MR AND MRS WHATEVER পর্ব-১২

0
1930

#MR AND MRS WHATEVER
পর্ব:12
#লেখিকা-Arshi khan

আমি আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়েই আছি অনেকক্ষন হল। আমার আত্মীয় স্বজন সবাই কান্না করছে।আমার শাশুরী ও যেন কোন অংশে কম না।আশরাফুল গেছে মসজিদে জানাজা পড়ানোর জন্য কথা বলতে আর কবর খুড়ার লোক ঠিক করতে।সবাই বলছে আব্বুর শেষ ইচ্ছা ছিল আমার সাথে কথা বলা।মৃত্যুর আগে বারবার করে বলছিল একবার আমার মেয়েটার কাছে ক্ষমা চাইতে পারতাম জদি!কিন্তু না আমি আসিনি।হয়তো আসতে চাইনি।কারণ আম্মু কল করে বলেছিল তোর আব্বুর শরীর খুব খারাপ হচ্ছে তুই জলদি চলে আয়।কিন্ত আমি আসিনি।আমাকে আশেপাশের মানুষ অনেক কটু কথাই বলছে।রেডিও স্টুডি এর গল্প অনেক এই শুনেছে।কয়েকমাস যাবত ভয়েস গুলো আমি ইউটিউব এ ও আপলোড করি।তাই আরো বেশি মানুষ এই ব্যাপারে জানে।বিশেষ করে আমার শাশুরী আম্মুকে দেখিয়ে অনেক কথা বলছে।আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা তারা কেমন মানুষ?একটা মানুষ মারা গেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ না করে তার লাইফের অতীত কে নিয়ে টানা হিচরা করছে।আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আব্বুর মৃত্যুর পিছনে আমার কথা গুলো বেশি কাজ করেছে।এত্তটা কষ্ট দিতে চাইনি আমি।কিন্ত আমার আর আম্মুর প্রতি আব্বুর ভালোবাসা কেন নেই ,অথচ শাশুরী আম্মুর জন্য কত্ত কান্না করলেন।আমি চুপচাপ বসে আব্বুর সামনে কোরআন তেলওয়াত করছি।এক ঘন্টা পর আশরাফুল আসল।আমি নিশ্চুপ বসে কোরআন এই পড়ে চলেছি।ফজরের আযান এর পর আব্বুকে কবর দেওয়া হবে।সবাই আমি কান্না না করার কারণেও নানান কথা বলছে।এখন বাজে ভোর পাচঁটার কাছাকাছি। একটু পর জানাজা তাই, আব্বুকে আমার কয়েকজন ভাই ও আশরাফুল মিলে নিচের তালায় নিয়ে যাচ্ছে।আম্মুর কান্নার রোল বেরে যেতে লাগল।আমার শাশুরী আম্মু আম্মুকে শান্তানা দিতে লাগলেন।আব্বু কে বের করার আগে আমি আশরাফুল এর হাত ধরলাম।
একটু দাড়াও।(নুসরাত আশরাফুল এর উদ্দেশ্য)

হুম। (আশরাফুল শান্ত সুরে)

আমি আব্বুর সামনে বসে তার কপালে আর গালে একটু চুম্বন করে তার মুখপানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। (নুসরাত মনে মনে)

সরো বের করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে লাস।গোসল করাতে হবে।জানাজার সময় হয়ে যাচ্ছে। (আশরাফুল নুসরাত এর হাত ধরে)

আমার কি হল জানিনা আমি আব্বুর গলা জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।
আব্বুউউউউউ আমার আব্বুকে লাস কেন বলছ তুমি?আমার আব্বু তো মরেনি।সে তো আমার সাথে কথা বলবে।আমার অনেক দিনের শখ আব্বুর আদর নিব।কোথায় সে তো এখন ও দেয়নি।আব্বু ও আব্বু শোন না আব্বু একবার শোন আমাকে একটাবার একটু আদর করবে আব্বু উঠো না।দেখ আমি বাধ্য মেয়ে হয়ে যাব।কোনদিন তোমার কথার অবাধ্য হবনা।কোনদিন না তুমি শুধু একবার উঠো আব্বু প্লিজ একটু কথা বল না!আব্বু আব্বু ও আব্বু।(নুসরাত মামুন জামান এর গলা জড়িয়ে)

সবাই এই হাহাকার দেখে ওকে শান্তানা দেওয়ার চেষ্টা করছে।আমি শুধু হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি এই মেয়ের কান্ড দেখে।কত্তটা বেদনার ওর জন্য হাতে সুযোগ থাকতেও ও আসতে পারেনি ওর আব্বুর অসুস্থার সময়।শুধু মাত্র আমার জন্য আজকে ওনার এত্ত তাড়াতাড়ি সবাইকে ছেড়ে যেতে হল।সবাই ওকে টেনে সরানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু ও যেন আরো বেশি আকড়ে ধরতে চাইছে ওনাকে।আমি এইবার সবাইকে সরিয়ে ওর সামনে বসে ওকে টেনে আমার কাছে আনতে চাইলাম।কিন্ত ও কিছুতেই সরে আসতে রাজি না।
প্লিজ ওনাকে ছেড়ে দাও মৃত্যুর পর এভাবে ধরলে শরীরে ব্যাথা পায়। প্লিজ নুসরাত সরে আসো ওনার গোসল দিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।(আশরাফুল নুসরাত এর হাত ধরে টেনে)

আশরাফুল প্লিজ আব্বুকে বল আমার সাথে কথা বলতে, আমাকে একটু আদর করতে বল না প্লিজ। আব্বুকে বল আমার তার উপর কোন রাগ নেই। আমি তার সাথে আর কোনদিন খারাপ ব্যবহার করব না।প্লিজ বলনা আব্বুকে উঠে আমার সাথে কথা বলতে। বলনা প্লিজ।(নুসরাত আশরাফুল এর বুকে কান্না করতে করতে)

ওর কান্না আমার বুকে গিয়ে যেন তীরের মতো বিধছে।আমার জন্য ও ওর আব্বুকে শেষ দেখা ও দিতে পারেনি।আমি ওর কান্না গুলো ঠিক নিতে পারছিনা।কিন্তু আমার ওর জন্য তো কোন মায়া কাজ করার কথা না।তাও ওর কান্না তে আমার মনটা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে কেন?ওকে সরানোর জন্য সবাই বলছে।তাই আমি ওকে টেনে আমার সাথে জড়িয়ে ধরলাম। ও কিছুতেই লাস বাইরে নিতে দিচ্ছে না।ওর মামাতো আর ফুফাতো ভাইরা ওনাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। আমি নুসরাতকে ধরে রেখেছি যাতে ও উঠে না যেতে পারে।ও পাগলের মত চিৎকার করছে।আর আমার শার্টের মধ্যেই নাকের জল চোখের জল দিয়ে ভরে ফেলছে।আমি হাটু গেরে বসে ছিলাম এখন পুরো আসাম পেতে বসে ওকে জড়িয়ে রেখেছি।ওর চিৎকার এ পুরো রুম কেপে উঠছে।ও আমাকে ছাড়িয়ে উঠতে চাইছে।আর অন্য দিকে আম্মুর (শাশুরী) দাঁত লেগে গেছে।ওনাকে আম্মু আর অন্যরা মিলে সুস্থ করার চেষ্টা করছে।(আশরাফুল মনে মনে)

ভোর পাচঁটা পনের

মসজিদে আযান দিতেই সবাই মিলে শেষ দেখা দেখার জন্য নিচে নেমে এসেছি।আব্বুর লাস কে গোসল করিয়ে খাটিয়াতে শুইয়ে দিয়েছে। আমি গিয়ে খাটিয়ার সামনে বসে পড়লাম। আব্বুর মুখে মাসাআল্লাহ কি সুন্দর হাসি।মৃত্যুর পরে অন্তত এই হাসিটা দেখতে তো পেরেছি।এই হাসি দেখার জন্য গত একুশ বছর অপেক্ষা করে যাচ্ছি। আর এই শেষ সময়ে এই হাসি টা দেখার সুযোগ হল। আমি আবার চিৎকার করে কান্না করতে লাগলাম। আশরাফুল আমাকে টেনে উঠানোর চেষ্টা করছে।আমি শক্ত করে খাটিয়া ধরে রেখেছি কিন্তু ও অনেকক্ষণ চেষ্টার পর আমাকে টেনে রুমে এনে গেট লক করে দিয়েছে।
আশরাফুল গেট টা খুল।(চিৎকার করে নুসরাত)

দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি প্লিজ ভেতরে থাক আর ওনার জন্য দোয়া কর।আমরা ওনাকে জানাজার জন্য নিয়ে যাচ্ছি তুমি প্লিজ নিজেকে সামলাও।(বলেই আমি দৌড়ে নিচে চলে আসলাম আশরাফুল)

আমি চিৎকার করতে থাকলাম গেটের মধ্যেই কয়েকটা লাথি ও মেরেছি।কিন্তু কারো খোলার নাম নেই।আমি গেটের সামনে বসে পড়লাম।
কেন আমি আম্মুর কল দেওয়ার সাথে সাথে আসলাম না কেন?তাহলে একটা বার অন্তত আব্বুর সাথে শেষ কথা টা তো বলতে পারতাম ।এসব ভাবতে ভাবতেই আমি কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আমার খেয়াল নেই।হঠাৎই আশরাফুল এর ডাকে আমি আস্তে করে তাকালাম। (নুসরাত)

উঠো খাটের উপর গিয়ে শোও এখানে শুয়ে থাকলে ঠান্ডা লাগবে।(নুসরাত এর হাত ধরে উঠিয়ে আশরাফুল)

আব্বুকে কবর দেওয়া কি শেষ?(নুসরাত শান্ত কন্ঠে)

হুম ।(আশরাফুল)

মাটির নিচে তো অনেক পোকা মাকর আছে,মাটি ও তো ঠান্ডা আব্বুর সেই জায়গায় ঠান্ডা লাগবে না!(নুসরাত)

তুমি প্লীজ একটু থাম আর খাটে উঠে বস।(আশরাফুল নুসরাত এর হাত ধরে)

আমি আশরাফুল এর হাত ধরে আস্তে করে খাটে গিয়ে বসলাম। তারপর ওর দিকে তাকিয়েই রইলাম।
আচ্ছা আশরাফুল তোমার ছোট ভাই আবির কে যখন কবর দিয়েছিলে তখন তোমার কষ্ট লাগেনি?(নুসরাত আশরাফুল এর দিকে তাকিয়েই)

ওর মুখে আবির এর নাম শুনে মেজাজ গরম হয়ে গেল।তাও আমি চুপচাপ এই থাকলাম কারণ এমনেই ও একটা শোকে আছে তা বাড়াতে চাইনা।(আশরাফুল মনে মনে)

জানো আব্বু যখন তোমার আম্মুকে ভালোবাসতো সে পৃথিবীর সব থেকে সুখি মানুষ ছিল। আম্মুর(শাশুরী)বিয়ের পর আব্বু পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।তাকে জোর করে আমার আম্মুর সাথে বিয়ে দেওয়া হয়।আমার জন্ম হয় বিয়ের চারবছর পর।আমাকে আব্বু পছন্দ করতোনা।আর না আমার কোন জিনিস কে।আবির এর জন্য আমি রেডিও তে কাজ শুরু করি।ও আমার ছয় মাসের ছোট ছিল তাও আমরা একে অপরের প্রেমে পড়ে যাই।ওর আর আমার প্রেমের সম্পর্ক ভাল চলছিল কিন্ত আমার বাড়িতে ও এসে আব্বুকে দেখে অবাক হয়ে যায়।তারপর থেকে ও দূরে দূরে থাকতে শুরু করে।অন্য দিকে ওকে তোমাদের থেকে আলাদা করার কারণে ও আরো কষ্ট পেত।একদিন আমি ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি কেন এমন করছে আমার সাথে!তার উত্তর টা ছিল এমন(নুসরাত)

ফ্লাশব্যাক

আবির প্লিজ বল কেন আমাকে ইগনোর করছ প্লিজ বল!তোমাকে ছাড়া, তোমার সাথে কথা না বলে থাকা আমার জন্য খুবই কষ্টের। (নুসরাত আবির এর হাত ধরেই)

নুসরাত শোন আমি চাইনা আমাদের সম্পর্কের কারণে দুইটা সংসার এর ভাঙ্গন ধরুক।(আবির হাত ছাড়িয়ে)

মানে!(অবাক হয়ে নুসরাত)

আমার আম্মুর ডাইরি টা আমি পেয়েছি আব্বুর আলমারির থেকে।জানো সেখানে কি লেখা ছিল, কার সম্পর্কে লেখা ছিল!জানার কথা না তোমার তাও বলি সেখানে তোমার আব্বুর আর আমার আম্মুর ভালোবাসার ও বিচ্ছেদের সব কথাই লেখা ছিল। তোমার আব্বুর একটা ছবিও ছিল। ঐদিন তোমাদের বাসায় গিয়ে ওনাকে দেখে আমি চিনে ফেলি তাই তোমার থেকে দূরে আছি।কারণ আমাদের এক হতে হলে তোমার আম্মুর সংসার নষ্ট হবে।আর একটা কারণ কি জানো আমার আম্মুর থেকে আমাকে এনে আব্বু রেখেছিল এত্তদিন। কিন্তু আমার নামে সম্পত্তি লেখা হলে ওনার দ্বিতীয় ওয়াইফ রাগ করেন। কারণ নিঃসন্তান হওয়ার কারণে আমাকে নিলেও তার কয়েক বছর পর ওনাদের একটা মেয়ে হয়।আর আমার সৎ মা চায় তোমার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে যেন তার বোনের মেয়েকে বিয়ে করি।কিন্ত তআ সম্ভব না আর তোমাকে ভুলা ও সম্ভব না।তাই তোমার থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। (আবির নুসরাত এর উদ্দেশ্য)

বর্তমান

সেদিন আমি আর ও প্লান করি পালিয়ে দূরে চলে যাব।কিন্তু আমার আব্বু আমাকে যেতে দেননি।উনি আমাকে রাস্তার মধ্যেই বেগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জোর করে নিয়ে আসে।তারপর আমার সাথে ওর আর যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি।সেই জন্য আব্বুর মনে খুব কষ্ট ।আর জানেন ও খুব বেশি ডিপরেশন এ থাকতো। আপনি যে ওর মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী ভেবে কষ্ট দিচ্ছেন তাও আমি জানি।কিন্ত আজকেই কেন এসব বলছি জানেন কারণ আজকে আমি স্টুডিও তে হাজার মানুষের সামনে আমার আর আব্বুর ভালোবাসার গল্প শেয়ার করেছি।আর ভেবেছিলাম এই শেষ আমার বলা গল্প। আর আপনার করা টর্চার ও শেষ হবে ভেবেই আজকে আপনার সাথে ছিলাম।কিন্ত আমি ভুল করে ফেলেছি খুব বড় ভুল আপনার উপর রাগ দেখাতে গিয়ে আমার আব্বুকে হাড়িয়ে বসলাম। জানেন এই কথা গুলো ও আপনাকে বলার কোন ইচ্ছে ছিল না। তাও বলছি কেন জানো আমার সাথে এটা তোমার শেষ কথা তাই ভাবলাম সবটা বলেই নাহয় বলেই যাই(নুসরাত আশরাফুল এর উদ্দেশ্য মুচকি হেসে)

মানে!(অবাক চোখে আশরাফুল)

না কিছুনা।আমি একটু ঘুমাই তুমি আম্মুর কাছে যাও আর কিছু খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিও।আর আমার আম্মুর খেয়াল রেখ প্লিজ!(অনুনয়ের সুরে নুসরাত)

তুমি এমন করে কথা কেন বলছ তুমি?(আশরাফুল ভিত কন্ঠে)

না বললাম আব্বু নেই তাই তাদের দেখে রাখার জন্য। (নুসরাত বলেই খাটে শুয়ে পড়লাম)

আমি ওর কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছিনা।ও খাটে শুয়ে পড়ল। আমি উঠে রুমের গেট টা একটু লাগিয়ে আরেক রুমে গেলাম। সেখানে আম্মু(শাশুরী) বসে কান্না করছে।আম্মু ও পাশে বসে চোখের জল মুছছে একটু পর পর।আমি ডাইনিং রুমে গিয়ে সবার খাবার এর আয়োজন করছি।(আশরাফুল )

কিছুক্ষণ আগেই এক পাতা স্লিপিং খেয়ে নিয়েছিলাম।তার পর এই আশরাফুল রুমে এসেছিল। অনেক কষ্টে ওর সামনে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম।আশরাফুল বের হতেই আমি উঠে একটা ছোট্ট চিরকুট লিখে আবার এসে খাটে শুয়ে পড়লাম(নুসরাত মনে মনে)

**************(চলবে)***********

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে