হৃদয় আকাশে প্রেমবর্ষণ পর্ব-০৩

0
871

#হৃদয়_আকাশে_প্রেমবর্ষণ
#লেখনীতে-শ্রাবণী_সারা
#পর্ব-৩

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। শুভ্র আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে থোকা থোকা কালো মেঘ। থমথমে চারিপাশ বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই। শরীর ঝলসানো রোদের তীব্রতা আজ না থাকলে ভ্যাবসা গরম পড়ছে। আবহাওয়া দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঝড়ো হাওয়ার সাথে ভাড়ী বর্ষণ নামবে। অবশ্য বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না গরমটা অন্তত কমবে।
রিশান ধীরেধীরে স্কুলড্রেস পড়ছে। এমনভাবে পড়ছে যেন তার হাত পা চলছেই না। শাহানা খান রুমে এসে ছেলের অলসতা দেখে বললেন,

রিশান জলদি কর তোর ভাইয়া দাড়িয়ে আছে তো। তোকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ও অফিসে যাবে।

রিশান গোমড়ামুখ করে বলে,
একদিন স্কুলে না গেলে কি এমন ক্ষতি হতো। তোমরা মা ছেলে উঠে পড়ে লেগেছো আমাকে স্কুলে পাঠাতে।

দিনকে দিন বড্ড ফাকিবাজ হয়ে যাচ্ছিস তুই। সামান্য মেঘ করেছে অমনি বাহানা শুরু হয়ে গেলো তাইনা। যাদের গাড়ি নেই রিকসা ভাড়াটা জোটাতে পারে না তাদের ছেলেমেয়েরা কোনো বাহানা খোজে না কষ্ট করে রোদে পুরে বৃষ্টিতে ভিজে পড়ালেখা করে। ছোট থেকে আরাম আয়েশে বড় হচ্ছো তো এজন্য যত হেয়ালিপণা।

রিশান মায়ের দিকে তাকিয়ে ব্যাগ নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো। শাহানা খান ছেলের যাওয়ার পানে চেয়ে হাসলো। এভাবে না বললে ছেলে কথা বাড়িয়ে আরো অজুহাত দেখাতো। বড় ছেলেটার তুলনায় ছোটটা বড্ড জেদি ও ফাকিবাজ। তবে তিনি দুটো ছেলেকে ভীষণ ভালোবাসেন।
.
ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে হৃদিতা এক বান্ধবীর বাসা থেকে নোট নিতে এসেছে। নোট নিয়ে রাস্তায় বের হওয়ার পরেই ঝড়ো বাতাস শুরু হলো। হৃদিতা মনে মনে এই ভয়টা পাচ্ছিলো কখন যেনো ঝড় শুরু হয়। মা আজ বাড়ি থেকে বেরোতেই মানা করেছিলো। ইমপর্টেন্ট ক্লাস ছিলো এজন্য হৃদিতা বের হয়েছে আজ। চারিদিকে ধুলোয় অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। এদিকটায় ফাকা রিকসা অটো দেখা যাচ্ছে না তেমন। হৃদিতা মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে ওড়না দিয়ে নাক মুখ চেপে ধরলো। ধুলোয় তার এলার্জি হয়। আজ নিশ্চিত এলার্জির যন্ত্রনায় ভুগতে হবে। হৃদিতার সামনে একটা গাড়ি এসে দাড়ালো। হৃদিতা ভ্রু কুঁচকে তাকালো সেদিকে। হুট করে সামনের গ্লাস নামিয়ে রিশান মুখ বের করে বললো,

হৃদি আপু গাড়িতে ওঠো। প্রচণ্ড ধুলো উড়ছে তাড়াতাড়ি এসো।

হৃদিতা দেখলো ড্রাইভিং সিটে নিশান রয়েছে। তার দৃষ্টি সামনের দিকে। হৃদিতা রিশানের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে বললো,

আমার সমস্যা হচ্ছে না রিশান আমি অটোতে করে চলে যাব।

নিশান হৃদিতার দিকে তাকালো। মেয়েটা নাকে মুখে ওড়না চেপে রেখেছে আবার বলছে সমস্যা হচ্ছে না। নিশান বললো,
হৃদিতা আপনি গাড়িতে আসুন এই ঝড়ের মধ্যে ফাকা অটো বা রিকসা পাবেন না।

হ্যা হৃদি আপু ভাইয়া ঠিকি বলেছে এসো।

হৃদিতা কয়েকসেকেন্ড ভেবে পেছনের দরজা খুলে উঠে বসলো। নিশান মৃদু হেসে গাড়ি স্টার্ট করলো। কিছুক্ষন পর হৃদিতা নিশানের দিকে একবার তাকিয়ে রিশানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
রিশান তোমাদের বাড়ি তো সামনেই আমাকে তো আরো এগিয়ে যেতে হবে তাহলে….

নিশান কথা কেটে বললো,
আমাদের বাড়ি মানে আপনার ফুপির বাড়ি ওখানে গেলে প্রবলেম কোথায়?

প্রবলেম নেই তবে আমি বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়া কখনো কোথায় যাই না। আজও যেতে চাইছি না।

ওও আচ্ছা। ঠিকআছে আমি নাহয় আপনাকে বাড়ি অবদি ছেড়ে দিয়ে আসবো।

হৃদিতা আর কিছু বললো না এ ব্যাপারে। রিশান হৃদিতার কাছে রুপকে নিয়ে এটা ওটা অভিযোগ করছে। হৃদিতাও হাসছে রিশানের কথা শুনে। কথার এক পর্যায়ে রিশান বললো,

ভাইয়া তুমি হৃদি আপুকে আপনি করে বলো কেনো? আপু তো ছোট তোমার?

ভাইয়ের প্রশ্নে থমকালো নিশান। হৃদিতা হা করে তাকালো রিশানের দিকে। ছেলেটা যে এমন কিছু বলবে তা হয়ত কেউ ভাবেনি। নিশান ড্রাইভ করতে করতে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,

ছোট হয়েছে তাতে কি। যাকে বলেছি তার অনুমতি ব্যাতিত তুমি বা তুই করে বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না।

হৃদিতা এবার সারাসরি তাকালো নিশানের দিকে। এই সামান্য বিষয়ে যে অনুমতি নিতে হয় তা হৃদিতার জানা ছিলো না!
রিশানকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে হৃদিতাকে নিয়ে তার বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামালো নিশান। ঝড়ো বাতাস কমে এখন ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হৃদিতা আনমনা হয়ে বৃষ্টি দেখতে ব্যস্ত। এদিকে যে নিজের বাড়িতে পৌছে গিয়েছে সে খেয়াল নেই মেয়েটার। নিশান ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকালো। মিনিটখানিক চেয়ে রইলো হৃদিতার দিকে। নিশানের চোখ আটকালো হৃদিতার ঘনকালো পাঁপড়িযুক্ত চোখে। ভীষণ স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে ওই চোখজোড়াতে। হৃদিতা পলক ফেললো সাথে সাথে নিশান চমকালো। এসব কি হচ্ছে তার সাথে! না চাইতেও কেনো হৃদিতার প্রতি সম্মোহিত হচ্ছে সে! ওই চোখজোড়াতে কি এমন আছে ও চোখে তাকালে কেনো অদ্ভুত অনুভূতি হয় মনে!
নিশান গভীর শ্বাস ফেললো। নিশান হয়ত বুঝতে পারছে এটা কিসের আভাস। নিজের মনকে আজ বড্ড অচেনা লাগছে। ইদানীং মনপাখিটা একটু বেশিই ছটফট করছে। বন্ধ করতে হবে এসব। মনপাখিটাকে বুঝাতে হবে তার অনুভূতিগুলো বড্ড বেমানান।
নিশান হৃদিতার নাম ধরে দুবার ডাকলো। হৃদিতা খানিক কেপে উঠে বললো,

হ্যা বলুন।

আপনার বাড়িতে চলে এসেছি।

হৃদিতা বাইরে তাকালো। বৃষ্টি দেখতে সে এতটাই মত্ত ছিলো যে নিজের বাড়ির সামনে গাড়িতে বসে আছে বুঝতেই পারেনি। হৃদিতা নিচু স্বরে বললো,

সরি, আসলে খেয়াল…..

ইটস ওকে। এই ছাতাটা নিন নয়ত দরজা অবদি যেতে যেতে ভিজে যাবেন।

নিশান একটা ছাতা এগিয়ে দিলো হৃদিতার দিকে। হৃদিতা না করতে পারলো না। ছাতাটা নিয়ে বললো,

ভেতরে আসুন না মা ও রুপ খুব খুশি হবে আপনাকে দেখে।

আজ নয় অন্য একদিন যাব।

হৃদিতা আর কিছু বললো না। গাড়ি থেকে নেমে ছাতা নিয়ে দুপা এগিয়ে থামলো। ঘুরে সামনের গ্লাসে টোকা দিবে তার আগেই নিশান তা খুলে দিলো। হৃদিতা মৃদু হেসে বললো,

থ্যাংকস এতটা হেল্প করার জন্য।

নিশান কিছু না বলে হাসলো কেবল। হৃদিতা চলে গেলো। নিশান হৃদিতার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, নিশান নিজেকে সামলা এটা অসম্ভব।
.
নদীর পাড়ে মুক্ত বাতাসে খোলা চুলে বসে আছে হৃদিতা। হৃদিতার ডানপাশে বসে আছে নিশান। হৃদিতার একহাত নিশানের হাতের বাধনে আবদ্ধ। এলোমেলো বাতাসে হৃদিতার চুল উড়ে চোখে মুখে পড়ছে এতে বিরক্ত হচ্ছে সে। নিশান আলতো করে হৃদিতার মুখের চুল গুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো। তাতেও বিশেষ লাভ হলো না। অবাধ্য ছোট চুলগুলো আবারো খেলা করতে লাগলো হৃদিতার মুখজুড়ে। নিশান হাসলো মেয়েটার বিরক্তিমাখা মুখ পানে চেয়ে। নিশান হৃদিতার কাধের একপাশের ওড়না তুলে হৃদিতার মাথায় জড়িয়ে দিয়ে বললো,

তোমার চুল তোমারই চোখে মুখে পড়ছে এতে এত বিরক্ত কেনো হচ্ছো হৃদি। নাও ওড়না দিয়ে চুল ঢেকে দিয়েছি এখন এত উড়বে না।

ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো হৃদিতা। চোখ বড় বড় করে আশেপাশে চোখ বুলালো। বিড়বিড় করে বললো, আমি তো রুমেই আছি এসব কি দেখলাম আমি কেনো দেখলাম! এটা আদৌও সপ্ন ছিলো তো?
হৃদিতা হাতে চিমটি কাটলো তাতে ব্যাথাও পেলো। তারমানে সে সত্যিই সপ্ন দেখেছে। কিন্তু এমন সপ্ন দেখার মানেটা কি? হৃদিতা তো কখনো নিশানকে নিয়ে কিছু ভাবেনি। তার ব্যাপারে সেভাবে কিছু জানার আগ্রহ দেখায়নি কখনো। তাহলে এমন অদ্ভুত সপ্নের কারন কি? হৃদিতা আর ভাবতে পারছে না। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে।
জানালায় তাকিয়ে দেখলো প্রায় সন্ধা হয়ে গিয়েছে। হৃদিতা বেড থেকে নেমে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো। তখনই রুপ হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো। হৃদিতাকে বললো,

আপু বাইরে আসো ভাইয়া ডাকছে।

মুহুর্তেই হৃদিতার চিন্তিত মুখে হাসি ফুটলো। রুপকে জিজ্ঞেস করলো,
ভাইয়া কখন এসেছে?

এই তো এখনি।

রুপ আবারো দৌড়ে চলে গেলো। হৃদিতা বেড থেকে ওড়না নিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করে রুম থেকে বের হলো।
রিয়াদ দেড়মাস পর আজ দেশে ফিরেছে। বাবার বিজনেসের কাজে তাকে সিঙ্গাপুর যেতে হয়েছিলো। বাবা মা ও বোনদের খুব মিস করেছে সে। রিয়াদ ড্রইংরুমে সোফায় বসে আছে রুপ এসে দাড়াতে তাকে টেনে কোলে বসালো সে। রুপের গাল টেনে আদুরে স্বরে বললো,

রুপরাণীর মুখটা এমন শুকিয়ে গিয়েছে কেনো শুনি। খাওয়া দাওয়া ঠিক করে করোনি তাইনা?

খাই তো মা আপু কত খাওয়ায় আমাকে।

হুমায়রা বেগম সামনের সোফায় বসে ছিলেন। সে হেসে বললেন,
ভাইয়ের কাছে ভালো সাজা হচ্ছে তাইনা। মা আপুর কথা শুনে কত খাও তুমি।

হৃদিতা আসতে রিয়াদ তাকে নিজের পাশে বসতে বললো। বোনকে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করলো। হৃদিতা হাসিমুখে ভাইয়ার সাথে কথা বলতে লাগলো। ভাইয়াকে এই দেড়মাসে অনেকবেশি মিস করছে হৃদিতা। বিশেষ করে তাদের খুনশুটি মুহুর্তগুলো বেশি মিস করেছে। রিয়াদ অত্যন্ত ফ্রী মাইন্ডের ছেলে অতি দ্রুত লোকের সাথে মিশে যেতে পারে। ভাইয়ের এ গুণটা হৃদিতা না পেলেও রুপ পেয়েছে।
রাতে হৃদিতা রুপ কেউ নিজের হাতে খেলো না। রিয়াদ খুব যত্ন করে দু বোনকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো। বোনদুটোকে ভীষণ ভালোবাসে সে। এতদিন পর বোনদের নিজ হাতে খাওয়াতে পেরে শান্তি লাগছে বেশ।
.

নিশানের ফোন অনেকক্ষণ ধরে বেজে চলেছে। নিশান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফোন হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকালো। ফোনের উপরে জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠেছে রাইসা নামটা। কোনো কারন বসত রাইসার নাম্বারটা ডিলিট করা হয়নি। রাইসা যে তাকে কখনো কল দিবে ভাবতে পারেনি। হঠাৎ কি প্রয়োজন পড়লো যার জন্য এতদিন পর নিজের এক্স হাজবেন্ডকে কল দিলো সে!
নিশান ফোন রিসিভ করে কানে ধরতে ওপাস থেকে অধৈর্য কন্ঠে বলে উঠলো,

এতক্ষণ কোথায় ছিলে নিশান? কখন থেকে কল দিচ্ছি তোমায়।

নিশান স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
কেনো কল দিয়েছো?

তুমি কেমন আছো জানতে মন চাইলো তাই কল দিলাম। কেমন আছো তুমি?

নিশান তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
আগের থেকে অনেক বেশি ভালো আছি। দোয়া করো যেনো আগামী দিন গুলোতে আরো ভালো থাকতে পারি। আর কিছু বলার আছে তোমার?

ওপাস থেকে ফোস করে নিশ্বাস ফেলার শব্দ এলো।
নাহ আর কিছু বলার নেই।

নিশান কিছু না বলে ফোনটা কেটে দিলো। রাইসার প্রতি আগে কোনো রাগ না হলেও এখন রাগ হয়। তার যদি অন্যত্র রিলেশন ছিলো তাহলে নিশানের সাথে বিয়েতে কেনো রাজি হলো সে। নিশান রাইসার খুব ভালো বন্ধু ছিলো বিয়ের আগেই তাকে জানালে আজ সবটাই অন্যরকম থাকতো। অন্তত বিয়ে নামক ট্যাগটা লাগতো না নিশানের গায়ে। নিজের সদ্য জন্ম নেওয়া অনুভূতি গুলো অনায়াসে প্রকাশ করতে পারতো। যদিও তাদের বিয়েটা লোক দেখানোর মত ছিলো। কাগজে কলমে ছাড়া একমাস একসাথে থেকেও কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি তাদের মাঝে।

#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে