#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
লেখনীতে- সানজিদা তাসনীম রিতু
অতন্দ্রিলা_আর_বৃষ্টি পর্ব-৬
পৃথিবীর রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। সারা শরীর সহ মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা নিয়ে হালকা ভাবে চোখ খুললো অভ্র। আঁকাবাঁকা হয়ে বিছানার উপর পড়ে আছে সে। মুখের ভিতর কেমন নোনতা আর ঝাঁঝালো স্বাদ। হাত তুলতে গেলো পারলো না, খুব ব্যথা। আস্তে করে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো অতন্দ্রিলা তার পাশেই পড়ে আছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলো কেমন ফ্যাকাসে লাগছে ওকে, নিষ্প্রাণের মতো। অপলক তাকিয়ে দেখছে অভ্র, নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে অতন্দ্রিলার শরীর, কোনো ক্ষত নেই শরীরে কিন্তু ওঠানামা করছেনা বুক। অভ্ৰ বুঝতে পারলো অতন্দ্রিলা মারা গেছে। গুমরে কেঁদে উঠলো অভ্র, কী করবে ও এখন! কীই বা করতে পারবে, ও তো নড়াচড়াও করতে পারেনা একা। কলিংবেল বেজে উঠতে চমকে উঠলো অভ্ৰ। ‘সার্ভেন্টসরা এসেছে বোধহয়’ ভাবলো সে। এবার দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দে চিল্লিয়ে কিছু বলতে গেলো কিন্তু ব্যাথার তীব্রতায় গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলোনা তার। কলিংবেল বাজতে বাজতে থেমে গেলো, কেউ আর দরজা ধাক্কাচ্ছে না। অসহায়ের মতো পরে থেকে নীরবে শুধু কাঁদতেই থাকলো অভ্র।
অনেক্ষন হয়ে গেছে তীব্র যন্ত্রণাটা যেনো বেড়েই চলেছে, অভ্র আর কাঁদতে পারছেনা, ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। নিঃস্বাস নিতে পারছেনা ঠিকমতো, তার ফুসফুস হাঁসফাঁস করছে একটু অক্সিজেনের জন্য। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ওর। অভ্ৰর মনে হচ্ছে ওকে কেউ টানছে। মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতর হয়ে গেলো সে, অনেক কষ্টে আরেকবার চোখ খুলে অতন্দ্রিলাকে দেখে ও চোখ বুজলো। ও অনুভব করলো ও তলিয়ে যাচ্ছে। কষ্ট, ব্যাথা সব চলে যাচ্ছে, শরীর হালকা হয়ে যাচ্ছে, অতলে আরও নীচে তলিয়ে যেতে থাকে সে।
=”অভ্র!” হালকা ভাবে চিৎকার দিয়ে মুখে হাত চাপা দিলো অতন্দ্রিলা!
-“কি হলো?” অভ্ৰ তাকিয়ে দেখলো চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে অতন্দ্রিলা।
=”তোমার শরীরের আলো আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে, এটা কি আগেও হয়েছে কখনো?
-“না তো।” অবাক হয়ে নিজের শরীর দেখতে থাকলো অভ্ৰ। কেমন আস্তে আস্তে ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে ওর শরীরের আলো।
হঠাৎ একটা আচমকা গায়েবী ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো অভ্ৰ।
অভ্রর শরীরের পুরোটা আলো চলে যাওয়ার পর ও চোখ মেলে দেখলো খুব পরিচিত একটা মুখ ওর মুখের উপর ঝুকে আছে। ওর মাথাটা ধরে আস্তে করে ওকে উঠে বসালো।
-“অতন্দ্রিলা…” গভীর আবেগে ডেকে কিছু বলতে গেলো অভ্ৰ।
=”তোমাকে এখন পুরোপুরি আমার অভ্রর মতো লাগছে।” অভ্রর কথার মাঝে কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালো অতন্দ্রিলা।
অভ্ৰ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো- “আমি তো তোমার…” হঠাৎ তার কথার মাঝে গায়েবী কণ্ঠে কেউ কথা বলে উঠলো-
–“অভ্ৰ, স্বাগতম তোমার নতুন জীবনে।”
অভ্ৰ আর অতন্দ্রিলা দুজনই অবাক হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে কণ্ঠের উৎস খুঁজতে লাগলো কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলোনা।
–“অভ্ৰ, আমি তোমার বাবা বলছি। আমাকে কোনো প্রশ্ন করোনা কারণ তোমরা এখন যা কিছু শুনবে সব রেকর্ড করা। তোমরা যেহেতু আজ আমার কথা শুনছো তারমানে তোমরা ৩ জন আজ ক্রিপটি গ্রহে। আর সবকিছুই আমাদের হিসাব মতোই ঘটেছে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য। তোমাকেও স্বাগতম তন্দ্রা।” বলে একটু থামলো গায়েবী কণ্ঠ।
–“এখন আমি কিছু কথা বলবো যেগুলো তোমরা জানোনা। আজ সেগুলো জানবে আর ক্রিপটির সাথে শুরু হবে তোমাদের নতুন পরিচিতি।”
অভ্ৰ আর অতন্দ্রিলা দুজন হতবাক হয়ে শুনতে থাকে কথা।
–“তন্দ্রা, তুমি এতক্ষনে জেনে গেছো যে তুমি এই ক্রিপটিরই একজন। হ্যা, তোমার নাম তন্দ্রা। তোমার পৃথিবীর বাবা মা তোমার নাম রাখে অতন্দ্রিলা।
আর যেই অভ্রকে তুমি তোমার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলে সে তোমার সাথে ছিলো পৃথিবীতে এখনও আছে তোমার সাথেই ক্রিপটিতে।”
এটুকু বলতেই অতন্দ্রিলা অবাক হয়ে তাকালো অভ্রর দিকে।
–“অভ্ৰকে আমি পৃথিবীর বাংলাদেশে আমার এক বিশেষ বিজ্ঞানী বন্ধুর কাছে রেখেছিলাম, যাকে অভ্ৰ বাবা হিসেবে জানতো। তার সাথে আমার স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যোগাযোগ হতো। সে আমার কাজ সম্পর্কে জানতো আর অনেক সহায়তাও করেছে। তাকে তার করণীয় সব কিছুই বলে দেওয়া হয়েছিলো তাই সে মারা যাওয়ার আগে অভ্রের প্রতি তার সব দায়িত্ব পালন করেই গিয়েছে। তাকে যাবতীয় নির্দেশনা দিয়েছিলাম আমি।” অভ্রর বাবার কথা শেষ হতেই একটা রোবট এসে রিহাকে ওদের কাছে দিয়ে চলে যায়। তখন দেওয়াল ভেদ করে একটা স্বচ্ছ কাঁচের কী-বোর্ড এগিয়ে আসে যেটার উপর তিনটি হাতের ছাপের চিহ্ন আছে, দুই পাশে দুটি বড় আর মাঝে একটি ছোট হাতের ছাপের চিহ্ন।
–“আমি তোমাদের কিছু দেখাতে চাই, তোমরা অনুগ্রহ করে মাপ অনুযায়ী হাতের ছাপের জায়গায় হাত রাখো।” আবারও বলে উঠলো অভ্ৰর বাবার কণ্ঠ।
অভ্ৰ আর অতন্দ্রিলা রিহার হাত ধরে হাতের ছাপের উপর রাখে তারপর ওরা দুজনও হাত রাখে। হঠাৎ আশেপাশের সবকিছু ঝাপসা হয়ে যায়, ওদের সামনের বড় দেয়াল ক্রিস্টাল স্ক্রিনে রূপান্তরিত হয়, ওরা দেখতে থাকে…
তিনটি ছোট্ট টিউবে ভ্রূণ নেওয়া হচ্ছে। আশেপাশে আরও অনেক ভ্রূণ নেওয়া হচ্ছে কিন্তু এই তিনটি ভ্রূণ যেনো একটু আলাদা, বিশেষ ধরনের টিউবে রাখা হচ্ছে এই তিনটি।
-“তোমাকে যেভাবে বলেছিলাম সেভাবেই সবকিছু দিয়েছো তো এই তিনটাতে?” দেখা যায় অভ্রর বাবাকে, উনিই কথাগুলো বললেন।
–“জি স্যার।” একজন কম বয়স্ক বিজ্ঞানী বললো।
-“মনে রেখো এই তিনটি কিন্তু খুবই বিশেষ আমাদের জন্য।” সাবধান করে বললেন অভ্ৰর বাবা, চোখে মুখে চিন্তা আর বিজয়ের ছাপ স্পষ্ট।
তারপর দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়। দেখা যায় তিনটি স্লিপিং টিউবে ওই তিনটি ভ্রূণের মতো আরো তিনটি ভ্রূণ কিন্তু অনেক ভালো ভাবে এই তিনটিকে লুকিয়ে রাখা হচ্ছে।
আবারও দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়, দেখা যায় পৃথিবীতে অভ্ৰ আর অতন্দ্রিলার ছোটবেলার কিছু দৃশ্য। আবার এদিকে ক্রিপটিতে অভ্রর একাকী বড় হওয়ারও কিছু দৃশ্য।
-“অভ্ৰ, তুমি আমার ছেলে, ক্রিপটির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ তুমি। তোমাকে ক্রিপটির ব্যাপারে আর আমাদের কাজ ও কাজের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানানো হয়েছে আবার অনেক কিছু গোপনও রাখা হয়েছে, যেমন আমার নির্দেশেই তোমার একটা সত্তা বা স্পিরিটের শক্তিকে বিশেষভাবে এখানে লুকিয়ে রাখা হয় আর আরেকটা সত্তাকে পৃথিবীতে রাখা হয়।
–“তন্দ্রা আর রিহাকে সম্পূর্ণ ভাবে পৃথিবীতে পাঠানো হলেও যেহেতু ওরা আমাদের গ্রহের আর আমাদের গ্রহের বয়সসীমা পৃথিবীর চেয়ে বেশি তাই ওদের চেতনাটাকে শুধু ওদের অবয়বের মধ্যে করে এখানে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় স্পেশাল ফ্রিজিঙ সিস্টেমে, যাতে কোনো কারণে পৃথিবীতে ওদের শরীর নষ্ট হলেও এখানে ওদের চেতনার সাথে জেগে উঠে নতুনভাবে আবার জীবনযাত্রা শুরু করতে পারে।” বলতেই থাকে অভ্রর বাবা, ওরা দুজন হতবাক হয়ে শুধু শুনছে সব।
–“অভ্ৰ, যেহেতু তোমার শরীর পৃথিবীতে ছিলো এতোদিন, আর তোমার শুধুমাত্র একটা সত্তাকে এখানে জাগিয়ে রাখা হয়েছিলো তাই তোমার শরীর থেকে আলো বের হতো। আজ তোমার পৃথিবীর শরীরের মৃত্যু ঘটে তাই আজ থেকে তুমি পরিপূর্ণ। ভালো থেকো অভ্ৰ, দোয়া করি তুমি আমার থেকেও বড় বিজ্ঞানী হও। তন্দ্রা, তুমি রিহা আর অভ্রর খেয়াল রেখো ঠিক যেভাবে পৃথিবীতেও ওকে আগলে রাখতে, বিদায়।” অভ্রর বাবার কথা শেষ হতেই অভ্ৰ আর অতন্দ্রিলা দুজন দুজনের দিকে অবাক হয়ে তাকায় তারপর দুদিক থেকে রিহার দুহাত শক্ত করে ধরে রাখে…
কয়েক মুহুর্ত পরে বেশকিছু প্রৌঢ় মানুষের প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে স্ক্রিনে, তাদের মধ্যে থেকে মাঝের জন হাসিমুখে বলে ওঠেন-
–“আমরা সবাই তোমার বাবা-মায়ের বন্ধু ও সহকর্মী অভ্ৰ। এতোদিন আমরাই তোমাকে আগলে রেখেছি। আজ থেকে তুমি পুরোপুরি মুক্ত। তুমি যা খুশি করতে পারবে, যেখানে ইচ্ছা যেতে পারবে।”
-“কিন্তু সেরিন? সেরিন কী বাঁচতে দিবে আমাদের?” চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করে অভ্রর।