অন্ধ তারার অশ্রুজল পর্ব-১১+১২

0
444

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল

১১.

প্রিয়তী নাস্তা বানিয়ে রেখেছে দেখে দারুণ খুশি হলেন মা। তবে সেটা হাবেভাবেই প্রকাশ পেল, সরাসরি কিছু বললেন না। খাওয়াদাওয়া শেষে আরেক দফা চা খাওয়া হলো।

বিকেলের আগে আর ইফতির সাথে কথা বলার সুযোগ হলো না প্রিয়তীর৷ অনেক কাজ করতে হলো। ইফতি দিনটা কাটিয়ে দিল ঘুমিয়ে। মাঝে উঠে শুধু নামাজ পড়ে এলো আর দুপুরের খাবার খেল।

বিকেলের দিকে আর কোনো কাজ রইল না। প্রিয়তী জানালার ধারে বসে রইল চুপচাপ। ইফতি খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে। প্রিয়তীর চোখে ঘুম নেই। তার আজ এত মন খারাপ লাগছে কেন বুঝতে পারছে না। সকালে ইফতির কথা শুনে? কিন্তু সে তো আগে থেকেই জানত ইফতির প্রাক্তনের কথা। তবে? প্রিয়তী চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুধারা মুছে নিল সন্তর্পণে। ইফতির দিকে চোখ পড়ে গেল তখন। দেখল ছেলেটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

প্রিয়তী একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। “কী দেখ?”

“কাঁদো কেন?”

“মায়ের কথা মনে পড়ছে।”

ইফতি হঠাৎ উঠে বসে বলল, “রেডি হও।”

“আমার জন্য ওই বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আর গিয়ে লাভ নেই।”

“ওখানে যেতেও বলছি না। এমনিতেই একটু ঘুরে আসি।”

“কোথায় যাব?”

“যেদিকে যেতে ইচ্ছে হয়!”

প্রিয়তী একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে।”

প্রিয়তী আলমারি খুলে কোন জামাটা পরবে ভাবছে, এমন সময় ইফতি বলল, “মা যে শাড়িটা দিয়েছিল ওটা পরো না।”

“এখন শাড়ি পরব?”

“কোনো অসুবিধা আছে?”

“উ….না। আচ্ছা পরছি।”

প্রিয়তীকে তৈরি হতে বলে ইফতি বাইরে বের হলো।

প্রিয়তী শাড়ি পরার পর মনে হলো তার সাজগোজের কিছু নেই৷ একটা লিপস্টিকও নেই। কেমন সাদামাটা লাগছে। সে দরজা খুলে বের হয়ে দেখল ইফতি নেই, কোথায় যেন গেছে।

একটু পর ইফতি ফিরল। ওদের বাসা থেকে কিছুটা দূরে একটা ফুলের দোকান থেকে কয়েকটা গোলাপ আর একটা বেলীফুলের মালা নিয়ে এসেছে সে। সাথে এক পাতা টিপ।

ইফতিকে দেখে প্রিয়তী বলল, “খুব সাদামাটা লাগছে তাই না? একটা লিপস্টিকও নেই যে লাগাব।”

ইফতি তখন নিজের হাতে প্রিয়তীর খোঁপায় ফুল গুঁজে দিল। কপালে পরিয়ে দিল ছোট কালো টিপ।

তারপর হেসে বলল, “তুমি আয়নায় একবার দেখো নিজেকে।”

প্রিয়তী দেখল। টিপ পরাতে দেখতে ভালো লাগছে, তবুও যেন কী নেই। ইফতি তার ঠোঁটের দুই পাশ দুই আঙুল দিয়ে একটু প্রসারিত করে বলল, “হাসিটা নেই৷ ওটা হলেই পারফেক্ট হবে।”

প্রিয়তী হাসল। ইফতি তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভূত রকমের ভালোলাগা কাজ করছে। কত ছেলেই তো তাকায়। রাস্তাঘাটে, পরিচিত কিংবা অপরিচিতের মধ্যে। তাদের কেউ কেউ ইফতির চেয়েও সুন্দর কিংবা সফল। কিন্তু বিয়ে জিনিসটার মর্মই আলাদা। একটা মানুষকে সম্পূর্ণ নিজের করে পাওয়া। আর তার মুগ্ধতাটুকু পৃথিবীর সেরা আনন্দের বিষয় মনে হওয়া!
_______________________________

ওরা অনেকটা ঘুরল সারা বিকেল। কোনো রিকশা বা গাড়ি নিল না৷ বাসা থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করল। প্রথমেই একটা পার্কে গিয়ে নাগরদোলায় চড়ল।

ইফতি ভয় পায় উঁচুতে উঠতে। এদিকে প্রিয়তীর ভীষণ পছন্দ৷ সে ইফতকে টেনেটুনে ওঠাল৷ ইফতি পুরো সময় চোখ বন্ধ করে প্রিয়তীর হাত শক্ত করে ধরে রইল। প্রিয়তী খিলখিল করে হেসে গড়াগড়ি খেল।

সেখান থেকে বেরিয়ে ওরা গেল একটা শপিং মলে। প্রিয়তীর পছন্দের কয়েকটা লিপস্টিক আর আইলাইনার কেনা হলো। ইফতি জোরাজোরি করলেও প্রিয়তী আর কিছু নিল না। সে এই দুটোই পছন্দ করে।

একটা আইসক্রিম পার্লারে গিয়ে মিক্সড ফ্রেভারের আইসক্রিম খেল। আইসক্রিম প্রিয়তীর নাকে লেগে যাওয়ায় সেটার গোপনে ছবি তুলে ফেলল ইফতি। তারপর হুমকি দিল, তার নাগরদোলায় ভয় পাওয়ার গল্প কারো কাছে করলে এই নাকে আইসক্রিম লাগানো ছবি ভাইরাল হয়ে যাবে।

ওরা জানে, ওদের এসব ছেলেমানুষী গল্প শোনার কেউ নেই। তবুও বলতে ভালো লাগে। অনেকদিন পর প্রাণ খুলে আনন্দ করতে বেশ লাগছে!

আইসক্রিম খাওয়া শেষে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করল তারা। ইফতি প্রিয়তীর হাত ধরে রাখল।

প্রিয়তী বলল, “আমার মনে হচ্ছে আমরা নতুন প্রেমে পড়া কাপল।”

ইফতি হেসে বলল, “সেটা বললেও খুব একটা ভুল বলা হয় না।”

প্রিয়তী চোখ মটকে বলল, “তুমি আমার প্রেমে পড়েছ?”

ইফতি উত্তর না দিয়ে রহস্য করে বলল, “তোমার কী মনে হয়?”

প্রিয়তীও প্রশ্নের উত্তর দিল না। কথাটা চাপা পড়ে গেল।

আরেকটু সামনে এগিয়ে ফুটপাতের পাশে কিছু গাছের দোকান দেখতে পেল ওরা। ইনডোর প্ল্যান, বাহারি টব আর নানা জাতের রঙ বেরঙের ফুলগাছ সাজানো।

প্রিয়তী আবদার করে বসল, “তোমার বারান্দাটা খুব সুন্দর। আমি কয়েকটা গাছ লাগাব সেখানে।”

ইফতি বলল, “যথা আজ্ঞা মহারাণী।”

প্রিয়তী পছন্দের কিছু গাছ আর টব কিনল। তারপর একটা রিকশা দেখে বাড়ি ফিরল তারা। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে আজান পড়ে গেল। ইফতি গাছগুলো বারান্দায় তুলে দিয়ে চলে গেল মসজিদে।

প্রিয়তীকে দেখে শাশুড়ী বললেন, “এতদিন তো প্রেম করলে। বাড়িতে একটা মানুষ অসুস্থ। এখন একটু কম ঘোরাফেরা করলে কী হয়?”

প্রিয়তীর মুখ ছোটো হয়ে গেল। মা গজগজ করতেই থাকলেন, “কোনো ধৈর্য সহ্য নেই..আমি আর কাকে বলি! আমার পেটের ছেলেই যখন এমন…”

প্রিয়তী নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে কেঁদে ফেলল। খুব অল্প কথায় চোখে পানি আসে তার। সত্যিই সহ্যক্ষমতা একদম নেই! কয়েক মিনিট চোখের জল ফেলে শাড়িটা বদলে নিল সে। তারপর নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকল। চা বানাল। খুঁজেপেতে কয়েক প্যাকেট নুডলস পেয়ে রেঁধে ফেলল সবার জন্য।

চা আর নাস্তা দেখে মাকে এবার একটু সন্তুষ্ট মনে হলো। প্রিয়তী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষকে খুশি রাখা পৃথিবীর কঠিন কাজগুলোর একটা।

চা নাস্তা নিয়ে সে তুবাদের ঘরেও দিয়ে এলো। মিফতা আর তুবা গল্প করছিল৷ তুবার শরীর এখন মোটামুটি ভালো। বিছানায় বসে আছে। প্রিয়তীকে দেখে আজ নিজেই কথা বলল, “কেমন ঘুরলে?”

প্রিয়তী একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “ভালো।”

তুবা আর কিছু বলল না। তবে প্রিয়তীর মনে হলো, তুবা হয়তো তাকে অনেক কিছু বলতে চায়, কিন্তু বলতে পারছে না। কোনোদিন পারবেও না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#অন্ধ_তারার_অশ্রুজল
১২.

স্মৃতিগুলো অনেকটা সিনেমার রিলের মতো। একবার চালু করে দিলে তখন যেন স্রোতের জলের মতো হু হু করে আসতে থাকে, চলতে থাকে পর্দার দৃশ্যগুলো। শুধু পার্থক্য হলো, একে চট করে বন্ধ করে দেয়া যায় না৷

সেই সকালে প্রিয়তীকে ঘটনা বলতে শুরু করার পর থেকে শুরু হয়েছে ব্যাপারটা। প্রিয়তী যখন সামনে থাকে না ঠিক সে সময়গুলোতেই ইফতির মনে পুরানো স্মৃতির ভিড় লেগে যায়। স্মৃতির টুকরোগুলো জোড়া লাগতে থাকে একের পর এক।

সেই যে তুবার সাথে দেখা হলো গায়ে হলুদের দিন, তারপর থেকে ঘটনাপ্রবাহ ইফতির মাথায় চলছে। প্রিয়তী রান্নাঘরে কাজ করছে। এই সুযোগ পেয়ে ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে অতীত। জাঁকিয়ে বসছে ডালপালা মেলে দিয়ে।

লাল টকটকে বিয়েবাড়ির গালিচার ওপর দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিমায় পরদিন সকালে তুবার ছবি তুলে দিয়েছিল ইফতি। বিয়ে উপলক্ষে জমকালো সাজে আবির্ভূত হয়েছিল তুবা। মেরুন শাড়ি, ঝলমলে গহনা আর মুখে উচ্ছ্বল হাসি। তাকে দেখতে অনেক বড় বড় লাগছিল। ইফতি তার ছবি তোলার প্রতিভা পুরোটাই খরচ করেছিল সেদিন তুবার ছবি তুলতে। ছবি তোলা শেষে তাকে মিষ্টি করে ধন্যবাদ জানিয়ে বান্ধবিদের সাথে ভিড়ে গিয়েছিল তুবা।

সেদিন ইফতির চোখ বারবার তাকেই খুঁজে নিচ্ছিল। তুবাও ঘুরেফিরে চলে আসছিল ওর সামনে। চোখাচোখি হতেই হচ্ছিল টুকরো হাসির বিনিময়।

বিয়ে শেষে কনের সঙ্গে তুবাও চলে গেল বোনের শ্বশুরবাড়িতে। যাবার আগে ইফতিকে বলে গেল, সে যোগাযোগ করবে ছবিগুলো নেবার জন্য।

সে রাতে ইফতির বিচিত্র এক শূন্যতা কাজ করছিল মনে। বিষন্ন লাগছিল সবকিছু। মাত্র কয়েক ঘন্টায় একটা মানুষ মনের এতটা দখল করে নিল কেমন করে? মনে হচ্ছিল পুরো বিয়েবাড়ি, এত লোক, সব ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই।

পরদিন ফিরে এসেছিল তারা। আসার পর থেকেই ইফতি অপেক্ষা করছিল তুবার জন্য। তুবা ওর ফোন নাম্বার নিলেও সে নিজে আগ বাড়িয়ে তুবার নাম্বার নেয়নি। ছটফট করেছে কদিন। বিয়ে আর হলুদে তোলা তুবার ছবিগুলো বারবার বের করে দেখেছে। কী মায়াবী মুখ! সতেজ নিষ্পাপ চাহনি। এতটা ভালো আর কাউকে কখনো লাগেনি ইফতির।

এক রাতে ইফতি স্বপ্নে দেখল তার আর তুবার বিয়ে হচ্ছে। তুবা বোনের বিয়েতে যে শাড়িটা পরেছিল সেটা পরেই বিয়ের স্টেজে বউ সেজে বসে আছে। হাসির কোনো কথা বলছে তুবা। ইফতি তার পাশে বসে হাসছে।

সেদিন ঘুম থেকে উঠে ইফতির দারুণ অস্বস্তি হলো, আবার ভালোও লাগল। বুঝতে পারল, মেয়েটাকে ছাড়া বোধহয় আর চলছেই না তার।

তুবা ফোন করল পাক্কা এক সপ্তাহ পর। সে ছবিগুলো ইমেইলে পাঠিয়ে দিতে বললেও ইফতি দেখা করতে চাইল।

সেদিন বিকেলেই দেখা করল তারা। নতুন ফ্লাইওভারের পাশে একটা কাচঘেরা চমৎকার রেস্তোরাঁয়। সেখান থেকে শহরের অনেকটা দেখা যায়। যে অংশটুকু চোখে পড়ে সেটুকু ব্যস্ততম শহরের সতেজ অংশ। গাছপালায় ঘেরা উদ্যান তখন কৃষ্ণচূড়া আর সোনালুর রঙ লেগে বড় আবেদনময়ী রূপ ধারণ করেছিল। কিন্তু সেদিকে নজর ছিল না ইফতির। তার মনে হচ্ছিল এদের সবটা রঙ শুষে নিয়ে অপরূপা তার সামনেই বসে আছে। কী ভীষণ ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে সে ফিরেছিল সেদিন।

অলিখিত কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল সেদিনই। তুবা আগেই মোহাবিষ্ট হয়েছিল, ইফতি ধরা দিয়েছিল সেই বিকেলে।

রাতে ঘুম আসছিল না ইফতির। ছটফট করে কাটছিল সময়। গভীর রাতে সে তুবাকে মেসেজ পাঠিয়েছিল, “তোমাকে একটু বেশিই ভালোলেগে গেছে তুবা।”

তুবা জেগে ছিল। পরের মিনিটেই ফিরতি উত্তর এসেছিল, “ভালোলাগা দিয়ে আমার চলবে না।”

“তবে?”

“ভালোবাসতে হবে।”

“ভালোবেসে ফেলেছি।”

“আমিও। আপনার অনেক আগেই।”

প্রেমের শুরুটা বড় মিষ্টি ছিল। তুবা তখন এইচএসসি ক্যান্ডিডেট। পরীক্ষা সামনে। প্রথম ক’দিন পড়াশুনা বাদ দিয়ে পুরোপুরি ইফতির মাঝেই ডুবে রয়েছিল। রাত জেগে কথা বলত তারা, কোচিং বাদ দিয়ে ঘুরতে যেত।

এরপর যখন তুবা টেস্ট পরীক্ষায় বিশাল এক ডাব্বা মারল, তখন ইফতির হুশ ফিরল৷ তুবা তখনও দিওয়ানা৷ রেজাল্টের দিন হাসতে হাসতে বলেছিল, “তোমার জন্য লক্ষ পরীক্ষা খারাপ দিলেও আফসোস থাকবে না।”

কথাটা শুনে ইফতির খুব মায়া লেগেছিল তুবার জন্য। তবে সে তখন শক্ত অবস্থানে চলে গিয়েছিল। রাত জেগে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল৷ কোচিংয়ে যেসব পড়া তুবা মিস করে গিয়েছিল সেগুলো নিজ দায়িত্বে বুঝিয়ে দিতে শুরু করেছিল। পড়াশুনার খবরদারি করতে শুরু করেছিল পুরোদমে।

টেস্ট পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় তুবার বাড়ি থেকে ওর মোবাইল কেড়ে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। ওদিকেও ব্যপক ঝড় চলছিল। তুবা কেমন করে যেন সামলে নিয়েছিল। ইফতি শর্ত দিয়েছিল ছয় ঘন্টা পড়াশুনা করলে তবে ফোনে আধঘন্টা কথা বলবে। তুবা মেনে নিয়েছিল।

সপ্তাহে একদিন দেখা করত তারা। দুজনেই পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করত সেই দিনটার। দেখা হলে ইচ্ছে হতো চোখ দিয়ে স্ক্যান করে মানুষটাকে নিজের কাছে রেখে দিতে। প্রতিবার বিদায় বেলায় তুবা কাঁদত। ইফতির হাত শক্ত করে ধরে রাখত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। মনে হতো ছেড়ে দিলেই মানুষটা পালিয়ে যাবে…

“এইযে শুনছো?”

প্রিয়তীর ডাকে কল্পনার ঘোর কেটে গেল ইফতির। প্রিয়তী চা আর নুডলস নিয়ে এসেছে। ওর চুল ঘামে ভিজে গালের সাথে লেপ্টে আছে। নাকের ওর মুক্তো বিন্দুর মতো ঘাম। চেহারায় একটা বিষন্নতা খেলা করছে, তাতে আরও বেশি সুন্দর লাগছে। হালকা গোলাপি রঙের জামায় মিষ্টি দেখাচ্ছে প্রিয়তীকে।

ইফতির খুব অপরাধবোধ হলো। প্রিয়তীর সঙ্গে সে অন্যায় করছে। সারাটা বিকেল যার সাথে ঘুরে এলো, তাকে রেখে সে ভাবনায় ডুবে ছিল অন্য কারো। যে কি না…

প্রিয়তী জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা?”

“না তো।”

প্রিয়তী মুখ মুছে এসে বসল পাশে। নিজের চায়ের কাপ তুলে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, “একটা কথা বলার ছিল।”

“কী কথা?”

“আসলে কথা না, ধন্যবাদ দেবার ছিল।”

“কেন?”

“আজকে বিকেলের জন্য। খুব সুন্দর সময় কেটেছে। বহুদিন এত সুন্দর বিকেল কাটাইনি।”

ইফতি খানিকটা লজ্জা পেল। তার নিজেরও খুব ভালো লেগেছে। তাহলে ফিরেই কেন তুবার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল? নিজেকে কেমন যেন চরিত্রহীন মনে হচ্ছে।

প্রিয়তী আবার প্রশ্নটা করল, “তুমি কি কিছু নিয়ে চিন্তিত?”

“না তো।”

প্রিয়তী যেন না বললেও সবটা বুঝে নিয়ে বলল, “শোনো, আমি জানি তোমার অতীত থেকে বের হতে সময় লাগবে। তুমি যে চেষ্টা করছ তাও আমি বুঝতে পারছি। নিজেকে প্রেশার দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার কোনো তাড়া নেই। যাবার কোনো জায়গায়ও নেই। এখানেই পড়ে থাকব।”

বলতে বলতে অন্যদিকে ঘুরল প্রিয়তী। তার চোখে পানি চলে এসেছে। ইফতি প্রিয়তীর একটা হাত ধরে বলল, “তুমি খুব ভালো মেয়ে প্রিয়তী। তোমার সাথে যা হচ্ছে সেটা তুমি ডিজার্ভ করো না।”

প্রিয়তী চোখ মুছে হেসে বলল, “তোমাকে কে বলল আমি খুব ভালো?”

“এতটা সময় একসাথে থাকার পরেও এটুকু জিনিস বুঝব না?”

“আমরা মোটেও এতটা সময় একসাথে থাকিনি। মোটে পাঁচদিন ধরে চিনি একে অপরকে। অনেক সময় বছরের পর বছর ধরেও মানুষ চেনা যায় না।”

ইফতি মাথা ঝাঁকাল। কথাটা সেও বিশ্বাস করে। তবে সে প্রিয়তীকে ভুল চেনেনি। আর এই অসাধারণ মেয়েটার সাথে সে কোনো অন্যায়ও করতে চায় না।

প্রিয়তীর হাতের মেহেদি অনেকটাই মুছে গেছে। ইফতি ওর হাতটা মেলে ধরে কিছুক্ষণ ওর হাতের রেখায় এলোমেলো আঁকিবুঁকি করল। প্রিয়তী চুপচাপ কান্ড দেখতে লাগল। ইফতি হঠাৎ বলল, “কোথাও ঘুরতে যাবে?”

প্রিয়তী অবাক হয়ে বলল, “আজই তো ঘুরে এলাম।”

“না না, এরকম ঘুরতে যাওয়া নয়৷ আমার অল্প কিছু টাকা জমা আছে। খুব অল্পই। তবে তা দিয়ে দেশের কোনো সুন্দর জায়গায় কয়েকদিন স্বচ্ছন্দে ঘুরে আসা যাবে। এই ধরো পাহাড় কিংবা সমূদ্রে।”

প্রিয়তী মৃদু হেসে বলল, “দেখা যাবে। আগে থিতু হয়ে নেই। এখন সময়টা অস্থির চলছে।”

ইফতি মাথা ঝাঁকাল।

প্রিয়তী ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে না গিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে শেখো। তুমি, মা, তুবা, আমি, সবাই কষ্ট পাচ্ছি। তুমি সবার সাথে স্বাভাবিক হও। স্বাভাবিক আচরণ করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ইফতি কিছু বলল না৷ প্রিয়তীর কোলে শুয়ে চোখ বুজে বলল, “চুল টেনে দাও তো। জোরে জোরে টানবে। আরাম লাগে যেন।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে