হৃদয় আকাশে প্রমবর্ষণ পর্ব-০১

0
979

#হৃদয়_আকাশে_প্রমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রাবণী_সারা
#সূচনা পর্ব

আমাকে বিয়ে করবি রুপ? গাঢ় লাল শাড়ী পরে তুই বউ সাজবি আর আমি শেরোয়ানী পড়ে বর সাজবো। দেখবি খুব সুন্দর মানাবে আমাদের। বলনা বিয়ে করবি আমায়?

ছোট্ট রুপ রিশানের মুখের দিকে টলমলে চোখে তাকালো। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে চোখ থেকে বর্ষণ নামবে। হলোও তাই। রিশানের কথা শুনে মেয়েটা কি বুঝলো কে জানে মুহুর্তেই ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠলো। রুপের হঠাৎ কেঁদে উঠায় ভ্যাবাচ্যাকা খেলো রিশান। তড়িঘড়ি করে সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো রুপের কাঁন্না থামাতে।

রুপ কি হয়েছে কাঁদছিস কেনো?

বড় আপু হৃদিতাকে দেখে রুপ তাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলে,
দেখোনা আপু রিশান ভাইয়া কি বলছে ওকে নাকি আমি বিয়ে করবো। আমি তো ছোট তাইনা তাহলে রিশান ভাইয়া এটা কেনো বললো?

রুপের কথাগুলো শুনে হৃদিতার খুব হাসি পেলো। তবে হাসলো না। নয়ত রুপের কাঁন্না আরো বেড়ে যাবে। রিশান হয়ত মজা করেছে। আর রুপ তা সত্যি ভেবে কাঁন্না জুরে দিয়েছে। হৃদিতা রিশানের দিকে তাকালো। রিশান ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে আছে রুপের দিকে। হৃদিতা রুপকে বললো,
রিশান ভাইয়া মজা করেছে রুপ। তুই রুমে যা আমি ওকে বকে দিবো।

রুপ রিশানের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙিয়ে চলে গেলো। রিশান বললো,
হৃদি আপু তোমার বোনটা এমন ছিঁচকাঁদুনী কেনো বলো তো। এই সামান্য কথায় কেঁদে কেঁটে চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেললো।

রুপের বয়স মাত্র ৭ বছর ও এসব মজা বোঝে নাকি। ওকে আর এ ধরণের কথা বলো না নয়ত সোজা গিয়ে বাবা মায়ের কাছে বিচার দেবে।

হৃদিতা রুপ দুইবোন। অবশ্য ওদের একটা বড় ভাইও আছে নাম রিয়াদ। সে এখন দেশের বাহিরে আছে। ফুপাতো ভাইয়ের বিয়েতে এসেছে ওরা। রিশান হৃদিতার ফুপির জায়ের ছেলে। ক্লাস এইটে পড়ে। ছেলেটা ভীষণ চঞ্চল স্বভাবের সবসময় মজার মুডে থাকে। সুযোগ পেলেই যে কারো সাথে উল্টোপান্টা কথা বলে মজা নেয়। যেমনটা রুপের সাথে করলো।

কিছুক্ষণের মধ্যে বরযাত্রী বের হবে। সকলে রেডি হয়ে গাড়ীর কাছে চলে এসেছে। হুমায়রা বেগম (হৃদিতা রুপের মা) হৃদিতাকে কোথাও না দেখে রুমে এসে দেখলো হৃদিতা নরমাল পোশাকে বসে আছে।

হৃদি এখনো তৈরি হোসনি কোনো? বরযাত্রী বের হবে তো জলদি কর।

হৃদিতা ডান পা টা বাড়িয়ে দিলো। হুমায়রা বেগম পায়ের দিকে খেয়াল করে বিচলিত হয়ে বললেন
তোর পা এতটা কাটলো কি করে? কখন কাটলো?

ছাদে গিয়েছিলাম ওখান থেকে কিছুতে বেধে কেটেছে। যতটা কেটেছে তার থেকে বেশি ব্যাথা হয়েছে।

পা কেটে রুমে বসে আছিস আমাকে কাউকে দিয়ে ডেকে পাঠাতে পারতি। এ অবস্থাতে আর কি করে বরযাত্রী যাবি। হাটতে প্রবলেম হবে। আমি বরং নিচে গিয়ে সবাইকে চলে যেতে বলি।

তুমি যাবে না?

না তোকে এভাবে রেখে আমি যেতে পারবো না।

ভাবী আপনি যান। রেডি হয়ে না যাওয়াটা ভালো দেখায় না তাছাড়া আপনি না গেলে রুপের যাওয়া বন্ধ হবে। ছোট বাচ্চা মন খারাপ করবে। আপনি নিশ্চিন্তে যান হৃদিতার খেয়াল রাখার জন্য আমি আছি রিতা আছে।

হৃদিতার ফুপির বড় জা শাহানা খান হাতে ঔষধ ও এন্টিসেপক্টিক ক্রিম নিয়ে রুমে এসে কথাগুলো বললেন।

আপনাদের কষ্ট হবে আপা। আমি না গেলে কোনো প্রবলেম হবে না রুপকে বুঝিয়ে নিবো।

এরই মাঝে হৃদিতার ফুপি রিতা রুমে এলো। সেও তারা দিলো হৃদিতার মাকে যাওয়ার জন্য। হৃদিতাও বললো যেতে। অগ্যতা হৃদিতার মা বরযাত্রীর সাথে গেলো।

সন্ধে হয়ে আসছে বউ নিয়ে ফেরেনি কেউ। বাড়িটা ফাকা ফাকা লাগছে। হৃদিতা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে নিচে এলো। কিচেন থেকে আওয়াজ আসছে। হৃদিতা কিচেনে গিয়ে দেখলো শাহানা খান পায়েস করছে। পায়েসের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারিপাশ। হৃদিতাকে দেখে শাহানা খান বললেন,

হৃদিতা মা কাটা পা নিয়ে নিচে এসেছো কেনো কিছু লাগবে তোমার?

হৃদিতা মৃদু হেসে বলে,
না আন্টি কিছু লাগবে না। রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছে না এজন্য আস্তে আস্তে হেটে এলাম।

ও আচ্ছা। তুমি ওখানে বসো। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে আসবে।

হৃদিতা পাশের ছোট টুলে বসলো। হৃদিতার সাথে টুকটাক গল্প করতে করতে পায়েস রান্না শেষ করলো শাহানা খান। একটা ছোট পাত্রে পায়েস তুলে হৃদিতাকে খেতে বললো। হৃদিতা খাবে না বলতে তিনি বললেন না খেলে মন খারাপ হবে তার। হৃদিতা কিছুটা লাজুক স্বভাবের। খুব তাড়াতাড়ি কারো সাথে মিশতে পারে না। তবে কারো সাথে ভালো সক্ষতা গড়ে উঠলে মন থেকে মিশে যায়। হৃদিতার মনে হয় এ বাড়িতে নিজের ফুপির থেকেও শাহানা আন্টির সাথে তার ভাবটা একটু বেশি। শাহানা আন্টির কথা কাজ কর্ম খুব পছন্দ তার।
হৃদিতা পায়েস খেয়ে বললো,
আন্টি পায়েসটা খুবই টেস্ট হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে এত লোকের মাঝে হঠাৎ পায়েস কেনো?

শাহানা খান হেসে বললেন,
আমাদের বাড়িতে নিয়ম আছে বাড়িতে নতুন বউ এলে তাকে পায়েস খাওয়াতে হয়। তোমার ফুপি এজন্য পায়েস রান্নার দায়িত্বটা আমাকে দিয়েছে। তবে বউ ছাড়াও আরো একটা কারন আছে। আমার বড় ছেলে নিশান পায়েস ভীষণ ভালোবাসে। ও আজ রাতে ইন্ডিয়া থেকে বাড়িতে আসছে। এসে পছন্দের খাবার দেখে খুশি হবে ছেলেটা।

হৃদিতা আর কিছু বললো না। নিশান নামটা শুনে কেনো যেনো চমকালো। কেনো এমনটা হলো সেটা অজানা হৃদিতার। নিশানকে প্রায় ৪/৫ বছর আগে দেখেছে। বেশ শান্তশিষ্ট ছেলে সে। তবে রেগে গেলে নাকি ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। ফুপির থেকে শুনেছে পড়াশুনা শেষ করে বাবার সাথে অফিস সামলায় সে। ফুপি আরো বলেছিলো বছর খানিক আগে নিশান তারসাথে পড়তো একটা মেয়েকে পারিবারিক ভাবে বিয়ে করেছে। হয়ত বউ তার সাথেই আছে। তবে হৃদিতা শাহানা খানের মুখে ছেলের বউকে নিয়ে কোনো কথা শোনেনি এখন অবদি।
______

কিছুক্ষণ আগে বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ হলো। রেজাউল সাহেব(হৃদিতার বাবা) হুমায়রা বেগমকে ডেকে বললেন তাড়া আজই বাড়িতে ফিরতে চায়। বিয়ে খেতে এসে অফিসের কাজের অনেক ঘাটতি হয়েছে। হৃদিতার ও ভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না। সব মিলিয়ে আর থাকা সম্ভব নয়। হুমায়রা বেগম ও সায় দিলেন তাতে। তিনি হৃদিতাকে বললেন নিজের সব গুছিয়ে নিতে। এদিকে রিতা ও তার হাজবেন্ড বলছেন আরো একটা দিন থেকে যেতে। রেজাউল সাহেব বললেন পরে কখনো সময় করে আসবে। তাছাড়া হৃদিতা রুপ ওদের মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে এসে বেড়িয়ে যাবে। হৃদিতা রেডি হয়ে ফুপি ফুপা, শাফিন ভাইয়া ও তার নতুন বউ রিফার থেকে বিদায় নিলো। তারপর শাহানা আন্টির রুমের দরজায় এসে নক করলো। যদিও দরজা খোলা কিন্তু এভাবে ঢুকে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। শাহানা আন্টি ভেতর থেকে হৃদিতাকে দেখে রুমে ডাকলো। হৃদিতা রুমে ঢুকে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। নিশানও আছে এ রুমে। ইতোপূর্বে নিশানের সাথে হৃদিতার সেভাবে কোনো কথা হয়নি। গতকাল রাতে আসার পর একবার দেখেছিলো তাকে। নিশান মায়ের বেডে চুপচাপ বসে আছে। হৃদিতাকে একপলক দেখে মেঝের দিকে তাকালো সে। হৃদিতা দেরি না করে শাহানা আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। কেনো যে এত অস্বস্তি লাগছে কে জানে।

রুপ মায়ের হাত ধরে বাইরে বের হওয়ার সময় রিশানকে দেখলো। রিশানও ওকে দেখে দাত বের করে হাসলো। যা দেখে রুপ চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। রিশানকে এখন মোটেও সহ্য হয় না রুপের। বদ ছেলে বলে কিনা তাকে বিয়ে করতে। কত্ত বড় সাহস। রিশান এগিয়ে এসে রুপকে বললো,
রুপ তোরা চলে যাচ্ছিস! হৃদি আপু আমাকে বললো তোদের বাড়িতে যেতে কই তুই তো একবার ও বললি না!

রুপ গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
তোমার মত দুষ্টু বদ ছেলেকে আমাদের বাড়িতে কেনো যেতে বললো হুম। তুমি খুব পঁচা।

ধমকে উঠলো হুমায়রা বেগম,
রুপ এভাবে কথা বলছো কেনো। রিশান ভাইয়াকে বলো আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে।

না কখনোই বলবো না।

রুপ মায়ের হাত ছাড়িয়ে রিশানকে ভেংচি কেটে হৃদিতার কাছে চলে গেলো। রিশান মনে মনে বললো,ছোট হলে কি হবে কথার কি ঝাজ। যেনো গোল মরিচ।
______

ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে হৃদিতা দুজন বান্ধবীর সাথে শপিংমলে এসেছে। হৃদিতার কোনো প্রয়োজন নেই সে মূলত বান্ধবীদের কেনাকাটায় সঙ্গ দিচ্ছে। ওরা ড্রেস দেখছিলো হঠাৎ কেউ হৃদিতার নাম ধরে ডাকায় পেছনে তাকালো। শাহানা আন্টি দাড়িয়ে আছেন পাশে নিশান ও রয়েছে। হৃদিতা উঠে শাহানা আন্টিকে সালাম দিলো। সে হাসিমুখে উত্তর নিয়ে জানতে চাইলো বাড়ির সবাই কেমন আছে। হৃদিতা উত্তরে বললো ভালো আছেন সবাই। শপিংমল থেকে হৃদিতাদের বাসা খুব বেশি দূরে নয়। হৃদিতা শাহানা আন্টিকে বললো বাড়িতে যেতে। তিনি নাকচ করে বললেন অন্য কখনো যাবে। অতঃপর কিছুসময় কথা বলে উনারা চলে গেলেন। তাদের কথা বলার পুরোটা সময় নিশান নিরবে মায়ের পাশে দাড়িয়ে ছিলো। ছেলেটা কি কথা একেবারেই কম বলে! এ বিষয়টা হৃদিতার মনে উকি দিলো। হৃদিতা আরো একটা বিষয় ভাবলো নিশানের বউ কোথায়? ও বাড়ি থেকে আসার সময়ও নিশানের সাথে কোনো মেয়েকে দেখেনি। আবার আজও বউ ছাড়া নিজের মাকে নিয়ে শপিং এ এসেছে!

গাড়িতে নিশান ও শাহানা খান পাশাপাশি বসে আছে। শাহানা খান ছেলেকে বললেন,
নিশান অনেকদিন তো হলো এখন তোর লাইফটা আবার নতুন করে গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আমার তোর বাবার তোকে নিয়ে চিন্তা হয় বাবা।

নিশান মায়ের দিকে মিনিটখানিক চেয়ে রইলো। মা কি বলতে চাইছে বেশ বুঝতে পারছে সে। নিশানের মা আবার বললেন,
রাইসাকে ভুলতে পারিস নি এখনো তাইনা?

নিশান আর চুপ থাকলো না গম্ভীর স্বরে বললো,
রাইসাকে মনে বসিয়েছি কবে যে ভুলতে পারবো না। ও নিজের পথ নিজে বেছে নিয়েছে বরং তাতে আমার ভালোই হয়েছে। কারন রাইসাকে আমি কখনো ভালোবাসিনি। শুধুমাত্র তোমার আর বাবার কথা রাখতে বিয়ে করেছিলাম ওকে।

রিশান একটু থেমে আবার বললো,
মা দয়া করে এ বিষয়ে আমাকে জোর করো না। আমাকে নিজের মত করে থাকতে দাও সময় হলে আমি নিজেই বলবো।

শাহানা খান গভীর নিশ্বাস ফেললেন। আজ তাদের ভুলের জন্য ছেলেটা অনেকটা গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। ছেলেকে বিয়ে করানোর আগে একটিবার যদি ছেলের মনের খোজ নিতো তাহলে আজকের দিনটি অন্যরকম থাকতো। রাইসা শুধুমাত্র একজন ভালো বন্ধু ছিলো নিশানের। অথচ তারা প্রেমের সম্পর্ক ভেবে তাদের বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলো।

#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে