অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১৬+১৭

0
795

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৬.

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। ইরাজ এখনও বাড়ি ফেরেনি। মেঘালয়ার তা নিয়ে বিশেষ কোন আগ্রহ নেই। সে নিজের মতো আধশোয়া হয়ে বসে পড়ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর, প্রায় এগারোটার দিকে ইরাজ আসলো। মেঘালয়া ইরাজের উপস্থিতি টের পেয়েও তাকাল না সেদিকে। ইরাজ পরনের কাপড় পরিবর্তন করে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে একেবারে বের হলো। মেঘালয়ার দিকে চোখ তুলে একবার তাকিয়ে দেখল, সে পড়ায় মগ্নতা দেখাচ্ছে। জিজ্ঞেস করল,

“তোর রেজাল্ট কবে?ʼʼ

মেঘালয়া আচমকা ইরাজের এমন ভারী গলা শুনে সামান্য চমকে তাকাল। যদিও চমকিত ভাবটা তার মুখে প্রকাশ পায় নি। আস্তে করে সংক্ষেপে জবাব দিল,
“আগামী পরশু।ʼʼ

ইরাজ আর বাক্য খরচ না করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। আজ প্রায় সপ্তাহখানেক পর তাদের এই দুটো কথা হলো। মেঘালয়া ছোট্রো একটা শ্বাস ফেলে পড়ায় মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে।

খাবার টেবিলে ইমতিয়াজ সাহেব দেখলেন, তারা তিনজন থাকলেও মেঘালয়া নেই। এদের দুজনের মাঝে কেউ যে ডাকতে যাবে না, তা তিনি জানেন। তা ভেবে খুব একটা ভালো লাগল না। তিনিই গলা উঁচিয়ে ডাকলেন মেঘালয়াকে, “মেঘা! ও মেঘা! নিচে আয় তো!ʼʼ

মেঘালয়ার কানে গেল মৃদূ আকারে সেই ডাক। সে বুঝল, বাবাই কেন ডাকছে। সেও চেঁচিয়ে জবাব দেয়, “ক্ষুধা নেই, বাবাই। তোমরা খেয়ে নাও, আমি পড়ছি।ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, “খেতে ডাকছি না। তুই শুনে যা।ʼʼ

বিরক্ত হয়ে বই, খাতা রেখে উঠে পড়ল মেঘালয়া। সিঁড়ির অর্ধেক অবধি নেমে বলল, “কি হয়েছে, বাবাই!ʼʼ

“এদিকে আয়, বলছি।ʼʼ

মেঘালয়া অলস ভঙ্গিতে নেমে এসে টেবিলের কাছে দাঁড়াল। ইমতিয়াজ সাহেব চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “বোস এখানে।ʼʼ

মেঘালয়া বলে ওঠে, “বাবাই..

ইমতিয়াজ সাহেব ধমকে উঠলেন, “বসতে বললাম তো!ʼʼ

অগত্যা বসে পড়ল মেঘালয়া। আনতারার মনে হয় এই ব্যাপারটা খুব একটা ভালো লাগল না। তা তার মুখ দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয়া নিজেই নিজের প্লেটে খাবার তুলে নিলো। তরকারীর পাত্রটি মেঘালয়ার কাছে রাখা। খেতে খেতে ইরাজ তরকারী নেয়ার উদ্দেশ্যে মেঘালয়াকে বলল, “তরকারী তুলে দে তো!ʼʼ

মেঘালয়া ইরাজের কথায় পাত্তা না দিয়ে বরং আনতারা খানমের দিকে তাকাল। আশানুরূপ, সে মুখটি গোমরা করে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। মেঘালয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ইরাজকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমার কাছে নয়। মামনির কাছে চান। তার ছেলে আপনি, এবং বাড়ির কর্তী সে।ʼʼ

মেঘালয়ার কথায় ইরাজ কোন প্রতিক্রিয়া না দেখালেও, আনতারা খানম কেমন করে যেন তাকলেন। মেঘালয়া তা দেখে হেসে ফেলল, “মামনি! তুমি শুধু শুধু ছেলেকে হারানোর চিন্তায় কাহিল হয়ে পড়ছো। ভেগে যাব না তাকে নিয়ে। চান্সই নেই, মামনি! বিশ্বাস করো, তোমার ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক সেরকমও নয়, যেমনটা রাস্তায় পরিচিত কারো সাথে হয়। তুমি শুধু শুধু এসব সস্তা ভাবনা, আর আচরণ দিয়ে নিজেকে তথাকথিত সকল মূর্খ শাশুড়ির মতো বানিয়ে তুলছো। তোমার কাছে যদিও এমনটা আশা ছিল না। তবে কি আর করার, তুমি যদি শাশুড়ি হয়ে ওঠো, আমারও বউমা হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে না। তুমি শেখাবে আচরণ, আমি শিখব। যাহোক, নাও ছেলেকে নিজের হাতে খাওয়াও। ওসব দায়িত্ব পালন; এমনকি সংসারে কোন বিশেষ আগ্রহ নেই আমার।ʼʼ

আনতারা খানম মেঘালয়ার মুখের কথাগুলো শুনে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেলেন। কেবল বিষ্মিত চোখে চেয়ে রইলেন মেঘালয়ার দিকে। আরো অবাক হলেন, যখন দেখলেন মেঘালয়ার করা এরকম নিরব অপমানের পরিপেক্ষিতে ইরাজ বা ওর বাবা কোনরকম কিছুই বলেনি। বরং স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে। ইমতিয়াজ সাহেব খাচ্ছেন, আর ইরাজ তরকারীর অপেক্ষায় গম্ভীর মুখে বসে আছে।

_
রুমে এসে ইরাজ বসল বিছানার ওপর। মেঘালয়ার তার আগেই চলে এসেছে। খানিক বাদে মেঘালয়াকে ডেকে উঠল, “মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া বই থেকে মুখ না তুলে জবাব দিল, “হু!ʼʼ

“কয়েল জ্বালিয়েছিস?ʼʼ

মেঘালয়া তাকাল একবার, আবার নিচের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দিল, “হু।ʼʼ

“কেন?ʼʼ

মেঘালয়া বিরক্ত হয়ে তাকাল, “মশার কয়েল কেন জ্বালানো হয়?ʼʼ

“তোকে প্রশ্ন করতে বলেছি? নাকি উত্তর চেয়েছি?ʼʼ

“আপনার এরকম যুক্তিহীন প্রশ্নের কোন জবাব নেই আমার কাছে।ʼʼ

“নিভিয়ে দে। এক্ষুনি।ʼʼ

মেঘালয়া রেগে উঠল। চোখ বুজে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বলল, “কী সমস্যা আপনার?ʼʼ

ইরাজ চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায়। মেঘালয়া চোয়াল শক্ত করে চেয়ে আছে। ইরাজ খোঁচা মেরে বলল, “গরীবের মেয়ে হলে তাও নাহয় বলতাম, বাপের বাড়ি এসি নেই, তুই কী করে বুঝবি, এসি চলা অবস্থায় কয়েল জ্বললে ধোঁয়া গুলো সব নাকে মুখে ঢোকে, আজরাইল সামনে এসে হাজির হওয়ার আশংকা থাকে। বা ল ডা এলার্জি আছে আমার। এক্ষুনি কাশি শুরু হবে। ফেলে দে কয়েল।ʼʼ

শেষের কথাটা এত জোরে ধমকে বলেছে ইরাজ, বন্ধ ঘরে বেজে উঠল চারদিকে। মেঘালয়া কিছুক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ইরাজের দিকে। শান্ত স্বরে বলল, “সিগারেটের পাঁজা পাঁজা ধোঁয়া গিলে হজম করে ফেলছেন অনায়াসে, কয়েলের ধোঁয়ায় ইন্তেকাল হয়ে যাবে, আপনার?ʼʼ

ইরাজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আবার মুখটা স্বাভাবিক করে জিজ্ঞেস করল, “অ্যারোসোল নেই?ʼʼ

“থাকলে কয়েল জ্বালিয়ে আপনার সাথে এই মধুর আলাপন করার শখ ছিল না আমার।ʼʼ

বলেই মেঘালয়া উঠে গিয়ে কয়েলের জলন্ত পাশের কিছুটা ভেঙে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে সেটা ফেলে দিয়ে এসে আবার পড়তে বসল।

প্রায় আধাঘন্টা পার হয়েছে। মেঘালয়া পড়ছে বসে। ইরাজ শুয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তবে ঘুম তাকে ধরা দিচ্ছে না। এপাশ-ওপাশ করে কেটে গেছে এতক্ষণ। অতিষ্ট হয়ে উঠে বসল। সোফার দিকে তাকাল, মেঘালয়া পড়ছে। ডাকল, “মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়া বিরক্ত হয়ে তাকায়। রুমে মৃদূ আলো জ্বলছে। মেঘালয়া টেবিলল্যাম্পের আলোতে পড়ছে। তাই মেঘালয়া যে ফিরে তাকিয়েছে তা বুঝা গেলেও মেঘালয়ার বিরক্তিভরা চেহারা হয়ত টের পাওয়া গেল না।

“কয়েল জ্বালিয়ে দে।ʼʼ

মুহুর্তের মধ্যে ক্ষেপে উঠল মেঘালয়া এমন একটা কথা শুনে। কপালে ভাঁজ পড়ল তার। দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “এই বন্ধ ঘরে এখন মরবেন না, আপনি?ʼʼ

ইরাজ ভাবলেশহীন জবাব দেয়, “মরলেও ঘুমিয়ে মরা ভালো। ঘুমোতে না পারলেও এমনিতেই অসুস্থ হয়ে মরে যাব। কথা কম বল, কয়েল জ্বালিয়ে দে।ʼʼ

“পারব না।ʼʼ

মনে হলো না মেঘালয়ার কথা ইরাজের কানে গিয়েছে। ইরাজ মেঘালয়ার ‘পারব না’ কথার পরিপেক্ষিতে ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “হুম। তাড়াতাড়ি জ্বালিয়ে দে।ʼʼ

এমনিতে মেঘালয়ার নিজেরও মশা লাগছে টুকটাক। বিরক্তিতে বুদ হয়ে উঠে দাঁড়াল। ইরাজকে বলল, “এসি অফ করুন। বারান্দার দরজা খুলে দিই, ঠান্ডা বাতাস আসবে।ʼʼ

ইরাজ এসি অফ করে দিল। মেঘালয়া কয়েল জ্বালিয়ে আবার এসে বসল নিজের জায়গায়। এখন আর পড়তে ইচ্ছে করছে না। বই,খাতা গুছিয়ে রেখে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো। যদিও সে জানে চেষ্টা বৃথা। ঘুম আসবে না।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎ-ই রুমের আলো জ্বেলে ওঠায় মেঘালয়া চোখ খুলে তাকাল। দেখল ইরাজ টিশার্ট গায়ে দিচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে, আবার তাকাল। আশ্চর্য! টিশার্ট কেন গায়ে দিচ্ছে! সে নাকি ঘুমাবে জন্য কয়েল জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। এখন কোথায় বেরোবে? বিনা কারনে কয়েল জ্বালিয়ে নিয়েছে! মেঘালয়া হতাশ এক নিঃশ্বাস ফেলল। আল্লাহ তার সাথে এ কাকে জুড়ে দিয়েছে! এমন ছন্নছাড়া মানুষই কেন তার গলায় ঝুলিয়ে দিতে হলো। ঘরের আলো নিভিয়ে ইরাজ দরজা খুলে বেরিয়ে গেল রুমের বাইরে। মেঘালয়া শোয়া থেকে উঠে বসল। ঘুম নেই চোখে। আস্তে করে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। হালকা হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। মনটা আবারও এই অগোছালো, চলমান, অনিশ্চিত জীবন নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে যায় তার।


ইরাজ আম্মুর রুমের সামনে এসে দেখল, দরজা চাপিয়ে রাখা রুমের। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কয়েকবার ডাক দিল ‘আম্মু’ বলে। এই ডাকের মাঝে জানান দিল, সে এসেছে, এবং প্রবেশের অনুমতিও চেয়ে নিলো যেন! তার মতো ঘাঁড় ত্যাড়া তো আর সোজা কথায় অনুমতি নিয়ে ঢুকবে না!

দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে দেখল আব্বু বিছানায় ঘুমিয়ে আছে। আনতারা খানম জায়নামাযে বসা। ইরাজের ভ্রু কুঁচকে গেল। এ সময় কোন ওয়াক্তের নামাযে বসেছে আম্মা! নাকি নফল নামাযে বসেছে। পাশে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল, আনতারা খানম মোনাজাতে বসেছেন। ঘরে জ্বলে থাকা মৃদু আলোতে ঝাপসা ভাবে দেখতে পেল মায়ের কান্নাজড়িত মুখখানা। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা। আনতারা খানম ওকে দেখে যেন আরো লম্বা করছে মোনাজাত। তা হয়ত বুঝল ইরাজ। চেয়ার টেনে বসল পাশে। একটু ঝুঁকে বলল, “আম্মা! তোমার মোনাজাত কিন্ত আমি আসার আগেই শেষ। আমি এসেছি টের পেয়ে আবার হাত তুলেছ, দেখে ফেলেছি আমি। এবার কী হবে?ʼʼ

আনতারা খানমের কী হলো কে জানে! হাত নামিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন এবার তিনি। ইরাজ ঘাঁড় ঝাঁকিয়ে চেয়ার সরিয়ে আম্মার পাশে নিচে বসল। গালটা ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। আনতারা অভিমানে ইরাজের হাতটা সরিয়ে দিতে চাইলে ইরাজ আরও খানিকটা চেপে ধরল। নিজের দিকে মুখ উচিয়ে ধরে, চোখে চোখ রেখে বলল, “কী হয়েছে? কাদছো কেন?ʼʼ

আনতারা খানম জবাব দিলেন না। একফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল ছেলের দিকে তাকিয়ে। ইরাজ একটু হাসল। বলল, “তখন মেঘের কথার জবাবে কিছু বলিনি বলে আল্লাহর কাছে আমার নামে নালিশ করছিলে?ʼʼ

কান্নাভেজা স্বরেই আনতারা বললেন, “না। সর, যা এখন।ʼʼ

“এত অনুগত, ভদ্র ছেলে তো নই আমি, তুমি বললেই চলে যাব?ʼʼ

আনতারা খানম মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। ইরাজ আবারও নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, “আম্মা! আজ মেঘ তোমাকে বলেছে, কিছু বলিনি। ও আজ প্রথমবার বলেছে। তুমি ওকে যখন কটুক্তি করেছ, ধিক্কারজনক কথা শুনিয়েছ, অপমান করেছ, মুখ ফিরিয়ে নিয়েছ; ও কিন্ত সবটা শুধু সহ্য করে গেছে। তখন তোমাকেও কিন্ত কিছু বলিনি।ʼʼ

“ওহ! তোর বউ, আর তোরা বাপ-ছেলে মিলে বদলা নিচ্ছিস?ʼʼ

“এরকম অবুঝ তো তুমি নও। তাহলে এভাবে কথা পেচানোর মানে কী?ʼʼ

“অবুঝই তো। তাই তো নিজের ছেলের মন বুঝতে
পারিনি।ʼʼ

ইরাজ একটা শ্বাস নিয়ে ঠেসে বসল এবার। বলল, “মেঘের প্রতি তোমার রাগটা কিসে? ও অন্যকারো সাথে চলে গিয়েছিল বলে? এ কথাটা বিয়ের আগে তোমায় জানানো হয়নি বলে? অথবা অন্যকিছু? এই মেঘালয়াকে তোমার চেয়ে ভালো কখনও আব্বুও বাসতে পারেনি। হঠাৎ-ই এমন কি হলো, সে তোমার চোখের বিষ হয়ে উঠল?ʼʼ

আনতারা খানম জবাব দিতে পারলেন না। ইরাজ আবার বলল, “যেভাবেই হোক, যাই হোক; মেঘ এখন বাড়ির বউ, আম্মা! আর পাঁচটা শাশুড়ির মতো আচরণ করে বাড়ির পরিবেশটাকে নাটকীয় করে তুলো না। এবার এটা বোলো না, আমি আমার বউয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলছি। তুমি নিজেও জানো তোমার এই আচরণ নিতান্তই যুক্তিহীন। কোন পুরুষের জীবনেই মা আর বউয়ের স্থান কখনোই এক হয় না, আম্মা। সকলের জন্য আলাদা আলাদা জায়গা থাকে মানুষের ভেতরে।ʼʼ

একটু থামল ইরাজ। আনতারা খানম নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইরাজ আবার বলল, “আর এমনিতেও মেঘের সাথে আমার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। তুমি যা ভেবে ওকে নিজের শত্রু ভেবে বসেছ, তা কেবল মূর্খতা, আম্মা! ও চাইলেও তোমার জায়গা নিতে পারবে না। আই থিংক, সেই জাতের মেয়েই না, মেঘ। সংসারের প্রতি কোন আগ্রহ নেই ওর। তবুও হেলাল আঙ্কেলের জন্য এতদিনে অনেক চেষ্টা করেছে এ বাড়িতে নিজের একটু জায়গা তৈরী করার। সুযোগ দেওয়া হয়নি। ছোটো মানুষ, এবার যদি ও আরো বিগড়ে যায়, তার দ্বায়ভার কাদের?ʼʼ

আনতারা খানম যেন খুব বুঝেছেন এমন ভঙ্গিমায় মাথা দুলালেন। নাক টানলেন কয়েকবার মৃদূ আওয়াজে। এরপর আচমকা জিজ্ঞেস করে উঠলেন,

“তোর এত ভালোবাসার পরেও তোদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয় কেন, রাজ? ছোটোবেলা থেকে ভালোবেসে গেলি, তুই। নজরে নজরে রেখে, নিরব যত্নে নিরাপত্তা দিয়ে বড়ো করে তুললি তুই। সেই নিমকহারাম মেয়ে অন্য পুরুষের হাত ধরে তোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পালিয়ে গেল। তাকে তুই বাড়ির বউ করে আনলি, আর আমি ফুল চন্দন দিয়ে বরন করে নেব? ভুলে যাস না, রাজ! আমি তোরই মা। তুই আমারই গর্ভের নাঁড়ি-ছেঁড়া ধন। মেঘাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না। আর না ওকে আবার আপন করে নিতে পারব। যে মেয়ের চেহারা দেখলে আমার ছেলের বুক ফাঁটা যন্ত্রনার আভাস পাই, তাকে কোলে ঠাঁই দেওয়া যায় না। আমি ওকে মায়ের মতো ভালোবেসেছি, মায়ায় জড়িয়ে রেখেছিল ওর নিষ্পাপ মুখখানি। জানতাম না এত নিষ্ঠুর আর পাষাণ্ড সেই মেয়ের ভেতর। কী করে পারল তোর ভালোবাসাকে ঠুকরে অন্যের হয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে? হয়ে যেতও তো এতদিনে। যদি না সেদিন সেই ছেলে ওকে ছুঁড়ে না ফেলত। তখন তুই কী করতি? নেশাখোর হয়ে ঘুরে বেড়াতি, তাকিয়ে দেখতাম তোর ধ্বংস মা হয়ে? এখনই বা কী সুখে আছিস? আয়নায় দেখেছিস নিজের চেহারা? সিগারেটে পোড়া কালো ঠোঁট। ঘুমের অভাবে কালি পড়ে যাওয়া চোখ? তোর ওই বিষাদভরা, এলোমেলো ছন্নছাড়া হাসি বুঝি না, আমি?ʼʼ

আম্মুর বলা কথাগুলতে ইরাজের চটা পড়ে ঘা’য়ে আবারও যেন খোঁচা লাগল। বুকটা রক্তাক্ত হয়ে উঠল আবারও। উদ্ভ্রান্তের মতো বসে রইল নির্বিকার চাহনিতে। আম্মুর অভিযোগ গুলো তো ফেলা যায় না! যে কথাগুলো ইরাজকে প্রতিক্ষণে তুষের আগুনে পুড়িয়ে মারছে, আম্মু সেই কথাগুলো এত অকপটে জানতে পারল কি করে? আচমকা পা গুটিয়ে আম্মুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল ইরাজ। আনতারার বুকটা ভিজে ওঠে। ইরাজ বেশ কিছুক্ষণ পর বলল, “আমি তো কোনদিন প্রকাশ করিনি আমার ভালোবাসা, আম্মু! তাই হয়ত, মেঘ বুঝতে
পারেনি!ʼʼ

আনতারা খানম মলিন হাসলেন, “এতদিন তুই যেভাবে, মিষ্টি শাসনে আগলে রেখেছিল ওকে, অন্য মেয়ে হলে, তোর মায়ায় জড়িয়ে তোর প্রেমে পাগলি হয়ে যেত। সব কথাই কি মুখে স্বীকার করতে হয়, রাজ! অন্তত, ভালোবাসা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষনা করে বেড়ানোর কিছু নয়। এ অনুভূতি বড়োই গোপন, আর তীব্র।ʼʼ

“ও বুঝতে পারেনি, ওর এই সরলতাই তো বড়ো টানত আমায়, আম্মু!ʼʼ

“তোর আর সাফাই গাইতে হবে না ওর হয়ে। তোর পাহাড়ের সম উচ্চ ভালোবাসা বুঝতে পারল না, আর ওই লম্পটের মিথ্যে ভালোবাসায় তার হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। হাহ!ʼʼ— তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন আনতারা।

ইরাজ আর কী বলবে এ কথার পরিপেক্ষিতে। আম্মা যে ওর বুকের সবটুকু জ্বালা মুখস্ত করে বসে আছে! তড়াক করে উঠে বসল। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা দিল বাইরের দিকে। আনতারা খানম কেবল বিষন্ন মুখে পেছনে চেয়ে দেখলেন বিক্ষিপ্ত, অশান্ত হয়ে ওঠা ইরাজের অগোছালো পদচারনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জায়নামাজ উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ইরাজ আম্মুর রুম থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বুকটা ভার লাগছে। বিষাদ ঘিরে ধরেছে চক্রাকারে। কোনভাবেই এখন রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। ধীর পায়ে হেলেদুলে হেঁটে বসার রুমে প্রবেশ করল। সেখানে সোফার পেছন থেকে দুটো বোতল দুহাতে বের করে নিয়ে ছাদের দিকে চলে গেল। এখন ইচ্ছে মতো গলায় ঢাললে, এই নেশা হয়ত ভুলিয়ে রাখবে বুকের ক্ষত-বিক্ষত হয়ে থাকা ঘা গুলোর যন্ত্রনা!

আনতারা বিছানায় গিয়ে ঘুমোতে অগ্রসর হলে, ইমতিয়াজ সাহেব বলে উঠলেন, “এক গ্লাস পানি ঢেলে দাও তো!ʼʼ

আনতারা চমকে উঠলেন, তাহলে কী ইমতিয়াজ সাহেব ঘুমাননি! তিনি চমকিত চিত্তেই গ্লাসে পানি ঢালতে ব্যস্ত হলেন। ইমতিয়াজ সাহেবের গলাটা কেমন যেন লাগল শুনতে! তিনি মা-ছেলের কথা সব শুনেছেন এতক্ষণে!

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৭.

রেজাল্ট শিট হাতে নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে মেঘালয়া সেদিকে। কিছুক্ষণ আগে ইরাজ মার্কশিট তুলে এনে হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকেছে হাত-মুখ ধুতে। মেঘালয়াকে দেখতে কেমন প্রাণহীন, জড়ো পদার্থের মতো লাগছে। যেন ভেতরে অনুভূতির বড়ো অভাব। মাথাটা ঝুঁকিয়ে চেয়ে আছে রেজাল্ট শিটটির দিকে। ইরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মেঘালয়াকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ডাকল, “মেঘ!ʼʼ

মেঘালয়ার পক্ষ থেকে জবাব নেই। অনিমেষ চেয়ে আছে সেই কাগজটির পানে। ইরাজ পা ফেলে বেরিয়ে যেতে অগ্রসর হয়ে আবার পা ঘুরিয়ে বিরক্ত হয়ে এসে বসল সোফার সামনে থাকা কাউচের ওপর। তখনই মেঘালয়ার চোখ থেকে টুপ করে একফোটা পানি সেই কাগজে পড়ে। ইরাজের ভেতরে আচমকা যেন এই দৃশ্য এক অদ্ভুত ধাক্কা মারল। মুচরে উঠল ভেতরে। কেঁড়ে নেওয়ার মতো কাগজটি হাত থেকে নিয়ে নিলো। মেঘালয়া ছেড়ে দেয় আস্তে করে। ইরাজ দেখেই এসেছে রেজাল্ট, আবারও কৃত্রিম ব্যস্ততা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল কাগজটি। অতঃপর নিজের স্বভাবসুলভ কঠিন ভাব ধরে রাখতে মৃদূ ধমক দেওয়ার মতো করে বলল,

“মেয়ে মানুষ ঢং ছাড়া আর কিছু জানেনা? এমন ভাব করছিস যেন, সাড়ে চার সাবজেক্টে ফেইল। ৪.৯৪ জিপিএ তে পাশ করেছিস। এভাবে শোক পালনের কি আছে?ʼʼ

মেঘালয়া এবার মুখ তুলে চাইল। ইরাজের বুকটা আবারও ধুক করে ওঠে। মেঘালয়ার চির পরিচিত চঞ্চল চোখদুটো আজ বিষাদের জলে টলমলে। গাল গড়িয়ে পানি বেয়ে পড়ল এবার। ভাঙা গলায় বাচ্ছাদের মতো অভিযোগ করে নিজের বিরুদ্ধেই মেঘালয়া, “A+ তো আসেনি। আব্বুর সামনে এবার দাড়াব কি করে?ʼʼ

কান্নায় ভেঙে পড়ল মেঘালয়া। ইরাজের কেমন অস্থির লাগছে। চেয়েও আজ আর মুখ ফিরিয়ে নিতে পারল না মেঘালয়ার থেকে। ইরাজের কি যেন হয়ে গেল। হুট করে উঠে এসে মেঘালয়ার পাশে বসল। নরম স্বরে বলল, “পাগলি! তুই তো গুচ্ছতে পড়তে চাস। আর এস এস সি এর জিপিএ ফাইভ আছে তো। অনায়েসে চান্স হয়ে যাবে।ʼʼ

মেঘালয়ার নাকের ডগা লাল হয়ে উঠেছে। ইরাজের এমন কণ্ঠস্বর তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল। চোখ মেলে তাকাল ইরাজের দিকে। থুতনির কাছে প্রতিক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার। ইরাজ সেদিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসল মৃদূ। অতঃপর বলল, “আঙ্কেল আসছে। বাপের সামনে এভাবে যাবি? আর তোর বাপ তোর অবস্থা দেখে আমাকে কেলিয়ে যাবে।ʼʼ

মেঘালয়া চমকে উঠে, আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ল। আব্বু আসছে, না জানি রেজাল্ট দেখে কত কষ্ট পাবে! আব্বুর সামনে যাবে কি করে মেঘালয়া! তা বুঝে ইরাজ আশ্বস্ত করে বলে, “রিল্যাক্স! তোর বাপ জানে। আমি তাকে সঙ্গে নিয়েই গিয়েছিলাম মার্কশিট তুলতে। চরম খুশি সে, মিষ্টি নিয়ে যখন তখন এসে পৌঁছাবে। তাড়াতাড়ি মুখে-চোখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেস হ।ʼʼ

মেঘালয়া উঠল না। থম মেরে বসে রইল। ইরাজ মার্কশিটের দিকে চেয়ে বলল, “কি ভাবছিস?ʼʼ

মেঘালয়া শুনতে পায়নি বোধহয়। ইরাজ আবারও কিছু বলতে যাবে, তখনই মেঘালয়া জবাব দেয়, “আমি বড়ো ভুল করে ফেলেছি জীবনে। নিজের কাছে নিজের ক্ষমা নেই। সকলে কি করে মেনে নেবে আমায়?ʼʼ— ব্যর্থতা প্রকাশ পায় মেঘালয়ার কথায়।

ইরাজ বুক ফুলিয়ে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিলো। নিচের দিকে একটু ঝুঁকে বসে, হাতের কাগজটি সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল, নিজের হাতঘড়ি চাপা দিয়ে। এরপর বলল,

“এরকম ভুল তোর বয়সে সকলেই করে। তবে তুই ঠিক ভুল করিসনি, করেছিস বোকামি। যেখানে কোন অনুভূতি নেই, সেখানে রিলেশনশিপে চলে গেলি? শখ করে? নিতান্তই নির্বোধ তুই, যে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারে না। শুধুমাত্র নিজেকে প্রমান করতে, জটিল কোন মায়া, অনুভূতি ছাড়াই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলি?ʼʼ— ইরাজের কথায় অস্পষ্ট তাচ্ছিল্য।

মেঘালয়া আজ আবারও অবাক হয় ইরাজের পাল্টি খাওয়া আচরণে। এভাবে তো কোনদিন বুঝিয়ে বলেনি, করেছে শুধু তিরস্কার। হঠাৎ-ই কিছু মনে পড়তেই এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে মলিন হাসল, “আর আপনি সবটা জানা সত্ত্বেও তা চলতে দিলেন!ʼʼ

ইরাজ কোন জবাব দিল না। আচমকা এ কথায় তার মুখটা কেমন কঠিন হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল। মেঘালয়াকে আবারও তাড়া দিল, “নিজেকে সামলে ফ্রেস হয়ে আয়।ʼʼ


হেলাল সাহেব এলেন দুপুরের দিকে। তার দুহাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট। আজ তিনি ইমতিয়াজ সাহেবের বাড়ি বন্ধু হিসেবে নয়, এসেছেন বেয়ান হিসেবে । এটা ভেবে যেমন উত্তেজনা কাজ করছে, তেমন একটু অপ্রস্তুত বোধও ঘিরে ধরছে তাকে। আর তা প্রায় সম্পূর্ণটাই আনতারা খানমকে ঘিরেই বোধহয়। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করার সময় একটু সংকোচ কাজ করল। আবার আজব অনুভূতিও হচ্ছে, তিনি তার ছোট্রো পরীর শশুরবাড়ি এসেছেন। এই তো কিছুদিন আগেও মেঘালয়া আব্বুর হাত ধরে শুক্রবার হলেই সন্ধ্যার পর ফুসকা খেতে যেত। রাত-বিরাত আবদার করত, “চলো কোথাও বসে আইসক্রিম খেয়ে আসি, আব্বু! এবার আবার না কোরো না যেন! চলো যাই।ʼʼ

তিনি নিয়ে যেতে না পারলে, ইরাজকে কল করতেন। ইরাজকে রাজী করাতে আবার আরেক খাটুনি হতো। ইরাজ তো জন্মের ঘাঁড় ত্যাড়া।

এসব ভাবতে ভাবতে ঢুকলেন ভেতরে। প্রথমেই দেখা হলো আনতারা খামনের সঙ্গে। ওখানেই বুকটা একটু ধুক করে উঠল, হেলাল সাহেবের। তবুও সাহস করে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “আসসালামুআলাইকুম, ভাবীজান! কেমন আছেন?ʼʼ

আনতারা খানম নিরস মুখে কেবল সালামের জবাবই দিলেন, এরপর নিজেকে কাজে মস্ত ব্যস্ত দেখানোর চেষ্টা করলেন। মেঘালয়া বোধহয় শুনেছে আব্বুর কণ্ঠস্বর। লাফিয়ে নেমে আসল সিঁড়ি বেয়ে। একদৌড়ে এসে আব্বুর বুকে। হেলাল সাহেব কোনমতো মিষ্টির প্যাকেট নামিয়ে রেখে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। এতক্ষণ মেঘালয়ার আব্বুকে নিয়ে বহু সংকোচ থাকলেও, এতদিন পর আব্বুকে এত কাছে পেয়ে সেসব ভুলে বসল একদম। ইমতিয়াজ সাহেব অফিসে এখন। মেঘালয়া টেনে নিয়ে গিয়ে আব্বুকে বসার ঘরের সোফাতে বসাল। হেলাল সাহেব মেয়ের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করছেন কিছু। এক পর্যায়ে মনে হলো, মেঘালয়া খারাপ নেই। তবে বাবার চোখ তো, মেঘালয়ার চোখের নিচের বসে যাওয়া অংশ বহু কথা বলে যায় বাবার কানে কানে।

বেশ কিছুক্ষণ পর কথায় কথায় মেঘালয়া আব্বুর কাছে আক্ষেপ প্রকাশ করে, “আব্বু! আমি ভুল করেছি, প্রতিনিয়ত তার শাস্তিও পাচ্ছি। আজ দেখো না আমার রেজাল্টের হাল। তবুও বলো তো, ভুলটা কি এতটাও বড়ো ছিল, যতটা মাশুল আমি দিয়েছি?ʼʼ

হেলাল সাহেব তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ মেয়ের মুখের দিকে। আজকাল সেই ছোট্রো মেঘালয়া বেশ ভারী ভারী কথা বলতে শিখেছে। হেলাল সাহেব ছোট্রো একটা শ্বাস নিয়ে বললেন, “ভুল কম, বোকামি বেশি করেছ তুমি।ʼʼ

মেঘালয়া ঘাঁড় নাড়ল, “হুম, আজ উনিও তাই বলল।ʼʼ

মেয়ের কথায় হাসলেন হেলাল সাহেব। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে, “বোকামিটা কি ছিল আব্বু!ʼʼ

“তুই নিজেই বুঝবি, মেঘা! বোঝার চেষ্টা করলে।ʼʼ

আব্বুর গলাটা বড়ো আদুরে লাগল এবার। মেঘালয়া ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল আব্বুর হাসি হাসি মুখের দিকে।


রাত এগারোটার দিকে রুমে আসল মেঘালয়া। আব্বুকে বিদায় দিয়ে তবে ফিরেছে রুমে। সারাটাদিন আব্বুকে কাছে পেয়ে যতটা ফুরফুরে লাগছিল মেজাজটা, এখন ঠিক ততটাই বিষন্নতা আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরছে ওকে। সন্ধ্যার দিকে ইমতিয়াজ সাহেব বাড়ি ফিরেছেন, তখন থেকে আলোচনা চলেছে, সবার মাঝে। একান্তে আর আলাপ করার সুযোগ পায়নি মেঘালয়া। আনতারা খানম পুরোটা দিন কেবল নিজের দ্বায়ভার পালন করেছেন, বেশি একটুও কিছু না। রাতের খাবার সকলে মিলে একসঙ্গে খেয়ে, তারপর হেলাল সাহেবকে পৌছে দিতে গেছে ইরাজ। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে বাইরে। আজ মেঘালয়া ভেতরটা হালকা হয়েছে এটা বুঝে, যে আব্বুর আর কোন ক্ষোভ নেই তার প্রতি।

সে মুখ-চোখে হালকা পানি ছিটিয়ে ধীর পায়ে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। মস্তিষ্ক ভাবার জন্য একান্ত সময় পেয়ে, প্রথমেই ভাবনায় নিয়ে এলো, রেজাল্টের কথা। ভারী নিঃশ্বাস ফেলল মেঘালয়া। দিন শেষে মানতেই হবে, বাপ তো বাপই। বাপ-মায়ের বাঁধা নিষেধ সাময়িকভাবে খারাপ লাগার হলেও, তা একদিন এটা প্রমান করে ছাড়ে, বা-মা কখনও সন্তানের খারাপের জন্য কিছু করে না। তারা গুরুজন, তাদের চিন্তা-ভাবনা সর্বদা অগ্রগামী। তারা অবশ্যই সন্তানের চেয়ে ভালো বোঝেন জীবন সম্বন্ধে! মেঘালয়াও আজ বোঝে, সে যতদিন আব্বুর ছায়াতলে ছিল, সে জীবনের সেরা সময় কাটিয়েছে। যখনই নিজে সিদ্ধান্ত নিতে সচেষ্ট হয়েছে, জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরু ঠিক ওখান থেকেই।

আচমকা ইরাজের কথা মাথায় এলো। অতীতের ভাবনায় মজে গেল সে।

ইরাজ কখনও তাকে সেভাবে বুঝতে দেয়নি তার ভেতরে লুকানো অনুভূতি। তবে আব্বুর পরেই মেঘালয়াকে আগলে রাখার জায়গা ইরাজের শাসনই তো ছিল! তখন ইরাজকে বড়ো বিরক্ত লাগত মেঘালয়ার। সবকিছুতে বাঁধা! এটা করবি না, সেটা করতে পারবি না, ওখানে যাবি না, এভাবে চলতে হবে। ইরাজকে নিজের চারপাশে কারাগারের শিকলের মতো লাগত।

ইরাজ মাস্টার্স কমপ্লিট করে ফিরে আসল বাড়িতে। এসে, টুকটাক বাবার ব্যবসায় মনোযোগ দিল। তার কোনকালেই ইন্টারেস্ট নেই চাকরির প্রতি। যেখানে নিজের বাপের ব্যবসা আছে, চাকরির প্রয়োজন মোটেই নেই। তখন মেঘালয়া সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এসময় ইরাজ নিয়ম করে, মেঘালয়ার কলেজে যাতায়াত করত। চোখে-চোখে রাখা, বাড়ি পৌঁছে দেওয়া, পরিচিত গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া, কখনও কখনও নিজে না উপস্থিত হতে পারলে লোক পাঠাত। এই ব্যাপারগুলো চরম বিরক্ত লাগলেও মেঘালয়া আব্বুর জন্য, আর ইরাজকে ভয় পাওয়ার কারনে চুপচাপ মেনে নিত।

কিন্ত মেনে নেয় নি আর এক পর্যায়ে। যখন তাবিরের প্রপোজাল সে এক্সেপ্ট করল, তারপর থেকে ইরাজের এই চোখে চোখে রাখার ব্যাপারটা মেঘালয়ার কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। একদিন সাহস করে ইরাজকে বলেই দিয়েছিল,

“আপনি আর আসবেন না আমার কলেজে। আমি অনাথ নই। আমার আব্বু স্বয়ং জীবিত। আপনি এভাবে আমার পেছনে বডিগার্ডের মতো লেগে থাকেন, তা নিয়ে পুরো কলেজে আমাকে বেবী গার্ল, ম্যানিকুইন, বার্বিডল বিভিন্ন নামে ক্ষেপানো হয়। আমি ছোটো বাচ্ছা নই আর, চলতে পারি একা।ʼʼ

আসলে তাকে কেউ ক্ষেপাতো না, বরং তাবির এরকম বিভিন্নভাবে মেঘালয়াকে ভড়কেছে। ইরাজকে স্বপ্নেও আর এরপর থেকে কোনদিন কলেজের আশেপাশে দেখতে পাওয়া যায়নি। এমনকি তারপর একেবারে দেখাও হয়েছিল সেই চট্রগ্রামে। এর মাঝে আর ইরাজ কোনদিন মেঘালয়ার সম্মুখে আসেনি।

মেঘালয়া আব্বুর কাছেও এসে অভিযোগ করেছিল ঠিক একইভাবে। মেঘালয়ার আদুরে মুখের কথা হেলাল সাহেব ফেলতে পারেন নি। তিনি কল্পনাতেও আনেন নি তার অগোচরে এমন কিছু ঘটিয়ে চলেছে মেঘালয়া। এরপর থেকে মেঘালয়া একাই যাতায়াত করত। তাবিরের কাছে নিজেকে স্বাধীন প্রমান করতে, সমাজের আর সব মেয়েদের মতো চাল-চলন আয়ত্ব করে ফেলেছিল প্রায়।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে