অমানিশায় সেই তুমিই পর্ব-১৪+১৫

0
1050

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৪.

ঘন্টাখানেকের মতো পড়ার পর মেঘালয়াকে অলসতা ঘিরে ধরল। কিন্ত ইরাজকে বলতে চেয়েও পারছে না, যে আর পড়তে ভালো লাগছে না। উশখুশ করতে লাগল কেমন। ইরাজ তা লক্ষ্য করে বলল, “এই মনোযোগ নিয়ে আবার পড়ব পড়ব ঢোল পিটিয়ে বেড়াস?ʼʼ

মেঘালয়া অসহায় মুখে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, “আপনি ভালো আচরণ শিখেন নি?ʼʼ

“ওই অধ্যায় যখন পড়াচ্ছিল, আমি ক্লাসের বাইরে
ছিলাম।ʼʼ

মেঘালয়া এমন একটা ভবঘুরে মার্কা জবাব শুনে অতিষ্ট ভঙ্গিতে মাথা দুলাল। ইরাজ জিজ্ঞেস করে, “কোথায় ভর্তি হওয়ার জন্য লাফাচ্ছিস?ʼʼ

মেঘালয়া শান্ত নজরে তাকাল। একটু ইতস্তত করে বলল,
“লাফালেই তো আর হয়ে যাবে না!ʼʼ

“এ কথাটা মস্তিষ্কের যে অংশ দিয়ে এখন ভাবছিস, আগে তা ব্যাংকে জমা রেখে এসেছিলি?ʼʼ

মেঘালয়া কটমট করে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল, “ক্যাকটাস!ʼʼ

ইরাজ কথাটা শুনতে পেয়েছে কি-না তা বোঝার উপায় নেই, তবে বলে উঠল, “গালি দিলে ভালো জাতের গালি দিবি, এসব আওলা-ঝাওলা গালিতে এলার্জি আছে আমার।ʼʼ

ইরাজের কথায় মেঘালয়া মুখ বিকৃত করে তাকাল। আজব মানুষ তো! গালিতে এলার্জি! আর গালি আবার ভালো মানের.. মানে কোন গালি ভালো মানের? গালির কি কোন ব্রান্ড আছে? নিজের ভাবনাতে বিরক্ত হয়ে মাথা ঝাঁকাল।
শান্ত একটা শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন পড়তেন?ʼʼ

“শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।ʼʼ

মেঘালয়া আশা করেনি ইরাজ সোজা জবাব দেবে। তবে ওকে অবাক করে দিয়ে হয়ত এই প্রথম ইরাজ সোজা উত্তর দিয়েছে। মেঘালয়া আবার জিজ্ঞেস করল, “এটা গুচ্ছতে না?ʼʼ

“হু।ʼʼ

মেঘালয়া উৎসাহিত হয়ে বলে, “তাহলে আমিও গুচ্ছরই কোন ভার্সিটিতে পড়ব। আপনি কি এডমিশনের সময় খুব বেশি পড়তেন?ʼʼ

ইরাজ এবার অপ্রস্তত বোধ করল। ওর অনিয়মিত লেখাপড়া কাউকে অনুপ্রাণিত করার বদলে ফেইল করিয়ে বসিয়ে রাখবে হয়ত। ও নিজে মানিয়ে নিতে পারত ওর নিজের বেপরোয়া চলনের সঙ্গে। কিন্ত আর কাউকে তা দ্বারা অনুপ্রাণিত অন্তত করা যায় না। ভাগ্য আর টুকটাক পরিশ্রমে সাস্টে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। বলল,

“প্রশ্ন কম কর। পারলে বেশি করে পড়। এমনিতেও তোর বাপ জেলার বাইরে যেতে দেবে না।ʼʼ

মেঘালয়া জিজ্ঞেস করল, “ আমাদের যশোরে কি গুচ্ছর বিশ্ববিদ্যালয় আছে?ʼʼ

ইরাজ বিরক্ত হয়ে বলে, “যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তির নাম শুনিস নি?ʼʼ

মেঘালয়া চুপ করে রইল। মনে মনে ঠিক করল, সে ওখানেই পরীক্ষা দেবে। হওয়া না হওয়া উপরওয়ালার হাতে। বই, খাতা গুছিয়ে রাখতে রাখতে হঠাৎ-ই মাথায় এলো– ইরাজ কথাগুলো বেশ সহজভাবেই বলেছে। এভাবে বিয়ের পর আজ অবধি কথা হয়নি। হাত থেমে গেল ওর। কিছু প্রশ্ন এসে ভিড় করল মনে। কিছুটা সময় নিলো প্রশ্ন করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে আস্তে করে বলল, “আমার জন্য তাবিরের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, এটাই কি কেবল আমার প্রতি ক্ষোভের কারন আপনার?ʼʼ

ইরাজ উত্তর দিল না বরং নিরবে উঠে দাঁড়াল। এখনও খানিকটা দুর্বলতা আছেই শরীরে। তবুও উঠে দাঁড়িয়ে টি-টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটি হাতে উঠিয়ে নিলো। সোজা হেঁটে বেলকনির দিকে চলে গেল। মেঘালয়ার ভেতরে জিদ চেপে বসে। বইগুলো উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে সোফার টেবিলের ওপর রেখে সেও বেলকনিতে গিয়ে ইরাজের পাশে দাঁড়ায়।

সন্ধ্যার পর অল্প খানিকটা সময় পেরিয়েছে। আকাশ সম্পূর্ণরূপে আঁধারে ঢেকে যায় নি এখনও। পরিবেশ মনোমুগ্ধকর। ইরাজ পকেট হাতরে লাইটার খুঁজল। পেল না। মেজাজ খারাপ হলো প্রচণ্ড।

“মেঘ, লাইটার এনে দে রুম থেকে।ʼʼ

“আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চলে এসেছেন আপনি।ʼʼ

“তারপর?ʼʼ

“এখন জবাব দিন।ʼʼ

“লাইটার’টা এনে দে।ʼʼ

ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মেঘালয়া, “আমার প্রশ্নের জবাব দিন, কথা কাটবেন না।ʼʼ

ইরাজ তাকাল উত্তেজিত মেঘালয়ার দিকে, চোখে চোখ মিলিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, বলল, “আর যদি না দিই?ʼʼ

মেঘালয়ার চোখে-মুখে আক্রোশ ফুটে ওঠে, “আর কতদিন লুকোচুরি খেলবেন। চাপা কথাগুলো খুলে প্রকাশ করার সৎ সাহসটুকু নেই আপনার ভেতরে?ʼʼ

ইরাজ মেঘালয়ার কথায় আবারও হাসল, “আরে! এত উত্তেজনা, আমাকে জানার? অতি উত্তেজনা হানিকারক। শান্ত হ।ʼʼ

মেঘালয়া চোখ বুঁজে জোরে জোরে শ্বাস নেয়, ঠোঁট জিহ্বা দ্বারা ভিজিয়ে নিলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল, “আমার অপরাধটা কি আপনার কাছে? আপনার কি মনে হয়? আপনার চোখের অবহেলা গুলো বুঝি না আমি? বিয়ের পর থেকে আজ অবধি প্রতি মুহুর্তে যে পরিমাণ লাঞ্ছনা আমি গিলে ফেলেছি ভেতরে, নিতান্তই এক আত্মমর্যাদাহীন আবর্জনাতে পরিণত হয়েছি নিজের কাছে। তবুও প্রতি মুহুর্তে নিজেকে সান্তনা দিয়ে যাচ্ছি, আমার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত এগুলো। তবে আজকাল কি মনে হয় জানেন, আমার ভুলের চেয়ে, মাশুল আমি অনেক গুন বেশি গুনে ফেলেছি। আমি ভুল যত বড়ো না করেছিলাম, আপনারা সকলে মিলে শাস্তি তার চেয়ে অনেকাংশ বেশি দিয়ে ফেলেছেন। এবার নাহয় জবাব দিন।ʼʼ

ইরাজ আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়ে শুনল মেঘালয়ার অভিযোগী ক্ষোভগুলো। হালকা হাসল। আস্তে আস্তে হাসি মিলিয়ে গিয়ে মুখটা বড্ড হিংস্র হয়ে উঠল। দাঁতে দাঁত পিষে মেঘালয়ার দিকে তাকায়, “শাস্তি তুই দিস নি, আমায়? যখন শুনেছিলাম বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিস অন্য কারো সঙ্গে, এবং তোকে উদ্ধারও আমার করতে যেতে হবে, তোকে ত্যাগ করেছি সেই মুহূর্তে। আর এতদিনের জমানো মসৃণ অনুভূতিতে ত্যাগের ধারাল আঘাত আমায় যা ক্ষত-বিক্ষত করেছিল, তার দাগগুলো আজও থকথকে ঘা হয়ে রয়ে গেছে ভেতরে। প্রতিক্ষণে জ্বলে পুড়ে যায়,
র ক্তা ক্ত হয়ে ওঠে বুকটা। তোকে দেখলেও সেই ক্ষততে খোঁচা লাগে। সেই তুই আমার তো হয়েছিস, তবে আমার অনুভূতিকে ছিন্নভিন্ন করার পর। তুই যতক্ষন চোখের সামনে থাকিস না, বুকের জ্বালা দমে থাকে। সামনে আসলে ধিক-ধিক করে জ্বলে ওঠে।ʼʼ

কথাগুলো বলে আচমকা শান্ত হয়ে উঠল ইরাজ। পরক্ষণে মুহূর্তে অদ্ভুত হেসে, শ্লেষের সঙ্গে বলল, “তুই তো ভুল করে মাশুল গুনছিস। আমি কিসের উত্তাপে পুড়ে ম রছি প্রতিক্ষণে? কারো প্রতি মায়া জন্মে যাওয়ার অপরাধে? সেই মায়াকে নিজ হাতে দাফন করেছি আমি। যা আর কোনদিন উতলে উঠবে না।ʼʼ শেষের কথাগুলোতে তীব্র ঘৃনা প্রকাশ পেল ইরাজের কণ্ঠে।

মেঘালয়া তাকিয়ে রইল কেবল, জবাব দিল না। ইরাজ এবার ঠোঁটটা আরও খানিকটা প্রসারিত করে হাসল। হাসির মাঝে কতশত লুকায়িত যন্ত্রনা ঝরে পড়ছে যেন!

মেঘালয়াও খোলা আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে অদ্ভুত গলায়, অবাঞ্ছিত এক প্রশ্ন করে বসল , “ভালোবাসেন, বলতে পারেন নি কেন?ʼʼ

ইরাজ যেন অবাক হলো না এমন একটা প্রশ্নেও। মৃদূ হেসে বলল, “যতদিনে বলব, তার আগেই দেখলাম আমার মেঘের বর্ষনে অন্য কেউ ভিজে উঠেছে। তারপর থেকে আর কোনদিন নিজের কাছেও স্বীকার করিনি– ওই মূর্খ মেঘকে আমি কোনদিন ভালোবেসেছি।ʼʼ

মেঘালয়া টলমলে চোখে ঘুরে তাকাল ইরাজের দিকে। চোখের পানিকে ছাপিয়ে ঠোঁটে হাসল, “অথচ সেই মূর্খতার পরিণাম হিসেবে মেঘকে পুড়াতে এত আয়োজন আপনার? এটাকে ভালোবাসা বলবেন আপনি? যেখানে ভালোবাসার চেয়ে ক্ষোভকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে? আপনার জিদ, অভিযোগ আর যন্ত্রনাগুলো আপনার কাছে এতটা প্রাধান্য পেয়েছে, আপনি সবটা ভুলিয়ে দিয়েছেন– মায়া, ভালোবাসা কিছুই অবশিষ্ট নেই।ʼʼ

ইরাজ শীতল কণ্ঠে বলল, “আমার ঘৃনা, ভালোবাসার চেয়ে বেশি সীমাহীন। আমার ত্যাগের ক্ষমতাকে এড়িয়ে চলা, যে কারো জন্য সাধ্যিহীন।ʼʼ

মেঘালয়া বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল, “ত্যাগ আপনার, সেই ত্যাগের তাপে ঝলসে গেছি আমি।ʼʼ

“সুখে ত্যাগ করিনি। একসময় ছুঁতে চাওয়ার মতো মনস্তাত্বিক অপরাধের দাম পরিশোধ করে, মূল্য চুকিয়ে তারপর ত্যাগ করেছি।ʼʼ

মেঘালয়া প্রশ্ন করে, “ত্যাগের মূল্য কি ছিল?ʼʼ

“মেঘকে আর এ জীবনে নিজের করে পেতে না চাওয়ার জিদ। অথচ শালার, ভাগ্যকে এড়িয়ে যেতে পারলাম কই।ʼʼ

মেঘালয়া হাসল। মুখে হাসি ঝুলিয়েই বলল, “আপনার প্রত্যেকটা কথা প্রমান করছে, ভালোবাসা কম, এ কাহিনিটা মূলত ঘৃনার। তাই পরবর্তিতে আর এই অনুভূতিকে ভালোবাসা বলে অপমান করবেন না।ʼʼ

তিরস্কারের মতো শোনায় যেন মেঘালয়ার কথাটা। একটু থেমে আবার বলল, “ সর্বস্থায় আমার ভুলগুলো সাথে ছিল। আর তাই ভুলগুলোকে বড্ড ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে এখন আমার। সকলে মিলে যখন আমায় শাস্তি দিতে ব্যস্ত ছিল, তখন ভুলগুলো ছাড়া আমার বলতে আর কিছুকে পাশে পাইনি।ʼʼ

আর দাঁড়াল না মেঘালয়া এক মুহূর্তও। রুমে চলে গেল বিষন্ন পা ফেলে। ইরাজ রয়ে যায় একা। আকাশের বুক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দৃষ্টিপাত করল– মেঘালয়া যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। আচমকা ভাবনায় এলো, সত্যিই কি ইরাজ ভালোবাসার চেয়ে যন্ত্রনাগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে? অভিযোগ গুলোকে ভালোবাসার মাঝখানে এনে, ভালোবাসাকে ক্ষয় করে ফেলেছে? নিজের ভাবনায় নিজেই পেচিয়ে যায় যেন! দোটানায় ডুবে গেল। মেঘালয়ার বলে যাওয়া কথাগুলো মস্তিষ্কে চক্রাকারে ঘুরতে থাকল। নিজেই নিজেকে বুঝাল, ইরাজ তো এমনই। তার যন্ত্রনাগুলো তার জন্য স্বরণীয়। তা সে ভুলতে চায় না, আর না চায় যন্ত্রনাদাতাকে মাফ করতে। ইরাজ শেখেনি এসব। সে বিশ্বাস করে, যে একবার ব্যাথার দিতে পারে, তার কাছে বারবার ব্যাথা প্রান্তির আশা রাখাই যায়। তাদের কোন ক্ষমা নেই ইরাজের কাছে।

নিজের ভাবনাগুলো, আর অনুভূতিতে ঠিক মেলাতে পারল না। ভেতরটা অশান্ত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। তড়িঘড়ি চারপাশে তাকাল। কিছু মনে পড়তেই পেছন ফিরে তাকাল। বেলকনির দেয়ালে ছোটো ছোট তাকের মতো কাঠ দ্বারা শো-পিছ রাখার ছোটো আসবাব বানানো হয়েছে। সেখানকার একটি তাকের মাঝে দিয়াশলাইয়ের বাক্স রাখা আছে।

সিগারেটে টান দিয়ে, ধোঁয়াটুকু মুখের ভেতরে চেপে রাখল কিছু সময়। ভেতটা অস্থির যন্ত্রনায় ঘিরে ধরছে ক্রমশ! ওপরে মুখ তুলে ধোঁয়ার কুন্ডলি ছাড়ল। তা এলোমেলো মেঘের মতো ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে। সেদিকে চেয়ে কেশে উঠল কয়েকবার। থামল না, সিগারেটটা আবারও মুখে পুড়ে নিলো। মনের অগোছালো ব্যথাগুলোকে শান্ত করতে সিগারেটের বিকল্প নেই; বলেই ধারণা ইরাজের!

চলবে..

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

১৫.

সকাল সকাল উঠে মেঘালয়া ফ্রেস হয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সকাল সাতটা বাজে ঘড়িতে। আজকে সূর্যের তেজ তুলনামূলক কম মনে হলো। এখনও তেমন ঝাঁজাল হয়ে ওঠেনি। সকালের নির্মল বাতাসে দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিলো মেঘালয়া। জীবনটাকে আজকাল একদম ভালো লাগে না তার। এই ছোট্র জীবনে কিছু দিনের ব্যবধানে তার সঙ্গে বহু তিক্ত ঘটনা ঘটে গেছে। যা ছিল তার জন্য সম্পূর্ণ ভাবনাতীত। একটা ভুল তাকে বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। সে মোটেই এত তাড়াতাড়ি এত বড়ো আর বুঝমতি হয়ে উঠতে চায়নি। তার সেই চঞ্চলতা, আহ্লাদ, আত্মমর্যাদাবোধ; সবই কেমন বাস্তবতার সংস্পর্শে জ্বলে ছাই হয়ে গেল। সে কতটা নিচু হয়ে উঠেছে সকলের চোখে। তাতে কি বিশেষ কোন লাভ হয়েছে! সে ভেবেছিল, এভাবে নিজের ভুলটা মেনে নিয়ে চুপ থাকলে হয়ত সকলের মন গলবে, তাকে সকলে আবারও গ্রহন করে নেবে।

ভুল এই ভাবনাটা ভেঙে দিয়েছে সকলে। সে এমনিতেও তাদের সম্মুখে খারাপ, আর ভালো হওয়ার চেষ্টাটাও করবে না। ইরাজের কথা মনে পড়ল। আপন মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল মেঘালয়া। ভালোবাসা! ইরাজ এটাকে ভালোবাসা বলে? যেখানে, তিক্ততা আর কিছুই নেই। মেঘালয়া নিজের জন্য কিছু করতে চায়। নিজেকে সে আত্মনির্ভর হিসেবে দেখতে চায়, যাতে সে প্রতিনিয়ত হাজারটা ভুল করে গেলেও কেউ যাতে তাকে নিচু চোখে দেখে, অবহেলা না করার সুযোগ পায়। সে করবে, আরো ভুল করবে, বারবার ভুল করবে। সে দেখতে চায় সকলে এবার কি করে?

ভয়ানক এক জিদের অঙ্গীকার করে বসল মেঘালয়া নিজের সঙ্গে। বারান্দা থেকে চলে এলো। রুম থেকে বেরোনোর সময় ভুলেও একবার তাকাল না বিছানায় শায়িত ঘুমন্ত ইরাজের দিকে। মুখভঙ্গি কঠিন তার, সেই বাচ্ছাসুলভ মেঘালয়াই যে এটা, তা চেনার উপায় নেই এই মেঘালয়াকে দেখে। রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল আস্তে করে। আনতারা খানম এখনও আসেন নি সেখানে। আয়েশা কাটাকুটি করছে। সে নিঃশব্দে রান্নাঘরে প্রবেশ করে ছোট একটি পাত্র হাতে নিলো। আয়েশা ব্যস্ত হয়ে বলে, “ভাবীমণি! আপনার কি লাগব, আমারে কন। আমি কইরে দিই।ʼʼ

মেঘালয়া গম্ভীর স্বরে জবাব দিল, “প্রয়োজন নেই। নিজের কাজ করুন, আমি করে নিচ্ছি।ʼʼ

আয়েশা আর কিছু বলতে পারল না। মেঘালয়া আপন মনে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিলো। তা কফিমগে ঢেলে ট্রেতে তুলে রান্নাঘর থেকে বের হবার মুহূর্তে আনতারা খানম আসলেন সেখানে। মেঘালয়া তাকাল না সেদিকে, নির্বিকার চিত্তে ট্রে নিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে। আনতারা খানম লক্ষ্য করলেন, মেঘালয়ার মুখে স্পষ্ট তিক্ততা।

মেঘালয়া ইমতিয়াজ সাহেবের রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়াল ইমতিয়াজ সাহেবের সম্মুখে। তিনি বসে আছেন ল্যাপটপ কোলে। পাশেই খবরের কাগজ। হয়ত খবরের কাগজওয়ালা মাত্রই দিয়ে গেছে, তা ওভাবেই পাশে রেখে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছেন তিনি। মেঘালয়ার উপস্থিতিতে চমকে তাকালেন সেদিকে। ওকে দেখেই সুন্দর এক হাসি দিয়ে বললেন, “আরে আম্মাজান যে! এত সকালে ঘুম ভেঙেছে আজ, ব্যাপার কি? প্রতিদিন তো দেখাই পাই না।ʼʼ

মেঘালয়া চমৎকার হাসল, “আজ থেকে পাবে। নাও তোমার কফি।ʼʼ

কফির মগ হাতে তুলে দিল মেঘালয়া। তা হাসিমুখে নিলেন ইমতিয়াজ সাহেব। কফিতে চুমুক দিতে দিতে ইশারা করলেন মেঘালয়াকে সামনের মোড়ায় বসতে।

“শরীর কেমন যাচ্ছে তোমার, বাবাই!ʼʼ

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই যাচ্ছে রে, মা। তবে একটুতেই খুব ক্লান্ত হয়ে উঠি আজকাল বুঝলি! আমার বাঁদর কি করছে? নিশ্চয়ই চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। তার হাতে কাজবাজ দিয়ে যে নাতি-নাতনি নিয়ে অবসরে যাব; তা আর হয়ে উঠছে না বলেই আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।ʼʼ —শেষের কথাটা বেশ ঢং করে বললেন ইমতিয়াজ সাহেব।

মেঘালয়া মাথা নত করে হাসল। ইমতিয়াজ সাহেব যে, কথার মাঝে নাতি-নাতনির ইঙ্গিত দিলেন, তা বুঝেই মূলত মেঘালয়ার এই অদ্ভুত হাসি। প্রসঙ্গ বদলাতে বলল,

“আব্বু কেমন আছে, বাবাই!ʼʼ

“তোর আব্বু আজকাল খুব অলস হয়ে গেছে রে! আমি তার জন্য অপেক্ষায়, তৃষ্ণার্ত প্রেমিকের মতো বিরহে ডুবে মরি, তার পাত্তা নেই। কল দিলে বলে, আজ একা চালিয়ে নে, পরে টরে দেখব।ʼʼ

মেঘালয়া এমন একটা কথা শুনে চোখ বড়ো-বড়ো করে তাকাল। তা দেখে ইমতিয়াজ সাহেব শব্দ করে হাসলেন। বললেন, “তোরাই শুধু পারিস? আমি আর হেলাল বয়সকালে কত মেয়ের ব্যাগের খাবার চুরি করে খেয়েছি। কত মেয়ের গায়ে ব্যাঙ ছুঁড়ে দে ছুট। সে মেয়ে ব্যাঙ দেখে পালাবে নাকি আমাদের তাড়া করবে।ʼʼ

এ পর্যায়ে মেঘালয়ার হাসতে হাসতে দম বন্ধ অবস্থা। ইমতিয়াজ সাহেব মুগ্ধ হয়ে দেখলেন, মনে হলো, সেই ছোট্র মেঘালয়া খিলখিলিয়ে হাসছে যেন! আস্তে করে বললেন, “মাশা-আল্লাহ!ʼʼ

তা বোধহয় কানে গেল মেঘালয়ার। হাসি থামিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল। ইমতিয়াজ সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, “থামলি কেন, মেঘা! কতদিন পর তোর খিলখিল হাসির রব শুনলাম। হাসতে ভুলিস না, মা। হাসিই তো একমাত্র বস্ত; যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে অমর করে। যে হাসতে ভুলে যায়, সে তো দুনিয়া থেকে মুছে যায় রে, মেঘা!ʼʼ

মেঘালয়া চোখটা কি সিক্ত হয়ে উঠল না! সে দ্রুত মাথা নত করে নিলো। ইমতিয়াজ সাহেব আদুরে গলায় বললেন, “তোর মামনি যা বলে ওসব ধরিস না। ও এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। সংসার জীবন এমনই হয় বুঝলি! একটু টানপোড়েন না থাকলে যে তাকে সংসারধর্ম বলা যায় না। একটু মানিয়ে নিয়ে চল, সৃষ্টিকর্তা কোন কষ্টই তার সৃষ্টিকে বেশিদিন ভুগতে দেন না।ʼʼ

মেঘালয়ার চোখ থেকে এক ফোঁটা তরল টপ করে পড়ল কোলের ওপর রাখা হাতের কব্জির ওপর। ইমতিয়াজ সাহেব এগিয়ে এসে মাথায় হাত দিলেন। মুখটা উচু করে ধরতেই ভেসে উঠল, মেঘালয়ার অশ্রুসজল মুখটা। বুকটা ভার হয়ে উঠল। যত্ন করে নিজের হাতে চোখের জল মুছে দিলেন তিনি। মেঘালয়া যেন আরও সায় পেয়ে গেল। ডুকরে কেঁদে উঠল আবারও। এবার একহাতে আগলে নিলেন ইমতিয়াজ সাহেব মেঘালয়াকে। অপর হাত মেঘালয়ার মাথায় রেখে বিলি কাটতে কাটতে বললেন,

“কি হয়েছে রে পাগলি! আব্বুর কথা মনে পড়ছে? যাবি? নিয়ে যাব!ʼʼ

মেঘালয়া মুখ তুলে চাইল, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, “বাবাই! আমি যে ভুলটা করেছিলাম, তার শাস্তি ফুরোচ্ছে না কেন? আর কত সহ্য করলে এই ভুল আমার পিছু ছাড়বে বলো তো?ʼʼ

ইমতিয়াজ সাহেব মৃদূ হাসলেন, “বোকা মেয়ে! কে বলেছে এসব ভুলের শাস্তি? তুই যা করেছিস, তোর বয়সে মানুষ তার চেয়ে বড়ো বড়ো ভুল এমনকি পাপ করে বসে। তোর সঙ্গে যা হচ্ছে তাকে ভুলের শাস্তি ভাবছিস, নিজের বোকামিতে। জীবনে এমন অনেক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়, যার জন্য কোন ভুলের প্রয়োজন হয় না। জীবন বড়োই বৈচিত্র্য রে মা! জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায় না, আর না যায় পরিকল্পনামাফিক পরিচালনা করা। বরং জীবন আমাদের যেভাবে পরিচালনা করে; সেভাবে চলা ছাড়া উপায় থাকে না। হেলাল তোকে বড়ো আহ্লাদে মানুষ করেছে, দুনিয়ার জটিলতা থেকে বাঁচিয়ে নিজের কাছে আগলে রেখেছিল, তাই এসব নতুন মনে হচ্ছে। অথচ সকলের জীবনেই এমন টানপোড়েন রয়েই যায় আজীবন; সেখানে ভুলের প্রয়োজন নেই।ʼʼ

কথাগুলো শুনতে শুনতে মেঘালয়ার ভেতরে অদ্ভুত এক সান্তনা চলে এলো। তবে ইমতিয়াজ সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বড়ো মায়া অনুভূত হলো। মানুষটা আসলেই অমায়িক। এও যে বাপ, মেঘালয়ার আরেক বাপ; ওর বাবাই!

ইমতিয়াজ সাহেব ধমকে উঠলেন, “আবার কাঁদছিস? কিছু বলছি না বলে স্পর্ধা বেড়েছে? চোখ মুছে ফেল! নয়ত নিয়ে গিয়ে শিশুতোষ স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে আসব। এত বড়ো মেয়ে এভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে?ʼʼ

মেঘালয়ার জানে, বাবাই ওর মন ভালো করতে এসব বলছে। চোখে পানি নিয়েই ঠোঁটে হেসে ফেলল, সঙ্গে হাসলেন ইমতিয়াজ সাহেব। মেঘালয়ার গুমোট হয়ে থাকা মনটা আচমকা বড়ো হালকা লাগে। এতক্ষণে কফি নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে দুজনের!

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে