অতঃপর সন্ধি পর্ব-১৫+১৬

0
1853

##অতঃপর_সন্ধি (১৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

থমকিত পুষ্পিতা। মস্তিষ্ক কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। আর কিছুই সে ভাবতে পারছে না। ভাবতে গেলেই নিজেকে পাগল পাগল লাগছে তার। ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন যেন কয়েক মুহুর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। অনুভূতিশূন্য পুষ্পিতা জারিন ফোন করল।

‘বয়ফ্রেন্ড বিদেশ পড়তে গিয়েছে খুব ভাব বেড়েছে তাই না?’

‘আজ রাতের জন্য আমাদের বাসায় এসে থাকতে পারবি?’ নির্লিপ্ত, উদাসীন, ক্লান্তভাবাপন্ন গলার আওয়াজ পুষ্পিতার।

কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম রেখার ভাঁজ পড়ে জারিনের। পুষ্পিতার নির্জীব, নিষ্প্রভতা ভালো ঠেকলো না তার। চিন্তিত, তটস্থ গলায় প্রশ্ন করলো,

‘কি হয়েছে পুষ্পিতা? তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?’

পুষ্পিতা কম্পান্বিত, উদ্বিগ্ন গলা দিয়ে বহু কষ্টে উচ্চারণ করলো,

‘মানসিকভাবে আমি খুব একা জারিন। আমার তোর সঙ্গ দরকার। নিঃসঙ্গতা আর একাকিত্বে আমি আমার জীবনও নিয়ে নিতে পারি। মানসিক চাপ আমি আর নিতে পারছি না। আমার দম বন্ধ লাগছে। চারপাশের হাওয়া কেমন বিষে ভরা।’

‘পাগল হয়ে গেলি নাকি? আর কি হয়েছে বলবি তো।’

‘যাকে বেশি ভালোবাসি সেই আমাকে জীবন্ত লা’শ বানিয়ে দিলো জারিন।’

আর কথা বাড়ালো না সে। খট করে মোবাইল কে’টে দিলো।

জারিনের চিন্তা সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ছে। পুষ্পিতা খুশি হওয়ার বদলে এমন কেন করছে হিসাব মিলাতে পারছে না সে। ভাবতে ভাবতে সে তার মায়ের রুমে গেলো।

বিহ্বল, অস্থিরচিত্ত, উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বাইরে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা। আবছায়া নভোমণ্ডলে মিটিমিটি তারা জ্বলছে। পুষ্পিতা খুব করে চাইছে তার নিঃশ্বাস আটকে যাক সারাজীবনের মতো। এই বাতাসে আর স্নিগ্ধতা নেই আছে শুধু বিষাক্ততা। কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে।বড্ড কষ্ট।

‘পুষ্পি চা খাবি?’ দরজায় ঠকঠক করে বললেন আফসানা হক।

পুষ্পিতা শুনলো কিন্তু উত্তর দিলো না। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কন্ঠনালীতে এসেই আটকে যাচ্ছে সব।

আফসানা হক আবারও ডাকলেন। এবারও নিসাড়া রইলো পুষ্পিতা। আফসানা হক আরেকবার ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। রান্নাঘরের দিকে পা দিলেন। চা হাতে আবারও এলেন পুষ্পিতার রুমের সামনে। উতলা, অধীর স্বরে আবারও ডাকলো,

‘পুষ্পি মা ডাকছি। উত্তর দিচ্ছিস না কেন? চিন্তা হচ্ছে আমার। তুই কি ঘুমোচ্ছিস?’

পুষ্পিতা বহুকষ্টে মৃদুস্বরে মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো, ‘হুম।’

আফসানা হক দাঁত কটমট করতে লাগলেন।

‘আমারে টেনশন দিয়ে ঘুমা তোরা এই সন্ধ্যায়। চিন্তায় কলিজার পানি আমার শুকিয়ে গেল।’ পুষ্পিতাকে বকতে বকতে সোফায় গিয়ে বসলেন।

__________________________

মায়ানের কথাগুলো আর ভাবতে পারছে পুষ্পিতা। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। চোখ জোড়া নিভু নিভু করছে। ক্ষণে ক্ষণে বুক গলিয়ে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘ নিঃশ্বাস। পুষ্পিতার খুব ইচ্ছে করছে ঘুমের ঔষধ খেয়ে সারাজীবনের মতো ঘুমিয়ে যেতে। অস্থির লাগছে তার।

‘পুষ্পিতা আমি এসেছি। দরজা খোল।’

জারিনের আওয়াজ পেয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো সে। ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলল। জারিন রুমে ঢুকেই এক নিঃশ্বাসে বলতে লাগল,

‘তোর জন্য মায়ের কাছে কত মিথ্যে বলেছি জানিস? কত জেরার মুখোমুখি হয়েছি আমি? এসাইনমেন্টের দোহাই দিয়ে আসলাম। ভাইয়া দিয়ে গেলো। এখানে এসেও আন্টির জেরা। উফ! এখন বল কেস কি?’

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগল সে। পুষ্পিতা দরজার ছিটকিনি আটকে খুব শক্ত করে ঝাপটে ধরলো জারিনকে। আঁতকে উঠল জারিন। পুষ্পিতার আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় শরীর কেঁপে উঠল তার। মুহুর্তেই থমকে গেল সে। চিন্তারা মাথায় জট পাকাচ্ছে। পুষ্পিতার অদ্ভুত ব্যবহারে জারিনের মাথায় চিন্তার পাহাড় জুড়েছে।

পুষ্পিতা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ফোপাঁনো শুরু করে দিলো। পুষ্পিতার চোখের পানি জারিনের কাঁধ স্পর্শ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জারিন। আতংকিত হয়ে নিজ থেকে সরাতে চাইলে পুষ্পিতা আরো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

অনবরত শব্দহীন কেঁদেই চলেছে পুষ্পিতা। কি বললে পুষ্পিতার কান্না থামবে সেটাই বুঝতে পারছে জারিন। পুষ্পিতার সাথে সাথে সেও সেও কেঁদে দিলো। ফাঁকা ঢুক গিলে ক্রন্দনরত হতবিহ্বল, দূর্বল গলায় বলল,

‘এভাবে কাঁদলে আমি বুঝবো কিভাবে কি হয়েছে। আর আন্টি তোর কান্নার আওয়াজ শুনে যদি প্রশ্ন করে উত্তর দিতে পারবি?’

জারিনকে ছেড়ে বিছানায় গিয়ে বসল পুষ্পিতা। অবিরাম হেঁচকি দিচ্ছে সে। পুষ্পিতার পাশে গিয়ে জারিন বসল।

পুষ্পিতার কান্নার বেগ থেমেছে অনেক্ক্ষণ। চোখের কোণে পানি শুকিয়ে সাদা রেখা পড়েছে। বাদে বাদে কেঁপে উঠছে তার শরীর। জারিন পুষ্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অসহায়ের মতো উত্তর জানার আশায়।

জারিনের দিকে তাকিয়ে বিষন্ন, প্রাণহীন হাসলো পুষ্পিতা।

‘মায়ান আমার সাথে সব সম্পর্কের ইতি টেনেছে জারিন।’

বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় জারিন। চোখ জোড়া বড় বড় করে বলে,

‘কি?’

পুষ্পিতা চোখ বন্ধ করে মাথা দুলায়।

‘কোন অপরাধে? কাল অব্দি তো সব ঠিক ঠাক ছিলো।’

‘অপরাধ জানি না। শুধু জানি উনার আর আমার দূরত্ব শুধু শারীরিক না মানসিকও।’

‘মানে তুই সিউর তো? উনি তো তোর সাথে মজাও করতে পারে। তাই না?’

‘আমি নাকি উনার ব্রাইট ফিউচার দেখে উনাকে ছাড়তে চাইছি না।’

বলেই কাতর চোখে চেয়ে রইলো জারিনের দিকে। জারিন যেন বিস্মিত হয়ে গেলো।

‘মজা করুক আর সত্যি বলুক, ওই একটা কথার কাছে উনার সমস্ত ভালোবাসা ফিকে হয়ে গিয়েছে। যেখানে কথা ছিলো উনার জীবনের সকল অভাব একটু একটু করে দূর করার জন্য আমি উনার সঙ্গ দিবো।’ আর বলতে পারলো না কিছু। গলায় কথাগুলো আটকে গেলো পুষ্পিতার।

জারিন পুষ্পিতার হাত দু’টো দৃঢ়ভাবে ধরলো। সান্ত্বনার স্বরে কিছু বলার আগেই আফসানা হকের ডাকল পড়ল। হকচকিয়ে গেল জারিন। এইদিকে পুষ্পিতা বোধশক্তিহীন। জারিন কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। চোখ খিঁচে বন্ধ করে জবাব দিলো,

‘আন্টি এসাইনমেন্ট এখনো কমপ্লিট হয়নি।’

‘খাবি না তোরা?’

‘তুমি টেবিলে রেখে দাও। আমাদের জন্য অপেক্ষা করার দরকার নাই। এসাইনমেন্ট শেষ হলে আমরা খেয়ে নিবো।’

কথাগুলো বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।

_____________________

মানসিকভাবে ভেঙে পড়া পুষ্পিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো সে।ঘুম নেই জারিনের চোখে। সে কোনোভাবে সমীকরণ মিলাতে পারছে না। খুব সন্তর্পনে পুষ্পিতার পাশ থেকে উঠে এলো।পুষ্পিতার ঘুম ভেঙে গেলে আর রক্ষা নেই।

ডাটা অন করে সার্চ লিস্টে গিয়ে মায়ানের আইডির সন্ধান করলো।ফ্রেন্ডলিস্টে থাকলেও কখনো তার সাথে মায়ানের কথা হয়নি। মায়ানের আইডির পাশে সবুজ বাতি জ্বলছে। জারিন পুষ্পিতার দিকে এক নজর তাকাল। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে মেসেঞ্জার থেকে মায়ানকে কল করল।

অচেনা জায়গায় ঘুম আসছে না মায়ানের। বুকের ভেতরটায় শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। পুষ্পিতার কন্ঠস্বর শোনার জন্য মন কেমন মুখিয়ে আছে। অশান্ত হয়ে আছে অন্তঃস্থল। পুষ্পিতার সাথে একটু কথা বলতে পারলে হয়তো অশান্ত মন শান্ত হয়ে যেতো এক লহমায়। তবে সে গুড়ে বালি। অশান্ত মনকে শান্ত করার একমাত্র রাস্তা সে নিজেই বন্ধ করে করে দিয়েছে। কপালে হাত ঠেকিয়ে পুষ্পিতার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো কল্পনা করতে লাগল সে। দৈবাৎ রিংটোন এর শব্দে চমৎকৃত হলো। ‘তাহিয়াত জারিন’ আইডি থেকে কল এসেছে। পুষ্পিতার গলার আওয়াজ শুনতে পাবে সেই লোভে কল রিসিভ করে। সালাম দিলো জারিন। মায়ানও সালামের জবাব দিলো।

‘ভাইয়া আপনি কি সত্যি পুষ্পিতার সাথে সম্পর্কের ইতি টেনেছেন? নাকি পুষ্পিতা কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এমন করছেন?’

‘আপনার কি মনে হয়?’

‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না বলেই আপনার কাছে জিজ্ঞেস করলাম। যদি সারপ্রাইজ দেওয়ার মতলব থাকে তো বাদ দেন। আমাদের বন্ধুত্ব হওয়ার পর থেকে পুষ্পিতাকে এতোটা ভেঙে পড়তে দেখিনি। কয়েক ঘন্টায় পুষ্পিতা মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।’

ধঁক করে উঠলো মায়ান বুকের ভিতরটা। মেয়েটার মায়ায় জড়ানো তার মোটেও ঠিক হয়নি। ছোট্ট একটা ভুলের জন্য আজ দুইজন ভালোবাসার দহনে পুড়ছে। নিজের দূর্বলতা প্রকাশ না করে যথেষ্ট কঠিন আর গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘তো পুষ্পিতা আপনাকে বলেছে সালিসি করার জন্য?আমার পুষ্পিতাকে যা বলার বলে দিয়েছি।ইট’স ওভার।’

জারিন যেন বোকা বনে গেলো মায়ানের কথায়।প্রতিত্তোরে কি বলবে ভেবে পেলো না। কিয়ৎকাল চুপ থেকে রাশভারী গলায় বলল,

‘কিছু কিছু মানুষ না চাইতে অনেক কিছু পেয়ে যায়। যার কারণে সে সঠিক মূল্যায়ন করতে জানে না৷ আপনিও তার ব্যতিক্রম নন। আমি যা বুঝার বুঝে গিয়েছি।পুষ্পিতা আমাকে সালিসি করার জন্য বলেনি। পুষ্পিতার মানসিক অবস্থা দেখে আমি নিজ থেকে আপনাকে কল করেছিলাম। ভাবিনি এভাবে অপমানিত হবো। মাঝে মাঝে মানুষের মা’ই’রে’র আ’ঘা’ত থেকে কথার আ’ঘা’ত বেশি ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করে। আর আপনি সেটা অলরেডি পুষ্পিতাকে করে ফেলেছেন।’

কথা গুলো শেষ করে ফুস ফুস শ্বাস ফেলতে লাগল জারিন। নিজের প্রতি নিজের রাগ লাগছে।

চুপ করে মায়ান কথাগুলো শুনে গেলো। তার কাছে উত্তর নেই। এক কূল আঁকড়ে ধরতে গিয়ে আরেক কূল নদীতে বিলীন হয়ে গেলো। মায়ান খুব করে বলতে চাইল, ‘আপনার সাথে পুষ্পিতা থাকলে একটু ভিডিও দিবেন? আমার না মেয়েটাকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করছে।’ তবে তা মুখে প্রকাশ করতে পারলো না। মনের সুপ্ত মনোবাসনা মনেই চাপা পড়ে রইলো। মুখ খুলে মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে জারিনের হুংকার শুনতে পেলো মায়ান।

‘ভবিষ্যতে কখনো যদি আপনাদের দুজনের এক হওয়ার সুযোগ আসে আমি জারিন তা হতে দিবো না। আপনার মতো ছেলে পুষ্পিতার মতো মেয়েকে ডিজার্ভ করে না। আফটার অল আপনি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না। আপনারা স্বার্থের জন্য নিজের মায়ায় জড়িয়ে স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে ছুড়ে ফেলতে দু’বার ভাবেন না।’ বলেই কল কে’টে দিল।

মায়ান হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে পানি জমেছে। মায়ান বেদনার্ত কন্ঠে আপন মনে বলল,

‘যাকে অলরেডি হারিয়ে ফেলেছি। তাকে আর কি হারাবো। এখন তো আমার চারপাশে শুধু হাহাকার আর না পাওয়ার যন্ত্রণা বেষ্টনী দিয়ে রেখেছে খুব শক্ত হাতে। এই বেষ্টনী হতে মুক্ত হওয়া আমার সাধ্যে নেই।’

_____________________

আজ তিনদিন হলো নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিয়েছে পুষ্পিতা। অসুস্থতার অজুহাতে বাসা থেকে বের হয়নি। আফসানা হকও সন্দেহ করতে পারেনি কিছু। শুকনো আর মলিন মুখে সোফায় বসতেই আফসানা হক পুষ্পিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আলতোভাবে। মায়ের দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রভ হাসলো সে।

‘একটু ছাদ থেকে ঘুরে আয় মা। তিনদিন যেভাবে বাসায় আছিস শরীর আরো খারাপ করবে। ছাদে যা ভালো লাগবে।’

বিনাবাক্যে মায়ের কথামতো ছাদে গেলো পুষ্পিতা। বিকেলের নির্মল বাতাসে মন একেবারে ফুরফুরে হয়ে গেলো পুষ্পিতার। চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করতেই হাতে থাকা মোবাইল ভাইব্রেট হলো। ছাদে আসার আগে কি ভেবে যেন সাথে করে মোবাইল নিয়ে এসেছিল।

মোবাইল স্ক্রিনে তানজিফের নাম জ্বল জ্বল করছে। কপাল কুঁচকে গেল পুষ্পিতার। এতোদিন বাদে কল করায় বেশ অবাকও হলো। কল রিসিভ করে তানজিফ কিছু বলার আগেই সে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

‘পুড়া ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে এতোগুলা দিন পর আমাকে কল দিয়েছিস?’

পুষ্পিতা গম্ভীর কণ্ঠে বলা কথা শুনে হাসল তানজিফ।

‘তোর ঘায়ে পুনরায় আ’ঘা’ত করার সাহস আমার নেই। বরং ঘা যেন গভীর না হয় সেজন্য যত্ন করে তোর সেই ঘায়ে মলমের প্রলেপ দিতে পারবো।’

#চলবে

ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

#অতঃপর_সন্ধি (১৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)

‘পুষ্পিতা আমি যদি তোকে আবারও বিরক্তি করি সহ্য করে নিবি?’

নিশ্চুপ রইলো পুষ্পিতা। নিরবতা ঘিরে রেখেছে তার চারপাশ।

‘মানুষের কিছু কিছু অনুভূতি অব্যক্ত। তুই আমার সেই অব্যক্ত অনুভূতি।’

নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছে পুষ্পিতা। গাল বেয়ে সমান্তরালে ঠকে যাওয়ার দুঃখ গড়িয়ে পড়ছে। তানজিফে কলিজা ছেদ করা কথায় কেন কাঁদছে তার জানা নেই। তানজিফ তো তাকে একতরফা ভালোবাসে। সে তো বাসে না।তাহলে তানজিফের কথাগুলো শুনে অন্তঃস্থলে থেকে থেকে ধঁক করে উঠছে। কোথাও নিজের অনুভূতি অপাত্রে দান করলো না তো? নিজের করা প্রশ্নের বানে জর্জরিত
সে।

‘পুষ্পিতা চুপ করে না থেকে কিছু বল না? আমি তোর হাতটা সারাজীবনের মতো ধরতে চাই। অধিকার দিবি? আমি তোকে সারাটা জীবন আগলে রাখবো। কারো মতো হাজারো স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝপথে ছেড়ে যাবো না। আমার শুধু তোকে চাই।’

বুক ভেঙে আসছে পুষ্পিতার। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। বুকের বাপশে যেন কেউ পাথর চাপা দিয়েছে। এমন অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। একনাগাড়ে হেঁচকি দিয়ে চলেছে।

‘আমি তোকে বলেছিলাম শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমি তোর অপেক্ষা করবো। আমি প্রতিটা রাতে প্রার্থনা করেছি আল্লাহ যেন কোনো একটা রাস্তা বের করে দেয় তোকে পাওয়ার জন্য।’

কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে তানজিফের। ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে সে।

‘চোখ বন্ধ করলে যখন তোকে ওই ছেলেটার পাশে দেখতাম আমার বুকের ভেতরে যে যন্ত্রণা হতো তা বলে বুঝাতে পারবো না। একেকটা রাত আমার কাছে ঠিক কতটা দীর্ঘ ছিলো শুধু আমিই জানি।’

কানে মোবাইল ঠেকিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল পুষ্পিতা। এবার কান্নার শব্দ তানজিফ শুনতে পাচ্ছে। তানজিফ নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর জন্য।

‘আমি তোকে বুকে নিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসতে চাই। আমার নির্ঘুম রাতের কষ্টগুলো পুষিয়ে নিতে চাই।’

পুষ্পিতা একটা কথার জবাব দিতে পারলোনা। মোবাইল বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তানজিফের কাতর স্বরে করা একেকটা অনুরোধ পুষ্পিতার বুকে প্রলয় বয়ে যাচ্ছে। খুব ভয়ংকর প্রলয়। বুকের নিপীড়িত ক্লেশ, যন্ত্রণা খোলা আকাশে বিলিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু তা বুকটাকেই আঁকড়ে ধরে আছে খুব শক্ত করে।

___________________

‘তোরে হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে ভার্সিটিতে নিয়ে আসলাম ক্লাস না করে সং হয়ে বসে থাকার জন্য?’

চোখে মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল জারিন। ভার্সিটির মাঠে হাঁটুর ভাঁজে মাথা গুঁজে বসে আছে পুষ্পিতা।

‘যে তোকে ছেড়ে দিতে দু’বারও ভাবেনি তার কথা চিন্তা করে কেন মানসিক চাপ বাড়াচ্ছিস?’

‘চাইলে সবকিছু পারা যায়?’ মাথা উঁচিয়ে অসহায়চিত্তে বলল পুষ্পিতা।

‘ঢং বাদ দে। মানুষ পারে না এমন কোনো কাজ নেই। হয়ত সময় সাপেক্ষ। বছরের পর বছর সংসার করার পরও বিচ্ছেদ হয় মানুষের। তারাও আবার নতুন করে শুরু করে। অন্যকারো সাথে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। নিজের ভালো থাকার জন্য মানুষ সব করতে পারে। করতে হয়। হাজারো ঝড় ঝাপটার পরে নিজের জীবনটা নিজেকেই গুছিয়ে নিতে হয়।অন্য কেউ এসে গুছিয়ে দিয়ে যাবে না।’

‘বলা যতটা সহজ করা ততটা সহজ না। একটা মানুষ আরেকটা মানুষের সাথে চব্বিশ ঘণ্টা মানসিকভাবে এটাচড থাকার পর হুট করে কোনো কারন ছাড়াই যখন দূরে সরে যায়, তখন ওই পরিস্থিতির মধ্য যাওয়া কতটা যন্ত্রণাদায়ক শুধু সে জানে। তারপরও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি।’

পীড়িত মুখে কথা গুলো বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ল পুষ্পিতা।

‘এখনো স্বাভাবিক আছিস কারন ভালো লাগা আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্যটা তুই করতে পারিসনি। তোর পছন্দের ব্যপারগুলো উনার মাঝে পরিলক্ষিত হতেই তুই বুঝে নিলি তুই উনাকে ভালোবাসিস। এরকম হাজারো ছেলে আছে। তার মানে কি তুই সবাইকে ভালোবাসিস?’

চোখ বড় বড় করে জারিনের দিকে প্রশ্নসূচক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা। জারিনের কথা কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না। জারিন পুষ্পিতার হাতটা ধরলো।

‘এমন না যে ভালোবাসলে তার মাঝে তোর পছন্দের সবগুলো দিক থাকবে। তোর অপছন্দের দিকগুলো মানিয়ে নেওয়াই হচ্ছে ভালোবাসা।’ খানিক চুপ থেকে পুনশ্চ বলল,

‘ভালোবাসায় স্যাক্রিফাইস থাকে কম্প্রোমাইজ থাকে।’

‘আমি মায়ানকে ভালোবাসি।’

‘তাহলে তানজিফ নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াতে চুপসে গিয়েছিলি কেন? তানজিফ যখন তোকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে নিতো তোর মুখের ভাব গতি পাল্টে যেতো। তখন কেন বার বার বলতি ওর ভাব বেড়েছে? তোর তো খুশি হওয়ার কথা ছিলো। তুই মুখে বলতি এক কথা তোর চোখ জোড়া বলতো অন্য কথা।’

মাথা নিচু করে ফেলে পুষ্পিতা। তার কাছে এর কোনো উত্তর নেই।

‘বিরক্ত হওয়ার মাঝে তোর অনুভূতি ছিলো। যা তুই কখনো অনুভব করতে পারিসনি। তুই কখনো তানজিফের চোখের দিকে তাকিয়েছিস? তাকাসনি। যেই চোখে তোর জন্য হাজারো ভালোবাসা ছিলো। যে চোখে ছিল তোকে পাওয়ার তৃষ্ণা।’

________________________

বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে সবুজ ঘাসে আঁকিবুঁকি করে চলেছে পুষ্পিতা। তীক্ষ্ণ আর সূঁচালো চোখে পুষ্পিতা কে পর্যবেক্ষন করছে জারিন। এতোক্ষণের এতো কথা যেন পুষ্পিতা শুনতেই পায়নি এমন ভাব। পুষ্পিতার গা-ছাড়া ভাব দেখে দাঁত কটমট করছে সে। জারিন রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘এই মিডটার্মে যদি তোর জন্য আমার রেজাল্ট খারাপ হইছে তো, তোরে আমি খাইছি।’

‘কাল রাতে আমি একটারও উত্তর পাইনি পুষ্পিতা। আমার উত্তর চাই।’

মোটা ভারী গলার আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকায় পুষ্পিতা। বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেল তার। যেন কেউ খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যঘাত ঘটিয়েছে।

‘যেখানে উত্তর তোর জানা আর কি উত্তর দিবো?’

‘তাহলে রাতে এভাবে কাঁদছিলি কেন?’

‘আমার মন চেয়েছিল কেঁদেছি।তোর সমস্যা?’

‘অবশ্যই সমস্যা।’

কথা বাড়াল না পুষ্পিতা। চুপ করে বসে রইলো। জারিন দুজনের কথার কিছুই বুঝলো না। বোকার মতো চেয়ে রইলো। তানজিফ ব্যাগটা পাশে রেখে ধপাস করে বসে পড়লো।

‘অধিকার দিলে আমি কখনো তোকে বিগত দিনগুলোর জন্য কথা শুনাবো না।’

‘বিয়ে করতে পারবি আমাকে?’ উদাসীন, নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল পুষ্পিতা।

পুষ্পিতার আকস্মিক কথায় যেন বাজ পড়লো জারিনের মাথায়। অবাক নেত্রে চেয়ে রইলো পুষ্পিতার পানে।

‘বিয়ে করার জন্য নিশ্চয়ই অধিকার চাইছি?’

‘প্রথম প্রথম এমন বড় বড় কথা সবারই থাকে। মাস ছয়েক পরে সবই ফুউউস হয়ে যায়। ছেড়ে দে ভাই। আমার একবার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে।’

‘ধরলে সারাজীবনের জন্য আকঁড়ে ধরবো। মাঝপথে ছেড়ে দেওয়ার জন্য না।’

‘কি করিস তুই? বিয়ে করলে কি খাওয়াবি?’

‘কেন তুই কি প্রতিদিন এক মণ চালের ভাত খাস?’

নাক উঁচু করে পুষ্পিতা তানজিফের দিকে তাকায়। জারিন মিটিমিটি হাসছে।

তানজিফ আরো একটু এগিয়ে বসল। হাত বাড়িয়ে পুষ্পিতার হাতটা ধরতে গিয়েও ধরলো না। কোমল গলায় বলল,

‘সবাই তো ক্যারিয়ার আর পরিবারের দোহাই দিয়ে ছেড়ে চলে যায়। আমি না হয় তোর হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের ক্যারিয়ার গড়লাম। আর ক্যারিয়ার গড়তে না পারলে বড় কোনো শপিং মলের সামনে বসে দুইজন মিলে ভিক্ষা করবো। হবে না?’

তানজিফের চোখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা। হুট করে মায়ানের বলা শেষ কথাটা মনে পড়ে গেল, ‘ব্রাইট ফিউচার দেখে ছাড়তে চাইছেন না?’

একজন ব্রাইট ফিউচার হবে বলে পুষ্পিতাকে ছেড়ে গেলো।আরেকজন পুষ্পিতার হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাইছে। দুইটা কথার বেড়াজালে আটকে গেলো পুষ্পিতা। অপলক তাকিয়ে আছে তানজিফের দিকে। কিন্তু মাথার উপরে ঘুরঘুর এগুলো।

তানজিফ এবার সাহস করে পুষ্পিতার হাতটা আলতো করে ধরলো। পুষ্পিতার চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে আকুল, কাতর স্বরে কন্ঠনালী দিয়ে উচ্চারণ করলো,

‘আমার হৃদয় ক্ষ’ত বি’ক্ষ’ত করা তোর চোখের পানি মুছে দেওয়ার অধিকার চাইছি। দিবি সেই অধিকার?’

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে