#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তূজা
সমাপ্তি পর্ব.
ইরাজকে জোর করেও সারাদিনে কিছু খাওয়ানো যায়নি। মেঘালয়াকে বেডে শিফ্ট করা হলেও পুরোপুরি হুশে নেই মেঘালয়া। বলা যায়, অবচেতনায় লুপ্তপ্রায় পড়ে আছে মেয়েটা। বিকেল থেকে সন্ধ্যা অবধি একাধারে বসে ছিল ইরাজ মেঘালয়ার মেঘালয়ার পাশে মেঘালয়ার হাতটা ধরে। ব্লাড প্রেশার এখনও পুরোপুরি কন্ট্রোলে নেই— ১২০/১৫০ চলছে। তবে ঝুঁকিমুক্ত বলা চলে। আনতারা খানম মেঘালয়াকে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছেন। ইরাজ বেরিয়ে এলে হেলাল সাহেব আবারও গিয়ে বসলেন নিঃশব্দে মেয়ের শিয়রে।
ইরাজ রোবটের মতো কৃত্রিম পায়ে হেঁটে হাসপাতালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো। শরীরে জড়ানো সেই গতকাল রাতের একটা জীর্ণ শার্ট। সারাদিনের অভুক্ত অবস্থায় মুখটা বড্ড শুকনো লাগছে তার। যে কেউ দেখলে অবাক হবে–এই কী সেই ইরাজ! সবসময় গুছিয়ে চলা ইরাজকে আজ বড়ো অগোছালো লাগছে। বারবার ইরাজকে ওই অর্ধ-বিকশিত কচি মুখটা চোখের স্মৃতি দংশন করছে। কেমন এক দুর্বিসহ যন্ত্রণা একাধারে খুঁচিয়ে যাচ্ছে ইরাজকে। আবার মেঘালয়ার ওই র ক্তশূন্য অচেতন মুখ!
ইরাজ রাস্তার পাশের এক দোকান থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনল। দিয়াশলাই চেয়ে নিলো দোকানদারের কাছ থেকে। সিগারেটে টান দিতে গিয়ে মনে পড়ে, মেঘালয়া আর বাচ্চার কোন ক্ষতি হবে বলে ইরাজ ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিল। চোখটা শক্ত করে বন্ধ করে নিয়ে লম্বা এক শ্বাস টেনে নেয়। যা সাথে সাথে শ্বাসে মিশে ফুসফুসে প্রবেশ করল একপাঁজা নিকোটিনের ধূম্র। আকাশের দিকে চাইল মুখ তুলে। আকাশে চাঁদ নেই। হতে পারে অমানিশা লেগেছে অথবা মেঘ জমেছে ঘটা করে। আকাশটাকে আজ ইরাজের নিজেরই প্রতিচ্ছবি মনে হলো। আশ্চর্যজনক ভাবে স্বাভাবিক ক্ষুধাটুকু এখনও হানা দেয়নি ইরাজকে। মস্তিষ্কে ব্যথার ক্ষরণ শুরু হলে বোধহয় গোটা শরীরের উদ্দীপনাও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে।
পর-পর বেশ কয়েকটা সিগারেট অন্ধকারচ্ছন্ন ওই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একসাথে টানল ইরাজ। প্যাকেট অর্ধেক। বুকটা জ্বলছে এবার। পানির পিপাসা অনুভব করল। তবে পানি পান করার কোনরূপ চেষ্টা না করে আবার ছুটল হাসপাতালের ভেতরে। মেঘালয়ার ওই বিবর্ণ মুখটা খুব জালাচ্ছে ইরাজকে। দূরে থাকতে চাইছে ইরাজ–যাতে ওই মুখে চেয়ে যন্ত্রণা দ্বিগুণ অনুভূত না হয়। অথচ দূরে থাকার ফলে যেন তা দ্বিগুন বরং কয়েকগুণ বেশি অনুভূত হচ্ছে। দরজাটা হালকা আলগা করে দেখল মেঘালয়াকে। পাশেই হেলাল সাহেব পরিশ্রান্ত মুখে বসে আছেন মেঘালয়ার দিকে পলকহীন চেয়ে। ইরাজ চলে এলো। বাবা-মেয়ের ভাবাবেগে দখলদারী করার ইচ্ছে হলো না। ইরাজ তো একালে মায়ায় পড়েছে মেঘালয়ার। অথচ এই লোকটা নিশ্চয়ই মেঘালয়ার জন্মেই আগেই আটকে গিয়েছিল ওই মেয়েতে! যেমনটা ইরাজ আটকেছিল নিজের সন্তানের মায়ায়। সে মায়া বড়ো জটিল, সে এক জাল বটে। যা ইরাজকে গ্রাস করেছিল ওই ছোট্ট শরীরের অধিকারী পুচকি শিশুটাকে চক্ষে না দেখেই।
ইরাজ দ্রুত এসে বসল বেঞ্চের ওপর। কথাগুলো ভাবতেই বুকটা মুচরে উঠেছে। শরীরটাও দুর্বল লাগল। বেঞ্চে বসতেই পাশে বসে থাকা আনতারা ছেলের মাথাটা নিজের কাধের সাথে আগলে নিলেন। অপর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “এত ভেঙে পরিস না, আব্বা! মেঘা ঠিক আছে, আল্লাহ দিলে আমার আবার নাতি হবে।ʼʼ
ইরাজের প্রতিক্রিয়াহীন মুখটা টেনে নিজের দিকে ঘুরালেন। বললেন, “তোর ছেলের জন্য নিজেকে যতভাবে পারা যায় কষ্ট দিচ্ছিস, সারাদিন না খেয়ে আছিস। কেন, তুই আমার ছেলে না? তুই একদিন বাপ হয়েছিস, আমি আঠাশ বছর মা হয়েছি। এবার বল, কার বেশি পুড়ছে সন্তানের জন্য– সন্তানের অবস্থা দেখে?ʼʼ
ইরাজ সেই শেষবার কথা বলেছিল সকালে। এরপর থেকে বোবা হয়ে গেছে সাথে যেন ঠসাও। মায়ের এমন অভিযোগী কথা শুনে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ঢোক গিলল। আস্তে করে বেঞ্চের ওপর পা তুলে আনতারা কোলে মাথা রেখে পা দুটো জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ইরাজের চেয়ে তুলনামূলক বেঞ্চটা বেজায় ছোটো। তবুও বাচ্চা ছেলের মতো পা-দুটো গুটিয়ে নিষ্প্রাণের ন্যায় পড়ে রইল ইরাজ মায়ের কোলে।
—
রাত দেড়টাও পেরিয়ে গেছে ঘড়ির কাঁটা। হাসপাতালটা সারাদিনের তুলনায় বেশ শান্ত। ইরাজ কেবিনের চাপানো দরজাটা খুলে নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়াল মেঘালয়ার বেডের পাশে। মেঘালয়া ঘুমিয়ে আছে। ইরাজ চেয়ে রইল কিছুক্ষণ একদৃষ্টে মেঘালয়ার মুখের দিকে। এই মেয়েটার খাতিরে ইরাজ নিজের পিতৃত্বকে হাজার জনম ত্যাগ করতে পারবে; হঠাৎ-ই এমন মনে হলো ইরাজের। এই মেয়েটার এই অসুস্থ মুখটার আড়ালে গেলেই কেবল সন্তানের কচি মুখটা পীড়া দিচ্ছে ইরাজকে। এই মেয়ে নজরে বন্দি হতেই কেবল মস্তিষ্ক প্রতিবাদ করে উঠছে, সব পেছনে ফেলে এই মেয়েটাকে সাথে নিয়ে কিছুদিন বাঁচার আছে ইরাজের।
আস্তে করে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে গাঢ় এক চুমু দিলো ইরাজ মেঘালয়ার কপালে। অতঃপর মেঘালয়ার ঠোঁটের কিনারায়। একহাতে মেঘালয়ার কাতর মুখখানি ও অপর হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চেয়ারে বসল, মেঘালয়ার বাঁ হাতে স্যালাইন চলছে। ক্যানোলা ঢুকানো শিরাটা খানিক ফুলে আছে। ইরাজ আলগোছে মেঘালয়ার হাতটা জড়িয়ে নেয় নিজের হাতের মাঝে। ফুলে থাকা শিরাটার ওপর বৃদ্ধা আঙুলি দিয়ে কয়েকবার স্পর্শ করল। ভেজা এক ঢোক গিয়ে তাকাল মেঘালয়ার দিকে। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। হাতটা ছেড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে অগ্রসর হয়। আকস্মিক ইরাজের হাতটা চেপে ধরা হয় পেছন থেকে।
ইরাজ ঘুরে তাকাল পেছনে। মেঘালয়ার চোখ বন্ধ, অথচ চোখের কিনারা দিয়ে তরল গড়িয়ে পড়ছে অঝোরে, ঠোঁট নিচে থুতনির ওপরে কম্পন উঠেছে। ক্যানোলা লাগানো হাতটা দিয়েই ইরাজের হাতখানা মেঘালয়া আরও শক্ত করে চেপে ধরল। ইরাজ চোখটা বুজে নিয়ে ধপ করে আবার বসে পড়ে চেয়ারটায়। মেঘালয়া হাসছে, চোখের টলমল পানিকে উপেক্ষা করেই পাগলি মেয়েটা হাসছে।
মেঘালয়ার মুখের ওই কাতর হাসি! ইরাজের কলিজা ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইল! বোকা মেঘ বুঝছে না তা! নাহ! আজও বুঝছে না। এ মেয়ে ইরাজকে কোনদিনই বুঝবে না। ক্ষণে ক্ষণে শুধু কলিজা ঝলসাবে ছেলেটার! ইরাজের লাল চোখদুটো, এলোমেলো চুল! মেঘালয়ার দৃষ্টি ইরাজের ওপর স্থির। আজ বোধহয় প্রথমবার এমন খামোশ দৃষ্টিতে দুজন দুজনার চোখে চেয়েছে! মেঘালয়ার কাত হয়ে থাকা মাথাটা বালিশে লেপ্টানো। চোখের কোণ বেয়ে একফোঁটা তরল গড়িয়ে পড়ল সাদা বালিশের ওপর। মেঘালয়া ঠোঁটটা আরও খানিকটা প্রসার করে চেয়ে দেখে ইরাজের ধ্বংসপ্রাপ্ত চেহারাটা। সর্বস্বান্ত ইরাজের চোখটা চেয়ে আছে মেঘালয়ার ঠোঁটের হাসির দিকে। মেঘালয়া ইরাজের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলে,
“আপনি ঠিকই বলতেন, ইরাজ! মেঘ অপদার্থ, জঘন্যতম অপদার্থ— যে নিজের ওপর রাখা কাছের মানুষগুলোর আশাগুলোকে কেবল আশা ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণায় বদলে দিতে পারে। দেখুন না, আব্বু আশা রেখেছিল,মেঘা অনেক বড়ো হবে, মেঘা সবসময় তার বাবার আদুরে মেয়ে হয়েই থাকবে। দেখেছেন কী করেছি আমি? ইরাজ আমায় পর্বতের মতো অটল ভালোবাসায় আগলে রেখে আশা রেখেছিল, আমি বুঝব তাকে কোন একদিন। দেখেছেন আমি কী করেছি? এবার আপনারা সকলে আশা রেখেছেন, একটা পুচকু আসবে,আমি আনব তাকে। দেখেছেন কী ..
প্রথমবার মেঘালয়া নাম ধরে ডেকেছে ইরাজকে। কেন! সবকিছু নির্বিশেষে ইরাজ এক অদ্ভুত কম্পন পের পায় নিজের বুকে।
চেপে চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। চোখের মণিতে ভাসমান ছলছলে জলটুকু চোখের পাতার চাপে বেড়িয়ে এসে পাপড়ি ভেজায় বোধহয় এবার। মেঘালয়ার হাতখানা সেও এবার শক্ত করে চেপে ধরে। নাকটা কেঁপে উঠল ইরাজের। মুখের চোয়াল শক্ত করে গালটা হা করে চোখ খুলে তাকায়। মেঘালয়ার কথা শেষ হয় না। মেঘালয়া আরেকটু হেসে দেয়। চোখে ভরে থাকা এক দলা জল তার গড়িয়ে যায় কপালের পাশ বেয়ে। ইরাজ ডানহাতের তর্জনী আঙুল টা চেপে ধরে বুকের মাঝখানে শক্ত কাঠামোর ওপর শক্ত করে। চেপে ধরে একটু নাড়ল আঙুলটা। নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে তার বারবার। মেঘালয়া একদৃষ্টে ইরাজের দিকে চেয়ে আবার বলতে শুরু করে,
“জানেন, ইরাজ! ক’দিন হলো জটিল এক অনুভূতি জ্বালাতন করতো আমায়। ঘুম হতো না একদম। এ অনুভূতির সঙ্গে একদম পরিচিত নই আমি। কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি। যাতে মিশে আছে, হারানোর ভয়, তার পাশে এক-জীবন থেকে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা আর তার সঙ্গে মিশে যাওয়ার এলোমেলো পাগলামি।ʼʼ
এটুকু বলে আবার হাসে মেঘালয়া। আবার বলে, “অথচ আগে কখনও এমন অনুভূতি জাগে নি। এই অনুভূতিটা কার প্রতি এসেছে জানেন?ʼʼ
ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে মেঘালয়া। সজল চোখে চেয়ে বলে, “যে পুরুষটাকে তার রুক্ষ, এলোমেলো আচরণের জন্য অপছন্দের তালিকার শীর্ষে রেখেছিলাম। অথচ কবে কবে যেন, তার ঘাঁড় ত্যাড়ামির মায়ায় আঁটকেছি। কবে থেকে যেন তাকে পুষতে শুরু করেছি নিজের গভীরে।ʼʼ
মেঘালয়ার চোখটা ভরে উঠেছে। কথাগুলো মেঘালয়া থেমে থেমে দুর্বল স্বরে, ক্ষীণ আওয়াজে বলছে। ইরাজ কেবল মলিন হাসল।
“তাবির আমায় বলেছিল, আমি আব্বুর চালিত পুতুল। বোকা মেঘ! সেকালে এত মূর্খ ছিলাম, ঘৃনা আমারও জাগে আপনার মতই মেঘের ওপর। এই দেখুন, ক’দিন আগে হুট করে বুঝতে পেরেছি, তাবির আব্বুর নাম কোরে আমার অপছন্দের পুরুষের কথা বলেছে বারবার। সহজ অঙ্ক– আব্বু তো আমায় কোনদিন শাসন করেনি! আব্বু আমায় বেঁধে রেখেছিল না কখনও, আব্বু ধমকায় নি, আব্বু আটকায় নি। আমার আব্বু তো আমার সঙ্গে প্রথম চোটপাট করেছিল, তার মুখ ডুবিয়ে ফেরার পর। আব্বুর কাছে আমি ছিলাম দেবী। যাকে আব্বু পূজা করেছে সকাল-দুপুর।ʼʼ
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল মেঘালয়া, “অথচ এই সরল অঙ্ক মেলাতে পারিনি সেদিন। ইরাজের সব কথা মিলে যায় আজকাল আমার কাছে— মেঘ, অঙ্কে জঘন্য কাঁচা। তাই-তো ইঞ্জিনিয়ারিং ওর কোনকালেই পছন্দ না। ইরাজ চরম অপছন্দের পুরুষ বরাবরই আমার। কারণ, আমায় বেঁধে রেখেছিল ইরাজ, সব-সময় শ্বাস আটকে নজরে রেখেছে ইরাজ, কোনদিন সাজতে দেয়নি, বাইরে বের হতে দেয়নি, একসাথে চললে, এতো বড়ো মেয়ে হয়ে গিয়েছিলাম, রাস্তাটা হাত ধরে পার করে দিতো ইরাজ। তার কড়া নজরে অতিষ্ট ছিলাম চিরদিন। তার জন্য আর পাঁচটা মেয়ের মতো অবাধে চলতে পারি নি। সব মিলিয়ে আমি তো তার পুতুল ছিলাম, আব্বুর না। অথচ এই হিসেব এই-তো ক’দিন আগে মিলেছে। ইরাজের মতে, ন্যাকা আমি,এজন্য এসব ছোট্ট ব্যাপারগুলোকে ভুল বুঝে জীবনটা সিনেম্যাটিক করে তুলেছি। তার মত আবার ফেলার মতো হয়না।ʼʼ
নিজের ওপর তাচ্ছিল্য হাসে মেঘালয়া, চোখে জল। বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয় মেঘালয়া। ইরাজ অদ্ভুত ভঙ্গিমায় হেসে ফেলে নিঃশব্দে। তার বুকের উঠা-নামা, আর ভারী নিঃশ্বাস মেঘালয়ার চেয়েও অস্বাভাবিক লাগে। মেঘালয়া একটু নড়ে-চড়ে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ একভাবে শুয়ে থেকে এক-ঘেয়েমি ধরে গিয়েছে। ইরাজ আতঙ্কিত হয়ে উঠল তাৎক্ষণিক। চোখে-মুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে। মেঘালয়া শান্ত হয়ে শুয়ে চেয়ে রয় কেমন করে যেন চিন্তিত ইরাজের দিকে। সেকেন্ড কয়েক পর ইরাজের চোখের দিকে তাকায়। চোখের মণিতে সূক্ষ্ম শিরাগুলোয় র ক্ত জমে চোখদুটোকে লাল দেখাচ্ছে। বারবার ঢোক গিলছে ইরাজ। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে! অথচ নীরবতায় জড়িয়ে সে যেন বুকের ব্যথাগুলোকে অনুভব করতে ব্যস্ত। মেঘালয়া নিভু-নিভু স্বরে বলতে শুরু করে,
“সেদিন গাড়ির ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দুধারের দোকানপাটের ব্যানার দেখে বুঝলাম, আমরা চট্রগ্রাম পৌঁছেছি। বড্ড হাঁসফাঁস লাগছিল কেন জানি। আমি সন্তষ্ট হতে পারছিলাম না, অথচ গেছি আমি নিজেই।ʼʼ
হেসে ওঠে মেঘালয়া, “একটা অজানা ভয় কাজ করছিল। ভয়টা কী জানেন? ইরাজের ভয়। মনের কোণে না চাইতেও অজান্তেই একটা বদরাগী মুখ এসে জ্বালাতন করছিল, এই হয়ত সামনে এসে দাঁড়াবে, চটাং করে থাপ্পর মারবে।এরপর কী হবে, আল্লাহ জানে! সে যে কেমন অস্থিরতা! ওই যে ছোটো থেকে ঢুকে যাওয়া এক ভয়! জায়েজ শাসন! আমি তাবিরকে বলেছিলাম, ‘বিয়ে কোথায়
করবে?ʼ বলল, ‘এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আপাতত হোটেলে থাকব, সকালে যা হয় হবে।ʼ কথাটা পছন্দ হয়নি আমার। হোটেলে গিয়ে রুমে ঢুকেও দরজাটা খোলা রেখেছিলাম। অস্থিরতা! দরজা বন্ধ করব! ভাবতেই গা শিউরে উঠছিল। আব্বু বা ইরাজ কারও হাতে পড়লে আমার রুহু বের করে নেবে। অথচ মাথায় এটা আসতে চাইছিল না, আমি না পালিয়ে এসেছি, প্রেমিকে সাথে এসেছি, তাদের নাগালের বাইরে। চারদিকে চোরের মতো তাকিতুকি করেছি— আল্লাহ জানে ক্যাকটাসটা কোথায়, দেখে ফেললে আমার কী হবে, এভাবে এত রাতে বাইরে এসেছি জানলে কী বিশ্রী ঝাড়ি শুনতে হবে… যেন আমি যশোরেই আছি। এক মুহুর্তের জন্যও মাথায় এটা সেট হয়নি– আমি দূরে আছি, আমার আশেপাশে ইরাজ নেই।ʼʼ
মেঘালয়া এ পর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমি আসলেই কারও ছায়াতলে বন্দি এক কচি পাখি। জোশের বশে যাহোক করে তো ফেলেছি, অথচ…
কিছুক্ষণ পর হোটেলের মেনেজার আসল সাথে কয়েকজন অপরিচিত লোক। এসেই তাবিরের গলায় ছুরি ধরে। তাদের ডিমান্ড আমাকে তাদের হাতে তুলে দিলে তাবিরের রেহাই।ʼʼ
মেঘালয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তবু থামল না। এটুকু বলে মৃদূ গা কাঁপিয়ে শব্দহীন হাসি হাসল। আস্তে করে হাসিটুকু মিলিয়ে শান্ত হয়ে যায় মুখটা, চোখ ঘোলা দেখায় তার। বলে, “তখন আব্বুর কথা মনে পড়েনি। কেন জানি না। তখন কেবল মনে মনে কল্পনা করে উঠেছিলাম, আমার ক্যাকটাস এসে এখানে দাঁড়ালে এ দুনিয়ার সবটুকু বিপদ আমার পাশ কেটে বেরিয়ে যাবে। আমি আজও জানি না, সেদিন কেন ওই অপছন্দের তিক্ত পুরুষটা সেখানে বাস্তবে পৌঁছানোর আগেও কল্পনায় আমি তাকে বহুবার সেখানে আমায় আগলে বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। যে-জন্য পুরো সময় একদম শান্ত, নিশ্চিন্ত দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি নিশ্চিত, ইরাজ আসবে, থাপ্পড় মারবে আমায়, বাজে ভাষায় বকবে, কটুক্তি করবে, আর তারপর? আমি নিরাপদ, এই এত বড়ো দুনিয়াতে সকল অনিষ্ট থেকে আমি নিরাপদ। সব বিপদ মিটে যাবে সে এসে দাঁড়ালেই। আজব, তাই-না! এই-তো ক’দিন আগে এ হিসেবগুলো আমি মেলাতে গিয়েও আমার মাথা গুলিয়েছে।ʼʼ
মেঘালয়ার কান্নারত মুখের দিকে চেয়ে ইরাজ ঠোঁট এলিয়ে ক্লান্ত হাসল। মেঘালয়া বলল, “ওই বদমাশ লোকটা কোনদিন ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করেনি আমায়, আমার দিকে বিরক্তি ছাড়া অন্য নজরে তাকায়নি, মিষ্টি করে কথা বলেনি। সে যেমন নিজের ভালো থেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল আমায়, তেমনই দুনিয়ার খারাপগুলো থেকে। এ ব্যপারটা কিছুদিন আগেই মিলিয়েছি আমি।ʼʼ
মেঘালয়ার কণ্ঠস্বর ভেঙে আসে। ঠোঁটটা বোধহয় বেঁকে এলো এবার কান্নার তরে। ঝরঝর করে ঝরে পড়ল অশ্রুবৃষ্টির জল গালের পাশ বয়ে। ঠোঁট ভেঙে হেসে ওঠে মেঘালয়া। যা দেখতে কান্নার মতো লাগে। আসলে মেঘালয়া বোধহয় কাঁদলই, সাথে হাসল। ইরাজ নিচের দিকে ঝুঁকে বসল এবার একটু। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। মেঘালয়ার কান্না এবার আর থামবে না। তাই কান্না জরানো ভাঙা কণ্ঠেই বলে,
“নিজের অজান্তেই ইরাজ নামক আমার স্বাধীনতার করাগার যে আমার অভ্যাস ও দৈনন্দিন চলনে পরিণত হয়েছিল–তা উপলদ্ধি করার সুযোগ হয়নি। আত্মনির্ভশীলতাহীন হয়ে পড়েছি আমি বহুবছর আগ থেকে। আমার অবলম্বন হয়ে উঠেছে ইরাজ। অথচ ইরাজের আচরণ বরাবর বিভ্রান্ত করতো আমায়। এত শাসন, বারণ লোকটার সাথে আমার দূরত্বই সৃষ্টি করেছে দিন-দিন। যেকোন মুসিবতে সমাধান হিসেবে তাকে আশা করলেও, তাকে পছন্দ করা হয়ে ওঠেনি। সেদিন সেই অন্ধকার রাতেও ইরাজকেই পাশে চেয়েছিলাম।ʼʼ
মেঘালয়া এবার কান্নামিশ্রিত স্বরে যেন অভিযোগ করে
ওঠে, “কী করব তাছাড়া? ছোটো বেলা থেকে তার হাতের পুতুলের মতো নাচিয়েছে, বলতে গেলে তার জন্যই সেদিন বলি হতে ওতদূর গেছি, সে আসবে না? আব্বুর বন্ধুর ছেলে, পার্টনারের ছেলে সে। সেরকম ভাবে থেকেছে নাকি? আমার জীবনটাকে হাতের মুঠোয় মুড়ে রেখেছিল। তাতে তার কঠোরতা আমার বদভ্যাস হয়ে উঠলে, সেটা আমার দোষ? তার শাসনের মায়ায় পড়ে গেলে, সেটা আমার দোষ? তার ওপর নির্ভরশীল হলে, সেটাও আমার দোষ? অথচ লোকটার ব্যবহার জঘন্য। চরম অসভ্য লোকটা, নমনীয়তার আকাল আছে তার মাঝে। আর সেজন্য তাকে আমার পছন্দ না। কোনকালেই পছন্দ না। করবও না পছন্দ, ওরকম রসকসহীন ক্যাকটাস মার্কা লোককে পছন্দ করার প্রশ্নই ওঠে না। তার চালচলন, কথাবার্তা, আচরণ সবকিছু কাঁটায় ভরা। সেজন্য তার মাঝে এতবছর আটকে থেকেও কোনদিন নিজের অনুভূতি বুঝতে সক্ষম হইনি আমি। লোকটা তারও শাস্তি দিয়েছে আমায়। আই ব্লাডি হেইট হিম।ʼʼ
ইরাজ হেসে ফেলল হঠাৎ-ই নিঃশব্দে। মাথাটা খানিক ঝুঁকিয়ে তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল কপালে রেখে নিঃশব্দে হাসে ইরাজ। মেঘালয়ার চোখের পানি শুকিয়ে গালে লেপ্টে আছে। শেষের কথাগুলোয় কপট আক্রোশ মিশে ছিল। মেঘালয়ার ঠোঁট ভেঙে আসে আবার, “আপনি কেমন? আপনার প্রতি কোন একরকম অনুভূতি কেন আসে না আমার? সবসময় মিশ্র কিছু অনুভব করি আপনাকে নিয়ে। একটু সহজ হলেও পারেন..ʼʼ
“এখন বিশ্রাম প্রয়োজন তোর, এসব ভারী ভাবনা পরেও ভাবতে পারবি।ʼʼ
ইরাজের কথাটা পছন্দ হলো না মেঘালয়ার। বলল, “আর আপনি?ʼʼ
“হু, আমি কী?ʼʼ
“আপনি কী করবেন?ʼʼ
“কী করতে বলছিস?ʼʼ
মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে দুর্বল স্বরে জিজ্ঞেস করে, “যা করতে বলব, করবেন?ʼʼ
ইরাজ মুখে জবাব দিলো না, কেবল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেঘালয়া বলল, “থাকুন আমার কাছে।ʼʼ
“আমি আছি, তুই ঘুমা।ʼʼ
মেঘালয়ার কাছে কথাটা বিশেষ এক অনুভূতি হয়ে মস্তিষ্কে সারা জাগায়। “আমি আছি।ʼʼ ইরাজ আছে। মেঘালয়ার বুকটা শান্ত হয়ে ওঠে। ইরাজের হাতের আঙুলগুলোর মাঝে সন্তর্পণে নিজের আঙুল ঢুকায়। চোখটা বুজে দীর্ঘ করে এক শ্বাস টেনে নিলো। ইরাজ চেয়ে রইল মেঘালয়ার অচঞ্চল মুখটার দিকে।
“খান নি কেন?ʼʼ
মেঘালয়ার ক্ষীণ স্বরে বলা কথাটায় ইরাজ কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল মেঘালয়ার দিকে। কিছুটা সময় নিয়ে আস্তে করে বলল, “খেয়েছি।ʼʼ
“আপনাকে জানতে জানতে আটকে গেছি আপনার মাঝে। নিজের ব্যপারে আমার কাছে মিথ্যা বলা বোকামি হবে আপনার।ʼʼ
ইরাজ চোখটা সরু করে বলে, “এত জানিস আমায়?ʼʼ
এই ছেলেটা এক ঝটকায় নিজের বাহ্যিক রূপে এসে যায়। এই কিছুক্ষণ আগে বিষাদে পরেপূর্ণ ছিল চেহারাটা হুট করে আবার নিজের ত্যাড়ামিতে ফিরে এসেছে। বলল, “পুরোটা নয়, তবে প্রায় পুরোটা।ʼʼ
ইরাজ সামান্য ঠোঁট প্রসার করে হাসল। বড়ো ক্লান্ত লাগল দেখতে সেই হাসি। মেঘালয়া আচমকা প্রশ্ন করে, “আপনি কেমন?ʼʼ
ইরাজ ভাবলেশহীন ভাবে ঠোঁট উল্টায়, সাথে কাধ ঝাঁকাল যেন সেও নিশ্চিত নয় এ ব্যপারে, “ধরে নে, আমি কিছুটা চাঁদ। আমার গুপ্ত নরম অনুভূতি, আলো। তাতে আলোকিত হয়ে ধন্য হবে আমার ভালোবাসা পাওয়া মানুষগুলো। আবার আমার ত্যাগের তপ্ততা সূর্যরশ্মির মতো প্রখর অগ্নিশোধিত। আর সূর্য যখন চাঁদের বারবার থাকে; চাঁদের সেই অবস্থা হলো ঘোর অমানিশা। আমি নামক ‘অমানিশায় সেই তুই’! যাকে পেয়ে হারিয়ে, ত্যাগের প্রখরতায় ডুবেছি, ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে চাঁদটা অমানিশার আড়ালে।ʼʼ
ইরাজ থামল। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা চেপে ধরল। আবার বলল, “তবে অমানিশা তো সারামাস থাকে না, মেঘ! যেমনটা তোর বিরহ আমার জীবনে মাসের কয়েকটা দিন করেই রয়, আবার বাঁকা চাঁদ উঠে ক’দিন পরে তা পূর্ণিমায় রূপ নেয়। তবে আমার জোৎস্না বিলাসের সুযোগ নেই। আমি তো মেঘে মগ্ন, পূর্ণিমার ওপর মেঘের ঘনঘটায় আমার আকাশটা অমানিশার মতোই তিমিরে ছেঁয়ে থাকে চিরকাল।ʼʼ
-সমাপ্ত