#গল্পপোকা_ধারাবাহিক_গল্প_প্রতিযোগিতা_২০২০
মায়াবী হরিণী পর্ব ৭
লিখাঃ জামিয়া পারভীন তানি
“ ছাদে যাবে? ”
সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, ছোঁয়া ও ঘুমিয়েই ছিলো। কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন বলে বাইরে এসেছিলো। তখনই ফুয়াদ ওকে জিজ্ঞেস করলো ছাদে যাবে কিনা!
ছোঁয়া কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু উপরে নিচে মাথা উঠালো আর নামালো৷ ওদের বাসা টা ৭ তলা। ছাদে উঠতে কষ্ট কম হয়, তাছাড়া ছাদ রাতেও খোলা থাকে। কেননা, চিলেকোঠায় একটা ঘর আছে, যদিও একজন থাকে। কিন্তু এতো রাতে জেগে থাকার সম্ভাবনা কম।
ছাদে আসতেই প্রাকৃতিক হাওয়া মন টা জুড়িয়ে দিলো। ভিতরে ভ্যাপসা গরম, অস্থির লাগছিলো ছোঁয়ার। অথচ ছাদে কতটা প্রশান্তি নিয়ে এসেছে। যে পাশে একটা ঘর আছে ওই পাশে টবে অনেক গুলো গাছ আছে। বুঝায় যাচ্ছে যিনি থাকেন উনি খুব সৌখিন। বেশ কয়েকটা গোলাপের ও গাছ আছে, যার একটায় গোলাপ ফুটেছে। ছোঁয়া ফুলের ঘ্রাণ ও নিয়ে নিলো৷ মিষ্টি ঘ্রাণ মন ভালো করে দেয়।
ফুয়াদ ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। ছোঁয়া একবার ফুয়াদের দিকে তাকিয়ে দেখলো, এরপর ধীর পায়ে হেটে গেলো। একটু লজ্জা লাগছে, এই প্রথম ওরা একসাথে একা এসেছে। ছোঁয়া কাছে যেতেই ফুয়াদ বলল,
“ খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা!”
“ কীসের? ”
“ চোখ দুটো বসে গেছে৷ এতো হাতের কাজ করো না৷ ”
“ আমি ঠিক আছি৷ ”
“ তুমি ঠিক থাকলেও আমি ঠিক নেই৷ তোমার গভীর চোখের মায়া হারিয়ে যাচ্ছে। আমি চাইনা তুমি গয়না বানানোর অতিরিক্ত চাপ নাও৷ পড়াশোনা ও তো করতে হবে। ”
ছোঁয়া ফুয়াদের দিকে আড় চোখে তাকালো। ছেলেটা তাকে নিয়ে এতো ভাবে৷ অথচ সে মনে করে ফুয়াদ ওকে বিয়ে করে বিরক্ত। অথচ অপ্রকাশিত কেয়ারিং যে তার মধ্যে থাকতে পারে ছোঁয়া কখনো ভেবে দেখেনি। ছোঁয়া বলল,
“ আমি এখনো পড়াশোনা শুরু করিনি। আর দিনের আলোয় যতটুকু সম্ভব ততটুকু কাজ করি৷ চোখে এক্সট্রা প্রেসার দিই না তো। তাছাড়া আপনি নিজেও অক্লান্ত পরিশ্রম করেন৷ আপনাকে রোদে গরমে কাজে পাঠিয়ে আপনার উপর আমাকে বহন করার মানসিক প্রেসার দেওয়ার কোনো মানেই হয় না। ”
“ আমি তো আয় করি নাকি!”
“ হ্যাঁ আয় করেন, কিন্তু আপনার সেভ করা উচিৎ। কেননা, কোচিং করছেন৷ কিছুদিন পর ভর্তি যুদ্ধে নামবেন। ফর্ম তুলা, পরীক্ষা দেওয়া, টাকার প্রয়োজন আছে। তাছাড়া কোথাও চান্স পেলে সেখানে ভর্তি হতেও অনেক টাকা লাগবে৷ আমি যদি কিছু করে সবার কষ্ট কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করি তাহলে ক্ষতি কি!”
“ বাইরে গিয়ে কাজ করার দরকার নেই। যদি অর্ডার নিয়ে বাসায় এসে সুযোগ সুবিধা মতো কাজ করার সুযোগ দেয় ওরা তাহলে ওদের সাথে কাজ করিও। ”
ছোঁয়া চুপ থাকে, এই রাগী ছেলেটা কিনা আজ তার জন্য ভাবছে, তার খেয়াল রাখছে৷ মনে মনে খুশিই হলো ছোঁয়া৷ মনে একটু সাহস নিয়ে ফুয়াদের ডান হাত নিজের হাত দুটো দিয়ে চেপে ধরে। ফুয়াদ নিজেও চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়, ছোঁয়া ও লজ্জায় চোখ বন্ধ করে। ছোঁয়া শুধু বলল,
“ ভরসা রাখবেন, আমি নিজের ক্ষতি করে কোন কাজ করবো না। ”
এটা বলেই ফুয়াদের হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে যায় ছোঁয়া। ফুয়াদ বুঝতে পারলো ছোঁয়া চলে গেছে, তাই দূর থেকে বলল
“ চাবি নিয়ে যাবে না!”
কে শোনে কার কথা, ছোঁয়া একদম ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ফুয়াদ ভাবলো, ছাদে আসার সময় দরজায় তালা দিয়ে এসেছে। দরজা না খুলতে পারলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে মেয়েটা। তাই তাড়াহুড়ো করে নিজেও নিচে নেমে গেলো। ফুয়াদ দেখলো, ছোঁয়া একপাশে দাঁড়িয়ে আছে গুটিসুটি মেরে। ভালোই লজ্জা পেয়েছে তাহলে, ভেবে মনে মনে হাসলো। কিছুক্ষণ পর দুষ্ট বুদ্ধির উদয় হয়, আরেকটু লজ্জা দেওয়ায় যায়। ভাবতেই সিড়ি ঘরের লাইট অফ করে দেয় ফুয়াদ। ছোঁয়া চমকে যায়, ফুয়াদ তখনই ছোঁয়ার ঘাড়ে হাত রাখে। ছোঁয়া আরও কাঁপতে শুরু করলো। তখনই ছোঁয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল,
“ আমার মায়াবী বউ। ” বলে ছোঁয়ার কানে হালকা কামড় দেয়।
ছোঁয়া আরও কাঁপতে থাকে, তখন ফুয়াদ দরজা খুলে ভিতরে চলে যায়৷ ছোঁয়া না পারছে নড়তে, না কিছু বলতে৷ এক জায়গায় স্ট্যাচু হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
ফুয়াদ বলল,
“ ভেতরে এসো, লোকে দেখলে খারাপ ভাববে৷ ”
ছোঁয়া চোখ টা খুলে একদম ঘরের ভেতর দৌড়ে চলে আসে৷ জীবনে প্রথম প্রেমের পরশ পড়েছে শরীরে। অন্যরকম মাদকতা কাজ করছে। মনের ভেতর অস্থিরতা বেড়ে গেছে। কিভাবে এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি পাবে সে নিজেও জানেনা। ছোঁয়ার ছোট্ট হৃদয়ে এখন হরেক রকম স্বপ্নের জাল বুনছে৷ বিশেষ করে একই বাড়িতে থেকে কাছাকাছি যেতে না পারার জন্য খারাপ লাগা তৈরী হয়েছে৷
শুধু মন চায় কাছাকাছি যায়,
ভালবেসে করি আপন তোমায়।
নীল আসমানে চলে যাই,
ডানা মেলে উড়বো দুজনায়।
চল প্রজাপতির পাখনা লাগাই,
ভাসবো এই রঙের দুনিয়ায়।
ভোমরা হয়ে চল ফুলের মধু খাই ,
ফুলের মাঝে স্বপ্নের বাসর সাজাই৷
শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পাশে থাকতে চাই,
ভালবাসা দিয়েই করবো জয় তোমায়।
°°°
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ফারুক কে খুব চিন্তিত দেখলো সারা৷ মুখ মলিন দেখে অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ তুমি ঠিক আছো তো!”
ফারুক কিছু না বলে মুখ ভার করে নেয়। কিছুক্ষণ সারা ফারুকের উত্তরের আশায় তাকিয়ে থাকে। উত্তর না পেয়ে নিরাশ হয় মন খারাপ করে ফেলে। তখন ফারুক বলল,
“ আমি বাবা হবার অযোগ্য তাইনা!”
“ কখনো কি তোমার সন্তানেরা অভিযোগ করেছে?”
“ ভালোবেসে তোমায় বিয়ে করেছিলাম বলে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করেছিলো আমার বাবা। আমার দুঃসময়ে তুমি আমায় ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরোনি। ধনীর ঘরে আদরের দুলালী আমার ঘরে এসে সারাজীবন খেটে খেটে বুড়ি হয়ে গেলো তবুও একবার ও অভিযোগ করোনি, কিংবা এই সিকিউরিটি গার্ড কে হেলা করোনি। কখনো আর ৫ টা স্বামীর মতো তোমায় সুখে রাখতে পারিনি, তবুও সব সময় হাসিমুখে সব সময় আমার সঙ্গ দিয়ে গেছো। অভাবে ভালবাসা নাকি জানালা দিয়ে পালায়, কিন্তু তোমাকে দেখে কখনো মনে হয়নি তুমি পালিয়ে যাবে। ভালবাসার টান কতটা তোমার কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু সন্তানেরা হয়তো আমার প্রতি বিরক্ত। কারণ তাদের কোনো চাহিদা আমি পূরণ করতে পারিনি৷ বরং তাদের জীবন সংগ্রামে ফেলে দিয়েছি। ”
সারা এবার কেঁদে ফেললো, কিছুক্ষণ কেঁদে হালকা হয়ে ফারুকের হাত ধরে বলল,
“ ওরা তোমাকে ভয় পায়। ”
“ কারণ আমি ওদের শাসন ছাড়া কিছুই করিনি। করবোই বা কিভাবে, সামর্থ্যের অভাবে ওদের সামনে দাঁড়াতেই লজ্জা লাগতো। ভালবাসার সাহস হয় নি কখনো। ”
“ আজ হঠাৎ এসব বলছো যে! মনটা খুব খারাপ লাগছে তাইনা!”
“ আমার বড় ছেলেটা বিয়ে করেছে , অথচ আমি জানতেই পারলাম না! আমি জানলে কি ওদের তাড়িয়ে দিতাম! ”
“ ফারুক…”
“ আমি বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে পারিনা বলেই হয়তো এই লুকোচুরি! ”
সারা কিছু না বলে কাঁদতে শুরু করলো।
চলবে…