#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
১৮.
ইরাজ যেদিন মেঘালয়ার মুখে এমন অনীহার বাণী শুনেছিল, তাকে আর বেশি করে বোঝাতে হয়নি যে, মেঘালয়া তার প্রতি বিরক্ত। আর তাবির যে মেঘালয়াকে পুরোদমে ফাঁসিয়ে ফেলেছে; এ কথায় সন্দেহের অবকাশ নেই। সেদিন ইরাজের ছটফটানি কেবল, ওই চাঁদহীন অমানিশায় ঢাকা খোলা আসমানের তারা’রা হয়ত নিরবে চেয়ে চেয়ে দেখেছিল। তারপর থেকে ইরাজ নিজেকে থামাতে সিগারেট অবধি থেমে থাকেনি। সব রকমের নেশায় ডুবিয়ে ফেলেছে নিজেকে। মাঝেমধ্যে নিজেকে শান্ত করতে, ড্রাগসের ব্যবহারও বাদ রাখেনি।
ছোটবেলা থেকে ইরাজ, মেঘালয়াকে বাবার বন্ধুর মেয়ে হিসেবেই দেখে এসেছে। তবে তাদের মাঝে বয়সের দুরত্বটা ছিল বেশ খানিকটা। যে কারনে মেঘালয়া যখন কেবল তার বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে, ইরাজ তখন একুশ বছরের তাগড়া যুবক। এখানে ইরাজের মাঝে এই অনুভূতিটা জাগার পেছনে দু পরিবারের অভিভাবকদের ভূমিকাও ছিল অল্প সল্প। হেলাল সাহেব ইরাজকে অতিমাত্রায় ভরসা করতেন। ছোটো থেকেই ইরাজ চরম বেপরোয়া স্বভাবের। আর এই স্বভাবটাই তাকে করেছিল সকলের কাছে অনন্য। তাকে কোনদিন সেচ্ছায় মেঘালয়ার আশেপাশে ঘেষতে দেখা যায়নি। যেন তার গায়ে চুলকানী হয়, এভাবে দূরত্ব বজায় রেখেছে সর্বক্ষণ। ইরাজের এই অনন্য স্বভাবের প্রতিই বোধহয়, হেলাল সাহেব গলে গেলেন। তিনি অবাধে মেঘালয়াকে ইরাজের ওপর ছেড়ে দিতেন। ইরাজ সেই ভরসার দাম রেখেছে সুদে আসলে। বরং তাকে ডেকেও পাওয়া যেত না মাঝেমধ্যে। যেন চরম বিরক্ত সে মেঘালয়াকে সঙ্গে নিয়ে চলতে। তবে চলতে চলতে, নিজের দায়িত্বের বাইরে কবে যে যূবক ইরাজের মনে মেঘালয়ার জন্য নরম অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল।
এখান থেকেই ওই কিশোরী মেঘালয়ার প্রতি আলাদা এক টান জন্মাতে শুরু করল, ইরাজের। এরপর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে জেলা ছাড়লেও, যখনই আসতো, মেঘালয়াকে শাসিয়ে রেখে যেতে ভুলত না। দিন দিন অভ্যাস এবং এই টানটা কবে যেন অধিকারবোধ, আর অধিকারবোধ থেকে ভালোবাসার মতো জটিল অনুভূতিতে পরিবর্তিত হয়ে গেল। তবুও ঘাঁড় ত্যাড়া ইরাজ মেঘালয়ার সম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করেনি কোনদিন। তার স্বভাব আচরণে পরিবর্তন আসেনি। সে যে খিটখিটে; সেই খিটখিটে মেজাজেরই রয়ে গেল।
এতে মেঘালয়ার সাথে তার সম্পর্কটা কখনও মধুর হয়ে ওঠেনি বরং শাসনের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এটা হয়ত মেঘালয়ার মনে হয়েছে বরাবর। কিন্ত ইরাজ যে মেঘালয়াকে সর্বদা জোর জবরদস্তিতে রেখেছে, এমন নয়। শুধু এই অসভ্য দুনিয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছে। মেঘালয়ার কোন ইচ্ছে সরাসরি পূরণ না করলেও, অপূর্ণ থাকতে দেয় নি। ইরাজের এই শাসনের পেছনের তীব্র অধিকারবোধকে আর আগলে রাখার ব্যাপারটি হয়ত মেঘালয়া কোনদিন ধরতে পারেনি!
সবশেষে বাজি! ইরাজের ওই সরল মেঘালয়ার প্রতি এতটাই বিশ্বাস ছিল, সে এত চতুর হয়েও এভাবে ভাবতে পারে নি যে, মেঘালয়া তাবিরকে সুযোগ দেবে তাকে নিয়ে খেলার। তা তো দিয়েছিল, তবুও ইরাজ মেঘালয়ার প্রতি নিজের দৃষ্টি সরায় নি, নিজের মতো করে প্রতিক্ষণে চেষ্টা করেছে মেঘালয়াকে আগলে রাখার। এতে তাবিরের বড়ো অসুবিধা হতো। সে মেঘালয়াকে যেভাবে চাইত, সেভাবে পরিচালনা করতে পারত না। তখনই তাকে নানান উষ্কানিমূলক কথা বলতে থাকে। কাজেও দিল তা। ইরাজ মেঘালয়ার অবহেলায় ঘৃনায় সরে আসল। সারাক্ষণ মনটা মেঘালয়ার কাছে পড়ে থাকলেও, দেহটাকে সে বেঁধে রেখেছিল নেশার দড়িতে। আনতারা খানম ছেলের অধঃপতন দেখেছেন কিছু কিছু। তবে তিনি আবিষ্কার করতে পারেন নি কারনটা। ইরাজকে বুঝতে পারা, সেও এক অভিযানই বটে!
যেদিন ইরাজের কাছে হেলাল সাহেবের অসহায় কল এলো, মেঘালয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না! সেদিন ইরাজ মেঘালয়াকে চিরতরে ত্যাগ করেছিল! তবে তার ত্যাগও বড়ো রহস্যময়। যাকে সে ঘৃনার সাথে ত্যাগ করল চিরতরে, কাটিয়ে ফেলল নাকি সব মায়া! তার জন্য ছুটতে তার এক মুহূর্ত ভাবতে হয়নি। শোনা মাত্র সে যশোর থেকে চট্রগ্রাম পাড়ি দিয়েছে। হুশে ছিল না এ খবর শোনার পর ইরাজ! ওই তাবির খারাপ কিছু করে না বসে মেঘালয়াকে নিয়ে। এই ভাবনাতে উন্মাদের মতো ছুটেছে সে সেদিন তার ত্যাগকৃত মেঘের রক্ষার্থে!
এই তার ত্যাগ! এই তার ঘৃনা!
দিনের পর দিন ইরাজ নিজেকে ধ্বংস করেছে, পুড়েছে, আঘাতে জর্জরিত হয়ে ডুবে থেকেছে রাতভর নেশায়। সকালে সূর্য উঠলে, দিনের আলোয় আবার ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়েছে, নিজের বেপরোয়া রূপে। তার রূপান্তর বড়ো জটিল। যার সত্যতা আবিষ্কার করা যায়নি কোনদিন।
এ সবটাই মেঘালয়ার কাছে অজানা ইতিহাসের পাতায় রচিত সত্য। যা তার বোকা মস্তিষ্ক কোনদিন আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। হয়েছে কি হয়নি কে জানে! হলেও হয়ত ইরাজ তা স্থায়ী হতে দেয় নি। কারন, তার আচরণ তো সেই বেপরোয়াই রয়ে গেছিল। কখনও কখনও যদি ইরাজের প্রতি খানিকটা মনোযোগ এসেছে মেঘালয়ার, তো পরক্ষণেই ইরাজের ত্যাড়ামির নিচে চাপা পড়েছে সেই মনোযোগটুক।
এতসবের পরেও ইরাজ বারবার চেয়েছে, মেঘালয়াকে এসব থেকে বের করে আনতে। কিন্ত, ওই যে অধিকার হারানোর যন্ত্রনা! যেখানে তাকে আগলে রাখার অধিকারটুকু মেঘালয়া নিজে কেঁড়ে নিয়েছে! সেখানে কোন মুখে সে গিয়ে আবার দাঁড়াবে মেঘালয়ার সম্মুখে! তাছাড়াও ইরাজ কখনও ভবনায় আনতে পারেনি, মেঘালয়ার পালানোর মতো এমন জঘন্য পদক্ষেপ নিয়ে নেবে। সে নিজেকে বারবার প্রস্তত করত, মেঘালয়াকে গিয়ে তাবিরের ব্যাপারে বলার। কিন্ত সামনে এসে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে যেত, মেঘালয়ার বলা সেই অবজ্ঞাসূচক কথাগুলো আর বাজিতে জিতে যাওয়ায় বিশ্রী হাসিতে মগ্ন তাবিরের মুখটা। ইরাজের বিশ্বাস আর ভরসা যেখানে মেঘালয়া পায়ে পিষে সামনে এগিয়ে চলেছে, সেখানে ইরাজ কি করে মেঘালয়ার সম্মুখীন হতে পারে আবারও। তবুও যদি ইরাজের আন্দাজ থাকত, তাবিরের পরিকল্পনা এত জঘন্য পর্যায়ে নেমে গিয়েছে, সে সব সংকোচ কাটিয়ে তার মেঘকে বাঁচিয়ে নিত। যেখানে তাবির শর্তে জিতে গিয়েছে; ইরাজ ভেবেছিল এখানেই শেষ। হয়ত সে নিজেই এবার খেলা শেষ করবে। কিন্ত, তাবির এখানেই থামেনি।
তাবিরকে শাসাতে আবারও সে গোপনে গিয়েছিল, তাবিরের কাছে। তাবিরের কাছে শুনে এসেছে, মেঘালয়া নাকি পাগল তার জন্য। তাকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। তার প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছে।
এরপর আর কি বলার থাকে? এ কথা বিশ্বাস করার ভিত্তিটুকুও মেঘালয়াই দিয়েছিল ইরাজকে; যেদিন সে ইরাজকে তার পিছু করতে নিষেধ করেছে। ইরাজ এ সময় পাগলের মতো উঠেছিল পুরো। তার নিজের ভালোবাসায় অন্যের অধিকার! তার কোন ভূমিকা নেই তার মেঘের জীবনে। যে মেঘকে সে নিজের সবটুকু মনোযোগে আবদ্ধ করে রেখেছিল এতকাল, সেই মেঘ তাকে নিজের আশেপাশে ঠায় দিতেও নারাজ! ইরাজ কেঁদেছে; অপমানে, দুঃখে, মন ভাঙার যন্ত্রনায়, অধিকার হারানোর ব্যর্থতায়, আত্মমর্যাদাবোধে লাগা তীব্র আঘাতে, সবশেষে মেঘকে ভুলতে চেয়ে, ভুলতে না পারার অপারগতায়। সেদিন ইরাজকে শান্ত করার শক্তি অতিমাত্রার, তীব্র অ্যালকোহলেরও ছিল না। সবশেষে সে ত্যাগ করেছিল তার মেঘকে। সে কেমন ত্যাগ, তার বর্ননা নেই, নেই কোন সরূপ।
এসব মেঘালয়া কোনদিন জানতে পারবে না। ইরাজ জানতে দেবে না। সে নিজেকে লুকিয়ে চলে, সে নিজের দুর্বলতা গুলোকে খুব সন্তর্পণে দাফন করেছে তার বেপরোয়া চলনের চাদরের তলে।
—
ভাবনাগুলো মেঘালয়াকে এই ধারণায় পৌঁছাতে সাহায্য করল; আজ দুপুরে আব্বু বলেছিল, সে ভুলের চেয়ে বোকামি বেশি করেছে। অতীতের এই বিশ্লেষনে মেঘালয়াও যেন তাই খুঁজে পেল। আব্বু তাকে ভাবতে বলেছিল বোকামিগুলো। মেঘালয়ার মনে হলো, এগুলোই তার বোকামি। সে ইরাজকে দূরে সরিয়েছে যেখানে, তার ধ্বংসের শুরু ঠিক সেখান থেকেই। এতদিনে এভাবে ভাবার মতো মানসিকতা কাজ করেনি তার মাঝে। আজ ভেবে, সবকিছু এলোমেলো লাগে বড্ড।
ভাবনায় মশগুল মেঘালয়া সম্বিত ফিরে পেল ভারী গলার আওয়াজে, “রুমে যা।ʼʼ
ইরাজের আচমকা উপস্থিতিতে মেঘালয়া একটু চমকে উঠল, তবে তা প্রকাশিত হলো না। ইরাজ এসে দাঁড়াল পাশে। মেঘালয়া একবার তাকাল ইরাজের দিকে। ইরাজ সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশে চাঁদ নেই। মেঘে ছেয়ে আছে, সাথে মৃদূমন্দ বাতাস। মেঘালয়াকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখে বিরক্ত হলো ইরাজ, “দাঁড়িয়ে গিলছিস কথা? রুমে যেতে বলেছি।ʼʼ
মেঘালয়া জবাব দিল, “এখানে ভালো লাগছে।ʼʼ
ইরাজের কণ্ঠ এবার একটু সিরিয়াস শোনাল, “তোর ভালো-খারাপ লাগার অনুভূতি জানতে চাইনি। এখান থেকে যেতে বলেছি।ʼʼ
মেঘালয়া এবার বেশ জিদের সাথেই বলল, “যাব না।ʼʼ
ভেবেছিল ইরাজ এ নিয়েও চোটপাট করবে হয়ত। অথচ ইরাজ আর কিছুই বলল না। সিগারেট জ্বালাতে উদ্যেত হলো। সিগারেটের ধোঁয়াতে এমনিতেও দাঁড়াবে না মেঘালয়া। মেঘালয়া তবুও দাঁড়িয়ে রয় চুপচাপ। কিছু সময় দুজনেরই নিরবতার পর মেঘালয়া অভিযোগের স্বরে বলল, “আপনি সব জানতেন। আমার জীবনটা আপনার কাছে একটা বাজি ধরার বস্ত মনে হয়েছিল? সব জেনে বুঝেও কোনদিন আমায় জানাতে আসেন নি। এটাকে ভালোবাসা বলবেন আপনি?ʼʼ
ইরাজের গায়ে সহ্য হলো না যেন মেঘালয়ার কথাগুলো। দাঁতের মাড়ি পিষে জবাব দিল, “তোর এসব বা লে র প্রশ্নের জবাব দিতে এখানে এসে দাঁড়াই নি আমি। আর কে বলেছে তোকে এটাকে ভালোবাসা বলছি? আমি বলেছি কোনদিন? নাকি আর কেউ বলেছে? ভালোবাসা! হাহ! এই শব্দটাকে মৃত্যুর চেয়েও বেশি ঘৃনা করি আমি, সেখানে তা ভেতরে পুষে রাখার প্রশ্নই ওঠে না।ʼʼ
মেঘালয়ার কাছে ইরাজের বলা কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য লাগল না মোটেই। আজকাল ইরাজকে বুঝতে চেষ্টা করে মেঘালয়া। কিছুটা বুঝতে সক্ষমও হয়। ইরাজের চোখের ছটফটানিগুলোতে মাঝেমধ্যেই নজর দেয় সে। সেখানে শুধুই বিষাদ নজরে আসে মেঘালয়ার। আজকাল সকলকে ছাপিয়ে নিজেকে ঘৃনা করতে ইচ্ছে করে। সকলে তাকে যে আদরে আগলে রেখেছিল, তা সে তুচ্ছজ্ঞান করে যে সিদ্ধান্তগুলোই নিয়েছে, সবগুলোতেই তাকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। তার আজকের পরিণতি কেবলই মাত্র তার আবেগী বয়সের করা ভুল, এবং বোকামির ফল।
এক সময় সকলেই নিজের করে আসা ভুলগুলোকে উপলব্ধি তো করে, তবে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর, যখন আর কোন লাভ হয়না। সে সমাজের চোখে সম্মান হারিয়েছে, ইরাজকে অজান্তেই নরক যন্ত্রনা দিয়ে ফেলেছে, নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করেছে, তাবিরের মতো অমানুষকে বিশ্বাস করার মতো নিকৃষ্টতম বোকামি করেছে, তার বদলে আবার তাকেই পুড়তে হয়েছে জলন্ত আগুনে। আজ তা বুঝতে পারলেও লাভের লাভ কিছুই নেই। আজকের পরীক্ষার ফলাফল তাকে আবারও একবার উপলব্ধি করাল, সে নিজের কতবড়ো ক্ষতি করে বসেছে। এবং সেই সকল মানুষকে ঘৃনা করেছে, যারা হয়ত সত্যিই তার আপনজন, তারা তার ভালোর জন্য সবটা লুটিয়ে দিতে প্রস্তত। তাদের যে আচরণ গুলো মেঘালয়ার কাছে বিষের মতো ঠেকত, সেই আচরণে আটকে থাকলে আজ তার পরিণতি এমন হতো না মোটেই।
মেঘালয়ার চুলগুলো হাত খোপা করা ছিল। বাতাসের তরে তা খুলে পিঠে ছড়িয়ে পড়ল। তাতে কোন সমীহ দেখাল না মেঘালয়া। ইরাজকে প্রশ্ন করল আবারও, “ভালোবাসা কি ফুরিয়ে যায় কখনও? কাউকে ভালোবাসলে ঘৃনা করা যায়?ʼʼ
ইরাজ মৃদূ হেসে ফেলল। অন্ধকারে তা দৃষ্টিগোচর হয় না মেঘালয়ার। সিগারেটটা ঠোঁটের ভাজ থেকে নামিয়ে হাতে ধরে জবাব দিল ইরাজ, “ভালোবাসা বড়ো নাজুক, স্পর্শকাতর আর মসৃণ অনুভূতি। তার ওপর অবেহেলা এবং অধিকারহীনতার মতো ধারাল অনুভূতি দ্বারা আঘাত করা হলে, ভালোবাসার সেই মসৃণ অনুভূতি প্রথমত ক্ষত-বিক্ষত হয়, র ক্তা ক্ত হয়, যার ফলে বুকে অসহ্য ব্যথার সৃষ্টি হয়। পরে অবশ্য সময়ের সাথে সাথে সে ব্যথা তুলনামূলক কমে আসে, সয়ে যায়! তবে ভালোবাসার অনুভূতিটা বদলে এক অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম হয়। যাকে ঘৃনা তো বলা যা না, তবে সে অনুভূতিতে আগের মতো মায়া, টান আর নেশা থাকে না। আঘাতগুলো জড়ো হয়ে এক কঠিন দেয়ালের রূপ নেয়, যে দেয়াল টপকে নরম অনুভূতিরা উঁকি দিতে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। সে দেয়ালকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে খুব।ʼʼ
মেঘালয়া অভিভূত হয়ে শুনল ইরাজের মুখে ভালোবাসার এমন ঘাত-প্রতিঘাতী সংগা। ইরাজকে বরাবর নতুন নতুন ভাবে আবিষ্কার করে যাচ্ছে মেঘালয়া। আজ যেমন এই ইরাজ মিলছে না তার পরিচিত ইরাজের সঙ্গে! মেঘালয়া খুব বুঝল, ইরাজের বলা কথাগুলো কোন বইয়ের পাতা থেকে সংগৃহীত বাক্যমালা নয়। ইরাজে বুক চিরে বেরিয়ে আসা, চাপা আত্মচিৎকার ঝরে পড়ল প্রতিটি শব্দের পরতে পরতে!
চলবে..
#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
১৯.
সপ্তাখানেক কেটে গেছে। এর মাঝে মেঘালয়ার ভেতরে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন এসেছে। মাঝেমধ্যে তাকে দেখতে টুকটাক খুশি লাগে, আবার বসে যায় মগ্ন হয়ে কিছু ভাবতে।
ইরাজের কিছু কাজ পড়েছে রাজশাহীতে। সে কাল সকাল সকাল রওনা হয়ে যাবে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। বারান্দার সিঙ্গেল সোফাটির ওপর বসে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে কিছু কাজে ব্যস্ত সে। মেঘালয়া এই রাত করে রুমের সাফ সাফাইয়ের কাজে লেগেছে। বিছানাটা পরিপাটি করে গুছিয়ে সোফার এলোমেলো কুশন গুলো ঠিক করে রাখতে শুরু করল। সে সময় দরজায় টোকা পড়ল। মেঘালয়া তাকাল সেদিকে। এ রুমে তো কেউ আসে না। আনতারা খানম তো মোটেই না, তাহলে কি বাবাই এসেছে? দ্রুত গলা উঁচিয়ে বলে উঠল, “আরে নব ঘুরিয়ে ঢুকে পড়ো। আবার অনুমতি চাইছো?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়ার কথায় হাসলেন। এসে বসলেন বিছানার ওপরে। মেঘালয়া এগিয়ে গিয়ে পাশে বসতে বসতে প্রশ্ন করল, “কী হয়েছে বাবাই? গরীবের বাড়ি হাতির কদম পড়ল যে!ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব শব্দ করে হাসলেন এবার। বললেন, “তাহলে তুই গরীব, আর আমি হাতি?ʼʼ
“আমি গরীব ঠিক আছে, তবে তুমি হাতি নও।ʼʼ
“তবে বললি যে!ʼʼ
“আরে কথার কথা ছিল। এখন বলো কী ব্যাপার?ʼʼ
“ব্যাপার তো সাংঘাতিক রে!ʼʼ
“বাবাই, শুধু শুধু সাসপেন্স ক্রিয়েট না করে জলদি বলো কি হয়েছে।ʼʼ
“তুই, কাল ইরাজের সঙ্গে যাচ্ছিস।ʼʼ
“বাবাই, তোমার প্রেসার বেড়েছে নাকি? একটু পানি ঢালব মাথায়?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব মুখ ফুলিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, “আমার প্রেসার লো।ʼʼ
“তুমি তোমার ওই ঘাঁড় ত্যাড়া ছেলের সাথে আমায় যেতে বলছো? রাস্তায় মেরে গুম করে দিয়ে, এসে বলবে, আমি হারিয়ে গেছি।ʼʼ
“কিছুই বলবে না। তুই তৈরী থাকবি।ʼʼ
“না বাবাই, অন্য যেকোন কিছু বলো মেনে নিচ্ছি। এটা বাদ।ʼʼ
“সব বাদে এটা।ʼʼ বলেই উঠে দাঁড়ালেন ইমতিয়াজ সাহেব।
মেঘালয়াও দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি দিন দিন নাছোড়বান্দা হয়ে যাচ্ছ, বাবাই!ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব সামনে এগোতে এগোতে বললেন, “আগেও ছিলাম।ʼʼ মেঘালয়াকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন এক প্রকার পালিয়ে। মেঘালয়ার যে যাওয়ার মত নেই তা না। সে আগে পরেই ভ্রমন প্রিয়। তবে সমস্যা হলো, যার সাথে যাবে তাকে নিয়ে। সে তো একটা, রাক্ষস!
—
সকালে ইরাজকে ডেকে তুললেন ইমতিয়াজ সাহেব। মেঘালয়া তখন গোসল নিচ্ছে বাথরুমে। ইরাজ জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে, ড্যাড! তুমি এখানে কেন?ʼʼ
“মুখ সামলে কথা বল, রাজ! বাড়ি আমার, তুই আমাকে জিজ্ঞেস করছিস আমি এখানে কেন?ʼʼ
বাবার কথায় যে রস ছিল তা বুঝতে ভুল হয়না ইরাজের। ভ্রু কুঁচকে বলল, “আজ মনে রঙ লেগেছে নাকি তোমার, ড্যাড!ʼʼ
“এই এসব ড্যাড, ফ্যাড ডাকবি না তো। যতসব ঢং। আমাদের বাপদের আমরা ‘আব্বাʼ বলে ডাকতাম।ʼʼ
ইরাজ চোখ উল্টে, হা করে নিঃশ্বাস নিলো। বলল, “বলো কী সমস্যা?ʼʼ
“মেঘালয়া যাবে তোর সাথে?ʼʼ
“আব্বু! তোমার শরীর খারাপ নাকি?ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব মুখ থমথমে করে বললেন, “এমনিতে তো দেখছি দুজনের মিল ভালো। অথচ বাস্তবে নেই কেন?ʼʼ
তারপর বুঝানোর মতো বললেন, “দেখ, মেয়েটা রেজাল্ট নিয়ে এখনও বিষন্ন। তোর তো অল্প কিছুক্ষণের কাজ। সঙ্গে গেলে একটু ঘুরে আসলে, মন ভালো থাকবে। হেলালের আমানত মেঘা। আমাদের তো দায়িত্ব ওকে ভালো রাখা।ʼʼ
ইরাজ উঠে দাঁড়াল। বলল, “সকাল সকাল নীতির বাণী না শুনিয়ে, নিজের কাজে মনোযোগ দাও তো, ড্যাড। আহা কী জ্ঞানের কথা! যেন আমরা কেঁদে-কেটে আমানতটা কোলে করে তুলে এনেছি!ʼʼ
ইমতিয়াজ সাহেব কপট রাগী মুখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। এ কি ছেলে তিনি পয়দা করেছেন!
—
ইরাজ বসার রুমে বসে বিশ মিনিটের মতো অপেক্ষারত। মেঘালয়া তৈরী হচ্ছে। ইমতিয়াজ সাহেব নরম কথায় ভিজিয়ে বসিয়ে রেখেছেন ইরাজকে।
প্রায় আধাঘন্টার মাথায় নেমে আসল মেঘালয়া। ইরাজের চোখ সিঁড়িতে যেতেই দৃষ্টি থেমে গেল সেদিকে। ভ্রুটা সামান্য কুঞ্চিত করে চেয়ে রইল। মেঘালয়া মেজান্টা ও আকাশী রঙের মিশ্রণে সাজানো একটি জামদানী কাতান শাড়ি পড়ে নেমে এসে দাঁড়াল নিচে। মাথাটা ঝুঁকিয়ে শাড়ির কুচি ধরে নেমেছে সিঁড়ি দিয়ে। নিচে নেমে দাঁড়িয়ে মাথা তুলে চাইল। ইমতিয়াজ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে নিজের মনে আওড়ালেন, “মাশা-আল্লাহ!ʼʼ
ইরাজের ভ্রুর সাথে সাথে এবার কপাল জড়িয়ে এলো। বেশ ভালোই মেকাআপ করেছে মেঘালয়া। খুব বেশি না হলেও, কমও বলা যায় না! মাঝারী চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দেওয়া। মেঘালয়ার চুলগুলো সামান্য কুঁকড়ানো। তা খুব একটা সেভাবে যেহেতু বোঝা যায় না— দেখতে খুব আকর্ষনীয় লাগে। থ্রি কোয়ার্টার হাতার মেজেন্টা রঙা ব্লাউজের ওপর আকাশী শাড়ির আচল পড়ে আছে। হালকা গহনা, সাথে টুকটাক সাজ। খুব স্নিগ্ধ লাগছে মেঘালয়াকে দেখতে। ওকে দেখে ইরাজ আর নজর ফেরায় নি। বুকের ভেতরে কোথাও একটা লাফালাফি লক্ষ্য করছে সে। আজ মেঘালয়াকে একদম তার পরিচিত ছোট্রো কিশোরী লাগছে না। যুবতী নারী, শাড়িতে! পুরুষ টিকবে কী করে! ইরাজ মেঘালয়াকে আজ যেন প্রথমবার এমনকি বাবার সম্মুখে দাড়িয়ে এভাবে খুঁতিয়ে দেখল। আচমকা নজর আটকা পড়ল মেঘালয়ার বুকের ওপরে ফর্সা গলায়। সেখানে চিকন এক পেন্ডেন্ট ঝুলছে। শাড়ির আচল গিয়েছে গলার খানিক নিচের অংশকে পেচিয়ে। কি যেন হয়ে গেল ইরাজের। দ্রুত চোখ সরিয়ে এদিক ওদিক তাকাল। এলোমেলো চোখে তাকাল চারদিকে।
মেঘালয়া বরাবরই একটু সাজগোজের দিকে আগ্রহী ছিল। যেটা ইরাজের জন্য করতে পারত না আগেও। স্কুলের ফাংশন অথবা কোথাও যাওয়ার সময়েও ইরাজের কটুক্তির ভয়ে সাজতে পারত না মেঘালয়া। আজও সেই ইরাজই তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। এ ইরাজের অবশ্য তার প্রতি আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবুও ইরাজই তো!
ইরাজ মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোটো ছোটো করে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে দাড়িয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল, “আমার সুন্নতে খৎনার অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস? এমন মূর্তি সেজেছিস কেন!ʼʼ
এমন একটা কথায় মেঘালয়া খিঁচে চোখ বুজে ফেলল। ইমতিয়াজ সাহেব জিহ্বা কামড়ে ধরলেন। এই ছেলের কী কোনদিন মতিগতি ভালো হবে না! মেঘালয়া কিছু সময় পর চোখ তুলে ইমতিয়াজ সাহেবের দিকে করুণ মুখে তাকাল। তিনি ঘাড় নাড়িয়ে আশ্বাস দিলেন। ইরাজ ভারী পায়ে বেরিয়ে গেল বাইরের দিকে।
মনে মনে আওড়াল, আমি যেভাবে আটকে গেছিলাম, রাস্তার লোকজনও সেভাবেই দেখবে! ভাবনাটা মাথায় আসতেই আবারও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। ওভাবেই গিয়ে গাড়িতে বসল।
মেঘালয়ার ইমতিয়াজ সাহেবের কাছে এসে মুখ ফুলিয়ে বলল, “এই ক্যাকটাসের সাথে তুমি আমায় পাঠাচ্ছ, বাবাই! আল্লাহ জানে আজ ঘটে কী আছে?ʼʼ
ওভাবেই গটগটে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে যেতে যেতে কপট ক্ষোভ ঝারল, “ছোটো বেলা থেকে জালাচ্ছে। কোন কিছুতেই শান্তি দিল না!ʼʼ
আনতারা খানম ইচ্ছে করে রান্নাঘরে বসে ছিলেন এতক্ষণ। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নির্বাক চেয়ে রইলেন মেঘালয়া হেঁটে অগ্রসর হওয়ার দিকে।
গাড়িতে মৃদূমন্দ বাতাসে মেঘালয়ার ঝিম ধরে যায়। চোখটা বুজে কখন যেন ঘুমিয়ে গেছে। ইরাজ ড্রাইভ করতে করতে মেঘালয়ার কোন সারা শব্দ না পেয়ে একবার তাকাল।
আবারও সেই এলোমেলো অনুভূতি। আটকে গেল মেঘালয়া গলায়। চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দেওয়া মেঘালয়া। বড্ড আদুরে লাগছে মেঘালয়াকে দেখতে। তড়াক করে নজর সরিয়ে সামনে তাকাল ইরাজ! স্টিয়ারিং থেকে এক হাত সরিয়ে হা করে হাতটা মুখে চেপে ধরে ঘাম মোছার মতো করে নাড়ল। জোরে জোরে শ্বাস নিলো ইরাজ। এই অনুভূতির সাথে ইরাজ কোনদিন আবারও পরিচিত হতে চায়নি। এখনও চাইছে না। তবে মস্তিষ্ক যেন এর ঘোর বিরোধে নেমেছে। এতদিন মেঘালয়াকে দেখেছে, এক ঘরে থেকেছে। তবে কোনদিন মেঘালয়ার প্রতি এমন অনুভূতিদের সারা পায়নি সে। বরং মেঘালয়াকে দেখলেই বুকের ব্যথারা নড়ে চড়ে উঠত। আজ অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করল ইরাজ নিজের মাঝে! যা সে বুঝেও বুঝতে চায় না, অনুভব করেও চায় সে অনুভূতিকে মিথ্যা প্রমান করতে।
—
নদীর ঘোলাটে পানি, বালিময় সেই নদীর তীর। আশেপাশে লোকজনের সমাগম যথেষ্ট। বিকেলের কয়েক দণ্ড পেরিয়েছে। সূর্য সেই নদীর দিগন্তেই যেন নিজেকে নদীর পানির আড়ালে লুকোতে ব্যস্ত।
মেঘালয়া গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। রাজশাহী জেলার পদ্মার পাড়। ইরাজের কাজ শেষ হয়েছে পাঁচ মিনিটে। এক ক্লাইন্টের সঙ্গে লেনদেনের ব্যাপারটা মেটাতে এসেছিল ইরাজ। মেঘালয়া ভেবেছিল এবার হয়ত ফিরে যাওয়ার পালা। রাস্তাঘাট তো তার চেনা নয়। একসময় ইরাজ এসে গাড়ি থামাল এই নদীর পাড়ে। মেঘালয়া সব ভুলে অভিভূত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল নদীর পানিতে চিকচিক করা অস্তমিত সূর্যরশ্মির দিকে। প্রতিটি ঢেউয়ে ঢেউয়ে সূর্যের আলো, স্রোতের বাঁকে বাঁকে কমলা-লাল প্রভা।
আস্তে আস্তে হেঁটে সে পানির দিকে এগিয়ে যায়। উঁচু হিলের চোখা প্রান্তটি বালুর মাঝে গেঁড়ে যাচ্ছে, হাঁটার তালে আবার উঠে আসছে। দারুন উপভোগ্য লাগছে ব্যাপারটা মেঘালয়ার কাছে। নদীর দিক থেকে তেড়ে আসা বাতাস মেঘালয়ার লম্বা শাড়ির আচল পতাকার মতো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাঝেমধ্যে। সাথে চুলের বেপরোয়া জ্বালাতনকেও এই মুহূর্তে মেঘালয়া চরম উপভোগ করছে।
নদীর এই অসামান্য রূপ দেখে, নদীকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় ওর, ‘তুমি এত স্নিগ্ধ আর সুন্দর কেন? তোমার কী কোন বিষাদ নেই? তোমার যে কোন বাঁধা নেই! এত রুপ, এত মাধুর্য আর প্রবাহমান জলরাশির অহংকারে নিশ্চয়ই তুমি সর্বদিকে সমৃদ্ধ! একটু ধুয়ে দেবে আমার আমার বিষাদগুলো, তোমার বুকে খেলে বেড়ানো ওই টলমলে জলে?ʼ
আচমকা নিজের পাশটা ফাঁকা লাগল। বেরিয়ে এলো চট করে নদীর মুগ্ধতা থেকে। হন্য হয়ে চারদিকে তাকাতেই দেখল পেছন থেকে ইরাজ হেলেদুলে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। হাতের দিকে তাকিয়ে মেঘালয়া বিষ্মিত চোখে চেয়ে রয়। ততক্ষণে ইরাজ এসে কাছে দাঁড়াল। মেঘালয়া একদৃষ্টে চেয়ে আছে ইরাজের হাতে থাকা আকাশী আর গোলাপি রঙা রেশমী চুড়ির দিকে।
ইরাজ বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, “হাত এগিয়ে দে।ʼʼ
মেঘালয়া ঠিক ঠাহর করতে পারেনি কথাটা। সে বিষ্ময় কাটাতে ব্যস্ত। ইরাজ হুট করে মেঘালয়ার বাঁ হাত চেপে ধরে নিজের দিকে আনল। বাঁ হাতের ওপর শাড়ির আঁচল মেলে আছে। তা খানিকটা তুলে, দু রঙের চুড়িগুলো খুব যত্নে রঙ মিলিয়ে সাজাতে থাকল। মেঘালয়ার বিষ্ময় কাটার বদলে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে এবার। চুড়িগুলো মেলাতে মেলাতে গম্ভীর স্বরে বলল ইরাজ, “শাড়ি পড়েছিস গায়ে, আর হাতটা বিধবা বানিয়ে রেখেছিস?ʼʼ
এরকম একটা কথাও কেউ এমন ভারী কণ্ঠে বলে! তবুও শুনতে অদ্ভুত লাগল মেঘালয়ার। একটু মুখ বিকৃত করে উঠল। মুখে অস্পষ্ট স্বরে একটু আর্তনাদ করে উঠল। চুড়িগুলো হাতে পরিয়ে দিল ইরাজ। চুড়ির মাপ পারফেক্ট, যে জন্য হাতে ঢুকাতে গিয়ে একটু ব্যথা পেয়েছে মেঘালয়া।
ইরাজ বলল, “তোর শাড়ির এই রঙটা কী? একটু গাঢ় বেশি। এমন রঙা চুড়ি পেলাম না। এই হালকা গোলাপিটাই ছিল।ʼʼ
মেঘালয়া অস্পষ্ট উচ্চারণ করে, “মেজান্টা!ʼʼ এরপর আনমনে হাত ঝাঁকিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে দুর্বোধ্য মিটিমিটি হাসি। অতিরিক্তই সুন্দর বলে মনে হলো চুড়িগুলো! আসলেই চুড়ি সুন্দর, নাকি চুড়িগুলোর পাওয়ার অনুভূতিটা জটিলতম সুন্দর! মেঘালয়া জানে না! ইরাজ ওকে ছেড়ে ততক্ষণে নদীর কিনারায় গিয়ে হাত পকেটে গুজে দাঁড়িয়েছে। তখনই চোখে পড়ল মেঘালয়ার, একটি ছোট্রো ছেলে চুড়ি ভর্তি আলনা নিয়ে এদিক সেদিক নদীর পাড়েই ঘুরছে। তার চোখে পড়েনি আগে। তবে ইরাজ দেখল কখন? আর কিনতেই বা গেল কখন!
মেঘালয়া সেদিক থেকে নজর ঘুরিয়ে ইরাজের দিকে তাকায়। পেছন থেকে দেখল টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নজর নিবদ্ধ নদীর শেষে ওই দিগন্তের ধোঁয়াশায়। চোখ কুঁচকে নিচের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে ফেলল। আবার সামলে নিলো নিজেকে। ইরাজের পাশে গিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণ পর ইরাজ নদীর বুকে নজর আটকে, হঠাৎ মুখ খুলল। অদ্ভুত অভিব্যাক্তিতে স্বগতক্তি করল, “বুঝলি মেঘ! জীবনটা এই প্রবাহমান নদীর মতো। যে স্রোত হারিয়ে যায় নদীর ধারাবাহিকতায়, তা ফিরে আসে না আর! নদী সেই শূন্যতার হাহাকারে আবারও ফুলে ফেঁপে ওঠে। তর্জন গর্জন করে দু কূল ভাসায়। নদীর এই আর্তনাদকে লোক সাধারণত জলোচ্ছাসের নাম দেয়।ʼʼ
মেঘালয়া চমকে ওঠে। সে না কিছুক্ষণ আগে নদীকে সর্বোচ্চ সুখী আর সুন্দর বলে গেল! এই স্নিগ্ধ নদীরও হাহাকার আছে! সেই পানিতে তার সমস্ত বিষাদ ধুয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে নদীকে মেঘালয়া। নদীর টলমলে পানির দিকে আবিষ্ট নজরে চেয়ে নেশাগ্রস্থের মতো জিজ্ঞেস করল, “আর যে স্রোতগুলো নদীর মাঝে, নদীর বুকে থেকে যায়, তারা কী নদীর আপন?ʼʼ
ইরাজ হাসল মনেহয় একটু! মেঘালয়া নদীর পাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে মৃদূমন্দ ঢেউ এসে কিছু কিছু বালু ধুয়ে নিয়ে মিশিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্যে।
“আপন বলতে কী বুঝিস তুই?ʼʼ
মেঘালয়া মৃদূ হেসে জবাব দিল, “বুঝিনা।ʼʼ
ইরাজও একই ভাবে বলে, “আমিও।ʼʼ
সন্ধ্যা নামবে প্রকৃতিতে খুব শীঘ্রই। ইরাজ মেঘালয়াকে তাড়া দিল, “চল হাঁটি।ʼʼ
মেঘালয়া ইরাজের আগে হাঁটছে। শাড়ির আঁচল বড়ো হওয়ায় তা মাটি ছুঁয়ে মেঘালয়ার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে ইরাজ কপাল কুঁচকে, চট করে আঁচলটা হাতে তুলে নিলো।
আকাশী রঙা শাড়িতে শোভা পাচ্ছে এক যুবতী, সে হাঁটছে সম্মুখে, তার পেছনে তারই শাড়ির আঁচল তুলে ধরে এগিয়ে চলেছে বিরক্তিতে বুদ হয়ে ওঠা এক পুরুষ। এ দৃশ্য মনে হয় সেখানে উপস্থিত সকলেই বেশ আগ্রহের সঙ্গে উপভোগ করল। ইরাজ ধমকে উঠল, “নদীর পাড় ঝাড়ু দেওয়ার টেন্ডার নিয়েছিস? শাড়ির আঁচল ঠিক রাখতে পারিস না, শাড়ি পড়তে বলেছিল কে?ʼʼ
মেঘালয়া ছোটো ছোটো চোখ করে পেছনে ফিরে আঁচলটা নিলো ইরাজের হাত থেকে। মুখে ভেঙচি কাটল গোপনে।
মাগরিবের আজানের পর সন্ধ্যার চাদরে ঢাকা পড়া নদীর কিনারা যেন সেজে উঠল আরেক রূপে। মেঘালয়া ফুসকা, ঝালমুড়ি, কুলফি মালাই, এরকম বহুকিছু খাওয়ার পরে খেল আবার কামরাঙা মাখা। তাতে ঠোঁট মুখ লাল করে ফেলেছে ঝালে। খাওয়ার সময় ঝাল লেগেছিল বটে, তবে তাতে পরোয়া করার সময় কোথায় মেঘালয়ার। ইরাজ শুধু ভ্রু কুঁচকে দেখছে তা। শেষে খাওয়া থামানোর পর সব ঝাল এসে হানা দিল যেন এবার। মেঘালয়া ঘেমে উঠেছে। ছটফট করতে করতে ইরাজকে বলল, “পানি এনে দিন, পানি খাব। মুখ জ্বলে যাচ্ছে।ʼʼ
ইরাজ এবার বেশ আরাম করে বসল চেয়ারে হেলান দিয়ে। রিল্যাক্স মুডে আছে সে খুব মেঘালয়ার হাল দেখ। সেভাবেই বলল, “মুখ না জ্বললে এনে দিতাম। একটু উপভোগ কর ঝালটা।ʼʼ
মেঘালয়া কটমট করে তাকাল। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে বলল, “ক্যাকটাস! দিন টাকা দিন, আমি কিনে আনছি পানি।ʼʼ
ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে ধরে, “হুমম! টাকা আমি দেব, পানি কিনে আনবি তুই? তুই টাকা দে, পানি আমি কিনে আনছি।ʼʼ
মেঘালয়ার ঠোঁট জ্বলছে, ঠিকমতো ঝগড়াটা করতে পারছে না ঠিক। তবুও নাক ফুলিয়ে,গম্ভীর মুখে বলল, “আচ্ছা! তো আপনার মানিব্যাগ ফাঁকা? জেনে কষ্ট হলো। আগে বলবেন তো! একটু কম খেতাম।ʼʼ
ইরাজ চোখটা চারদিকে ঘুরিয়ে আবার দৃষ্টিপাত করল মেঘালয়ার দিকে। একটু এগিয়ে বসে মেঘালয়ার দিকে ঝুঁকে আস্তে করে শান্ত কণ্ঠে বলল, “এই পাবলিক প্লেসে থাপ্পড় খেলে কেমন লাগবে তোর?ʼʼ
মেঘালয়াও ইরাজের মতো করেই বলল, “সে এক মোহনীয় অনুভূতি!ʼʼ
এমন পরিস্থিতিতে এরকম একটা পাল্টি খাওয়া কথায় ইরাজ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। মুখটা গম্ভীর করে উঠে পড়ল চেয়ার থেকে।
মেঘালয়া নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার সম্মুখে এসে দাঁড়াল দুটো ছেলে। তারা অবশ্য এখনও কিছু বলে নি। মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এখানে সামনে এসে এভাবে দাঁড়ানোর কারন কি? ছেলেদুটোর মাঝে একজন জিজ্ঞেস করল, “একাই নাকি? কেউ আসেনি সাথে?ʼʼ
ইরাজ এসে পাশে দাঁড়াল। হাতে পানির বোতল। মেঘালয়ার অদ্ভুত এক কাণ্ড করে বসল। দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ইরাজের বাহু জাপটে ধরে, গা ঘেষে দাঁড়াল। যেন বিনা বাক্যে বুঝিয়ে দিল, ‘উহু, একা আসিনি। আমার ক্যাকটাস এসেছে আমার সঙ্গে!ʼ
ছেলেগুলো মেঘালয়ার বয়সেরই। এদিকে ইরাজ তো জলজ্যন্ত পুরুষ। সন্ধ্যার আধো আলোতে স্পষ্ট ইরাজের জলন্ত চোখ আর শীতল চেহারা খানা। দুজন আস্তে করে কেটে পড়ল। মেঘালয়া চেয়ে রইল সেদিকে। কয়েক মুহূর্ত পার হলে আচমকা নিজের দিকে খেয়াল যেতেই ঝাড়া দিয়ে হাত বের করে এনে দুরে ছিটকে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে ফেলল। সেটা বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা হলো, মনে হলো মেঘালয়ার চেয়ে ইরাজ বেশি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে ঘটনাটিতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে এদিক ওদিক অগোছালো দৃষ্টি ফেলছে। তড়িঘড়ি মেঘালয়ার হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল।
মেঘালয়া বোতল হাতে ধরে হঠাৎ-ই ভাবে, ইরাজ কী লজ্জা পেয়েছে! ছেলে মানুষের আবার এসব ছোটোখাটো বিষয়ে লজ্জা? তবে ইরাজ এমনই। সে জানে, আগেও ইরাজ কোনদিন তার দিকে আকর্ষন অনুভব করেছে, এমন কিছু তার আচরণে প্রকাশ পায়নি। ইরাজের মুখের সেই অপ্রস্তুত ভাব মনে পড়তেই মাথাটা নত করে নিয়ে ফিক করে ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল মেঘালয়া। কপালে হাত ঠেকিয়ে মুখটা আড়াল করে ফেলল।
চলবে..
[ ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন। ২২০০+ শব্দ লিখেছি।]