-ফাগুণের নবধারা পর্ব- ৪

0
1670

-ফাগুণের নবধারা

পর্ব- ৪

– শাহাজাদী হুমাশা।

সুমু বারান্দায় বসে নাভিদের দিকে চেয়ে আছে।অপর পাশের বারন্দায় বসে নাভিদও চেয়ে আছে।দুজনে চুপ, কিন্তু কথা বলছে তাদের চোখ আর কিছু অনুভূতি।একে অন্যের দিকে চেয়ে হাজারো না বলা কথা গুলো জেনো পড়ে নিচ্ছে।পুরোটা বিকেল তারা এভাবেই কাটালো।মাগরিবের আজানের পরই সুমু উঠে ভিতরে চলে গেলো।

নিঝুম বাহির থেকে এসে নিধির সাথে করা আজকের দূর্ব্যবহারের কথা চিন্তা করতে থাকলো।অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নিলো সে নিধির কাছে মাফ চাইবে।

ইলমা বিকেলের অলস সময়টা ফাহিমের সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দিলো।আজ বহুদিন পর তার মনটা আনন্দে ভরে উঠেছে।সে আজ অনেক খুশি।আজানের পর নিঝুমের সাথে দেখা হতেই আজ আর সে তার সাথে দূর্ব্যবহার করলো না।বরং নিঝুমকে অবাক করে দিয়ে সে নিজেই তাকে কফি অফার করলো।কিন্তু বেচারা নিঝুম বিকেল থেকে নিধির কথাই ভেবে যাচ্ছে তাই আজ আর সে ইলমার কথায় খুব একটা পাত্তা দিলো না।এরকম আচরণে ইলমা অভস্ত না।হঠাৎ করে তার কি জেনো হলো।এই অবহেলাটা নিতে না পেরে তার মন খারাপ হয়ে গেলো।কিন্তু সে নিজের আচরণে নিজেই অবাক হচ্ছে।

আজ শুক্রুবার।দেখতে দেখতে প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেলো রোকসানাদের এ বাড়িতে আসার।দুশ্চিন্তা মুক্ত কিছু সময় কাটালো রোকসানার। আরও কিছু জিনিস দেখলো সে।এই যেমন আবিদ লোকটা।তার সম্পর্কে করা রোকসানার প্রায় সকল ধারণাই ভুল হলো। তবুও তার ভুল গুলো হওয়াতেও সে অদ্ভুত এক আনন্দ পেলো।

বাসার সবাই আজ খানিকটা ব্যস্ত। সুমু আর নাভিদের বিয়ের শপিং করতে যাবে সবাই।রোকসানার শরীর ভালো না থাকায় সে বাসায় থাকবে আর নিঝুম বাসায় থাকবে সাথে তাদের বাসার কাজের মেয়েটা।ইলমার ইচ্ছে না থাকলেও মায়ের পিড়াপীড়ি তে যেতে হচ্ছে। সকালের নাস্তা করেই সবাই বের হবে।আসতে সন্ধ্যা হবে।আত্মীয় বাড়িতে দাওয়াতেও যেতে হবে তাই।আমিনা বেগম নিঝুম কে রুকুর খেয়াল রাখতে বলে সবাইকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন।

সাড়ে ১১ টা নাগাদ ডোরবেলটা বেজে উঠলো। রুকুদের কাজের মেয়ে লতা দৌড়ে গিয়ে লুকিং গ্লাসে দেখে দরজা খুললো।দরজা খুলতেই একটা ৫ বছরের মেয়ে দৌড়ে রুকুর ঘরে গিয়ে রুকুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।নিঝুম রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো রুকু কার সাথে যেনো হেসে হেসে কথা বলছে। উকি দিতেই দেখলো একটা ছোট্ট মেয়ে।সে মেয়েটাকে চেনে।এটা বাড়িওয়ালার নাতনি নিহারীকা। সবাই নিহা ডাকে। রুকুকে দেখে নিঝুমেরও আনন্দ হচ্ছে।কতদিন পর রুকুকে এভাবে হাসতে দেখছে যে হাসিতে কোনো কৃত্তিমতা নেই। নিঝুম রুকুর ঘরে গিয়েই বললো –
মা মেয়ের কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য দুঃখিত।রোকসানা হাসলো।
নিঝুম আবার বললো আমি নিচে যাচ্ছি আপু।তুই থাক। কিছু লাগলে কল করে দিস।রুকু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে আবার বাচ্চা মেয়েটার সাথে কথা বলতে লাগলো।

নিহা রুকুর বিছানায় বসে তার স্কুলের সব বন্ধুদের কথা বলছে আর হেসে কুটিকুটি হচ্ছে কি নিষ্পাপ সে হাসি।রুকু নিহাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো –
নিহা তুমি আমাকে মামণি ডাকো কেনো? তোমার আম্মু রাগ করবে না? মুহূর্তেই নিহার মন খারাপ হয়ে গেলো।সে বললো – আমার আম্মু নেই।চমকে গেলো রুকু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো তোমার আব্বু বাসায়? নিহা মাথা নেড়ে সায় দিলো।লতা নিহা আর রুকুর জন্য দুটো গ্লাসে জুস নিয়ে আসলো।নিহা জুস খেতে খেতে রুকুকে জিজ্ঞেস করলো – মামণি তোমার পেটে কি আমার ভাই?? নাকি বোন? রুকু নিহার কথায় হাসলো নিহা জুস শেষ করে রুকুর পেটে কান লাগিয়ে তার অনাগত ভাই বা বোন কে জলদি আসতে বললো সে তাদের সাথে বাবার সাথে সুইমিং শিখবে তাই।
নিহার কথায় রুকুকে অবাক করে দিয়ে পেটের ভেতরের বাসিন্দা লাথি দিলো মৃদু।

আবিদ ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেড়ে ছাদে গেলো। গাছ গুলোতে পানি দিবে।সাথে তাদের ছাদের সুইমিংপুল টাতে কিছুক্ষণ সাতার কাটবে।সুইমিংপুল টা একান্তই আবিদের শখের বসে করা খুব বড় না হলেও খুব ছোটও না।১৩ তালা এপার্টমেন্ট টার ছাদের পুলটা অনেক শখ করেই বানিয়েছে আবিদ।পুরো ছাদ টা সে নিজের ইচ্ছেমত সাজিয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময় তাকে বাহিরে কাটাতে হয়।তাই নিজের বাসায় খুব একটা থাকা হয়ে ওঠেনা।সুইমিং করার কিছুক্ষণ পরেই নিচে চলে এলো আবিদ। নামাজে যাবার সময় হয়ে যাচ্ছে প্রায়।ঘরে এসে নিহাকে ডেকেও সে পেলোনা।নিহার দাদী জানালো সে রুকুদের ঘরে গিয়েছে।আবিদ মুচকি হাসলো।

নিহা আবিদের মেয়ে।তবে আপন মেয়ে নয়।নিহাকে আবিদ কুড়িয়ে পেয়েছিলো যখন নিহার বয়স দেড় বছরের মত ছিলো। এরপর থেকে নিহাকে সে নিজের মেয়ে হিসেবে পরিচয় দেয়।প্রথমে আবিদের বাবা গাঁইগুঁই করলেও পরে নিহার সাথে তার সখ্যতা হয়ে যাওয়ায় সে আর এ নিয়ে কথা বাড়ায়নি। তাই নিহা এখন তাদের পরিবারের সদস্য আবিদের কন্যা।

নিঝুম দুপুরে বাসায় খাবেনা বলে জানিয়ে দিলো রোকসানাকে।তাই রোকসানা নিহাকে নিয়ে খেতে বসলো।নিহাকে মুখে তুলে খায়িয়ে দিচ্ছে রুকু আর রাজ্যের গল্প করে যাচ্ছে নিহা।রুকুর খুব মায়া হচ্ছে মেয়েটার জন্য।আবিদ বাসায় ফিরে দেখলো নিহা নেই।নিহাকে ছাড়া সে কখনো খেতে বসে না। তাই উঠে নিহাকে ডাকতে গেলো রুকুদের বাসায়।কলিং বেল দিয়েই দাড়িয়ে রইলো সে।লতা দরজাটা খুলে দিলো আবিদকে দেখে।আবিদ নিহার কথা জিজ্ঞেস করতেই লতা রুকুর রুমটা দেখিয়ে দিলো আবিদকে।ভিতরে গিয়ে আবিদ অবাক হয়ে চেয়ে রইলো নিহা আর রুকুর দিকে।নিহা গরগর করে কথা বলছে আর রুকু তার মুখে নলা তুলে দিচ্ছে।আবিদ অবাক কারণ নিহা সবার সাথে মিশেনা।দাদা-দাদী আর আবিদই তার ভুবন।সে কারো কাছে খেতেও চায়না।অথচ আজ পুরো ব্যাতিক্রম।
আবিদ নিহাকে ডেকে বললো –

আমাকে ছাড়াই খেয়ে নিলে? নিহা বাবার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসি দিলো।
– তোমার সাথেতো রোজ খাই বাবা,আজ মামণির সাথে খাচ্ছি।
আবিদের বিস্ময়ের সীমা রইলোনা।নিহা রুকুকে মা ডাকছে।অথচ এই মেয়ের জন্য সে বিয়ে করেনি।বাসা থেকে বহু পাত্রি দেখা হলেও নিহার পছন্দ হয়নি বলে আবিদ এগোয় নি।এছাড়া তার পেশার জন্য ও নিহাকে এমন কারো কাছে রাখবে বাবা মায়ের পরে যে বিশ্বস্ত এমন কাউকেই পায়নি।

রুকু আবিদের চেহারা দেখে বুঝলো আবিদ অবাক হয়েছে।রুকু আবিদ কে তাদের সাথে খেতে বসতে বললো আবিদ বসতে চাইলোনা।নিহা আবিদকে জোর করায় আবিদ বসলো।খাবারের আইটেম দেখে আবিদ আরো অবাক হলো প্রায় সবই তার পছন্দের খাবার।গরম ধোয়া ওঠা পোলায় চালের খিচুড়ি, ডিম ভুনা,মাছের কোফতা, সব্জি, সাদা মুরগির মাংস আরর সাথে সালাদ।
রুকু আবিদকে বেড়ে দিয়ে সে নিজে খেতে বসলো আবিদ মানা করলো তাকে ব্যস্ত হতে। এইসময়ে এত প্রেশার না নেয়াই ভালো।দুপুরের খাবার খেতে খেতে রুকু কথা বলছে আবিদের সাথে।চুপচাপ আবিদ একজন ভালো শ্রোতা।আর রুকু বক্তা।
– আবিদ সাহেব আপনার স্ত্রীর বিষয়ে জেনে দুঃখিত।এত ছোট বয়সে নিহা তার মাকে হারিয়েছে।নিহা লতার সাথে খেলছিলো তখন।আবিদ রুকুকে বললো
– আমি অবিবাহিত। নিহা আমার আপন মেয়ে না।আমি তাকে দত্তক নিয়েছি।
– অবাক হলো রুকু।আর বললো- আমি দুঃখিত।আমি জানতাম না ব্যাপারটা। আবিদ হালকা হেসে বললো ব্যাপারটা বাবা -মা ছাড়া আর কেউ জানেনা আর আপনি আজ জানলেন।আমার পেশার জন্য আমাকে বছরের অর্ধেক সময় বাহিরে থাকতে হয় নিহা তখন মার কাছে থাকে।
রুকু আবিদকে তার পেশা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো।আবিদ স্বাভাবিক ভাবে বললো সে একজন পাইলট। বাংলাদেশ এয়ারওয়েজ এর।

রুকুদের খাওয়া শেষ হলে রুকুর ঘরে গিয়ে আবিদ দেখলো নিহা ঘুমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত হয়ে।আবিদ রুকুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিহাকে ওখানেই রেখে এলো।আজকের দুপুরটা বেশ ভালো কেটেছে তার।অনেকদিন পর এভাবে গল্প করেছে কারও সাথে।রুকুও আবিদ যাওয়ার পর বিশ্রাম নিতে গেলো নিহার পাশে শুয়ে পড়লো সে।

চলবে….