অতন্দ্রিলা_আর_বৃষ্টি শেষ পর্ব

0
1896

#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০

লেখনীতে- সানজিদা তাসনীম রিতু

অতন্দ্রিলা_আর_বৃষ্টি শেষ পর্ব

বৃদ্ধ লোকটি অভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন-“অভ্ৰ তুমি জানো যে তোমার বাবা আর ব্ল্যাকহোল তৈরি করতে পারছিলেন না আর অন্য সিস্টেমে তৈরি করতে গিয়ে উনি ব্ল্যাকহোলের সাথে হারিয়ে যান, কিন্তু উনি আসলে ওটা অন্যভাবেই বানিয়েছিলেন সেরিন ধ্বংসের জন্য। কিন্তু সেরিন ধ্বংস করা যাচ্ছিলো না, তাই উনি সিদ্ধান্ত নেন যে উনি স্পেসটিউবে করে সেরিনে যাবেন আর সেরিনের সাথে মিশে গ্রহটিকে নিয়েই চলে যাবেন ব্ল্যাকহোলের মধ্যে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তোমার বাবা তার পরবর্তী পরিকল্পনা আমাদের বুঝিয়ে তোমাদের জন্য এই রেকর্ডটি তৈরি করেন। উনি আমাকে ব্ল্যাকহোল তৈরির তত্ত্ব দিয়ে গেছিলেন আর এটাও বলেছিলেন আর মাত্র একটি ব্ল্যাকহোল তৈরি সম্ভব, কারণ অপরিমিত কৃত্রিম ব্ল্যাকহোল আমাদের গ্রহকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। সময় বিকৃত হতে হতে একাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে ক্রিপটি। তুমি তো জানো ব্ল্যাকহোল তৈরিতে কতোটা শক্তি লাগে আর সেটি কতোটা ভয়াবহ হয়।”
-“হ্যা।” বললো অভ্ৰ।

–“তোমার বাবা বলেছিলেন যদি সেরিন নিয়ে উনি চলে যেতে পারেন তাহলে তুমি উনার সব কিছুর দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্য হওয়ার পর যেনো শেষ ব্ল্যাকহোলটি বানিয়ে তার মাধ্যমে তোমাদের পূর্ণ ভাবে ফিরিয়ে আনি ক্রিপটিতে আর তোমাদের সবকিছু জানিয়ে দেই। তোমার বাবা সেরিনের অংশ হয়ে চলে গেছেন। আমরা জানতে পেরেছি যে সেরিন এখন এমন একটি গ্যালাক্সির সৌরজগতে আছে যেখান থেকে সেটি আর ফিরতে পারবেনা, আর খুব দ্রুত সেই গ্যালাক্সির সূর্যের সাথে মিশে শেষ হয়ে যাবে।”
চোখে পানি টলমল করে ওঠে অভ্রের।
–“মন খারাপ করোনা অভ্ৰ, উনি একজন আদর্শ মানুষ এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী ছিলেন তাই নিজের গ্রহের জন্যে আমাদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন।” একটু থেমে উনি ভরসার হাসি দিয়ে অভ্রর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন-

–“তোমার বাবার সবকিছুই তুমি এখন থেকে ব্যবহার করতে পারবে, আর তুমি চাইলে যেকোনো সময় আমাদের সাথে যুক্ত হতে পারবে। আমরা আশা করবো তুমি তোমার বাবার মতোই বিচক্ষন বিজ্ঞানী হবে কারণ এতোবছর ধরে তোমায় চলাফেরা, জানার আগ্রহ, মহাকাশ নিয়ে গবেষণা সবকিছুই আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। তোমাদের মেয়ে রিহা পরিপূর্ণ ভাবে ক্রিপটির সদস্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সূত্রধর। তন্দ্রার গর্ভপাত হওয়ার পর রিহার শরীর নষ্ট হয়ে যায় তাই স্বয়ংক্রিয় ভাবেই ও ক্রিপটিতে জেগে ওঠে। যেহেতু ও তোমার সাথে যুক্ত তাই ওকে আমরা তোমার কাছে তোমার গাড়িতে রেখে দেই তোমার অজান্তেই। আর তন্দ্রার মাঝে কিছু বেসিক পরিবর্তন আনতে হবে, যা আমরা ডাটা ইনপুট করে দিবো সময়মতো।”
=”আমার কিছু জানার ছিলো।” অতন্দ্রিলা বললো। এতোক্ষন সে চুপচাপ হতবাক হয়ে সব শুনছিলো।
–“হ্যা, তন্দ্রা বলো।” বলে উনি অতন্দ্রিলার দিকে তাকালেন।
=”অভ্ৰ আর আমাকে যেভাবে আনা হয়েছে তাতে কি পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয়েছে?”
–“পৃথিবীর গুরুতর কোনো ক্ষতি হয়নি। তুমি তো জেনেছো এতোক্ষনে ব্ল্যাকহোলের ব্যাপারে, এর থেকে নির্গত রশ্মির শক্তির ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা আগে থেকেই জানতো তাই তারা পদক্ষেপও নিয়েছিলো। এতে কোনো মানুষ বা প্রাণীর ক্ষতি হয়নি, পরিবেশের যেই ক্ষতিটুকু হয়েছে তা দ্রুতই প্রকৃতি পুষিয়ে নিবে। চিন্তা করোনা, পৃথিবী সুস্থ আছে।”
স্বস্তির নিঃস্বাস ছেড়ে অতন্দ্রিলা আবার বললো- “আর একটা জিনিস, এই বাড়িটা পৃথিবীর আমাদের বাড়ির মতো কেনো?”
বৃদ্ধ লোকটি হালকা হেসে বললেন–“অভ্রর বাবা একজন বিচক্ষণ বিজ্ঞানী হলেও অনেক সৌখিন ছিলেন, অভ্রর পৃথিবীর বাবার বাড়ির ডিজাইন তার খুব পছন্দ হয়েছিলো তাই তিনি এই বাড়িটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এমনভাবে ডিজাইন করেন যাতে এটা দেখতে পৃথিবীর ওই বাড়িটির মতো হয়, কিন্তু এর ভিতরেই আমাদের বাড়ির মতো সকল প্রযুক্তি সেট করে দিয়েছিলেন সেটা তুমি দেখতেই পারছো, আর তাছাড়া তোমরা এই বাড়িতে থেকে অভ্যস্থ হবে এটাও উনি ভেবে রেখেছিলেন।”
=”জী বুঝতে পেরেছি।” বলে উনার দিকে তাকিয়ে হাসলো অতন্দ্রিলা।

এরপর উনি তিনজনের দিকেই একবার করে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন–“তোমরা ভালো থাকো। তোমাদের দরকারি সবকিছুই তোমরা পেয়ে যাবে। আমাদের কাউকে যদি দরকার হয় তাহলে জানিও, তোমাদের সাথে আমাদের সর্বক্ষণ যোগাযোগ থাকবে।” বলে উনারা বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
উনারা চলে যাওয়ার পর কাঁচের স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে ইটের দেয়ালে পরিণত হলো। অভ্ৰ আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অতন্দ্রিলার দিকে তাকিয়ে হাসলো। সেই হাসিতে স্বস্তি, ভরসা, সব কিছু পাওয়ার আনন্দ ছিলো।
অতন্দ্রিলা অভ্রর দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে রিহার দিকে তাকিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের সাথে লাগোয়া বেলকনির দিকে এগিয়ে গেলো। অভ্ৰও ওকে অনুসরণ করলো।

দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে বাইরের দিকে তাকিয়ে। রিহা অতন্দ্রিলার কোলে খিলখিল হাসির রব তুলেছে। ওদিকে রঙিন আকাশ ভেঙে রঙিন বৃষ্টিমালা ঝরতে শুরু করেছে। অতন্দ্রিলা রিহার দিকে কিছুক্ষন অপলক তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে বাইরে তাকালো, ভাবছে সে- ‘এই বৃষ্টি আজ আর আকাশের কান্না নয়, এই বৃষ্টি সকল কষ্টের উর্ধে, এই বৃষ্টি আনন্দের বৃষ্টি, এই বৃষ্টি কখন থামবে কে জানে। না থামলেই বা ক্ষতি কি।’
=”অভ্ৰ…” অতন্দ্রিলার ডাকে অভ্ৰ ওর দিকে তাকাতে ও বললো- “একটা জিনিস তো অজানাই থেকে গেলো।”
-“কী?”
=”জানা হলো না তো আমাদের সাথে বৃষ্টির কী সম্পর্ক?”
অভ্ৰ হালকা হেসে রিহার গাল টেনে ওকে নিজের কোলে নিয়ে অতন্দ্রিলার হাত ধরে বললো- “কিছু না হয় এখন অজানায় থাক। লম্বা জীবন পরে আছে, আস্তে আস্তে নাহয় জেনে নিবো সব দুজনে মিলে।” একটু থেমে গভীর আবেগ ভরা চোখে অতন্দ্রিলার দিকে তাকালো অভ্ৰ, তারপর বললো- “তবে তোমাকে কিন্তু এখন থেকে রোজ আমার প্রিয় গান শোনাতে হবে আর আমি আগের মতো তোমাকে অতন্দ্রিলাই ডাকবো। তোমার জন্য এই নামই ঠিক আছে।” বলে মুচকী হাসলো অভ্ৰ।
অভ্রর মুখে সেই পরিচিত দুষ্টুমি মাখা হাসি আর চাহনী দেখে অতন্দ্রিলাও হেসে ওর কাঁধে মাথা রাখলো। অভ্ৰ একহাতে রিহাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে অতন্দ্রিলার কপালে আর মুখে লেগে থাকা চুল সরিয়ে কানের পাশে গুঁজে ওর কপালে ঠোঁট ছোয়ালো। লজ্জায় অতন্দ্রিলার ফরসা গাল লাল হয়ে গেলো, তার লজ্জা পাওয়া দেখে অভ্ৰ বেশ জোরেই শব্দ করে হেসে ফেললো। অভ্রর হাসি দেখে অতন্দ্রিলা ওর বুকে আলতো আদুরে ঘুষি মেরে লাজুক হাসি দিলো। রিহা এটা দেখে একবার ওর বাবার দিকে তাকালো তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে ওদের হাসির সাথে তাল মিলিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ছোট্ট দুহাতে দুজনের গলা জড়িয়ে ধরলো।
হয়তো এভাবেই আবেগ, ভালোবাসা আর বৃষ্টিমাখা হয়ে কাটবে ওদের পরবর্তী দিনগুলো। ভালো থাকুক ওরা, ভালো থাকুক ক্রিপটি।

‘আমার কথাটি ফুরোল নটে গাছটি মুরোলো।’

√কিছু তথ্য:-
*স্পেসটিউব হলো মহাকাশযানের একটি ক্ষুদ্র অংশ বা ক্ষুদ্র মহাকাশযান বলা যেতে পারে, যাতে মহাকাশযানের মতো সুবিধা রয়েছে কিন্তু এটি জরুরী ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য তাই কম দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে।
**কৃত্রিম ব্ল্যাকহোল তৈরি সম্ভব না, ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে বানানো যাবে কিনা আমার ধারণা নেই। ব্ল্যাকহোল থেকে কোনোকিছুই অন্য কোথাও যায়না, কোনোকিছু ট্র্যাক করাও সম্ভব না। ব্ল্যাকহোলের কেন্দ্রের ছিদ্র এতোই ক্ষুদ্র যে তার ভিতর দিয়ে অনু পরমাণু যেতে পারবে হয়তো কিন্তু ফিরে আসা অসম্ভব।
***ক্রিস্টাল রেকর্ড হলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বানানো থ্রিডি ফুটেজ বা ইমেজ, যার মাধ্যমে কথা বলা মানুষটি সামনেই আছে এমন অথবা ঘরের মধ্যে থেকেই কথা বলছে মনে হয়।
****স্পিরিট অর্থ হলো আত্মা।

*গল্পটি রোমান্স এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সংমিশ্রনে বানানোর চেষ্টা করেছি, তবে কিছু তথ্য সঠিক দেওয়া হয়েছে গল্পটি বুঝতে পারার সুবিধার্থে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে