হৃদয় আকাশে প্রেমবর্ষণ পর্ব-১০

0
803

#হৃদয়_আকাশে_প্রেমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রাবণী_সারা
#পর্ব-১০

পরেরদিন দুপুরের পর শাহানা খানের জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলে চারিপাশে চোখ বুলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায় আছে। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে বুঝতে পারলো সে হাসপাতালে আছে। শাহানা খান অনুভব করলেন তার মাথাসহ মুখের একপাশ ব্যান্ডেজে মোড়ানো। শরীরটাও অনেক ভাড়ী। হঠাৎ করে তার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর বিষ্ফোড়নের কথা মনে পড়ে আৎকে উঠলো সে। সে একটু নড়চড়ে উঠতে একজন নার্স এসে বললো,
আপনার জ্ঞান ফিরেছে! প্লিজ আপনি নড়বেন না প্রবলেম হবে আমি এক্ষুণি ডাক্তারকে ডাকছি।

নার্স বেড়িয়ে যাওয়ার মিনিটখানিকের মধ্যে ডাক্তার এলো। ইতোমধ্যে বাইরে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে শাহানা খানের জ্ঞান ফিরেছে। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে শুনে নিশান অস্থির হয়ে উঠলো ভেতরে ঢুকার জন্য। ডাক্তার বলেছে পেসেন্টের কন্ডিশন দেখে তবেই তাদেরকে ভেতরে যেতে এলাউ করবেন। রিশানকে কোনোভাবে কেউ সামলাতে না পেরে ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে পাশের কেবিনে রাখা হয়েছে। আয়মান খান সেখানের ছিলেন স্ত্রীর জ্ঞান ফিরেছে শুনে ছুটে এলো সে।
ডাক্তার শাহানা খানের চোখ দেখে খানিক চুপ রইলেন। চোখজোড়া কেমন ঘোলাটে হয়ে আছে। এটা তো ভালো লক্ষণ নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচণ্ড ভয় থেকে পুড়ে যাওয়া রোগীদের মাথায় চাপ পড়ে। এজন্য মাথায় রক্ত জমাট বাধে ফলে ব্রেইন স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে। আর চোখ ঘোলাটে হওয়া মাথায় রক্ত জমাট বাধার পূর্ব লক্ষণ।
ডাক্তার খেয়াল করলেন শাহানা খান ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছেন তার গলার আওয়াজ খুবই কম ছিলো। ডাক্তার নার্সকে ইশারা করলো কান পেতে শোনার জন্য। নার্স তাই করলো। শাহানা খান ধীরে ধীরে বলছেন,

আমার স্বামী ও আমার ছেলেদের দেখবো ওরা কোথায়? ডাকুন না ওদের।

নার্স ডাক্তারকে বলতে ডাক্তার তাকে বললো,
পেসেন্টের অবস্থা তেমন ভালো দেখছি না যেকোনো মুহুর্তে কিছু ঘটে যেতে পারে। উনি যাদেরকে দেখতে চাইছে ডাকুন তাদের। আর শুনুন তাদেরকে বলে দেবেন পেসেন্টের সামনে এসে যেনো কেউ ইমোশনাল হয়ে না পড়ে।

রিশান ঘুমিয়ে থাকায় আয়মান খান ও নিশান ভেতরে এলো। আয়মান খান স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলেন। আর নিশান দরজার পাশে দাড়িয়ে মায়ের ব্যান্ডেজে মোড়ানো পুরো শরীরে চোখ বুলালো। তার কেবলই মনে হতে লাগলো মায়ের কষ্টের ভাগটা যদি নিজে নিতে পারতো তাহলে অন্তত মায়ের এত যন্ত্রণা হতো না। কতই না যন্ত্রণা ভোগ করছে তার মমতাময়ী মা। কাঁন্না যেনো গলায় আটকে আছে তার। নিশান নিজেকে স্বাভাবিক করে ধীর পায়ে মায়ের কাছে গেলো। ব্যান্ডেজরত ক্যানুলা পড়ানো হাতটা আলতো করে ছুয়ে দিলো।

শাহানা খান বড় ছেলের দিকে মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালেন তারপর মৃদু হেসে ক্ষীণ স্বরে ভাঙা ভাঙা ভাবে বললেন,
কেঁদেছিস তাইনা! তোকে তো আমি অনেক স্ট্রং ভাবতাম এমন ভেঙে পড়লে চলে হুম। এই দেখ মা কথা বলছি তোর সাথে।

নিশান বহু কষ্টে কাঁন্না চেপে বললো,
তোমার ছায়া আমাদের দুভাইয়ের উপর না থাকলে কি করে স্ট্রং থাকবো বলোতো মা! জানো মা রিশানকে একদমই সামলানো যাচ্ছিলো না এজন্য ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।

শাহানা খান আবার কিছু বলতে নিলে ডাক্তার বললেন,
পেসেন্টের এত বেশি কথা বলা ঠিক হবে না আপনারা এখন বাইরে যান। আর আপনাদের মধ্যে কেউ একজন আমার চেম্বারে আসুন ইমপর্টেন্ট কথা আছে।

শাহানা খান যেতে দিতে চাইলেন না। নিশান মাকে অনেক বুঝিয়ে তবে বের হলো। এবং বলে গেলো রিশানের ঘুম ভাঙলে ওকে নিয়ে আবার দেখা করতে আসবে।

আয়মান খান ডাক্তারের সাথে গেলেন। ডাক্তার শাহানা খানের শারীরিক কন্ডিশনের ব্যাপারে বললেন তাকে। আরও বললেন যদি দেড় দুই ঘন্টার মধ্যে অবস্থার উন্নতি হয় তাহলে তারা শাহানা খানের ব্রেইনের একটা অপারেশন করবেন। সেই অপারেশনের মাধ্যেমে মাথায় যতটুকু রক্ত জমেছে তা বের করে ফেলা হবে। তবে এইমুহূর্তে সেই অপারেশনটা করা ঠিক হবে না।
আয়মান খান সব শুনে আরো ভেঙে পড়লেন। কি হবে এরপর? তার স্ত্রী বাচবে তো? সে নিশানকে তেমন কিছু জানালো না নয়ত ছেলেটা আরো বেশি ভেঙে পড়বে। আয়মান খান এ বিষয়টা হৃদিতার বাবা ও নিজের ভাই আরাফের সাথে শেয়ার করলেন। হৃদিতার বাবা বললেন,

ভাই আপনি টেনশন করবেন না আল্লাহকে ডাকুন সব ঠিক হয়ে যাবে।
.

সত্যিই আশ্চর্যজনক ভাবে শাহানা খানের অবস্থা দেড় ঘন্টার মধ্যে আরো উন্নতি হলো। আগের তুলনায় চোখের ঘোলাটে ভাব কিছুটা কমেছে। কথাও ঠিকঠাক বলছেন। এতে ডাক্তার নার্সরাও অবাক হলেন। কেনোনা পুড়ে যাওয়া রোগীরা এত তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হতে পারে না। তার উপর শাহানা খানের শরীরের প্রায় ৮০ ভাগই পুড়ে গিয়েছে। ডাক্তার সহ সকলে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানালো। তার ইশারা ছাড়া যে কিচ্ছু হয়না। শাহানা খানকে আই সি ইউ থেকে বের করে কেবিনে সিফট করা হলো। ডাক্তার আয়মান খানকে জানিয়ে দিলেন অপারেশন ঘন্টাখানিক পরে করবেন ততক্ষণ সে কেবিনে থাকবেন।
শাহানা খানের আপনজনেরা সবাই একে একে দেখা করলো। রিশান তো ঘুম ভাঙার পর থেকে মায়ের কাছে থেকে একপাও নড়ছে না। রুপ নিজের মায়ের হাত ধরে কেবিনে এসে রিশানের দিকে তাকালো। কেনো যেনো আজ রিশানের জন্য খারাপ লাগছে ওর। রিশান কাঁন্না করলে ওর ও কাঁন্না পাচ্ছে। রুপ রিশানের পাশে এসে দাড়ালো রিশান তাকালো শুধু কিছু বললো না। রুপ হাত বাড়িয়ে রিশানের চোখের কোনার পানিটুকু মুছে দিয়ে বললো,

কেঁদো না তুমি তোমার মা ভালো হয়ে যাবে দেখো।

রিশান কোনো প্রতিউত্তর করলো না নিরবে চেয়ে রইলো রুপের মলিন মুখের দিকে।
.

একজীবনে মানুষের কত সপ্ন থাকে,কত চাওয়া থাকে সবই কি পূরণ হয়? হয় না। কারন মানুষের জীবনটা যে চিরস্থায়ী নয়। জন্মালে মরতে একদিন হবেই এই বাণীটা বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই মানুষের মন ও মস্তিষ্কে গেথে যায়। এটাই যে প্রকৃতির নিয়ম। আসলেই আমরা মানুষেরা অল্প কিছুদিনের অতিথি মাত্র এ পৃথিবীতে। যার যতদিন হায়াৎ থাকবে ততদিনই বাঁচবে।

শাহানা খানের অপারেশনের জন্য সব রেডি করে ডাক্তার আয়মান খানকে বললেন ২০ মিনিটের মধ্যে তাকে ওটিতে নিয়ে যাবেন। আয়মান খান শাহানা খানের কেবিনে ঢুকলো। সেখানে হুমায়রা বেগম,রিতা ও শাহানা খানের বোন ছিলেন। আয়মান খানকে দেখে একে একে বেড়িয়ে গেলো তারা। আয়মান খান স্ত্রীর পুরো শরীরটা একবার দেখে গভীর নিশ্বাস ফেললেন। তিনি টুল টেনে বসলেন বেডের পাশে। শাহানা খান তাকালেন তার চোখ দুটো পানিতে টলটল করছে। আয়মান তাকে শান্তনা দিতে বললেন,

তুমি ভয় পেয়ো না শাহানা খুব তাড়াতাড়ি তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পর তোমার মাথায় একটা অপারেশন করা হবে তারপর আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠবে তুমি।

শাহানা খান ঠোঁট বেকে একটু হাসলেন। চোয়ালের একপাশে পুড়ে যাওয়ায় ঠোঁট নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে তার। তিনি অনেকটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন,
আয়মান আমার আর কোনো অপারেশন করতে হবে না আমি জানি আমি আর সুস্থ হতে পারবো না। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আয়মান ভীষণ। আমার সময় যে ফুরিয়ে এসেছে।

আয়মান খান চমকে গেলেন শাহানা খানের কথাগুলো শুনে! এসব কি বলছে সে! নাহ তার স্ত্রীর কিচ্ছু হবে না।

শাহানা এসব কথা কেনো বলছো তুমি। তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে….

মিথ্যে শান্তনা দিও না তুমি নিজেও তো বুঝতে পারছো আমার কষ্টটা। আমার ছেলেদের ডাকো আয়মান ওদেরকে আমি দুচোখ ভরে একটু দেখতে চাই আর শোনো হৃদিতাকেও ডাকবে।

আয়মান খানের গাল বেয়ে কয়েকফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। তা দেখে শাহানা বললেন,
কাঁদছো কেনো তুমি নিজেকে শক্ত রাখো আমার কিছু হয়ে গেলে ছেলেদেরকে তো তোমাকেই সামলাতে হবে।
.

ডাক্তার যখন তাড়া দিলেন শাহানা খানকে ওটিতে নেওয়ার জন্য শাহানা খান তখন সারাসরি ডাক্তারকে বললেন সে ওটিতে যাবে না। তার কোনো অপারেশনের প্রয়োজন নেই। কেবিনে উপস্থিত সকলের মধ্যে সেই মূহুর্তে ডাক্তারের থেকে আশ্চর্য বোধহয় আর কেউ হয়নি। তার কারন হচ্ছে শাহানা খানের এতটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা! কথায় আছে মানুষ মারা যাবার আগে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যায় শাহানা খানের ক্ষত্রেও সেটাই হয়েছে। ডাক্তার খেয়াল করলেন শাহানা খানের চোখজোড়া আবারো ঘোলাটে রুপ ধারণ করছে। এবং নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। তাকে দ্রুত অক্সিজেন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। নার্সদের নির্দেশ দেওয়া হলো স্ট্রেচার আনতে পেসেন্টকে আবারো আই সি ইউ তে সিফট করতে হবে। কেবিনে তখন নিশানও ছিলো মায়ের অবস্থা খারাপ হতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়লো ছেলেটা। মা বলে চিৎকার করে ব্যান্ডেজ করা হাতটা আকড়ে ধরলো সে। ইতোমধ্যে বাইরে থাকা অনেকেই কেবিনে চলে এসেছে। রিশান একছুটে এসে মায়ের পাশে বসে কাঁদতে লাগলো। মা তো সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো এই তো একটু আগেও কথা বললো মা তার সাথে। তাহলে এখন এমন করছে কেনো মা? শাহানা খান চোখের ইশারায় বারবার অক্সিজেন মাস্ক দেখাচ্ছে। একজন নার্স বললেন,

পেসেন্ট হয়ত কিছু বলতে চাইছে আপনারা যদি বলেন মাস্কটা খুলে দেওয়া হবে।

আয়মান খান বেডের পাশেই পাথর হয়ে দাড়িয়ে আছেন। স্ত্রীর শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছেন। তিনিই বললেন মাস্কটা খুলে দিতে।

নার্স মাস্ক খুলে দিতে শাহানা খান বড় করে শ্বাস ছাড়লেন। তিনি হৃদিতাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। হৃদিতা কাছে আসতে তিনি অত্যন্ত ধীর গলায় থেমে থেমে বললেন,

আমার ছেলেটাকে দেখো মা আজকের পর থেকে ওর ভালো মন্দ সবকিছু দেখার দায়িত্ব তোমার। আমার ছোট ছেলে রিশানকেও দেখে রেখো তুমি।

থামলেন শাহানা খান বারবার ঢোক গিয়ে শ্বাস নিয়ে আবারো বললেন,
বড্ড আশা করেছিলাম তোমাকে বউ করে বরণ করে ঘরে তুলবো। কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার আর হলো না। সুখে থেকো তোমারা।

কেবিনের সকলের চোখে পানি জমেছে। হৃদিতা কাঁন্নারত অবস্থায় নিশানের দিকে চাইলো। নিশান অপলক চেয়ে আছে মায়ের মুখের দিকে। শাহানা খান নিশান ও রিশানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

তোদের মায়ের দোয়া সবসময় তোদের সাথে থাকবে। ভালো থাকিস বাবারা। মা চলে যাচ্ছি বলে একদম ভেঙে পড়বি না কেউ কেমন।

তারপর তিনি কেবিনে থাকা সকলের দিকে চোখ বুলালেন। এখানে সকলেই তার কাছের মানুষ। এই মানুষগুলোকে ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিতে চলেছেন তিনি। শাহানা খান হয়ত আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সে আর বাঁচবে না। সর্বশেষ তিনি আয়মান খানের দিকে তাকালেন কিছু বলতে যাবে সেই মুহূর্তে তার শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে গেলো। নিশান রিশান একসাথে মা বলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। নার্স জলদি অক্সিজেন মাস্ক পড়ালো তাকে। শাহানা খান আয়মান খানের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলেন। শেষ সময়ে এসে স্বামীকে কিছু বলতে না পেরে বড্ড আফসোস হচ্ছে তার।
স্ট্রেচারে তোলার জন্য নার্সরা এগোতে শাহানা খানের অবস্থার আরো বেশি অবনতি হলো। অক্সিজেন মাস্ক থাকতেও অস্বাভাবিক ভাবে নিশ্বাস নিচ্ছেন তিনি। ছটফট করছে চোখদুটো যেনো উল্টে যেতে চাইছে। মায়ের এমন অবস্থা রিশান সহ্য করতে পারলো না সেখানেই জ্ঞান হারালো। আর নিশান নিস্তব্দ হয়ে কেবল চেয়ে রইলো মায়ের মুখের দিকে। মিনিট খানিক পাড় হতে শাহানা খান নিস্তেজ হয়ে গেলেন। হা করে বড় শ্বাস ফেলে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন! এর ১০/১৫ সেকেন্ড পরে তার নাক ও মুখ দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে এলো। মুহুর্তেই পুরো কেবিনজুরে কাঁন্না আহাজারি শুরু হয়ে গেলো। কাঁদলো না শুধু নিশান সে আগের মতোই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে