Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"অন্ধ তারার অশ্রুজলঅন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-৯+১০

অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-৯+১০

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

৯.

কখন যেন তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল প্রিয়তীর। ফজরের আজানে ঘুম ভাঙল। দেখল জানালার পাশে চেয়ারেই বসে আছে এখনো। মাথাটা ঠেকানো গ্রীলের সাথে। ঘাড় খানিকটা ব্যথা হয়ে আছে বেকায়দায় পড়ে থাকায়। সে উঠে ওযু করে এসে নামাজ পড়ল। মোনাজাতে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে বসে রইল। সেভাবে কিছুই চাইল না, শুধু অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকল কপোল বেয়ে। সে জানেও না কী চায়। শুধু একটাই প্রার্থনা, যাই হোক, তা যেন ভালো হয়। সবাই যেন ভালো থাকে। তুবা যেন সুস্থ হয়ে যায় সেই দোয়াও করল।

নামাজ শেষে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই ইফতিকে দেখতে পেল। হেঁটে আসছে। বোধহয় এত সকালে রিকশা পায়নি। ইফতি একবার ওপরের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। ইফতি মলিন মুখে একটু হাসল। আলো এখনো ভালো করে ফোটেনি। আধো অন্ধকারেও প্রিয়তীর মনে হলো সে ইফতির মুখের প্রতিটা রেখা পড়তে পারছে এত দূর থেকেও।

দরজা খুলে দিয়েই প্রিয়তী জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা?”

ইফতি খানিক ভাঙা গলায় বলল, “ভালো। মোটামুটি সুস্থ আছে। বাসায় নিয়ে আসবে একটু পর।”

ইফতি বাথরুমে ঢুকে ফ্রেশ হতে হতে প্রিয়তী কয়েক ফালি ব্রেড টোস্টে মাখন লাগিয়ে নিয়ে এলো। সাথে কফি। ইফতি খাবার দেখে একগাল হেসে খেতে বসে গেল। মিনিট দুইয়ের মধ্যেই গপাগপ গিলে নিয়ে বলল, “চলো বারান্দায় গিয়ে বসে কফি খাই। তোমার জন্যও এক মগ বানিয়ে আনো।”

প্রিয়তী কফি বানিয়ে ফেলল। বাবার ঘরে একবার উঁকি দিল। তিনি হাঁটতে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ নামাজ পড়ে এসে জামা জুতো পরে বের হন রোজ। প্রিয়তীকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী বলল ইফতি?”

“তুবা ভালো আছে বাবা৷ একটু পর নিয়ে আসবে।”

“আলহামদুলিল্লাহ। আমি তাহলে বের হই। এসেই কিন্তু চা খাব…”

প্রিয়তী হেসে বলল, “আমি বানিয়ে রাখব।”

বারান্দায় বসে প্রকৃতির শোভা দেখার কোনো সুযোগ নেই। শুধু চোখে পথে দাঁত বের করা ইট পাথরের রঙ বেরঙের দালান, সরু পথ আর একটুখানি ধূসর আকাশ।

আজ ছুটির দিন বলে অফিসের তাড়া নেই। নইলে এতক্ষণে পিলপিল করে লোকজন বেরিয়ে আসত বাড়িঘর থেকে। দিনের শুরুটা হতো ভয়ানক ব্যস্ততা দিয়ে। আজ সব যেন ঢিমেতালে চলছে। রাস্তায় শুধু এক সবজিওয়ালা বসে গেছে তাজা সবজি নিয়ে। দুটো কুকুর হাই তুলছে পাশে শুয়ে। প্রিয়তী ভাবল, “শুক্রবারে সব বন্ধ থাকে, শুধু খাওয়াটাই বন্ধ করা যায় না।”

ইফতি জিজ্ঞেস করল, “কী ভাবো?”

“কিছু না৷ আচ্ছা, তুবার কি মৃগীরোগ আছে?”

“নাহ। খিঁচুনি অন্য কারনেও হতে পারে। ডাক্তার সেভাবে খুলে তো বলেননি। তবে মৃগীরোগ নেই।”

“ওহ। আসলে…”

“কী?”

“তুবা সেদিন রাতে আমাদের দেখে কষ্ট পেয়েছিল।”

ইফতি চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থেকে বলল, “তোমাকে যেভাবে বিয়ে করেছি সেভাবে যদি আগে ভাবতাম আর ওকে বিয়ে করে ফেলতাম তাহলে হয়তো সবাইকে এত কষ্ট পেতে হতো না।”

কথাটা শুনে প্রিয়তীর কেন যেন ভালো লাগল না৷ সে কোনো কথা বলল না। ইফতি একঝলক ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল কথাটা বলা উচিত হয়নি। যদিও সে অতটা ভেবে বলেনি৷

তবে সে থামল না। প্রিয়তীকে না বললে আর কাকে বলবে? বলল, “আমারই দোষ জানো। শুরু থেকেই আমার দোষ। আমি জীবনে কোনো কাজেই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। যার কারনে বরাবরই ভুগেছি৷ আর এখন আরও কিছু মানুষকে নিয়ে ভুগছি।”

“মিফতা আর তুবার বিয়ে তো আর তুমি করাওনি। তারা নিজের ইচ্ছায় করেছে। এসব ফালতু কথা বন্ধ করো।”

“না প্রিয়তী। তুমি সবটা জানো না। জানলে বলতে না এ কথা।”

“কী জানি না? বলো তো। আজ সবটা বলবে।”

ইফতি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ইন্টারেস্টিং কিছু না প্রিয়তী। খুব সাধারণ একটা কাহিনী৷ তোমার ভালো লাগবে না।”

“তোমার কি মনে হয় আমি ভালো লাগার জন্য শুনতে চাইছি?”

“কেন শুনতে চাইছো?”

“তোমাকে বোঝার জন্য।”

“আচ্ছা তার আগে বলো তো, তুমি কি আমাকে হাজবেন্ড হিসেবে পুরোপুরি মেনে নিয়েছ?”

“হ্যাঁ! কেন তোমার কি মনে হয়েছে মেনে নেইনি?”

“না, পরিস্থিতি এমন যে…”

প্রিয়তী এবার পাল্টা প্রশ্ন করল, “তার মানে কি তুমি আমাকে স্ত্রী হিসেবে এখনো মানতে পারেনি?”

ইফতি মৃদু হেসে বলল, “কবুল বলার পর থেকেই মানি।”

প্রিয়তী ইফতির হাতে হাত রেখে বলল, “আমিও।”

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ কাটল, চোখে চোখ রেখে, হাতে হাত রেখে। দু’জনেরই মনে হলো এত সুন্দর একটা সকাল, এত সুন্দর সময় খুব কম আসে।

প্রিয়তী একসময় ইফতির কাঁধে মাথা রাখল। মনে মনে বলল, “জানি, আমাদের সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে একটু সময় লাগবে৷ এখনো মনের দূরত্ব অনেক। তুমি অতীতের সম্পর্ক থেকে বের হতে পারোনি, আমিও এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনে থিতু হতে পারছি না৷ তবুও এই অগোছালো সময়ের মাঝে একটু শান্তি আমার তোমার কাছেই লাগে। তোমার সাথে কথা বলা, কিংবা তোমার পাশাপাশি থাকার সময়টুকুতে ভয়ভীতি উড়ে যায়। মনের বোঝা হালকা মনে হয়। পৃথিবীটা বড় সুন্দর লাগে।”

ভাবতে ভাবতে প্রিয়তীর চোখে পানি চলে এসেছিল। সে আলতো করে চোখ মুছে সোজা হয়ে বসে বলল, “কথা ঘুরে গেছে। কী বলার কথা ছিল?”

ইফতি এতক্ষণে মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছে কথাগুলো। বলতে লাগল, “তুমি হয়তো জানো না, তুবা আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয়৷”

প্রিয়তী কথাটা শুনে অবাক হলো। সত্যিই সে এটা জানত না৷ মনের ভেতর খুঁচিয়ে ওঠা একটা প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল। এজন্যই তুবার জন্য মিফতাকে বিয়ে করা সহজ হয়েছে।

ইফতি বলে গেল, “তুবার মা আমার বাবার ফুপাতো বোন। ওর বাবা চাকরিসূত্রে নানান জায়গায় থাকতেন বলে আমাদের সাথে যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। তুবার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় গ্রামের বাড়িতে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা একত্রে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স পনেরো, তুবার আট। বুঝতেই পারছো, ছোটো একটা বাচ্চা ছিল। সে সময়ে ওর জন্য কোনো অনুভূতি আসা সম্ভব না। তুবা মিফতার সাথে খেলাধুলা করত, ওরা সমবয়সী না হলেও কাছাকাছি বয়সের ছিল। সেবার চলে আসার পর আবার অনেকদিন দেখা হয়নি ওর সাথে। দ্বিতীয়বার দেখা হলো বছর চারেক আগে। তুবার বড় বোনের বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলাম সবাই। অনুষ্ঠান গ্রামেই হয়। তবে সে সময় ওর বাবার পোস্টিং ছিল আমাদের বাসার কাছেই।

তখন তুবার বয়স আঠারো, আমার পঁচিশ। মিফতা সেবার যায়নি। সে ইউনিভার্সিটির ট্যুরে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। তুবা তখন আর সেই ছোট্ট মেয়ে ছিল না। বড় হয়ে গিয়েছিল। ওর সাথে কেমন করে জড়িয়ে গিয়েছিলাম জানি না, শুধু মনে আছে, গায়ে হলুদের রাতে গানের আসরে একসাথে গলা মিলিয়ে গান গেয়েছিলাম। তারপর থেকে সে অহেতুক লজ্জা পেত আমাকে দেখতে। অদ্ভূত চোখে তাকাত। সেই চোখের ভাষা বুঝতে না পারার কোনো কারন নেই। যাহোক, অনুষ্ঠান শেষে আমরা বাসায় চলে এলাম। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা বলতাম। একদিন দেখা করলাম। তারপর থেকেই…”

ইফতি খেয়াল করে দেখল প্রিয়তী কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ শুনছে। তার মুখে মাখামাখি হয়ে আছে গাঢ় বিষন্নতা।

হঠাৎ কলিংবেল বাজল। চমকে উঠে প্রিয়তী যেন বাস্তবে ফিরল। তারপর ওড়নাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে উঠে গেল দরজা খুলতে। বাবা চলে এসেছেন। চা বানানো হয়নি৷ প্রিয়তী ঝড়ের গতিতে চায়ের পানি চুলায় চাপিয়ে তবেই দরজা খুলল। বাবা ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, “চা হয়েছে?”

“হয়ে যাবে। আপনি হাতমুখ ধুয়ে স্থির হয়ে বসুন, আমি আনছি।”

প্রিয়তী আর ইফতির কাছে যাবার সময় পেল না। শুধু চা বানালে তো চলবে না, নাস্তা বানাতে হবে। জানালা দিয়ে একখন্ড রোদ এসে পড়েছে। বেলা হয়ে যাচ্ছে। চা হতে হতে দ্রুত হাতে আটা মাখতে শুরু করল সে। পুরোপুরি ডুবে গেল কাজে।

এদিকে ইফতির ইচ্ছে হলো নিজেকে কষিয়ে একটা চড় মারতে। আসল কথা না বলে এত খুঁটিনাটি বলার কী দরকার ছিল! মনে পড়ল আর স্মৃতিচারণের মতো গড়গড় করে বলে গেল! এমনিতেই মেয়েরা তাদের স্বামীর প্রাক্তনকে সহ্য করতে পারে না। আর এখানে প্রাক্তনই না শুধু, একই মানুষটা তার জা! এক বাসায়ই থাকতে হবে। না, তার একেবারেই উচিত হয়নি প্রিয়তীকে এসব বলার। নিজের বোকামির জন্য সে বারবার বাঁশ খাচ্ছে! ছোটোবেলায় কি তাকে বোকামির ট্যাবলেট হওয়ানো হয়েছিল? নাকি কোনো ভ্যাকসিন কম দেয়া হয়েছিল? চিন্তায় পড়ে গেল ইফতি।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

১০.

রাতটা দীর্ঘ, অথচ সুন্দর। শীতের রাত বলে মাঝরাত ঘনিয়ে আসার পর মনে হচ্ছে দিনের আলো ফেলে এসেছি সুদূরে। এখন শুধু তারাভর্তি রাতের আকাশের নিচে বসে স্বপ্নজাল বোনা। ইফতি একটা পাতলা টিশার্ট পরেছে। সোয়েটার সামান্য দূরত্বেই পড়ে আছে, উঠে গিয়ে পরতে ইচ্ছে করছে না। ছাদের রেলিংয়ে দুই পা তুলে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিল সে। ঠান্ডায় কেঁপে ওঠার মধ্যেও হাই তুলল। গত দু’দিন ধরে তার মাথাব্যথা ছিল, যেটা পুরোপুরি চলে গেছে। আজকের দিনটা তার মনে চমৎকার স্মৃতি হিসেবে জমা থেকে যাবে।

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে এত আনন্দ হয় এটা ইফতি আগে কখনো অনুভব করেনি। আজ দুপুর নাগাদ তারা সপরিবারে গ্রামে এসেছে দূর সম্পর্কের এক বোনের বিয়ে খেতে। গ্রামের প্রায় সবাই অর্ধপরিচিত, কেউ কেউ পুরোপুরি অপরিচিত৷ প্রতিটি বিয়েবাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এখানেও এক দঙ্গল মেয়ে দল পাকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইফতির বয়সী ছেলেরা বোধহয় এসব মেয়ের আগ্রহ কিংবা পরিহাসের বিষয়বস্তু। ইফতি যতবার তাদের পাশ দিয়ে গেছে, মেয়েগুলো চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছে। কেউ কেউ চাপা হেসেছে৷ খুবই বিব্রতকর অবস্থা। ইফতি চেষ্টা করেছে এদেরকে এড়িয়ে যেতে।

বিকেলের দিকে সে যখন বিশাল জাম গাছটার নিয়ে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে মুখ করে বোঝার চেষ্টা করছিল গাছটার বয়স কত, তখনই তার কানে একটা আওয়াজ এলো। কেউ আসছে, পায়ে নুপুর, কিংবা হাতে চুড়ির টুংটাং আওয়ার তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ভালোভাবেই।

ইফতি পেছন ফিরে দেখল হলুদ শাড়ি পরা ফুটফুটে একটা মেয়ে। খুব মিষ্টি দেখতে। বড় বড় চোখ, গায়ের আলোমাখা রঙ, কপালের টিপ, সব মিলে ঘোর লাগা সুন্দর।

মেয়েটা একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন?”

ইফতি চিনতে পারেনি। তবে এটা বললে যদি মেয়েটা কিছু মনে করে, তাই বলল, “হুম।”

“ওমা! কী করে চিনলেন? সবাই দেখলেই বলে কত বড় হয়ে গেছিস তুবা! তোকে দেখলে চেনাই যায় না।”

কথা বলার ঢঙে হেসে ফেলল ইফতি৷ বলল, “সবাই না চিনলেও আমি তোমাকে চিনেছি তুবা।”

তুবা খুশি হয়ে বলল, “চেনার জন্য ধন্যবাদ। আজকের অনুষ্ঠানে আপনাকে কিন্তু গান গাইতে হবে। আমরা গায়ে হলুদ মাখা শেষ হলেই আসর বসাবো। বড়রা সব বাদ। শুধু আমরা থাকব৷ আপনাকে দাওয়াত দিয়ে রাখলাম।”

“এমনিতেই তো দাওয়াতে আছি। আবার নতুন করে দাওয়াত?”

“হ্যাঁ! আমাদের নিজেদের প্রোগ্রাম যে তাই! গতকাল সব প্ল্যান হয়েছে। আপনি ছিলেন না তাই আপনাকে স্পেশাল ইনভাইটেশন দেয়া হলো।”

“ধন্যবাদ।”

তুবা ঘুরে চলে যাচ্ছিল৷ ইফতি তাকে ডেকে থামাল।

“তুবা শোনো…”

“জি?”

“কনে তোমার কী হয় যেন?”

তুবা খিলখিল করে হেসে ফেলল। ওর লতার মতো শরীরটা মনে হলো গড়িয়ে পড়বে। ঝর্ণার মতো উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত হাসিতে ইফতিও হেসে ফেলল।

তুবা বলল, “আপনি আমাকে চেনেননি তাই না? কনে আমার বড় আপু।”

ইফতি বলল, “ওহ আচ্ছা! তুমি সেই তুবা! মিফতার নাকে কামড়ে দিয়েছিলে যে! তুমি এত বড় হয়ে গেছ!”

তুবা হিহি করে হাসতে হাসতে চলে গেল। তার খুব মজা লাগছিল।

সন্ধ্যার দিকে কাচা হলুদ বাটা দিয়ে কনের গাল, কপাল, হাত মাখানো হচ্ছিল, আর ইফতি স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। ফটোগ্রাফির একটা নেশা তখন চেপে বসেছিল। আলোর কমতি ছিল বলে ছবিগুলো মনমতো আসছিল না৷ তার ওপর কনে এতই লাজুক যে মুখ তুলে তাকায় না পর্যন্ত! ইফতি বিরক্ত হয়ে ছবি তোলা বাদ দিয়ে বসে পড়ল।

তাকে বসতে দেখে তুবা এসে হাজির হলো। “বউয়ের ছবি তোলা শেষ? তাহলে আমাদের ক’টা ছবি তুলে দিন না।”

“আমাদের মানে?”

“আমার বান্ধবী, কাজিনদের আর আমার।”

ইফতি ভুরু তুলে তাকাল। অন্তত পনেরোটা মেয়ে। সে হাত তুলে বলল, “স্যরি৷ শুধু তোমার ছবি তুলত চাইলে রাজি আছি। নয়তো আমি নাই।”

তুবা একটু মন খারাপের ভাব করে মেয়ের দলের কাছে গিয়ে সংবাদটা জানাল। কিছুক্ষণ কথা বলে ফেরত এসে বলল, “ওকে! তাহলে আমার ছবি তুলে দিন।”

ইফতির মনে হলো তুবা মন খারাপের ভান করলেও তার একার ছবি তুলতে চাওয়ায় সে আসলে দারুণ খুশি হয়েছে।

উজ্জ্বল আলোতে গিয়ে ছবি তোলা হলে। অনেক ছবিই তুলল ইফতি। একধারে মরিচবাতি, মোমবাতি আর মেয়েটার নিজস্ব আলোয় ছবিগুলো খুব সুন্দর হলো। তুবা সেগুলো দেখে নিজেই বাক্যহারা হয়ে গেল। দুই গালে দাত দিয়ে বলল, “মাশাআল্লাহ!”

ইফতি হেসে ফেলল। তুবা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “ছবিগুলো দেবেন কিন্তু।”

“উহু, এগুলো আমি বাঁধাই করে আমার ঘরে টানিয়ে রাখব।”

কথাটা মজা করে বললেও তুবা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। ইফতির দিকে আর চোখ তুলে তাকাল না। সোজা চলে গেল ঘরের ভেতর।

হলুদ শেষে গানের অনুষ্ঠান শুরু হলো। মেয়েদের সাথে সাথে অনেকগুলো ছেলেও জড়ো হলো। তুবা এলো সবার পরে। এসে ইচ্ছে করেই যেন ইফতির মুখোমুখি বসল।

একটা বোতল মাঝে রেখে ঘুরিয়ে দেয়া হবে। যে দুজনের দিকে পয়েন্ট করে বোতলটা থামবে, তাদের গাইতে হবে।

অনেকেই গাইল। খোলা আকাশের নিচে, মরিচবাতির আলোয়, ছিমছাম শান্ত গ্রামের পরিবেশে, মিহি হাওয়ার দানা গায়ে এসে লাগতে লাগল, সেই সাথে কোরাস গানের আওয়াজ পরিবেশটা জমিয়ে তুলল। শহুরে কোলাহল আর জীবনের চাপে পিষ্ট ইফতির তখন এমন খোলা পরিবেশে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পেরে মনে হচ্ছিল জীবনের সতেজতা ফিরে এসেছে।

কখন যেন বোতলটা তার দিকে ঘুরে গেল খেয়াল করেনি ইফতি৷ সবাই যখন তাকে আর তুবাকে গান গাইতে বলল, তখন হুশ ফিরল। কী গাইবে? গান গাইতে পারে না সে। তবে বলল না কিছু৷ এখানকার কেউই গান গাইতে পারে না, তবুও সবাই গাইছে, আনন্দ প্রকাশ করছে। সে করলে ক্ষতি কী?

তুবাই প্রথম গান ধরল। গানটা শুনে একটু চমকালো ইফতি৷ এটাই গাইতে হলো! মেয়েটা কি কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে তাকে? সে কি তাতে সমর্থন জানাবে? ইফতির মন প্রাণ তখন কোনো যুক্তির বাঁধ মানল না। ইচ্ছেই করল না। এক রহস্যময়ী সদ্য যুবতী কন্যার এমন আহ্বান অগ্রাহ্য করার ইচ্ছে বা সামর্থ্য কোনোটাই হয়তো তার নেই।

তুবার গানের লাইনটা ছিল, “কে প্রথম কাছে এসেছি…

ইফতি তারপর গলা মেলালো, “কে প্রথম চেয়ে দেখেছি…

তুবা গাইল, ” কিছুতেই পাই না ভেবে..

দুজন একত্রে গাইল, “কে প্রথম ভালোবেসেছি…তুমি না আমি?

গানের কলি গুনগুন করে ভাজতে ভাজতে ঘুমিয়ে পড়ছিল ইফতি৷ আওয়াজ শুনে চোখ মেলল।

“জ্বর বাঁধাবেন নাকি? নিচে যাবেন না?”

ইফতি চোখ মেলে দেখল তুবা৷ হালকা গোলাপি একটা সালোয়ার কামিজ পরে আছে। শাড়ি বদলে সাজ ধুয়ে ফেলেছে। শুধু চেহারার মিষ্টতা আর সরলতা ধুয়ে ফেলতে পারেনি৷ ইফতি উঠে বলল, “হুম। বাতাসটা ভালো লাগছিল।”

তুবা প্রশ্ন করল, “আমি কি গানটা ভালো গেয়েছিলাম?”

“হুম। খুব ভালো হয়েছিল।”

“আপনিও ভালো গাইতে পারেন।”

“তোমার গান পছন্দ?”

“উহু, গায়কদের পছন্দ।”

“মানে?”

তুব হেসে বলল, “কিছু না।”

“পড়ো কিসে?”

“এইচএসসি দেব।”

“তুমি তো দেখি বাচ্চা মেয়ে!”

তুবা হেসে বলল, “দেখে কি বুড়ি মনে হয়?”

“না, তবে কথা শুনে আরেকটু বড় মনে হয়েছিল৷ এখন দেখি নেহায়েতই বাচ্চা।”

কথা বলতে বলতে তারা ছাদ থেকে নেমে এলো। তুবা ইফতিকে তার থাকার ঘর দেখিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার আগে আরেকবার ফিরে তাকিয়ে খানিক করুণ মুখ করে প্রশ্ন করল, “এইচএসসি দিচ্ছি। খুব বেশি বাচ্চা নিশ্চয়ই নই৷ আঠারো হয়ে গেছে আমার।”

ইফতির ওর চোখ পড়তে পারছে। ভালোলাগা লুকাতে ব্যথ হওয়া একজোড়া চোখ কিছু একটা খুঁজছে আকূল হয়ে। ইফতি ধরা দিল না। বলল, “যাও ঘুমাও৷”

তুবার সেই মুখটাই কল্পনায় ভেসে ছিল ইফতির। সম্বিত ফিরল প্রিয়তীর ডাকে। “খাবে না? নাস্তা বানানো শেষ। বাবাকে খেতে দিয়েছি৷ তুমিও খেয়ে ফেলো।”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে পড়ল ইফতি। “আসছি।”

আবারও স্মৃতির পাতায় হারিয়ে গিয়েছিল সে। স্মৃতিগুলো ইরেজার দিয়ে মুছে ফেলা গেলে ভালো হতো। কিন্তু কিছু জিনিস মোছা যায় না। বরং মোছার চেষ্টা করলে আরও ক্ষতবিক্ষত হয় মন।
_______________________________

দ্রুত হাতে রুটি বানাচ্ছে প্রিয়তী। রান্নাবান্নায় খুব পারদর্শী না হলেও অল্পবিস্তর সবই শিখেছে সে মায়ের কাছে। রান্নার শখও আছে, তাই খারাপ লাগে না। তাওয়ার রুটিটা উল্টে দিয়ে শেষ রুটিটা বেলে ফেলল সে৷ তারপর গরম রুটি খুন্তিতে করেই টেবিলে নিয়ে গিয়ে ইফতির সামনের ঝুড়িতে রাখল। ইফতি আজ অনেকটাই অন্যমনষ্ক। নইলে সে খাবার খায় খুব আগ্রহ করে।

ইফতির জায়গাটা অবশ্য পূরণ করে দিচ্ছেন বাবা। তিনি অনবরত বলে যাচ্ছেন, এত পাতলা রুটি বানাতে পারার জন্য প্রিয়তীকে একটা ছোটোখাটো মেডেল অন্তত দেয়া উচিত।

ওরা খাওয়া শেষে উঠতেই কলিংবেল বাজল। হাসপাতাল থেকে বাকিরা চলে এসেছে। প্রিয়তী দরজা খুলে সরে দাঁড়াল।

স্বামীর কাঁধে ভর দিয়ে তুবা ঢুকল। বোঝা যাচ্ছে, শরীর দুর্বল। সে প্রিয়তীর দিকে চাইলও না৷ ইফতির দিকে এক পলক তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি৷ প্রিয়তীর মায়া হলো ওকে দেখে। আচ্ছা, ইফতিরও কি খুব মায়া লাগছে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ