠল,
“এই যে আপনারা, আপনারা সকলে জানেন তো ও কে?”

স্টিফেনের আঙুল নন্দার দিকে। গ্রামবাসীরা উপর-নীচ মাথা দুলালো। কয়েকজন জবাব দিল,
“হ্যাঁ, জানবো না কেন? ও অলকানন্দা।”

“ওর সাথে সেদিন কী করিয়া ছিলেন মনে আছে? কীভাবে আপনাদের থেকে বাঁচাইয়া আমি এই গ্রাম থেকে ওকে নিয়া গিয়াছিলাম সে কথা নিশ্চয় আপনাদের স্মরণে আছে?”

কয়েকজন মাথা নাড়াল। কয়েকজন পাথরের মূর্তির ন্যায় তাকিয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল। স্টিফেন অ্যালেনের দিকে তাকাল, ভয়ঙ্কর কণ্ঠে নির্দেশ দিল,
“এক্ষুণি তলোয়ার নিয়ে আসো অ্যালেন।”

তলোয়ারের কথা শুনতেই লোক সমাগসে কলরব উঠল। ভয়ে অনেকে কয়েকপা পিছে চলে গেলো। গাছের সাথে বাঁধা লোকটা চেঁচিয়ে উঠল। অসহায় কণ্ঠে বলল,
“আমাকে ছেড়ে দেন, সাহেব। আমি ইচ্ছেকৃত কিছু করতে চাইনি। আমাকে ছেড়ে দেন।”

স্টিফেন যেন কোনো কথা-ই শুনলো না। চোখ-মুখ তার ভয়ঙ্কর। তাচ্ছিল্য করে সে বলল,
“সেদিন আমার সানশাইনও বাঁচিতে চাওয়ার আকুতি করিয়া ছিল। তাকে ছাড়িয়া ছিলা কী?”

লোকটা কথা বলল না। হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। অ্যালেনও তন্মধ্যে ধারালো একটি তলোয়ার নিয়ে উপস্থিত হলো। যার তীক্ষ্ণতা দেখে লোকটা হতভম্ব। আকুতি ভোরা কণ্ঠে নন্দার উদ্দেশ্যে বলতে লাগল,
“আমাকে ছেড়ে দেন, বৌঠান। আমি তো আপনার সাথে কিছু করিনি।”

“সুযোগ পেলে তো আমাকে ছিঁড়ে খেতেও দু’বার ভাবতেন না। ভাগ্যিস সেদিন পালাতে পেরে ছিলাম। নাহয় কী ছাড়তেন আমাকে আপনি? আমিও তো আকুতি করে ছিলাম।”

লোকটা চিৎকার করে উঠল। বাঁচতে চাওয়ার আকুতি মিনতি করতে লাগল বারবার। স্টিফেন তলোয়ার নিয়ে এগিয়ে গেল তার দিকে। লোকটা আর টিকতে না পেরে অবশেষে সুরবালা দেবীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“মা ঠাকুরণ, আমাকে বাঁচান। আপনার পরিবারের মানুষ বলাতেই তো আমি এসব করে ছিলাম। নাহয় কী আমি জানতাম যে বৌঠান এখানে আসবে? আমাকে জানিয়েছিল বলেই তো জেনেছিলাম। করতে বলেছিল বলে এমনটা করেছি। আমাকে বাঁচান।”

সুরবালা দেবীর সাথে সাথে উপস্থিত সকলে চমকে গেল। কেবল চমকালো না স্টিফেন। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। তবে সে হাসির আকার, আকৃতি নেই। বড়ো আড়ালের হাসি তা। সুরবালা দেবী চমকে উঠলেন। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন,
“কে বলেছে এসব করতে! আমার বাড়ির মানুষ এমন বলবে কেন? কে বলেছে এমন!”

লোকটা সামান্য শ্বাস নিল, উচ্চ স্বরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আপনার বাড়ির আরেক পুত্রবধূ কৃষ্ণপ্রিয়া আর আপনাদের বাড়িরই একজন পুরুষ নবনীল বাবু এ কাজটি করতে বলেছিলেন। তার বিনিময়ে অনেক স্বর্ন মুদ্রা আমাকে দিয়ে ছিলেন। এমনকি তারা এটাও বলেছিলেন যেন বৌঠানের সাথে তেমন খারাপ কিছু না করি। এর আগেই তারা গ্রামবাসীকে খবর দিয়ে নিয়ে এসে বৌঠানকে ফাঁসিয়ে দিব। কেন ফাঁসাবে, কী তার কারণ কিছুই জানা নেই আমার। আমাকে যা বলা হয়েছিল কেবল তা-ই করেছিলাম। তবে শেষ অব্দি বৌঠানের এমন রূপ লাবণ্য দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনি বলে তার শরীরে হাত দিয়ে ফেলেছিলাম। তার এত সুন্দর রূপ। যে কেউই তো…….”

বাকি কথা বলতে পারল না আর লোকটা। তার আগেই তার বিকট চিৎকার ভেসে এলো। সকলে তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলল। লোকটার জিহ্বাটা মুখ থেকে আলাদা করে নিয়েছে স্টিফেন। স্টিফেনের চোখের সাদা অংশ লাল রক্তজবার ন্যায় রূপ লাভ করেছে। কপালের রগ ফুলে একাকার। হিংস্র চোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল,
“সানশাইনের ব্যাপারে আর একটা বাজে শব্দ বাহির যেন নাহয় এই মুখ দিয়া তাই এই ব্যবস্থা করিলাম। শুধু ও না, সেদিন যারা যারা সানশাইনের সাথে অন্যায় আচরণ করিয়াছিল সকলকে তার হিসাব দিতে হইবে। হোক সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে। হিসাব আমি নিবোই।”

নন্দা তার মুখ চেপে ধরল। সুরবালা দেবীর কাছে সবটা কেমন ঘোরের মতন ঠেকল। নবনীল আর কৃষ্ণপ্রিয়া কি-না শেষমেশ এমন একটা কাজ করল! এত নিচু কাজ! মনোহর হাসল। তার চোখে অশ্রুরা টলমল করছে। সে সুরবালা দেবীর দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
“আমি বলেছিলাম না বড়োমা? বৌঠান এমন কিছু করতে পারেনা। বৌঠান ফুলের মতন পবিত্র, আমি জানতাম। এই মানুষটার সাথে আমি নিজেই কতকিছু করতে চেয়েছিলাম কিন্তু তার পবিত্রতার কাছে আমি যে বড়ো নগন্য। আমার মতন একটা নগন্য মানুষ এটা বিশ্বাস করেনি অথচ তোমরা বিশ্বাস করেছিলে। কীভাবে করেছিলে! পবিত্রতায় সেদিন কলঙ্ক লেপেছিলে। আজ বুঝলে তো!”

কথা থামিয়ে সে নন্দার কাছে হাঁটু মুড়ে বসলো। দু-হাত জোর করে মাথা নত করে বলল,
“আপনার সাথে অনেক খারাপ আচরণ করেছিলাম, বৌঠান। আমাকে ক্ষমা করবেন। আর কৃষ্ণপ্রিয়ার দোষের শাস্তি কীভাবে দিবেন! ও নিজেই দিয়ে দিয়েছে নিজেকে শাস্তি। মেয়েটা বড়ো বোকা। সংসার, স্বামী ভেবেই নিশ্চয় কাজটা সে করেছিল। আর কাজটা যে ভুল তা উপলব্ধি করতে তার বোধহয় দেরি হয়ে গিয়েছিল যার জন্য সে গলায় কলসি বেঁধে মরল। সেদিন বুঝিনি, তবে আজ বুজছি৷ তবুও যদি শাস্তি দিতে চান তবে আমাকে দেন। ওর স্বামী হিসেবে আমারও তো দায়িত্ব আছে শাস্তি ভাগ করার। মেয়েটা নিশ্চয় সংসারের ভালো করতে গিয়ে আপনার ক্ষতি করেছিল। আমি তার শাস্তি মাথা পেতে নেব।”

গ্রামবাসীদের মুখেও কোনো শব্দ নেই। নিশ্চুপ সুরবালা। নন্দন মশাই আমতা-আমতা করে বলল,
“নবনীল কোথায়? বেশ কয়েকদিন যাবত তো ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। ধরা পড়ে যাবে বলেই কী গা ঢাকা দিয়েছে?”

নবনীলের খোঁজ পড়তেই সকলের মাঝে গমগমে ভাব শুরু হয়ে গেলো। কোথায় নবনীল? কোথায় লুকালো!

এতশত কথার মাঝে চুপিসারে ভাবছে একটি মস্তিষ্ক। নবনীলের মাংস মাগুর মাছদের খেতে কেমন লেগেছিল? এত পাপ যে করেছে তার মৃত্যু আরও ভয়ঙ্কর হওয়া উচিত ছিল না?

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে