গল্পটা_নিশ্চুপ_বালিকা’র
(৪র্থ অংশ)
রচনায়- অনামিকা ইসলাম ‘অন্তরা’
পরদিন ক্লাসের বিরতি চলছিল। সবাই যখন যে যার মতো বাহিরে চলে যায় নীলিমা তখন বই নিয়ে চুপটি করে বসে। বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছিল নীলিমা। পাশে এসে বসে বান্ধবি শাকিলা। শাকিলা’কে দেখে বইটা বন্ধ করে ফেলে নীলিমা। কিছু বলবি? ইয়ে ফোনের ঐ ছেলেটা কে? সত্যি’ই কি তোর বয়ফ্রেন্ড? জবাবে ক্ষাণিক হাসে নীলিমা। ভ্রু-জোড়া কিঞ্চিৎ বাকা হয়ে যায় শাকিলা’র। আশ্চর্য! হাসির কি বললাম এখানে? – কিছু না। – তো হাসির কারণ কি? – ছাড়তো। তারপর আন্টি কেমন আছে? – নীলি! কথা ঘুরাবি না একদম। – ও আমার প্রাক্তন! – মানে এক্স বয়ফ্রেন্ড? – হু, – ব্রেকআপ হলো কিভাবে? – কারণ জানতে চাস না শাকিলা। ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করে এখনো। – এতটা ঘৃণা?! – হ্যাঁ, ঘৃণা করি আমি ওকে। খুব খুউব ঘৃণা করি… – তাহলে এভাবে ওয়ালপেপারে সেট করে রাখার মানে কি? ডিলিট করে দিলেই পারিস। – নাহ, ডিলিট করবো না আমি। – কেন? – ওকে আমি ভুলতে চাই না। সারাজীবন ঘৃণা করে বাঁচতে চাই। ওয়ালপেপারেই থাকবে ও। যতবার দেখবো মনে মনে ঠিক ততবার গালি দেবো। আর এটাই হবে ওর প্রাপ্য। – আমি কি জানতে পারি আসলে ঠিক কি হয়েছিল? – ও একটা প্রতারক শাকিলা। – ………. – ও আমাকেও ভালোবাসতো আবার একইসাথে আমার বান্ধবিকেও আই লাভ ইউ বলতো। – মানে এক সাথে দুইজনের সাথে প্রেম? – হ্যাঁ… – তারপর? – তারপর যখন আমরা দু’বান্ধবি বিষয়টা জানতে পারি তখন পরিকল্পনা করি। হিয়া ওকে দেখা করার জন্য ডাকে। ও আসে। কথা ছিল ও হিয়া’র সাথে দেখা করবে। কিন্তু সেখানে সেদিন আমাদের দুজনকেই দেখতে পায়। – ইন্টারেস্টিং তো! তারপর… – তারপর আর কি… ও আমাদের দু’জনকেই অস্বীকার করে। – মানে??? – মানে ওর স্পষ্ট কথা, ও আমাদের কাউকে চিনে না। – তারপর? – কেটে পড়ে… – পরে কথা হয়নি আর? – নাহ! হিয়া’রও অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। আর আমিও সিম চেঞ্জ করে ফেলি। – সম্পর্কের ইতিটা তবে সেখানেই ঘটে? – হ্যাঁ… – স্যরি, অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেললাম। – শাকিলা! জীবন বহতা নদীর মতো। কারো জন্য থেমে থাকে না। সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে চলছে বিরামহীনভাবে। ভালোই আছি। মাঝেমধ্যে মনে হয় কি যেন নেই। তখন ডেল কার্নেগীর কথা মনে হয়। তিনি লিখেছেন, একজন বিশেষ লোকের ভালোবাসা হয়তো তুমি হারিয়ে ফেলতে পারো কিন্তু মন থেকে ভালোবাসা নামক বস্তুটি কখনো হারায় না। সেটা আরেকজনকে খুঁজে নেয়। একজনের প্রতি ভালোবাসা আরেকজনে সঞ্চার হয়ে যায়। জেনে রেখো আরেকজন আছে। তাই নষ্ট হলাম না। ধ্বংস করলাম না নিজেকে। পরদিন প্রতিদিনের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একটু দেরী করে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয় নীলিমা। প্রথম ক্লাসের বিরতি শেষে সবাই তখন মাঠে আড্ডায় মেতে উঠেছিল। দুর থেকে নীলিমা’কে আসতে দেখে’ই আড্ডার মাঝ থেকে উঠে পড়ে শাকিলা। নীলিমা কাছে আসতেই প্রশ্ন করে, কিরে? এত লেইট করলি যে? মাঠের মাঝেই বসে পরে নীলিমা। নীলিমা’র অনুকরণে নিঃশব্দে শাকিলা’ও বসে পরে পাশে। শাকিলা’র হাতে ছিল কাগজের পাখা। নীলিমা সে পাখা হাতে নিয়ে বাতাস করতে শুরু করে। পাশ থেকে শাকিলা’র প্রশ্ন- ‘কিরে? বাসা পেয়েছিস?’ পাখাটা হাত থেকে পাখা’টা নামিয়ে ফেলে নীলিমা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানায়, পাইনিরে। — নীলি! তোকে আমি বলছিলাম শুভ্র ভাইয়া’র সাথে কথা বলতে…! — হাঃ হাঃ বড় ভাই! তোদের ঐ বড় ভাই আজ দু’দিন ধরে নিখোঁজ। — মানে কি? — মানে আর কি? ওনাকে আমি কালকে সারাদিনে একবারো ক্যাম্পাসে দেখিনি। তারপর আজ এই যে এত লেইট হলো ওনার জন্য শুধু। ওনাকে খুঁজতে খুঁজতে এখন আমি ক্লান্ত…. — এত সকালে ওনাকে কেন খুঁজছিস? — কি জন্য আবার? ভাবছিলাম আজকে সকাল সকাল’ই বের হবো। — এখন তো ক্লাসটাও মিস করে ফেললি! — বাদ দে! কয়টা বাজে? — এখন তো ১১টা বেজে ৭মিনিট। ২য় পিরিয়ড শুরু হওয়ার এখনো ৮মিনিট বাকি আছে। (ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) — ভাল্লাগছে না! আচ্ছা, রুমে চল… — চল…. একসাথে দুটো ক্লাস শেষ করে তবে’ই বাহিরে আসে নীলিমা। এদিকওদিক তাকিয়ে নীলিমা’র দু’চোখ কেবল শুভ্র’কেই খুঁজছে। কিন্তু কোথাও পায়নি। বিষণ্ন মনে বকুলতলায় বসেছিল নীলিমা। কোথা থেকে যেন ছুটে আসে শাকিলা। হাপাতে হাপাতে জানায়, শুভ্র ভাইকে প্রিন্সিপাল মেডামের রুমে দেখে এসেছি। তুই তাড়াতাড়ি অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়া….! বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় নীলিমা। প্রিন্সিপালের রুমে? — হ্যাঁ! ঐখানে বসে কিছু একটা খাচ্ছে দেখলাম! — খাচ্ছে? তাও প্রিন্সিপালের রুমে? — সেটাই তো দেখলাম। — আচ্ছা, ধন্যবাদ! তুই তাহলে এখন যা…. — ওকে! বাই… — আল্লাহ হাফেজ। বান্ধবীকে বিদায় দিয়ে নীলিমা অফিসের সামনে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। মিনিট দশেক পর বেরিয়ে আসে শুভ্র। ডানে তাকিয়ে নীলিমা’কে দেখে বিপরীত দিকে মোড় নেয় শুভ্র। ঐপাশের গেইট দিয়ে বেরিয়ে পরে বাহিরে। দ্রুত পায়ে পিছন দিয়ে ছুটতে থাকতে নীলিমা। সেটা দেখে শুভ্র আরো দ্রুত হাটা শুরু করে। ব্যর্থ নীলিমা এবার পেছন থেকে ডাক দেয়, ভাইয়া…! ডাক শুনে গম্ভীর মুখে পেছনে ফিরে তাকায় শুভ্র। ছুটতে ছুটতে কাছে যায় নীলিমা। সালাম দেয়। — আসসালামু আলাইকুম! — ওয়ালাইকুম আসসালাম। — আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে আমি হয়রান হয়ে গেছি ভাইয়া। — কেন? — ঐ যে মনে নেই আপনার? আপনি বলছিলেন আমাকে বাসা খুঁজে দিবেন! — হ্যাঁ, মনে পড়ে’ছে! — তো যাবেন এখন? — স্যরি, নীলিমা! যেতে পারবো না আমি। — যেতে পারবেন না মানে? — মানে আমার কাজ আছে। আপনি যান! আর বাসা খুঁজা এটা তো কোন কঠিন কাজ নয়। — ওহ, আচ্ছা! — হু, আসি আমি। শুভ্র চলে যায়। বিষণ্ন মনে নীলিমা কতক্ষণ সে স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর সামনের দিকে পা বাড়ায়।