অতন্দ্রিলার রোদ পর্ব: ১০(ইরাবতীর ইশকুল)

0
903

অতন্দ্রিলার রোদ
পর্ব: ১০(ইরাবতীর ইশকুল)
লেখা : শঙ্খিনী

ঢাকার অদূরে সাভার এলাকায় রোদের বাবা ইউসুফ সাহেবের বিশাল জমি। মৃত্যুর আগে উনি জায়গাটি রোদের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। এখানেই শুরু হবে ইরাবতীর ইশকুলের কাজ।
আজ সকাল থেকেই অতন্দ্রিলা এখানে। ফাঁকা জমিতে দাঁড়িয়েও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে  বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে, গান গাইছে, লেখাপড়া করছে।

       অতন্দ্রিলা আঙ্গুল উচিয়ে রোদকে বলল, “ওখানে, ওখানে হবে স্কুলের মূল বিল্ডিং। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ে থাকবে ৫২ টা ক্লাসরুম, ১২ টা টিচার্স রুম, ৪ টা সাইন্স ল্যাব, ২ টা সিক রুম এবং এক সুবিশাল হলরুম।”
      রোদ বলল,“বিল্ডিংয়ের ডিজাইন তুমি করবে নাকি?”
       “আমি যদি আর্কিটেক্ট হতাম, তাহলে অবশ্যই করতাম। এখন আমি শুধু আপনাকে ধারনা দিচ্ছি।”
        “ভালো। এখন বলো হোস্টেলটা কোথায় হবে?”
        “স্কুল বিল্ডিংয়ের মুখোমুখি থাকবে আবাসিক হোষ্টেল। আমার অবশ্য ইচ্ছা আছে ছেলে এবং মেয়েদের জন্যে আলাদা আলাদা হোস্টেল করার। কারণ একটা ছেলে একটা মেয়েকে প্রাইভেসি দিতে পারে না, কিন্তু একটা মেয়েকে অন্য আরেকটা মেয়েকে প্রাইভেসি দিতে পারে।”
        “তুমি কি কোনো ভাবে বোঝাতে চাইছো যে আমি তোমাকে প্রাইভেসি দেই না?”
        “আপনার ব্যাপারটা আলাদা। কথা হচ্ছে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের প্রসঙ্গে। যাইহোক, যেটা বলছিলাম। হোস্টেলের ঠিক পাশেই থাকবে অবসর কেন্দ্র।”
        “অবসর কেন্দ্রটা আবার কি?”
         “বাচ্চারা লেখাপড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আসবে অবসর কেন্দ্রে। এখানে থাকবে লাইব্রেরী, গান এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র শেখার ব্যাবস্থা, ছবি আঁকার ব্যাবস্থা, নাচ শেখার ব্যাবস্থা। এই তিনটা বিল্ডিং ছাড়া যে ফাঁকা জায়গা অবশিষ্ট থাকবে, সেটাকে দুই অংশে ভাগ করা হবে। প্রথম অংশ হবে খেলার মাঠের। মাঠের একদিকে পিচ বানানো হবে, বাচ্চারা ক্রিকেট খেলবে। অন্যদিকে গোলপোস্ট টানিয়ে বাচ্চারা ফুটবল খেলবে।
দ্বিতীয় অংশটা হবে বাচ্চাদের ক্যাম্পাস। সেখানে থাকবে এক ভাস্কর্য।”
        “কার ভাস্কর্য?”
        “ইরাবতীর।”

রোদ মনে মনে স্বীকার করল, অতন্দ্রিলা মেয়েটার চিন্তাভাবনা অত্যন্ত গোছানো।

      রোদ শীতল গলায় বলল, “আচ্ছা ভালো কথা, স্কুলের অধ্যক্ষ হবে কে?”
      অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি।”
       “তুমি শিক্ষকতা জানো?”
       “অধ্যক্ষ হতে শিক্ষকতা জানতে হয় না। একজন অধ্যক্ষের তিনটা বিশেষত্ব থাকে। সেগুলো হলো – চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান, তীক্ষ্ম নজর এবং নেতৃত্বে পারদর্শিতা। তিনটাই আমার মধ্যে কমবেশি আছে। আমার ধারনা আমি পারবো।”
      “আমারও ধারনা তুমি পারবে। কারন তুমি যেকোনো কাজই অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে করো।”
     “জানি। একটা মজার কথা শুনবেন?”
      “হুঁ।”
      “স্কুলের উপাধ্যক্ষ হতে আবার দুটি গুণ লাগে। সেগুলো হলো – সকল ঘটনা তদারকি করতে পারা এবং যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারা। এই দুটি গুন আছে আমার আপার। তাই আমার আপা হবে এই স্কুলের উপাধ্যক্ষ।”
       “কিন্তু তোমার আপা তো তোমার পছন্দের মানুষদের তালিকায় নেই।”
        “তাতে কি হয়েছে? আপার মধ্যে এই দুটো গুন আছে। এছাড়া তিনি অতিরিক্ত কথা বলেন এবং মানুষকে অতিরিক্ত জ্ঞান দেন। এগুলোও একজন উপাধ্যক্ষের বৈশিষ্ট।”
        রোদ ক্লান্ত গলায় বলল, “আকাশের অবস্থা কিন্তু ভালো না, যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। ফিরে যাবে তন্দ্রি?”
         “চলুন।”

রোদ অতন্দ্রিলাকে পৌঁছে দিয়ে অফিসে চলে গেল। দুপুরের দিকে নামল ঝুম বৃষ্টি।
অতন্দ্রিলা চিন্তা করছে, এখন বৃষ্টিতে ভিজলে কি সেটা শিশুসুলভ কাজ হবে? নাহ্, বৃষ্টিতে অযথা নাচানাচি করা শিশুসুলভ কাজ। কিন্তু বৃষ্টিতে পাটি পেতে বসে থাকাটা শিশুসুলভ কাজ নয়।

অতন্দ্রিলা তা-ই করল। বৃষ্টির মধ্যে ছাদে পাটি পেতে বসে পরল। একদৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে সে।
একদৃষ্টিতে জানালার ভিতর থেকেও বৃষ্টি দেখা যেত। কিন্তু সেটা অনুভূত হত না।
এখন অতন্দ্রিলা একইসঙ্গে বৃষ্টি দেখছে এবং অনুভব করছে।
   
বৃষ্টিতে ভিজে অতন্দ্রিলার বেশ ভালো ঝামেলা হয়েছে। জ্বর এসেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে, চোখ কটকট করছে।
জ্বর এসেছে, আসতেই পারে। এটা হৈচৈ করে বাড়ির লোকদের জানানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাই অতন্দ্রিলা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।

সন্ধ্যা সাতটা। অতন্দ্রিলা চাদরের নিচে। সে বুঝতে পারছে না জেগে আছে নাকি স্বপ্ন দেখছে। হঠাৎ, কপালে এক হিমবাহের মত ঠান্ডা হাত অনুভব করল। তাকিয়ে দেখল, হাতটা রোদের। অতন্দ্রিলা বুঝতে পারলো, তার ঘুম ভেঙেছে।

অতন্দ্রিলা এখনো শুয়ে আছে।
       রোদ নিচু গলায় বলল, “জ্বর আসল কিভাবে?”
        “বৃষ্টির মধ্যে বসে ছিলাম।”
        “বৃষ্টির মধ্যে কেউ বসে থাকে?”
        অতন্দ্রিলা ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি থাকি। কেন থাকি সেটা এখন বলতে ইচ্ছা করছে না।”
         “বলতে হবেও না। একটু উঠে বসো তো তন্দ্রি।”

অতন্দ্রিলা উঠে বসল। রোদ সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে থার্মোমিটার দিয়ে দিল। কয়েক মিনিট পর ব্যস্ত ভঙ্গিমায় থার্মোমিটার হাতে নিল রোদ।
        অতন্দ্রিলা বলল, “কত জ্বর?”
        “একশ দুই পয়েন্ট পাঁচ। তুমি ওষুধ খেয়ে আবার শুয়ে পরো।”
        “খালি পেটে ওষুধ খাবো?”
       রোদ অতন্দ্রিলার দিকে প্যারাসিটামল এবং পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল,  “অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট খালি পেটে খাওয়া যায় না। প্যারাসিটামল খাওয়া যায়।”

অতন্দ্রিলা বাধ্য মেয়ের মতো ওষুধ খেয়ে শুয়ে পরল।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

রাত একটা। জ্বর কমার কোনো নামগন্ধ নেই।
রোদ অতন্দ্রিলা কপালে জলপট্টি দিতে ব্যস্ত।
         অতন্দ্রিলা বিড়বিড় করে বলল, “কেন করছেন আমার জন্যে এসব?”
         রোদ হতাশ গলায় বলল, “অসুখ নামের দানবটা খুবই ভয়ংকর। এই দানবের থাবায় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর একজনকে হারিয়েছি। দ্বিতীয়বার সেই দানবকে আমার আর কোনো প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিতে দেব না।”

অতন্দ্রিলার গা বেয়ে শীতল হওয়া বয়ে গেল। রোদ কি বলল? “আর কোনো প্রিয় মানুষকে কেড়ে নিতে দেব না।”
এর মানে কি? অতন্দ্রিলা রোদের প্রিয় মানুষগুলোর একজন? তাহলে তো মন্দ হয় না।

আজ ১৪ই মার্চ, অতন্দ্রিলার জম্মদিন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ১৫ কিংবা ১৬ই মার্চে পালিত হয়ে আসছে তার জন্মদিন। এর কারন হলো অতন্দ্রিলার পরিবারের প্রায় সকলে তার জন্মদিন মনে রাখতে পারে না।

একবার হলো কি, জন্মদিনের পরের দিন অতন্দ্রিলা স্বাভাবিক গলায় হামিদ সাহেবকে বলে, “বাবা জানো কাল না আমার জন্মদিন ছিল।”
হামিদ সাহেব এক দারুন অপরাধবোধে ভোগেন। সেই দিনই বাড়িতে ধুমধাম করে জন্মদিনের আয়োজন করা হয়।

গত বছর হামিদ সাহেব ঘোষনা দিয়েছিলেন, “এবার কিছুতেই অতর জন্মদিন ভুলে যাবো না।”
ঘোষণা অনুযায়ী তিনি ঠিক রাত বারোটায় ফুলের তোড়া নিয়ে অতন্দ্রিলার ঘরের দরজার সামনে উপস্থিত হন,জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। সময়টা একদম ঠিক থাকলেও, তারিখটা ছিল ভুল।
      অতন্দ্রিলা ফুলের তোড়া গ্রহণ করে স্বাভাবিক গলায় বলে, “ধন্যবাদ বাবা। কিন্তু আজ আমার জন্মদিন না। আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা দিবস। আমার জন্ম দিবস সামনের মাসে।”

অতন্দ্রিলার ধারনা, “জন্মদিন নিজস্ব আনন্দের দিন। এই দিনে নিজে নিজে আনন্দ করা উচিত।”
জন্মদিনে অতন্দ্রিলা সারারাত বই পড়ে। সকালে উঠে রান্না করে, ছাদে বসে গান গায়, নিজের সঙ্গে কথা বলে।

আজও হয়তো তা-ই করবে। রাত বারোটা বেজে গেছে ১২ মিনিট হয়েছে। আকাশে ঘন মেঘ করেছে, দমকা হাওয়া বইছে চারিদিকে।
অতন্দ্রিলার টেলিফোন বেজে উঠলো। টেলিফোন করেছে রোদ।
       রোদ ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, “একটু নিচে এসো তো।”

অতন্দ্রিলা বুঝে গেছে রোদ জন্মদিন উপলক্ষে কোনো আয়োজন করেছে। সে নিচে নেমে গেল।
নাহ্, নিচে কোথাও রোদ নেই। অতন্দ্রিলা বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দেখে রোদ গাড়িতে বসা।
      রোদ বলল, “তন্দ্রি গাড়িতে উঠে এসো।”

অতন্দ্রিলা কোনো প্রশ্ন না করে গাড়িতে উঠল।

       রোদ উৎসাহিত গলায় বলল, “শুভ জন্মদিন।”
        “জানলেন কি করে?”
         “চাইলেই জানা যায়। চলো তোমাকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই!”
       অতন্দ্রিলা বিস্মিত গলায় বলল,“কোথায়?”
         “গেলেই দেখতে পাবে।”

রোদ অতন্দ্রিলাকে নিয়ে গেল ফাঁকা এক ব্রিজের ওপর। গাড়ি থেকে নেমে রোদ গাড়ির পেছন থেকে একটা খাঁচা বের করল।
খাঁচাভর্তি পাখি।
         অতন্দ্রিলা কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “এসব কি?”
         “আজ তোমার জন্মদিন উপলক্ষে আমরা এই চব্বিশটা পাখিদেরকে বন্দী জীবন থেকে মুক্তি দিব।”
         “চব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল বলে চব্বিশটা পাখি?”
          “হুঁ!”

অতন্দ্রিলা মহা আনন্দে পাখিদের খাঁচা থেকে মুক্ত করছে। এভাবে কোনো মানুষকে যদি বন্দী জীবন থেকে মুক্তি দিতে পারতো, তাহলে  আরও বেশি আনন্দ হতো।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে