অনুতপ্ত পর্ব-৮

0
1148

#অনুতপ্ত ৮ম পর্ব
#সাদমান হাসিব

রুবাইয়ার শাশুড়ি ও স্বামী মারা যাবার পর রুবাইয়া স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করছে, এখন তাকে কথা শোনানোর মত কেউ থাকলো না। রুবাইয়ার বাবা-মা রুবাইয়া যা করে তাতেই খুশি, তারা কখনো মেয়েকে শাসন করেনি। সিরাত অস্ট্রেলিয়াতে লেখাপড়া করছে দিনকে দিন তার চাহিদা বেড়ে চলছে, কিছুদিন পরে পরে লেখাপড়ার বাহিরেও সিরাতের অনেক টাকা হাত খরচ দিতে হয়। রুবাইয়া চাকরি করার সুবাদে ঘুষ গ্রহণ করা শুরু করে, এদিকে আরাফ বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। দুই ছেলের খরচ জোগাতে রুবাইয়া দিশেহারা, তাই সুযোগ পেলেই ঘুষ গ্রহণ করতো রুবাইয়া।

রুবাইয়ার অফিসে নতুন বস এসেছে, পুরনো বস বদলি হয়ে গেছে। নতুন বসকে রুবাইয়ার কাছে ভালো মনে হয় না, কারণে-অকারণে রুবাইয়াকে তার রুমে ডেকে গল্পগুজব করে, রুবাইয়া যেমনই হোক চরিত্রের দিক দিয়ে সে ভালো। বস নামের বয়স্ক লোকটার নিলজ্জ চাহনি রুবাইয়ার গা ঘিনঘিন করে। একদিন অফিস ছুটির পর বস রুবাইয়াকে বলে তুমি কিছুক্ষণ অফিসে থাকো কয়েকটা ফাইল নিয়ে তোমার সাথে কথা বলবো। সবাই অফিস থেকে চলে গেছে, রুবাইয়ার কেমন অস্বস্তি লাগছিল, কিন্তু সে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিল না।

মিসেস রুবাইয়া আমি জানি আপনার স্বামী অনেকদিন যাবত মারা গেছে, আপনি একা আছেন, আপনার বয়স তো তেমন হয়নি। কিন্তু দুইটা ছেলের মুখের দিকে চেয়ে কিছু করার মত সাহস পাচ্ছেন না, আমরা যদি গোপনে একটা রিলেশন স্টার্ট করি সেটা তো কেউ জানবে না। আমার জন্য যেমন ভালো হবে তোমার জন্য তেমন ভালো হবে।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, কিসের রিলেশন ক্লিয়ার করে বলুন।

মানে আমার স্ত্রী তো চিটাগাং থাকে, আমি এখানে একা থাকি, মাঝে মাঝে তুমি যদি আমাকে সময় দিতে, আমার ফ্ল্যাটে যেতে।

মুখ সামলে কথা বলবেন, আপনি আমার বস আপনাকে চাকরির ক্ষেত্রে আমি সম্মান দেবো মান্য করে চলব, কিন্তু আপনি পার্সোনাল ভাবে আমাকে এভাবে কু-প্রস্তাব দিতে পারেন না। যদি দ্বিতীয়বার এই দুঃসাহস করেন আমি প্রশাসনে জানাতে বাধ্য হবো।

রাগে গজ গজ করতে করতে রুবাইয়া বসের রুম থেকে বের হয়ে আসলো। বস মাহমুদুল হক রুবাইয়াকে দেখে নিবে এমনই মনে মনে ভাবছে, আমাকে অপমান তোমাকে আমি দেখে নিব। তুমি আমাকে হুমকি দাও প্রশাসনে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে, তুমি কিভাবে এখানে চাকরি করো সেটা আমি দেখে নেবো।

রুবাইয়ার স্বামী নেই এটা বস জানতেন সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চেয়েছিল, কিন্তু সে সফল না হয়ে রুবাইয়ার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো। তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে জানাবে, এটা ভেবেই বস মনে মনে একটা কুবুদ্ধি আঁটলো। সুযোগের অপেক্ষা করেছিল বস, একদিন হাতেনাতে ধরা পড়ে যায় রুবাইয়া ঘুষ গ্রহণের সময়। বস জানতো রুবাইয়া ঘুষ গ্রহণ করে ম্যানেজারের সাথে মিলে, তাই ম্যানাজার এর মাধ্যমে চক্রান্ত করে রুবাইয়াকে ঘুষ দেওয়ার উস্কানি দেওয়া হয়। আর সেই মুহূর্তে পুলিশকে খবর দিয়ে রুবাইয়াকে ধরিয়ে দেয় হাতেনাতে। ঘুষ গ্রহণ করার অপরাধে রুবাইয়া চাকরীচ্যুত হয় এবং জেলে যায়। সিরাত যখন জানতে পারে তার মা ঘুষ গ্রহণের দায়ে জেলে আছে তখন তার নানুকে কল দিয়ে বলে, এমন মায়ের দরকার নেই। যে মায়ের জন্য আমাদের মান সম্মান নষ্ট হয়, আমি এমন মায়ের সাথে কথা বলতে চাইনা, আমি আর যাব না বাংলাদেশে। এদিকে আরাফ সেও তার মাকে দেখতে আসে না, আরাফের মনে হয় তার মা তার বাবার আর দাদির প্রতি যে অন্যায় করছে সেটার শাস্তি পাচ্ছে।

রুবাইয়ার মা-বাবা রুবাইয়াকে জামিনে মুক্ত করে, যা টাকা পয়সা ছিল সবকিছু আইন-আদালত করতে করতে শেষ হয়ে যায়। শেষে রয়ে যায় বাবুর রেখে যাওয়া ফ্ল্যাটটা, সেটা বিক্রি করে রুবাইয়া মামলা থেকে অব্যাহতি পায়। তারপর চলে যায় মায়ের বাসায়, সিরাত অস্ট্রেলিয়াতে চাকরি করে আর বাংলাদেশে ফিরেনা। রুবাইয়া অনেক কান্নাকাটি করে সিরাতকে দেখার জন্য।

সিরাত বলে, এমন মায়ের দরকারই নেই, ঘুষ নেওয়ার অপরাধে যে জেল খাটে সে মায়ের সাথে দেখা না করাই ভালো।

রুবাইয়া কেঁদে কেঁদে বলে, আমি তো তোদের জন্যই এগুলো করতে চেয়েছি, তোর বাবা অসুস্থ হবার পর তোকে অস্ট্রেলিয়া লেখাপড়া করানোর জন্য ততটা সামর্থ্য আমাদের ছিল না, আমি তোকে অস্ট্রেলিয়ার পাঠাই। কিন্তু তোর চাহিদা পূরণ করতে যেয়ে আমাকে অসৎ পথে ঘুষ গ্রহণ করতে হয়। এদিকে আরাফের লেখাপড়ার খরচ আরেকদিকে তোর চাহিদা আমি কি নিজের জন্য কিছু করেছি? যা করেছি তোদের জন্য করেছি।

তখন সিরাত উত্তর দেয়, তুমি আমাকে বললে না কেনো অস্ট্রেলিয়া লেখাপড়া করাতে পারবেনা, সে সামর্থ্য তোমার নেই, আমি তো তোমাকে জোর করিনি। তাই বলে তুমি অসৎ উপায়ে টাকা কামাবে, সমাজের কাছে আমাদেরকে নিচু করবে। বাবা তো কখনও ঘুষ গ্রহণ করেননি খারাপ কাজ করেনি, সে ভালোভাবে সংসার চালাইছে। কিন্তু তুমি সুখের সংসারে অশান্তি শুরু করেছিলে, তোমার পাপের কারণে আজ তোমার অধঃপতন, আমি এখানে ভালো আছি, তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবেনা।

তুই এটা কি বলিস, তোকে আমি কত ভালোবাসি, তোকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো। তুই বাংলাদেশে চলে আয়, এখানে এসে জব কর, আমরা সবাই একসঙ্গে থাকবো।

সিরাত ফোন কেটে দিলো, রুবাইয়া বুঝতে পারছে সিরাত তাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসলে তাকে না দেখে এত বছর থাকতো না। রুবাইয়ার চোখে পানি এসে গেছে, তার নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে, যে সন্তানদের জন্য সে এতকিছু করছে, সেই সন্তান তাকে ভালোবাসে না। সেইদিক দিয়ে বাবুর মা খুব ভাগ্যবতী ছিল, এই কথা মনে পড়ে রুবাইয়ার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবুকে তার মাকে ছাড়তে কতকিছুই না করছে তবুও বাবু তার মাকে ছাড়েনি, আর রুবাইয়া তার সন্তানকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ পাঠালো কত কষ্ট করে পড়ালো আর সেই সন্তান আজ তাকে অবহেলা করে। আরেক ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বের হয়েছে, আরাফ তার নানুর বাসায় এসে থাকেনা, মেসে থাকে। আরাফ তার মাকে বলে যেদিন নিজের বাসা করতে পারব সেদিন তোমাকে নিয়ে আসব আমি চাইনা মামা মামীর বাসায় থাকতে, তোমার থাকার ইচ্ছা তুমি থাকো।

রুবাইয়ার ভাইয়ের বউ সব সময় কথা শোনায় রুবাইয়াকে। রুবাইয়ার ভাইয়ের বউ তার ভাইকে বলে তোমার মা-বাবাকে না হয় খাওয়াবে তোমার বোন আমাদের এখানে থাকবে সেটা তো আমার সহ্য হবে না। তার ছেলে আছে বিদেশে লেখাপড়া করে চাকরি করে, এক টাকা খরচ পাঠায় না মায়ের জন্য, আরেক ছেলে সে মায়ের খোঁজ খবর নেয় না। এমন করে তো চলতে পারে না আমার সংসারের আয় উন্নতির কথা আমাকে ভাবতে হবে।

রুবাইয়া এত সব কথা সহ্য করতে পারেনা, সে বুঝতে পারে ভাইয়ের সংসারে সে বোঝা হবে গেছে। রুবাইয়া পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে এক বাসায় আয়ার চাকরি নেয়। তার এই পরিস্থিতির জন্য সে নিজেই দায়ী, যে ছেলেকে মানুষ করার জন্য এত কিছু করলো সে ছেলে আছে তাকে ঘৃনা করে। রুবাইয়া ভাবে তাহলে কি আমি আমার সন্তানকে মানুষ করতে পারিনি? এত লেখাপড়া করিয়ে অমানুষ করে ফেললাম। আরাফ যখন শুনতে পারে তার মা অন্যজনের বাসায় আয়ার কাজ করছে, তখন সে তার মাকে নিয়ে যায় তার কাছে। একটা বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানেই থাকে মাকে নিয়ে এবং টিউশনি করে সংসার চালায়। কিছুদিন পর আরাফের চাকরি হয়ে যায়, এখন সে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে মাকে নিয়ে সেখানেই থাকে। আরাফ যখন টিউশনি করায় পরিচয় হয় বৃষ্টির সাথে, বৃষ্টির ছোটভাইকে আরাফ প্রাইভেট পড়াতো। বৃষ্টির আরাফকে ভালো লেগে যায়, তাদের মাঝে সম্পর্ক হয় বন্ধুত্বের। বৃষ্টির বাবা সেনাবাহিনী মেজর। বৃষ্টি আরাফকে প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব দেয়, আরাফ তাতে রাজী হতে চায়নি, আরাফ বৃষ্টিকে জানায় সে তার মাকে নিয়ে টিউশনি করে সংসার চালায়, আর বৃষ্টির পরিবার উচ্চবিত্ত বৃষ্টির বাবা কখনো আরাফকে মেনে নিতে চাইবে না।
বৃষ্টি তাকে বুঝায় তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছ জব পেয়ে গেলেই বাবাকে বললে, বাবা তোমাকে মেনে নিবে। বৃষ্টির কথা আরাফ ভেবে দেখে ঠিকই তো ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছি চাকরি হয়ে গেলে বৃষ্টির বাবার সামনে দাঁড়াবো তখন অবশ্যই মেনে নিবে, যেকোনো সময় আমার চাকরি হয়ে যাবে। তখন আরাফ বৃষ্টিকে বলে যতদিন পর্যন্ত আমি প্রতিষ্ঠিত না হই আমাদের রিলেশন গোপন থাকবে আমি প্রতিষ্ঠিত হবার পর তোমার বাবার সাথে কথা বলবো। তোমার বাবাকে বলবো তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই। বৃষ্টি এতদিন অপেক্ষা করছিল আরাফের চাকরি হবার, এখন চাকরি হবার পর বৃষ্টি আরাফকে তাড়া দিচ্ছিল তার বাবার সাথে কথা বলার জন্য। আরাফ বৃষ্টিকে বলল কয়েকটা দিন অপেক্ষা করো আমি সবকিছু গুছিয়ে নিই তারপর তোমার বাবার কাছে যাবো।

সিরাত আরাফ এর কাছে ফোন দিয়ে জানালো সে বাংলাদেশে আসবে, আরাফ বুঝতে পারল যখন শুনতে পারছে সে চাকরি পেয়েছে তার মাকে নিয়ে ভালোভাবে আছে তখন সিরাত বাংলাদেশে আসতে চাইছে। এতদিন যখন অভাবে ছিলো তারা তখন তো সিরাত বাংলাদেশে আসতে চায়নি।

অফিস থেকে এসে আরাফ তার মাকে বলল, আম্মু ভাইয়া সামনে মাসে বাংলাদেশে আসবে।

তুই সত্যি বলছিস সিরাত বাংলাদেশে আসবে, আমার সিরাত বাংলাদেশে আসবে। আরাফ মনে মনে বলে তোমার ছেলে স্বার্থনেশি, তোমার মতই হয়েছে যখন শুনেছে আমরা ভালো অবস্থানে আছি ভালো চাকরি করছি, বাংলাদেশে আসতে চাইছে এত বছর তো আসলো না। আরাফ নিজে একটা ফ্ল্যাট কিনতে চাচ্ছে, ফ্ল্যাট কেনার পরে বৃষ্টির বাবার সাথে কথা বলবে। বৃষ্টিকে আরাফ রুবাইয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রুবাইয়ার খুব পছন্দ হয়েছে বৃষ্টিকে ছেলের বউ বানাতে। রুবাইয়ার ইচ্ছা ছেলের বউকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসবে। যেন কোনদিন বলতে না পারে শাশুড়ি জ্বালাতন করে, দেখতে পারেনা।

আজ ৬ বছর পর সিরাত বাংলাদেশে আসছে, রুবাইয়া ছেলের পছন্দের অনেক কিছু রান্না করেছে।
খুব আদরের ছেলে সিরাত, রুবাইয়া আরাফ এর চেয়ে সিরাতকে বেশী ভালোবাসতো, সে ছেলের মুখ এত বছর পর দেখতে পাবে, রুবাইয়ার মনে আজ অনেক আনন্দ। আরাফ অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এয়ারপোর্টে গেল ভাইকে রিসিভ করতে। অস্ট্রেলিয়া থেকে এইমাত্র বিমান ল্যান্ড করল। আরাফ অপেক্ষা করছে ভাইয়ের জন্য, কিছুক্ষণ পরেই সিরাতকে দেখতে পেল আরাফ।সিরাতের সাথে একজন বিদেশিনীকে দেখে আরাফ বুঝতে পারলো না সিরাতের সাথে বিদেশিনী মেয়েটি কে? কাছে আসতে ভাইকে জড়িয়ে ধরল আরাফ, সিরাত বিদেশিনী মেয়েটির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো।

আরাফ এ হলো তোর ভাবি ক্যামেলিয়া, আমরা বিয়ে করেছি ছয় মাস হলো।

আরাফ খুব বেশি অবাক হয়ে গেল, তার ভাই তাদেরকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলছে, সে বুঝতে পারলো সিরাত মায়ের মত স্বার্থপর টাইপের, নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। আরাফ এটাও বুঝতে পারলো মাকে না জানিয়ে তার ভাই বিয়ে করেছে এতে তার মা খুব কষ্ট পাবে।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে