অনুতপ্ত পর্ব-০১

0
2894

#অনুতপ্ত ১ম পর্ব
#সাদমান হাসিব

আমার মা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বিধবা হয়, আমাকে সাত মাসের পেটে নিয়ে, তারপর আমার জন্ম। নানা-নানি চেয়েছিল আম্মুকে দ্বিতীয় বিয়ে দিয়ে সংসারী করতে, আম্মু তাতে রাজি হয়নি বলেছে আমার সন্তানকে আমি মানুষ করতে চাই। আমি যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি তখন আমার মামা আম্মুর জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে, বলে একটা লোক আছে তার সন্তান হয়না স্ত্রী কিছুদিন আগে মারা গিয়েছে সে লোক আমাকে সহ গ্রহণ করবে। আম্মু রাজী হতে চায়নি, অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করানো হয়। বিয়ের পর লোকটা আমাকে প্রথম প্রথম অনেক আদর যত্ন করে, কিন্তু কিছুদিন পর আম্মুর আড়ালে আমাকে মারধোর করতো, আর নিষেধ করত আমি যেন আম্মুকে না বলি। একদিন অনেক জোরে আমার গালে থাপ্পড় মারে, তার আঙ্গুলের দাগ আমার গালে চকচক হয় ভেসে উঠছিল, সেটা দেখে আম্মু বুঝতে পারে লোকটা আমাকে থাপ্পর মেরেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করার পরও আমি চুপ ছিলাম, আম্মু বুঝে নিয়েছে সেই লোকটা আমাকে মেরেছে। সাথে সাথে লোকটার গালে কষে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে আমাকে নিয়ে সেদিনই সে বাড়ি থেকে চলে আসে। নানু বাড়ি এসে বললো, যে লোকটা বলেছিল আমার সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো মানুষ করবে, বাবার স্নেহ ভালোবাসা দিবে সেই লোকটা আমার ৮ বছরের ছেলের গায়ে এভাবে হাত তুলছে। আমি আমার ছেলেকে নিয়ে জীবনটা পার করে দেবো, সেই লোকটার সাথে সংসার করবো না। আম্মু আমাকে নিয়ে ঢাকা চলে আসে নেমে পড়ে তার জীবন যুদ্ধে, মানুষের বাসায় কাজ করে আমাকে লেখাপড়া শিখায়।

লেখাপড়া শেষ করে এখন আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা, ভালো বেতনে ভালো পোস্টে চাকরি করি। ভালোবেসে বিয়ে করেছি রুবাইয়াকে, আমার ভালোবাসার মানুষকে আম্মু হাসিমুখে মেনে নেয়। রুবাইয়াকে ছেলের বউ হিসেবে নয় নিজের মেয়ের মত ভালোবাসে আমার আম্মু, কিন্তু রুবাইয়া আমার আম্মুকে সহ্য করতে পারেনা। এর প্রধান কারণ হলো আমি আম্মুকে খুব ভালোবাসি, অফিসে যাবার আগে আম্মুর কাছ থেকে দোয়া নিয়ে যাই, আবার অফিস থেকে ফিরে প্রথমে আম্মুর রুমে যাই আমার আম্মুর কী লাগবে না লাগবে সেটা তার কাছে জিজ্ঞেস করি, এটাই রুবাইয়ার সহ্য হয়না। আমি সন্তান হিসেবে আমার দায়িত্ব পালন করি। এটা নয় যে রুবাইয়ার প্রতি স্বামীর দায়িত্ব পালন করিনা, আমি রুবাইয়ার প্রতি স্বামী হিসেবে সকল দায়িত্ব পালন করি। কিন্তু মায়ের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে দেখে রুবাইয়া ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। কেন মায়ের প্রতি এত ভালোবাসা তার মনে হয় তার থেকে আম্মুকে বেশি ভালোবাসি। আমি আসলে তাকে বুঝাতে পারিনা মায়ের ভালোবাসা এক রকম, স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা আরেক রকম। রুবাইয়া আমাকে অনেক কথা বলে আমি তার প্রতিবাদ করি না কারণ সে এখন প্রেগন্যান্ট তাই তাঁকে উত্তেজিত করতে চাইনা, তাই সবকিছু সহ্য করে চলছি।

এর কিছুদিন পর আমার ছেলে সিরাতের জন্ম হয়, দেখতে দেখতে সিরাতের এখন এক বছর। দিনকে দিন রুবাইয়ার ব্যবহার খুব খারাপ হচ্ছে, সে চাচ্ছে না আমি আমার আম্মুর সাথে কথা বলি তার দেখাশোনা করি। রুবাইয়ার এমন কথা আম্মুর কানে পৌঁছে গেছে, তাই আম্মু খুব মনমরা হয়ে থাকে, আমাকে ডেকে বলে বাবু তুই আমাকে অন্য একটা বাসায় রেখে আস, আমার যা যা প্রয়োজন কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিবি। আমি চাইনা তোর সংসারে অশান্তি হোক, আমি তোর মুখের হাসি দেখতে চাই, তোর জন্য আমার জীবনটা ত্যাগ করেছি আমি চাই তুই সুখী হ।

আম্মুর মুখে হাত দিয়ে আর কথা বলতে দিলাম না, আমার চোখে পানি এসে গেছে, তাকে বললাম আম্মু তুমি যদি একথা দ্বিতীয় বার বল আমি মরে যাব, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না, তুমি আমার সব দুনিয়াতে মায়ের মত আপন কেহ নাই। স্ত্রী-সন্তান তারাও আমার আপন কিন্তু মায়ের মতো ভালোবাসা কেউ দিতে পারে না, এই দুনিয়া সবাই পর হয়ে যায় মা কখনও পর হয়না, তুমি আমাকে পর করে দিও না, কখনো পর করে দিও না। এটা বলতে বলতে আমি আম্মুর পায়ের নিচে মাথা রেখে কান্না করছি, এটা দেখে রুবাইয়া আরো বেশি জ্বলে উঠলো। সেদিনই আমার ছেলে সিরাতকে নিয়ে তার বাবার বাড়ি চলে গেল। আর বলে গেল তোমার আম্মু যা বলেছে তাই করো তাকে অন্য বাসায় রাখো, না হলে ভালো কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসো, মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দিবে। এই কথা বলার সাথে সাথে আমি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে থাপ্পর মেরে দিলাম আর সে পড়ে গেল, খাটের উপর পড়ে ঠোঁটের কোণে খানিকটা কেটে গেল। তার চিৎকারে আমার ছেলে চিৎকার করে কান্না শুরু করছে, আমি তখন তাকে ধরতে গেলাম, সে চিৎকার করে বলল আমাকে স্পর্শ করবে না, আমি তোমার সাথে সংসার করবো না, চলে যাচ্ছি আমার ছেলেকে নিয়ে। আমি তাকে বললাম, আমার ছেলেকে নিয়ে কোথাও যেতে পারবেনা তুমি, যেতে চাও একা চলে যাও আমার ছেলেকে নিতে পারবেনা।

কি বলছো ছেলেকে রেখে যেতে, কখনো না, আইনে ১২ বছর পর্যন্ত মায়ের অধিকার, ছেলে আমার কাছেই থাকবে ১২ বছরের পরে ছেলে যদি তোমার কাছে থাকতে চায় তাহলে নিতে পারবে তার আগে না।

আমি আর কিছু বললাম না আমার ছেলেকে নিয়ে রুবাইয়া চলে গেল। আম্মু আমাকে অনেক বুঝালো তাকে অন্যখানে রেখে আসতে, আর রুবাইয়াকে ফিরিয়ে আনতে। আম্মুকে বলে দিলাম তুমি কখনো বলবে না তোমাকে অন্যখানে রেখে আসতে, রুবাইয়া সংসার করতে চাইলে নিজেই আসবে।
একদিন দুইদিন করে সাতদিন হয়ে গেল রুবাইয়া ফিরে আসেনা, কল দিলে ধরে না আমার ছেলের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, এতদিন ছেলেকে না দেখে থাকি নাই কখনো। নিরুপায় হয়ে রুবাইয়ার বাসায় গেলাম, বললাম বাসায় ফিরে আসতে। সে বলল কখনো ফিরবো না তোমার মা ওই বাসায় থাকলে। আমি ছেলেকে কোলে নিতে চাইলাম, রুবাইয়া সিরাতকে আমার কোলে দিতে চায়না, বলে আমার কাছে দিলে নিয়ে চলে আসবো। তাকে বললাম কোলে দাও নিয়ে চলে যাব না, তোমাকে নিতে এসেছি।

তোমার মাকে নিয়ে আমি এক বাসায় থাকব না তুমি তোমার মাকে আলাদা করবে না, তাই আমি তোমার বাসায় যাবো না, আগে আলাদা কর তারপর নিতে এসো, না হলে নয়।

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুবাইয়াকে বললাম, ঠিক আছে চলো আম্মুকে আমি অন্য কোথাও রেখে আসবো।
আমার কথা শোনার সাথে সাথে রুবাইয়ার চোখ আনন্দে ঝলমল করে উঠলো।

সত্যি বলছো তুমি তোমার আম্মুকে অন্য কোথাও রেখে আসবে, না কি আমাকে নিয়ে যেতে মিথ্যা বলতেছো।

আমি মিথ্যা বলা পছন্দ করি না সত্যিই আম্মুকে রেখে আসবো।

ওকে তাহলে যাচ্ছি, মনে রেখো কাল পরশুর মধ্যে যদি তোমার মাকে অন্যথায় না রেখে আসো আমি আবার চলে আসবো।

আম্মুকে অন্যথায় রেখে আসবো এটা শুনে রুবাইয়ার যতটা আনন্দ হচ্ছে তার বিপরীতে আমার কলিজা পুড়ে যাচ্ছে, সেটা রুবাইয়া হয়তো বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চেষ্টা করছেনা। তার জিত হয়েছে এতেই সে আনন্দিত আমার কষ্ট দেখার মত মন-মানসিকতা তার নেই। আমার শাশুড়ি আমাকে বিকেলের নাস্তা দিল, খেয়ে রুবাইয়াকে বললাম রেডি হতে। রুবাইয়া আমাকে বলল আজ রাতটা থেকে যাবে, কাল দুপুরে তার বড় বোন রিমি আসবে, তাই কাল লাঞ্চের পরে বাসায় ফিরবে।

তখন আমি বললাম, ঠিক আছে তাহলে তুমি কাল চলে আসো আমি এখন যাই।

তুমি যাবে মানে, আজ তুমি থাকবে কাল আমরা একসঙ্গে যাব, আপু আসতেছে কাল সকালে, অনেকদিন ধরে আমার বোনটাকে দেখিনা।

রিমি আপুকে তুমি তিন মাস আগে দেখলে সেটা অনেকদিন হয়ে গেল।

তুমি বুঝবে কি আমার আপু আমার কতটা আদরের, সে আমাকে অনেক ভালোবাসে, তিন মাস দেখি না মনে হচ্ছে তিন বছর।

মনে মনে ভাবলাম, তোমার আপু তোমার আদরের হয় আর আমার মা অনাদরের, নিজেরটা ষোলআনা পরেরটা এক আনাও না।

আমি আম্মুকে বাসায় একা রেখে গিয়েছি তাই চলে আসতে চাচ্ছিলাম শ্বশুর-শাশুড়ির আবদারে থেকে যেতে হল। আম্মুকে কল দিয়ে বললাম রাতে আসবো না রুবাইয়াকে নিয়ে কাল বিকেলে আসবো। আম্মু খুশী হয়ে বললো ঠিক আছে বউ যে আসতে চেয়েছে এটাই অনেক।

রাতে অনেক রান্নাবান্না হয়েছে আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি অনেক খুশি, মনে হচ্ছে তাদের মেয়ে যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে। সেই যুদ্ধ জয়ের আনন্দে রাতে অনেক কিছু রান্না করেছে। আমার পেটে তেমন কিছু যাচ্ছে না, আমার মাকে আমার সাথে রাখতে পারব না এই শর্ত দিয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে হচ্ছে, আমি এমন সন্তান মাকে অন্যথায় রাখবো এই কথা কিভাবে বললাম। খুব কষ্ট পাচ্ছি বাট আমার সন্তানকে ছাড়াও থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমি মনে হয় সাগরের মাঝখানে পড়ে গেছি কি করব না করব ভেবে পাচ্ছি না। অল্প করে খেয়ে উঠে পরলাম, শাশুড়ি বলল কি বাবা তুমি এত অল্প খেলে কেন রান্না কি ভালো হয়নি, তোমার জন্য স্পেশাল পায়েস তৈরি করেছি তুমি তো পায়েস পছন্দ করো। তাদেরকে কিভাবে বুঝাবো আমার বুকের ভিতরে কতটা উত্তাল ঢেউ তোলপাড় করছে, শ্বাশুড়ীর কথা রাখতে দু’চামচ পায়েস মুখে দিলাম।

খাবার পর শ্বশুর আমাকে ডেকে বললেন, বাবা দেখো সংসারে এমন টুকটাক ঝগড়া লেগেই থাকে তাই বলে স্বামী স্ত্রী আলাদা থাকলে কেমন দেখায়। রুবাইয়কে আমি বুঝিয়েছি বাসায় চলে যেতে সে জিদ ধরে আছে তোমার মায়ের সাথে থাকবে না। আচ্ছা তুমি তোমার মাকে বোঝাতে পারো না সে যেন রুবায়াকে নিজের মেয়ের মত ভালোবাসে। শাশুড়িরা কেন যে এমন হয়, ছেলের বউকে মেয়ের মত ভালোবাসতে পারে না, শত্রু মনে করে।

আমি শ্বশুররের কথা শুনছি আর ভাবছি আপনি তো আপনার নিজের মেয়েকে মানুষ করতে পারেননি, সে আমার মাকে শত্রু মনে করে, দুচোখে দেখতে পারেনা, কেমন মেয়ে মানুষ করেছেন শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে বলে।
আমি চুপচাপ শ্বশুরের পরামর্শ শুনলাম, কিছু বললাম না, তারপর উঠে গেলাম ঘুমানোর জন্য। আসলে ঘুম তো আর হবে না বৃথা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা।

রুবাইয়াকে আজ অনেকটা খুশি খুশি লাগছে, সিরাতকে আমার বুকের উপর দিয়ে, আমার হাত নিয়ে হাতের উপর মাথা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রুবাইয়া শুইলো।

বাবু শোনো আমি একটা প্ল্যান করেছি, এই শীতে আমরা সুন্দরবন বেড়াতে যাব, সাথে কিন্তু আপু দুলাভাইকে নিয়ে যাব। আম্মু আব্বু যদি যেতে চায় তাহলে কি তোমার কোন আপত্তি আছে?

না কিসের আপত্তি থাকবে তোমার মা-বাবা তাদের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি, তারা আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি। সঙ্গে যেতে পারে এতে আমার আপত্তি থাকার কথা নয়, আমার মা হলে না হয় কথা ছিল, সেতো আর যেতে পারত না।

বাবু তুমি এটা কেমন কথা বললে, আমার মা-বাবার কথা বলাতে তোমার মাকে নিয়ে তুলনা দিয়ে কথা বললে, এটা তুমি ঠিক করলে না। আর শোনো তোমার মায়ের সাথে আমার মা-বাবা তুলনা করবেন না, এটা মাথায় রাখবে।

ও সরি আমি বুঝতে পারিনি তোমার মা-বাবার মূল্য অনেক বেশি আর আমার মা তো সাধারন একজন মানুষ তার সাথে তোমার মা বাবার তুলনা দিয়ে অনেক বড় ভুল করে ফেললাম।

তুমি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে চাও?

ঝগড়া করতে যাব কেন, তোমার সাথে ঝগড়া করার কোন ইচ্ছা আমার নেই।

রুবাইয়া উল্টো দিকে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল, সিরাতকে আমার বুকের উপর থেকে নামিয়ে জড়িয়ে ধরে আছি, আর ভাবছি একটা সন্তানকে মানুষ করতে কতটা কষ্ট হয় তুমি কেন বুঝতে চাও না রুবাইয়া। তোমার সন্তান যখন বড় হবে বিয়ে করবে তার স্ত্রীর কথায় তোমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখতে চাইবে তখন তোমার কেমন লাগবে, এটা কেন উপলব্ধি করতে পারোনা, প্লিজ একবার উপলব্ধি করে দেখো একটা সন্তান মানুষ করতে কতটা কষ্ট হয় বাবা-মায়ের। পরিশেষে বাবা-মা সন্তানের বোঝা হয় কি করে প্লিজ একটু ভাবো।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে