অঙ্গীকার (৭ম পর্ব)

0
1935
অঙ্গীকার (৭ম পর্ব) লেখা- শারমিন মিশু সামিহা দরজা খুলে দিতেই রাদিয়া কেমন যেন একরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় বাসায় প্রবেশ করলো। চোখমুখ ফুলে প্রচন্ড লাল হয়ে আছে। মনে হয় অনেক কেঁদেছে। মুনিরার বুকের ভিতর কেমন যেন করে উঠলো। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে উনি কেঁদে দিয়েছে। কোথায় ছিলি তুই? কি হয়েছে?? ফোন কেন বন্ধ তোর? এইরকম নানারকম প্রশ্ন করতে লাগলো। আফিয়া আস্তে করে ধীর পায়ে বিছানা ছেড়ে উঠে আসলো। মাকে উদ্দেশ্য করে বললো। মা কি শুরু করেছো? ওকে আগে ঠিক করে বসতে দাও। রাদিয়ার রুমে রাদিয়াকে নিয়ে গিয়ে আফিয়া চেয়ার টেনে বসে বললো,,, রাদি কি হয়েছে? তুই কোথায় ছিলি এতক্ষন? ফোন কেন ধরিসনি? -রাদিয়া কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,,সরি আপু ফোন সাইলেন্ট ছিলো আমার মনে ছিলনা। আজ সারাদিন হসপিটালে দৌঁড়াদৌড়ি করাতে ব্যস্ত ছিলাম। -হসপিটাল??? হসপিটালে কেন?? -মুনিরা বললো,, হসপিটালে গিয়েছিস কেন? তোর কিছু হয়নিতো? -ওহ হো মা!!! আমার কিছু হয়নি। -আফিয়া বললো,, তাহলে কাকে নিয়ে হসপিটালে ছিলি? -আপু নিতু… বলে রাদিয়া আর কিছু বলতে পারছেনা কান্নার তোড়ে। -নিতু কে? আর কি হয়েছে। -আপু সেদিন যে মেয়েটি আমাদের বাসা এসেছিলো সেই নিতু। -বাসায় এসেছে,,, কিছুক্ষন ভেবে আফিয়া বললো ও সেই আধুনিকা মেয়েটা?( সেদিন রাদিয়ার কাছে কি যেন নোটের জন্য ওর একটা ফ্রেন্ড আসছিলো। মেয়েটাকে দেখেই আফিয়া ইন্নালিল্লাহ বলে মুখে হাত দিলো। মেয়েটা এমন একটা পোশাক পরে এসেছিলো ওর হাতের বাহুগুলো উপরে পুরো খোলা ছিলো। পিঠ পুরো দেখা যাচ্ছিলো।মাফলারের মত কি যেন একটা গলায় পেঁছিয়ে রেখেছিলো। পায়ের দিকে একেবারে হাটু পর্যন্ত খোলা ছিলো।শাফী তখন বাসায় ছিলো। তাই আফিয়া রাদিয়াকে ডেকে মেয়েটাকে ভিতর রুমে নিয়ে যেতে বললো। মেয়েটার চলাফেরা কথাবার্তা পোশাক সব পাশ্চাত্যদের মত। আফিয়া অবাক হলো এই মেয়ের সাথে রাদিয়ার বন্ধুত্ব এই ভেবে। এদের সাথে মিশলে যে কেউ খারাপ হতে পারে।
পরে রাদিয়াকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো মেয়েটার নাম নিতু,, খুব বড়লোকের মেয়ে। সবসময় এরকম ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে ও চলাফেরা করে। রাদিয়া আফসোস করে বললো,,, সত্যি বলতে কি আপু ওর সাথে কলেজ থেকে বন্ধুত্ব। বলা ঠিকনা এগুলো কারণ কেউ কাউকে খারাপ করতে পারেনা এটা ঠিক। আমি যদি ঠিক থাকি কেউ আমাকে খারাপ করতে পারবেনা। সত্যি বলতে কি ওর প্ররোচনায় আমি তখন অনেকটা বিগড়ে গিয়েছি ইসলাম থেকে সরে গিয়েছি। ওরা যখন আমাকে এসব ব্যাপারে বলতো, তখন আমার ঈর্ষা হতো ওরা কতো স্বাধীন আর আমি কেমন? ওরা যেভাবে ইচ্ছা চলতে পারছে আর আমাকে বন্দী পাখির মত জীবন কাটাতে হচ্ছে। ওরা এভাবে চলতে পারলে আমি কেন পারবোনা এই ভেবে ভেবে আমি অনেকটা খারাপ হয়েছি। এখন ওদের সাথে আমার মিশা ঠিকনা তারপরও অনেকদিনের বন্ধুত্ব হুট করে বদলে ফেলতে পারিনা তাই ভাবছি আস্তে আস্তে সরে যাবো। সেই সাথে চাইছিলাম যাতে ও এ জীবন থেকে ফিরে আসে।) আফিয়া মনে মনে বললো সেই স্বাধীন মেয়ের এখন কি হলো? -আফিয়ার কথায় রাদিয়া বললো হুম সেই মেয়ে। -কি হয়েছে ওর? -রাদিয়া চোখের পানি ছেড়ে বললো আপু নিতুকে গনধর্ষন করা হয়েছে? -কি??? কি বলছিস? -হুম আপু সত্যি বলছি। -কে করেছে কিছু জানা গেছে? -হুম আপু। ছেলেটার সাথে ওর সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিলো। এক পর্যায়ে ওরা দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ছেলেটার দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী নিতু দেখা করতে গিয়েই এ অবস্থা। আপু বিশ্বাস করতে পারবিনা ওর শরীরের যে বিশ্রী অবস্থা। শরীরের কোন একটা জায়গা খালি নেই আঁচড়ের দাগ ছাড়া। রক্তাক্ত অবস্থা একেবারে। -আফিয়ার চোখ দিয়ে ও পানি পড়তেছিলো,, এখন কি অবস্থা? -ভালোনা আপু বাঁচে কি মরে তার ঠিক নেই এখনো জ্ঞান ফিরেনি । বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলো। ওর মায়ের কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলার কান্নায় হাসপাতালের সবার চোখের পানি ঝরেছে। খবরটা যখন শুনলাম না গিয়ে থাকতে পারিনি। ওখান থেকে যে আসবো তারও কোন উপায় ছিলোনা। নিতুর বাবা ব্যবসার কাজে নেপালে গিয়েছে। মেয়ের খবর শুনেই উনি রওনা দিয়েছেন। ওদের কোন আত্মীয় ও ছিলোনা শুধু নিতুর এক মামা ছিলো। উনি হাসপাতালে ডাক্তারের সাথে কথা বলা ব্লাড যোগাড় করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ওর মায়ের পাশে থাকার মতো কেউ ছিলোনা তাই আমরা আসতে পারিনি। পরে উনাদের আত্মীয় স্বজনরা আসাতে আমরা চলে আসলাম। -আফিয়া আফসোসের স্বরে বললো হায়রে আধুনিকতা!! হায়রে স্বাধীনতা!! আজ তার স্বাধীনতা তাকে কোথায় নিয়ে গেলো। মানুষ আধুনিকতার নামে আজ যে নগ্নতা প্রকাশ করছে ছেলেদের সাথে ফ্রিমাইন্ডে চলার কথা বলে যে অবাদ মেলামেশা করছে তার পরিণতি আজ হয়তো নিতু পেয়েছে। বলা ঠিকনা তারপর ও আজ ওর এ অবস্থার জন্য ও নিজেই অনেকটা দায়ী। -জানিস আপু আইসিউ রুমের বাহিরে দাড়িয়ে যখন ওকে দেখলাম তখন নিজের ভিতর কেমন মৃত্যুর ভয় চলে আসলো। যে মেয়ে এতো আধুনিক চলাফেরা করতো সারাক্ষণ ছেলেদের নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতো সে আজ বলতে গেলে একেবারে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে আছে। আমার শুধু একটা কথা মনে হতে লাগলো আজ তো আমার সাথে এরকম কিছু হতে পারতো। আমি যে পথে চলে যাচ্ছিলাম আজ তো ওর জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। কেন তখন বুঝিনি আমি? -মুনিরা কান্নাজড়িত কন্ঠে বললো,,, আল্লাহ না করুক। সময় থাকতে আল্লাহ তোকে হেফাজত করেছে এটাই আমার প্রাপ্তি। আল্লাহ সব বাবা মায়ের মেয়েগুলোকে এরকম বিপদ থেকে রক্ষা করুক। ওই মেয়েটাও যেনো তার মায়ের কোলে ফিরে আসুক মৃত্যুর দুয়ার থেকে। -আফিয়া বললো,,, তুই ওখানে ছিলি আর আমাদের সবার টেনশনে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। -আপু ওই পরিস্থিতিতে আসলে কোনকিছুই মাথায় ছিলনা। আচ্ছা তুই বিশ্রাম নে আগে পরে কথা হবে বলে সবাই বেরিয়ে গেলো। পরদিন সকালে রাদিয়ার এক বান্ধুবী ফোন করে জানালো সারারাত মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পরে ভোর ছয়টার দিকে নিতু এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছে। তার বাবার এতো এতো টাকাপয়সা তার মেয়ের জীবন বাঁচাতে পারেনি। খবরটা শুনে রাদিয়া সাথে সাথে বেরিয়ে গেলো শেষবারের মত মেয়েটিকে দেখার জন্য। বেশ কিছুদিন পর… আফিয়ার ডেলিভারির ডেটও ঘনিয়ে আসলো। ডাক্তারদের দেয়া ডেট অনুযায়ী এখনো দশদিন বাকী আছে। কিন্তু আজ সকাল থেকে আফিয়ার শরীরটা কেমন জানি অন্যদিনের চেয়ে খুব খারাপ লাগছিলো। কেমন জানি লাগছে ও বুঝতে পারছেনা। কাউকে বলতে ও পারছেনা। শাফী সেই সকালে বেরিয়েছে ওদের দুরসম্পর্কের কোন আত্মীয় জানি মারা গেছে তার জানাজা পড়তে এখনো ফিরেনি। বলেছে মা বাবার সাথে দেখা করে সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবে। আফিয়া অনেকক্ষণ থেকে সহ্য করেছে কাউকে কিছু বলেনি ওর মনে হয়েছে এটা হয়তো এমনি ব্যাথা। এখনো তো অনেক দিন বাকী আছে। শাফী ফোন করলে ওর সাথে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলেছে এই লোককে কিছু জানালে পাগলের মত ছুটে আসবে এটা আফিয়া ভালো করে জানে। মুনিরা মেয়ের কুঁচকানো চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করেছে খারাপ লাগছে কিনা? আফিয়া বললো না মা আমি ঠিক আছি। দুপুরের দিকে মুনিরা খেয়ে শুয়েছে সারাদিনের ব্যস্ততার পরে এই একটুখানি সময় পায় উনি বিশ্রামের জন্য। রাদিয়া টিউশনিতে গেছে সামিহা এখনো স্কুল থেকে ফিরেনি। মুনিরা চোখের উপর খারাপ কোন স্বপ্ন দেখাতে ইন্নালিল্লাহ্ বলে শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসলো। ইয়া আল্লাহ দিনদুপুরে এ কি স্বপ্ন দেখলাম আমি!! ঠিক তখনি পাশের রুম থেকে আফিয়ার একটা চাপা চিৎকার শুনতে পেলো। উনি অনেকটা দৌড়ের গতিতে ওর রুমে আসলো। এসে দেখলো ও বালিশে হেলান দিয়ে হাত দিয়ে পেট চেপে ধরে কাঁদতেছে। মুনিরা মেয়ের পাশে বসে বললো,,, কি হয়েছে রে মা? কষ্ট হচ্ছে? -মা আমার পেটে ব্যাথা করছে। -মুনিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললো,,, বেশি ব্যাথা করছে? -হ্যা মা অনেক বেশি। মুনিরা কি করবে এ অবস্থায় উনার মাথা কাজ করছেনা। দুইটা মেয়ের একটা ও বাসায় নেই। উনি কোনরকমে রাদিয়াকে ফোন দিয়ে বাসায় আসতে বলে পাশের বাসার ভাড়াটিয়া ডাক্তার ফারজানা ফেরদৌসীকে ডেকে আনলো। এসময় উনি বাসায় থাকে বলে পাওয়া গেলো। আফিয়া বললো,,, মা তোমাদের জামাইকে ফোন দিয়ে আসতে বলো আমার খুব ভয় করছে। -ডাক্তার ফারজানা আফিয়াকে অভয় দিয়ে বললো,,, চিন্তার কিছু নেই মা। তোমার সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আল্লাহ চাইলে অবশ্য হাসপাতালে নেয়ার দরকার হবেনা। রাদিয়া মায়ের ফোন পেয়ে ছুটে আসলো। ও বাসায় এসে শাফীকে কল দিয়ে বললো,,, ভাইয়া আপুর অবস্থা ভালো না আপনি তাড়াতাড়ি আসুন বলেই ফোন কেটে দিলো। শাফী আফিয়ার ফোন পেয়ে ভিতর থেকে শিউরে উঠলো,,, একটু আগেই তো কথা বললাম হঠাৎ করে… ও আর ভাবতে পারলোনা। তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে বেরুতে নিলেই পিছন থেকে সালেহা বেগম বললো,, কি হয়েছে বাবা? -মা আফিয়ার অবস্থা ভালোনা। ওদের বাড়ী থেকে ফোন আসছে। -তুই তো বললি ভালো আছে। এখন আবার কি হলো? -সব তো ঠিকই ছিলো। আমি ও তো বুঝতে পারছিনা কি হলো। আমি যাচ্ছি মা পরে তোমাকে জানাবো। -দাঁড়া বাবা আমিও যাবো। মেয়েটার এ অবস্থা আমি বাসায় বসে থাকি কি করে। শাফীর ছোটফুফুকে সালেহা ফোন দিয়ে আসতে বলেছে। উনারা ফিরে না আসা পর্যন্ত যাতে এ বাসায় থাকে। কিছুক্ষন পর মা ছেলে বেরিয়ে পড়লো আফিয়াদের বাসার উদ্দেশ্যে। ভেতরের রুমে সবাই আফিয়াকে নিয়ে আছে। এদিকে শাফী নামাজের বিছানায় বসে একমনে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে যাচ্ছে যাতে সব ভালোভাবে হয়ে যায়……..
চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে