ছি!ছি!ছি! আমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছি না।সমাজচ্যুত হয়ে গেছি। জঘন্য ব্যাপার!জঘন্য!চারিদিকে কানাঘুঁষা আমাদের পরিবার নিয়ে। ছিহ্!!ছিহ্!কোন মানে আছে হ্যা!!কোন মানে আছে এই বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরার?
নিরার শ্বশুর মশাই আবার বিয়ে করতে চাচ্ছেন।তাই সে লজ্জায়, ঘৃনায় এই কথাগুলো তার সবচাইতে প্রিয় বান্ধবীর কাছে বলছিল।আত্নীয়-স্বজন,বন্ধু-বান্ধন,পাড়া প্রতিবেশী,সবার কাছে সে এখন শুধু এই একটা বিষয় নিয়েই আলাপ করে,বিভিন্ন রকম মশলা মিশিয়ে গল্পটিকে আরো মজাদার করে তোলে।বর্তমানে তার আলোচনার একটাই বিষয়-তার শ্বশুর আবারও বিয়ে করতে চান।
নিরার শ্বশুর -শ্বাশুড়ির ভালবাসার বিয়ে ছিল।দীর্ঘ আট বছরের গভীর প্রেম দুজনকে এক সূতোয় বেঁধে দিয়েছিলো বিয়ের মাধ্যমে। এরপর ঘর আলো করে আসে একএক করে চারসন্তান।নিরার বর সিহাব হচ্ছে তাদের প্রথম সন্তান। সে হিসেবে নিরা এই পরিবারের বড় বউ।আরো একজন দেবর শফিক ও দুজন ননদ মিশু ও মিলিকে নিয়ে বেশ বরসড় পরিবারেই সে তার সংসার জীবন শুরু করে।তার খারাপ লাগতো না।সবাই বেশ আন্তরিক। পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যের সাথে প্রত্যেকের সম্পর্কের গভীরতা ছিল উল্লেখ করার মতো । এমনটা সচরাচর দেখা যায় না।ভাই-বোন,ভাই-ভাই,বোন-বোন,বাবা-মা’র সাথে সন্তানরা, তারা নিজেরা স্বামী -স্ত্রী দুজন, সবাই যেন এক আত্না।চমৎকার একটা পরিবার।
এর বছর খানেক পর,নিরার দেবর শফিকেরও বিয়ে হলো।নিরার ঘর আলো করে সন্তান এলো,এক ছেলে,এক মেয়ে।আর ওর দেবরের দুই ছেলে এক মেয়ে।যৌথ পরিবার।আরো যে দুজন ননদ ছিলো, মিশু আর মিলি,তাদেরও খুব ভালো পরিবারে বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেলো।তারা যে যার মতো নিজেদের সংসার আর সন্তান নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরলো।বেরাতে আসতো মাঝেমধ্যে।
নিরার নিজের সন্তান ও তার দেবরের সন্তানদের স্কুলে যাবার বয়স হতেই সবাইকে একএক করে স্কুলে ভর্তি করে দিলো।ওরা সবাই স্কুলে যেতে শুরু করলো।
হঠাৎ একদিন,কি জানি কি মনে হলো,নিরা অনুভব করলো,তার নিজের বাচ্চাদের স্কুল,টিউটর,ওদের লেখাপড়া,খাওয়া ঘুমের ঠিকঠাক মতো যত্ন নেয়া হচ্ছে না-বাড়িতে এত লোকের ভিড়ে আর সংসারের এতশত কাজের ভিড়ে ।এর উপর আত্নীয়-স্বজনরা তো সবসময়ই আসছেন,থাকছেন পালা করে,সেসব আতিথেয়তাওতো তো কম ঝামেলার না!সব তাদের দুই বউকেই সামাল দিতে হয়।আবার অসুস্হ বৃদ্ধ শ্বশুর -শ্বাশুড়ির সব ধরনের যত্ন তো আছেই! বাড়ির বাচ্চারা একসাথে হয়ে সবাই সারাক্ষণ শুধু খেলাধূলায় আর নানাধরনের দুষ্টুমিতে মেতে থাকে,লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই কারো। আর সেও শ্বশুর-শ্বাশুড়ির যত্ন করতে গিয়ে নিজের সন্তানদের সময় দিতে পারে না।এসব ভেবে ভেবে সারাদিন সে মন খারাপ করে থাকে।খুবই চিন্তিত হয়ে পরলো সে তার বাচ্চাদের ভবিষ্যত নিয়ে।।তাই সে তার স্বামী সিহাবের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলো।দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো,তারা আর এক সাথে এই যৌথ পরিবারে থাকবে না।কোন একটা বাসা ভাড়া নিয়ে এই পরিবারের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়ে আলাদা সংসার করবে।তবে যদি একটু নিজেদের,সন্তানদের ও নিজের সংসারের দিকে নজর দিতে পারে! দুজনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, দেবর ও জা কে জানানো হলো বিকেলের চা’য়ের টেবিলে বসে। মা কথাটি শুনে বড় ছেলের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন নিরবে। চকচক করছে চোখ দুটো।এক্ষুনি বুঝি পানি গড়িয়ে পড়বে!
না তিনি কাঁদেন নি।নিজেকে সামলে নিয়েছেন খুব দ্রুত।
যাও।অবশ্যই যাবে।জীবনে সন্তান মানুষ করা সবচেয়ে কঠিন কাজ।অনেক মা,তার শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করেও সন্তান মানুষ বানাতে পারেনা।শিক্ষিত হয়তো করতে পারে।এই উদ্দেশ্য নিয়ে যদি তোমরা সবাইকে দূরে ঠেলে দিয়ে স্বার্থপর হও, আমি বলবো যাও।তিনি সবার সামনে থেকে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
শ্বশুর,নিয়াজ মোহাম্মদ এতক্ষণ কিছু বলেন নি।এবার মুখ খুললেন। মাঝেমাঝে এই বুড়ো-বুড়ির কাছে নিয়ে এসো দাদুৃমনিদের।মন কাঁদবে ওদের জন্য। জন্ম থেকেই তো আমাদের সাথে!খুব একা একা লাগবে বাবা।
আমি নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবছি না।তোমরা ভালো থাকো।
সিহাব বললো,বাবা তোমরা নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবোনি?তুমি কি তোমার বাবা-মা মানে আমার দাদা দাদুর কাছ থেকে দূরে সরে নিজেদের মতো করে আলাদা সংসার সাজিয়ে আমাদের বড় করোনি?নিরিবিলি খুব যত্ন করে লেখাপড়া শেখাও নি?মানুষ করোনি?
সিহাবের বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন,হ্যারে বাবা,আসলে আমরা সবাই খুব স্বার্থপর। আর তা চক্রাকারে ঘুর্নায়মান…..
এভাবেই চলছিল দিন,মাস,বছর ।তারপর হঠাৎ একদিন, বাচ্চাদের স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষা শেষের রেজাল্ট নিতে নিরা ওদের স্কুলে গিয়ে সেখান থেকেই শ্বাশুড়িকে ফোন করলো,আজ এক্ষুনি সে আসছে।আজ সারাদিন থাকবে তাদের সাথে। সিহাব অফিস শেষে আসবে রাতের খাবার নিয়ে আমরা সবাই একসাথে খুব আনন্দ করবো আজযে আমাদের ভীষণ খুশির একটা দিন মা।নিরা আনন্দের এক হাসি দিয়ে ফোন রাখলো।
নিরার শ্বাশুড়ি তার ছোটছেলের বউকে ডাকলো,বউমা ও বউমা,সোমা,মা,তাড়াতাড়ি পোলাও,কোরমা,ঝাল কম দিয়ে গরুর মাংসের কাবাব আর গরুর মাংসের একটা ঝাল তরকারি করো তো।বাচ্চারা গরুর মাংস খেতে পারে না।ওরা কাবাব খাবে।তাই ঝাল কম দিও আর খুব মিহি কোরো যেন দানাদানা না থাকে আর রুই মাছ ভাজবে।শোনশোন,বেগুন ভাজি,ফুলকপির বড়া,আর আর..
ছোট বউ সোমা এবার শ্বাশুড়ির খুব কাছে এসে খুব জোরে জোরে হাহাহা শব্দে হাসছে…
কি বলছেন মা?দুনিয়ার সব খাবারের নাম কেনো এক নিশ্বাসে বলে যাচ্ছেন? কি হলো?
আরে আমার বড় বউমা আসছে আমার বড় নাতি নাতনিকে নিয়ে।সিহাব আসবে অফিস ছুটির পর।তখন সে রাতের খাবার আমাদের সবার জন্য কিনে আনবে।আজ নাকি ওদের খুব খুশির একটা দিন।
ওওও তাই বলেন।ওরা তো আসেই।একেবারে আসে না তা তো না।অবশ্য খুব কমই আসে এ বাসায়,লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে।আচ্ছা যাই আমি রান্না বসাই,তবে আপনার এতগুলো আইটেম হবে না।দুপুরে খাবে,সারাদিন ওরা থাকবে এই সময়ের মধ্যে যা কিছু পারি করি।ঠিক আছে মা?
হাহাহা হম মা ঠিক আছে। তবে পোলাও কোরো।
অবশ্যই মা,পোলাও,কোরমা,পায়েস থাকবেই।
ছোট বউ খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো বড় জা,ভাসুর আর তাদের সন্তানদের নিখুঁত আপ্যায়ন আর আদর যত্ন করার জন্য।
নিরা এলো।শ্বশুর -শ্বাশুড়ি যার পর নাই খুশি ওদের দেখে।নিরা তাদের সালাম করলে,তার মাথায় হাত দিয়ে শ্বশুর -শ্বাশুড়ি দুজনই অনেক অনেক দোয়া করলেন।শ্বাশুড়ি মা তো বুকে টেনে নিয়ে আদর করলেন।বললেন,বলো মা,তোমার খুশির সংবাদ টা এবার শুনি।নিরা এবার তার হতের মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা লালমোহন বের করে তার শ্বাশুড়ির মুখের কাছে ধরতেই ছোট বউ চিৎকার দিয়ে সামনে এসে বলতে লাগলো, মাগোমা!! ভাবি!! কি করেন?মা’র ডায়াবেটিস, হাইপ্রেসার,থাইরয়েডের সমস্যা,কোলেস্টেরলের মাত্রা নরমাল ছাড়িয়ে অনেক বেশি, তুমি বুঝি জানোনা?
জানিতো।তবে এই মিষ্টির উপলক্ষ শুনলে বাবা-মা না খেয়ে থাকতেই পারবেন না।খাবেনই খাবেন।তুমি দেখবে?
কি উপলক্ষ মা তা-ই তো শুনতে চাচ্ছি?শ্বশুর -শ্বাশুড়ি দুজনই জানতে চাইলেন।
আপনার বড় নাতি টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে আর ছোট জন এবারের ফাইনাল পরীক্ষায়, যে দ্বিতীয় হয়েছে তার চাইতে অনেক বেশি নাম্বার পেয়ে তার ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
টিচাররা,অভিভাবকরা সবাই তো আমাকে রত্নগর্ভা উপাধি দিয়েছে।
কথাটা বলা শেষ হতে না হতেই নিরার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি আলহামদুলিল্লাহ বলে,নিরার হাতের প্যাকেট থেকে,দুজন দুটো মিষ্টি দ্রুত খেয়ে নিল।
কি বলো ছোট বউ মা!এই মিষ্টি আমরা খাবোনা?
এমন খুশির মিষ্টি অন্তরে গিয়ে পৌছায়,শরীরের কোন ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই তার।হাহাহা খুব হাসছেন দুজন,খুব খুশি আজ তারা।নাতি-নাতনিদের কাছে ডাকলেন,ওরা আসলো না।কাছে গিয়ে খুব আদর করলেন এটা সেটা জিজ্ঞেস করলেন কোন উত্তরই তারা দেয় নি।চুপচাপ টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।কোন কথা,দুষ্টুমি,হাসি-আনন্দ, খেলাধূলা কিচ্ছুতে নেই।একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে।নিরার দেবরের ছেলেমেয়েরা,যাদেরকে জন্ম থেকেই দেখে আসছে,খেলাধূলা,দুষ্টুমিতে একেকজন ছিল একেকজনের চাইতে সেরা,তাদের কাছ থেকে পর্যন্ত নিজেদের আলাদা করে রাখছে সারাক্ষণ।
এভাবে সারাদিন পার হলো।জা,শ্বশুর,শাশুড়ির সাথে হাসি,গল্প,আনন্দে সারদিন কেটে যাবার পর সিহাব এলো অনেক খাবার নিয়ে।কিছু কাচ্চির প্যাকেট,বোরহানী আর অন্যদিকে চাইনিজ আইটেম গুলো-ফ্রাইড রাইস,চিকেন ফ্রাই,স্যুপ আরো নানা রকম কারি আর এক কার্টুন সফট ড্রিংক।
নিরার জা বলে উঠলো,বাবা-মা তো এগুলো খেতে পারবেন না।খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।
তুমি চুপ করো তো বউমা,এই আনন্দের তুমি কি বুঝবে?তোমার ছেলেমেয়েরা তো ঠিকমতো সব সাবজেক্টে পাশই করতে পারে না।যদিও করে একেবারে টেনেটুনে নাম্বার!তুমি এত ভালো রেজাল্টের মর্ম বুঝবে নাকি?
ছোট বউ খুব কষ্ট পেলো খুব।বাকি সময়টা তাদের সবার সাথে হাসিখানি মুখ নিয়ে কাটালেও তার হৃদয়টা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তখন সে কাউকে কিছু বুঝতে না দিলেও সবাই চলে যাবার পর বেচে যাওয়া সব খাবার দাবার ফ্রিজে রখলো,ময়লা প্লেট,বাটি, গ্লাস,কাপ,চামচ সহ যাযা ব্যবহার করা হয়েছে সব কিছু মেজে ধুয়ে পরিস্কার করে,টেবিল পরিস্কার করে,শ্বশুর -শ্বাশুড়িকে ঔষধ খাইয়ে,তাদের বিছানা ঝেড়ে, মশারী টানিয়ে দিয়ে,জগে পানি ভরে, তাদের ব্যবহারের দুটো গ্লাস ভালো করে ধুয়ে, শোবার ঘরে বিছানার সাইড টেবিলে রাখলো।দুজনকে বিছানা পর্যন্ত যাওয়ার সব রকম ব্যবস্হা অত্যন্ত যত্নসহকারে করে লাইট নিভিয়ে ডিম লাইট জালিয়ে দরজা চাপিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে গেলো।
তার নিজের বাচ্চারা যে যার মতো বিছানায় আঁকাবাকা হয়ে বালিস -কাঁথা ছাড়া ঘুমিয়ে পড়েছে।কাছে গিয়ে বসে ওদের কপালে,নাকে, গালে চুমু খেতেখেতে নিজের অজান্তেই সে কেঁদে দিল।
কি হলো?এত হাসিখুশি মানুষটা হঠাৎ এভাবে কাঁদছে কেন?কি হলো?কোন সমস্যা?
বাচ্চাগুলোর দিকে একদম নজর দিতে পারিনা।আমি এক ব্যর্থমা।কি খেলো,কখন এসে ঘুমালো কিছু খেয়াল করতে পারিনি।এত কষ্ট হচ্ছে আমার!
সে কাঁদছে। শফিক বললো,দেখো,বড় ভাবিকে সংসার,বাচ্চা সামাল দিয়ে কি সুন্দর বাচ্চাদের জুয়েল বানিয়ে ফেলেছে।ওরা ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার হবে না,বড় বড় অফিস আদালতে চাকরি করবে না তো কি আমাদের এই খারাপ রেজাল্ট করা বাচ্চারা করবে বলো?বড় ভাইকে দেখে বুকটা এত বড় হয়ে গেছে। ভাবির দিকে তো তাকালে আনন্দে আমার মন ভরে উঠে।রত্নগর্ভা জননী।আমার ভাস্তি আর ভাইস্তাদের দেখেছো,ওদের দিকে তাকালে গর্ভে বুক ফুলে ওঠে।
ছোট বউ উত্তর দিলো,হ্যা ওরা এখানে থাকতে আমার বাচ্চাদের মতোই রেজাল্ট করতো।ভাবি ওদের লেখাপড়ার জন্য ভালো রেজাল্টের জন্যই তো এ বাড়ি ছেড়েছিলেন।সংসারের সব কাজ করে বচ্চাদের খাওয়া,ঘুম,লেখাপড়া সহ সব যত্ন তিনিও সেসময় নিতে পারতেন না আমারই মতো।তোমরা তাকে কত গাল মন্দ করেছো,কতকত অভিযোগ ছিল তার নামে!আমার শ্বশুর -শ্বাশুড়ি তো রিতিমত আমার সাফাই গাইতেন আর বড়ভাবিকে অভিসম্পাত করতেন দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে।
আজ কেন উল্টো গান তোমাদের সবার???
সোমা(ছোট বউ) কাঁদছে।
সন্মানিত, সুখী আর সফল হতে হলে যে স্বার্থপর হতে হয়,এর জলজ্যান্ত প্রমান আমি আজ পেয়ে গেছি।আর তাই বলছি আমি নিজেও স্বার্থপর হতে চাই। ঠিক এমনি স্বার্থপর,বড়ভাবির মতো।সোমা, দুহাত জড়ো করে স্বামীর কাছে যেন সাহায্য চাইছে।
শফিক তার চোখের জল মুছে দিতে দিতে বললো,আমি সব বুঝি।কিন্তু বাবা-মার কি হবে?দুজনারই বয়স হয়েছে।নানা রকম অসুখ বিসুখ বাসা বেধেছে শরীরে। নিজের কোন কাজ তো উনারা নিজেরা করতে পারেন না।আম্মা তো খুব বেশি অসুস্থ!
আমি তো করেছি এতদিন যতটুকু পেরেছি।অভিজ্ঞ একটা কাজের লোক রাখো,যে রান্না থেকে শুরু করে ঘরের অন্য সব কাজ পরবে এবং রোগীর সেবা যত্ন করতে পারবে।
একজন না পারলে দুজন রাখো।বাবার তো আর টাকা-পয়সার অভাব নেই।
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে এই প্রস্তাব দেয়া হলে,শফিকের বাবা-মা,দুজনেই প্রথম রাজি না হলেও পরে নানা যুক্তি তর্কে শেষ পর্যন্ত রাজি হতে বাধ্য হয়েছেন।
আজ ছোট ছেলে শফিকও স্বার্থপর হলো।সে এ বাড়ি ছাড়লো,বাবা-মার কাছ থেকে দূরে চলে গেলো,তার বউ সন্তান নিয়ে নিজের মতো করে আলাদা একটা সংসার করার উদ্দেশ্যে,ছেলেমেয়েকে শিক্ষিত ও মানুষ করার উদ্দেশ্যে।
এর পর দিনগুলো কখনও খারাপ যায়নি নিরার শ্বশুর আর শ্বাশুড়ির।প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো বুকে।মন খারাপ করে থাকতো দুজনই।ঘর কেমন খালি খালি লাগতো।রাতে ঘুমাতে গেলে ঘুম আসতো না, চোখের পানিতে দুজনারই বালিশ ভিজতো।
নিরার শ্বাশুড়ি আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই বলছিলেন,সন্তানের চেয়ে প্রিয় যে পৃথিবীতে কিছু নেই!চারটা ফুল আমার অন্তরের বাগানে ফুটেছিল।সেখানে প্রজাপতি, মৌমাছিদের খেলা আর পাখিদের মুগ্ধ করা মিষ্টি গানের সুর আমাকে আর তোমাকে সারাটাদিন আনন্দ দিত।এত সুখ আর কিছুতে পাই না।আজ আমার চারটা ফুলগাছ আমার বাগানে নেই।তারা অন্য বাগানে গিয়ে ফুল ফোটাচ্ছে।সেখানেও পাখিরা গান করে,প্রজাপতি আর মৌমাছিরা খেলা করে।কিন্তু আমরা দেখতে পাইনা।সে ফুলের সুবাস নিতে ইচ্ছে করে বুক ভরে কিন্তু নিতে পারিনা।কিভাবে নেবো?আমাদের বাগানে যে আজ আর সেই ফুল গাছগুলো নেই।তাই আমাদের বাগান আজ শূন্য!
নিয়াজ মোহাম্মদ(নিরার শ্বশুর) বললেন,তবে ওরা যে যেখানে আছে বেশ ভালো আছে। ওরা সুখী হবে,শান্তিতে থাকবে,হেসে খেলে আনন্দ উল্লাসে জীবনের সব ইচ্ছে, চাওয়া- পাওয়া, মিটিয়ে নেবে।নেক না ক্ষতি কি?আমরা তো তাই চাই আমাদের সন্তানরা খুব ভালো থাকবে সবসময়ই।
এমন স্বান্তনা তাদের জীবন বদলে দিলো।একজন সাহায্যকারী থাকলেও নিরার শ্বাশুড়ি ঘরের ছোটখাট অনেক কাজে নিযেকে ব্যস্ত রাখেন সারাক্ষণ। তারা দুজনেই সময় মতো নিজেদের ঔষধ খেয়ে নিচ্ছেন,সকাল বিকেলের চা-কফি নিজ হাতে বানিয়ে বারান্দায় বসে গল্প করেকরে পান করছেন । পুরোনো দিনের কতকত গল্প!!কখনও তো সেসব মনে করে হসতে হাসতে দুজনের চোখে আনন্দাশ্রু ঝড়ে পরতো।একসাথে বসে পুরোনো দিনের গান শুনতে শুনতে ঠিক সেই বয়সে,সেই সময়ে একেবারে যেন সেই মূহুর্তগুলো ফিরে পেতেন!
আমরা যেন নতুন বিবাহিত দম্পতি! কি বলো?
স্ত্রীর হাতদুটো ভালোবাসার জোড়ে খুব শক্ত করে ধরলেন।তখনও ছিলাম এ বাড়িতে শুধু আমরা দুজন,আর আজ,এখনও আবার সেই নবদম্পত্তির মতো এই বারিটিতে সেই আমরা দুজনই।
বেশ চলে যাচ্ছে সময়।ভালো আছেন দুজন দুজনাকে নিবিড়ভাবে কাছে পেয়ে।নতুন করে নিজেদের চিনে নিচ্ছেন আর খুঁজে পাচ্ছেন নিজেদের কাছে নিজেদেরকে প্রতিদিন,প্রতিমুহূর্তে।
ছেলেমেয়েরা আসে খুব কম।ওরা প্রত্যেকে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতায় মগ্ন। ছেলেমেয়েরা কে কার চাইতে কত ভালো রেজাল্ট করতে পারে সেই প্রতিযোগিতায় দৌড়াচ্ছে সবাই।ওদের কারো সময় নেই এই বুড়োবুড়িকে সময় দেয়ার।সমস্যা হয় না।মন চাইলে তারা বাইরে বেরাতেও যায়।ছেলেমেয়েদের বাসায় গেলে ওরা খুশি হয়,আদর-যত্ন করলেও নিজেরা বাচ্চাদের লেখাপড়ার পেছনে এত বেশি ব্যস্ত থাকে,মাঝে মাঝে মনে হয়,তারা যেন ওদের সময় নষ্ট করে দিচ্ছেন, বিরক্ত করছেন।ওরা তো সারাদিন রাত শুধু পড়ে আর পড়ে।তাই আর যান না কারো বাসায়।খোলা মাঠে ঘুরে বেড়ান।সমুদ্রও খুব টানে।বয়সের ভারে যেতে পারেননা।তবুও কষ্ট করে গিয়েছিলেন কিছুদিন আগে।সাগরে নামেননি।তবে কাছে গিয়ে দুজন পা ভিজিয়েছিলেন। সাগরের পানি হাতের তালুতে নিয়ে স্ত্রীর দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
কি আনন্দ কি আনন্দ আহা!!!জীবনটা এত সুন্দর! তুমি ছাড়া তো একদম অসম্পূর্ণ আমি।আমৃত্যু আমারই হয়ে থেকো।নিয়াজ সাহেব,স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললেন।
সাগর দেখা শেষে শরীর আর চলছিলো না।বাড়ি ফিরে গেলেন।এই তো!চমৎকার সময় পার করেছেন তারা দুজন।খুব ভালো আছেন তারা।একা লাগে না তো!
এতো ভালোর মাঝেও এতো এতো সুখ-শান্তির মাঝেও যে ভয়ংকর কষ্ট, তার হিংস্র কালো থাবা দিয়ে আক্রমণ করে রক্তাক্ত করবে,জখম করে দেবে এই চমৎকার পরিবারটিকে কেউ তা স্বপ্নেও ভাবেনি আর তার কোন প্রস্তুতিও তাদের কারো মধ্যে ছিলনা।নিরার শ্বাশুড়ি মারা গেলেন।হঠাৎ করেই মারা গেলেন।কেউ কিচ্ছু টেরও পেলেন না।ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে তার।
অন্য সব দিনের মতো নিরার শ্বশুরের ঘুম আগে ভাঙলো খুব ভোরে।তিনি অযু করে নামাজ পড়ার আগে বেশ কয়েকবার তার স্ত্রীকে নামাজের জন্য ডাকেন। এর পরও কোন সারা না পেয়ে নিজে আগে নামাজ আাদায় করে স্ত্রীর কাছে গিয়ে গায়ে হাত দিয়ে তাকে ডাকতেই,তার বুকের উপর যে হাতটি ছিল,সেটা বুক থেকে নিচে বিছানায় পরে গেলো।হাত পা সমস্ত শরীর হিম শীতল।কেমন কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে আছে!
এত ভোরে হাসপাতালে ফোন করলেন।এম্বুলেন্স এলো।হাসপাতালে নেবার পর ডাক্তার সাথে সাথে বললেন রোগী তো বেঁচে নেই!
সমস্ত পৃথিবী যেন শূন্য হয়ে গেলো!কেউ নেই,কেউ কোথাও নেই।সে একা, খুব একা!
মানুষটা এভাবে কিছু না বলে চলে গেলো?উনি কেন কিছুই টের পেলেন না?তবে নিয়াজ সাহেব কাঁদছেন, খুব কাঁদছেন। একদম ছোট বাচ্চাদের মত চিৎকার করে কাঁদছেন।খুব খুব কষ্ট হচ্ছে তার।খুব স্বাভাবিক। ছোট বেলার বন্ধু।দুজন দুজনকে বড় হতে দেখেছেন,বুড়ো হতে দেখেছেন। প্রেম,ভালোবাসা,বিয়ে,সংসার,সন্তান, নাতি নাতনী…
চলছিল তো! বেশ ভালো ছিলেন,সুখী ছিলেন তারা।আমৃত্যু নিখাদ ভালোবাসা ছিল স্ত্রীর প্রতি তার।কিন্তু তবুও কিছু না বলে কেন সে চলে গেলো??মানতে পারছেন না তিনি।
স্ত্রীর মৃত্যুর ঠিক চল্লিশ দিন পর যেদিন সব আত্মীয় -স্বজন,চার ছেলে-মেয়ের পুরো পরিবার এক হলো,সেদিন তিনি সবাইকে একসাথে করে বললেন,আজ আমার সব সন্তানরা,আত্মীয় -স্বজন,বন্ধু -বান্ধব এক হয়েছে।যা অন্য কোন সময় সম্ভব না।তাই আমি সবার উদ্দেশ্যে আমার নিজের এক মতামত, ইচ্ছের কথা সবাইকে জানাবো।তোমাদের কারো পছন্দ হলে হবে আর না হলে নাই।আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নরবো না।
কি বাবা?বড় ছেলে জানতে চাইলো।
আমি আবার বিয়ে করতে চাই।
কথাটা শোনা মাত্র ছেলে তার সামনে থেকে এক ঝটকায় নিজেকে দূরে সরিয়ে নিলো।ছি,বাবা!ছি!
এসব তুমি কি বলছো?তাও আাবার মায়ের মৃত্যুর এই চল্লিশ দিনের দিন!তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?পাগোল হলে না-কি?
ছোট ছেলে বললো,আক্কেল- জ্ঞানের মাথা খেয়ে বসেছো না-কি?
মেয়েরা তো কাঁদতে শুরু করলো
মিশু বাবাকে ধরে বলতে শুরু করলো,ও বাবা কি বলো এসব!!!বাবা গো, তোমার তো নাতি- নাতনী,মেয়ের জামাই,ছেলের বউ সবই আছে ।কিসের অভাব?কেন এমন অলুক্ষনে কথা ভাবছো?
আমরা সমাজে মুখ দেখাবো কিভাবে?
মিলি বললো,না বাবা না।এসব বাদ দাও।বরং আমাদের কাছে এসে থাকো।এ বাড়ি ভাড়া দিয়ে দাও।
ছেলের বউরা নিরা ও সোমা,সামনে থেজে চলে গেলো।অন্য ঘরে গিয়ে যার পর নাই খারাপ মন্তব্য করতে থাকলো শ্বশুরের নামে।
আত্মীয় -স্বজন সবাই খারাপ কথা বললো।তার চরিত্র নিয়ে নানা রকম জঘন্য সব গল্প চলতে থাকলো।
কেউ আর তাদের বাড়ি আাসে না।সে যকেই ফোন করে সবাই তাকে গালমন্দ আর ছিছি করে।
কতজনার কাছ থেকে যে কত কথা শুনেছেন নিয়াজ সাহেব!তার ছেলেমেয়েরা বাবার নামে যে সব নোংরা কথা বলে বেড়াচ্ছে,সেসব যার কাছে বলছে সে-ই আবার নিয়াজ সাহেবের কাছে এসে বলে দিচ্ছে। কেউ কেউ তো এটা এক মজার খেলা বানিয়ে খেলছে।
এবার তিনি সব ছেলেমেয়েদের ডাকলেন।কেউ এলেন না।
আরেকদিন ডাকলেন।কেউ কোন সারা না দেয়াতে তিনি নিজেই বড় ছেলের বাসায় গেলেন এবং সবাইকে এ বাসায় আনার ব্যবস্হা করতে বললেন।
অনিচ্ছা স্বত্বেও সবাই এলো।তিনি বাচ্চাদের সরিয়ে দিতে বললেন এবং দরজা বন্ধ করে সবাইকে তার সামনে বসতে বললেন।
এবার তিনি গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করলেন, তোমাদের বারবার ডাকলাম কেউ এলে না তাই আজ এখানে আমাকেই আসতে হলো বাধ্য হয়ে।
তোমরা তো জানো,
আমি আমার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।মা-বাবার মৃত্যুর পর,তাদের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হই একমাত্র আমি।সে সম্পত্তির পরিমান যে কম না তোমরা তা খুব ভালো করে জানো।
এরপর আমার নিজের রোজগারের টাকায় আমি যেসব, জমি আর বাড়ি করেছি সেইসব সম্পত্তির মালিক এখন পর্যন্ত এই আমিই।যদি আমি তোমাদের নামে লিখে দেই তবেই তোমরা তা ভোগ করতে পারবে।নতুবা পারবে না।ঠিক না?
কেন বলছেন এসব?ছোট মেয়ে বললো।
তোমরা আমার নামে কোথায় কার কাছে কি বলে বেরাচ্ছো তার সবই আমার কানে আসছে।খুব আগ্রহ নিয়ে,খুব মজা করে রস মিশিয়ে মিশিয়ে আমাকে সে কথাগুলো তারা নিজ দ্বায়িত্বে ফোন করে বা বাড়ি এসে বলে দিয়ে যাচ্ছে।এতে যেমন আমার সন্মান হানী হচ্ছে তেমনি তোমাদেরও সন্মান কমছে বই বাড়ছে না।
এগুলো খুব রসালো গল্প। তোমাদেরও হয়তো বলতে ভালো লাগে।কিন্তু একটা বিষয় কি কোনদিন ভেবে দেখেছো যে,এতে কার লাভ হচ্ছে? আর যারই হোক আমার আর তোমাদের না।
আমার সন্তান তোমরা।তোমাদের মতো আপন তো এই দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। ব্যাপারটার পজিটিভ দিক না দেখে তোমরা যেভাবে দেখছো,সেটা ভুল।লোকে যা বুঝে বুঝুক।তোমরা কেন তোমাদের বাবার বিরুদ্ধে কথা বলবে?
এতে তোমাদেরও ক্ষতি হচ্ছে আমারও হচ্ছে। তোমরা বোকারা বুঝতে পারছো না।
বাবা,তুমি কি চালাক?তুমিই তো এই সুযোগটা করে দিয়েছো।বড় মেয়ে বলে উঠলো।
আচ্ছা যদি খারাপ মনে করো,তা সংশোধনের চেষ্টা করবে।নিজেদের ঘরের ভেতরের সমস্যা নিজেরা না সমাধান করতে পারলে,বাইরের কেউ কোনদিন এসে সমাধান করে দেবে না।এতে সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে।সমাধান তো হয়ই না বরং সম্পর্কে ফাটল ধরে। আমি চাইনা এমন কিছু হোক।
মা’র চল্লিশার দিনে তুমি এমন এক বিচ্ছিরি প্রস্তাব দিলে সবার উপস্থিতি তে কি আর বলবো?আমরা লজ্জায় কারো দিকে কেউ তাকাতে পর্যন্ত পারছিলাম না।ছোট ছেলে খুব ঘৃনার স্বরে বাবাকে কথা গুলো বললো।
তোমাদের মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে আর কখনো ফিরবে না।তোমরা সবাই চলে গেছো।যেদিন তোমাদের মা মারা গেলেন,সেদিন,মৃত্যুর তৃতীয় দিন যাকে আমরা কুলখানি বলি আর এলে চল্লিশার দিন।আর বাকী দিনগুলোয় আমার একা একা কিভাবে কেটেছে কেউ কি এসে, থেকে জেনেছো না বুঝতে পেরেছো?জোড়া হারানোর ব্যাথাটা যে তীব্র, তা তোমরা বুঝবে না।আমি খুব একা হয়ে গেছি।সারাক্ষণ তোমাদের মায়ের স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। আমি পারছিনা আর পারছিন।খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি।
তাই এমন সিদ্ধান্ত নিলাম।
আর বউমা,জামাইরা তোমরাও শোন,আমাকে নিয়ে যার যা খুশি বলে যে বেরাচ্ছো,একবারও কি ভেবে দেখেছো, তোমাদের সবার সংসার আছে,সন্তান আছে আর তাদের নিয়ে তোমরা যে ভাবে ব্যস্ত থাকো,তাতে তোমাদের দিন খুব ভালোভাবেই চলে যায়।কিন্তু আমি?আমি কি করে, সময় পার করি?কি নিয়ে আমার দিন যায় রাত যায় বলোতো?তোমরা তো বলেই বেঁচে যাও।গভীর ভাবে বাস্ববটা ভাবো তো একবার?
আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের নামে লিখে দেবো।শুধু যে বাড়িটায় থাকছি সেটা ছাড়া। আমি আমৃত্যু ঐ বাড়িতেই থাকবো।এরজন্য আমার একজন সঙ্গ চাই।মানুষ কখনও একা থাকতে পারে না।
আমার তো কথা বলারও কেউ নেই।দেবে তেমরা কেউ আমাকে সারাক্ষণ তোমাদের মহামূল্যবান সময়? দেবে?আমি গল্প করবো,গান শুনবো,বাগানে ঘুরে বেড়াবো,সকাল বিকাল ছাদে হাটবো আর ছাত্রজীবনের চমৎকার স্মৃতিগুলো মনে করে খুব হাসবো!হবে কেউ তোমরা আমার তেমন সঙ্গী?হয়তো বলবে এখন তোমাদের সাথে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে।কিন্তু এতে কি তোমাদের সংসারে বিরক্তির কারন হবো না?তখনও কি আমি একা থাকবো না?তোমরা কেউ কি আমার সার্বোক্ষনিক সঙ্গী হতে পারবে?
বলো তোমাদের মধ্যে কে পারবে সেটা??
কেউ কোন উত্তর দিলো না।সবাই মাথা নিচু করে আছে।
তোমাদের মা আমার ছেলেবেলার বন্ধু, তারপর প্রিয়তমা,এরপর হলো আমার সবচাইতে কাছের মানুষ, আমার খুব আদরের বউ।সবশেষে,দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় যে সন্তান,আমার সেই সেরা সম্পদদের গর্ভধারিনী মা।সে ছিল আছে থাকবে তার জায়গায়।সে জায়গায় দুনিয়ার কারো প্রবেশাধিকার নেই।
তিনি বোধহয় একটু কাঁদলেন।পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,আমি যাকে বিয়ে করবো ভাবছি,সেও হবে আমারই মতো নিঃসঙ্গ কেউ। যার স্বামী বা সন্তান থাকবে না।তাহলে তোমরা যা বলে বেরাচ্ছো,তোমাদের সম্পত্তির ভাগ নিয়ে,সে চিন্তাটাও আর থাকলো না।কি বলো?তবে আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। তোমরা যদি সাহায্য করো তো ভালো।নইলে আমি নিযেই আমার সঙ্গী খুঁজে নেবো।অন্তত কথা তো বলতে পারবো!
বাবা,আমরা দুঃখিত!! বাবা মাফ করে দাও আমরা বুঝতে পারিনি।এভাবে কখনো ভেবে দেখিনি।কারন আমরা যে মানুষ হইনি বাবা।বড় ছেলে কথাগুলোকে বলছিল আর বাকীরা বাবার পায়ের কাছে বসে মাথা নারছিল আর কাঁদছিল।
বড় মেয়ে বললো,বাবা,তোমার সিদ্ধান্তই ঠিক। আমরা তোমার জন্য একজন উপযুক্ত সঙ্গী খুঁজে আনবো।
এরপর শুরু হলো নতুন আর এক অধ্যায়।সব ছেলেমেয়েরা, দুই ছেলের দুই বউমা,দুই মেয়ের জমাই-সবাই মিলে খুব উঠে পড়ে লাগলেন,তার জন্য যোগ্য আর উপযুক্ত সঙ্গী খোঁজার জন্য। খবরের কাগজে,ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দিলেন,বিভিন্ন ম্যারেজ মিডিয়াগুলোরও সাহায্য নেয়া হলো।কিন্তু কোন লাভ হলো না।সবাই আসে শুধু সম্পত্তির লোভে।হতাশ হলেন সবাই। কোথায় পাবেন এমন একজন মায়াবী নারী যে আমৃত্যু শুধু আমার বাবার সাথে থাকবেন,যার সত্যি কোন পিছু টান থাকবে না?সবাই খুব চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন।
শিহাবের নানু,নিয়াজ মোহাম্মদের শ্বাশুড়ি, সবাইকে তার বাসায় যেতে বললেন।তিনি আজও জীবিত আছেন।মেয়ের মৃত্যুর পর অনেকটাই নরম হয়ে গেছেন।তাছাড়া বয়স তাকে খুব বেশি কাবু করতে পারেনি।একসাথে একই দিনে সময় বের করা সবার জন্যই খুব কঠিন। তবুও জরুরি তলফে ছুটির দিন খুঁজে বের করে সবাই এক হয়ে নানুর বাসায় গ্রামের বাড়ি গেলো বাবাকে সাথে নিয়ে।
বাড়ি পৌঁছাতে সবার রাত হয়ে গেলো।ক্লান্ত শরীরে,রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে সবাই ঘুমিয়ে পরলো।পরদিন ভোরে ঘুৃম ভাঙলে,নিয়াজ সাহেব সেই প্রথম এই বাড়িতে জামাই হয়ে আসার পর যেমন আদর যত্ন পেয়েছিলেন,আজও ঠিক তেমনি জামাই আদর পাচ্ছেন।অনেক অনেক মজার মজার খাবার রান্না করা হয়েছে।পুকুরের তাজা মাছ,ঘরে পালা মুরগী, গাছের লাউ,নানারকম টাটকা ফল,ঘরে পাতা দই আরো অনেক অনেক মাজার মজার খাবার।তারা যাওয়াতে শিহাবের নানু যার পর নাই আনন্দিত।তবুও খুব কাঁদছেন বড় মেয়ের জন্য। তারই চোখের সামনে তার মেয়ের লাশ!সহ্য করার মতো না।
এর মাঝেও তিনি সবার সাথে নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে একটা বিশেষ বিষয়ে গভীর আলোচনা আছে বলে সবাইকে খাওয়ার পরে বড় টানা বারান্দায় বসতে বললেন।সবাই এলো।চা দেয়া হলো ছোট ছোট গ্লাসে।
জামাই শোনেন,আমি খবর পেয়েছি আপনি আবার বিয়ে করতে চাচ্ছেন। তো খুবই ভালো কথা।একা কতদিন থাকবেন?সবারই তো সংসার আছে কে আপনাকে সময় দেবে?
নিয়াজ সাহেব কিছু বলছেন না শ্বাশুড়ির মুখের উপর। আর তাকাতেও পারছেন না করো দিকে।মাথা নিচু করে বসে আছেন।
আমি বলছিলাম,আপনি যেমন সঙ্গী চাচ্ছেন, তন্য তন্য করে খুঁজে যাচ্ছেন,কিন্তু আজও তেমনটি পাননি,আমার কাছে ঠিক তেমন এক নারীর সন্ধান আছে।
সবাই একসাথে বলে উঠলো, কে?কে?হুররে!!!! কে নানু?
তোদের ছোট খালা।সে তো বন্ধা রে।পাঁচবছর সংসার করলো,কোন সন্তান হলোনা।অলক্ষী,অপয়া,বন্ধ্যা-এসব উপমায় আমার এই অসহায় মেয়েকে তারা সেই কবে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলো!আর নিলো না।ওদের কাগজে কলমে ছাড়াছাড়ির ব্যবস্হা করলাম অন্য কোথাও বিয়ে দেবো বলে।বাচ্চা হয়না বলে জামাই ছেড়ে দিয়েছে কথাটা সবার মুখে মুখে ঘুরতো।জেনেশুনে কেউ আমার এই মেয়েকে আর বিয়ে করেনি।সেই থেকে সেই আছে আমার সঙ্গী হয়ে।আমি আর কয়দিন!
তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাকে আমি তোমার হাতে তুলে দিতে চাই বাবা।ও খুব ভালো মেয়ে।আমার বড় মেয়ের মতোই।ও তোমার খুব ভালো সঙ্গী হবে।
সবাই দৌড়ে নানুকে জড়িয়ে ধরলো।সবাই কেন কাঁদছে? এত খুশির প্রস্তাবে বুঝি কাঁদতে আছে?
ওদের বাবা কাঁদছেন সবচেয়ে বেশি।চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে তো পড়ছেই।
বিয়ে হয়ে গেলো খুব ধুমধাম করে নিয়াজ সাহেবের,হুবহু দেখতে তার স্ত্রীর মতো মুখের অধিকারিণী তার স্ত্রীরই ছোট বোনের সাথে।
দুজনেই দুজনার যোগ্য সঙ্গী খুঁজে পেয়েছেন।
সন্তানেরা মায়ের গন্ধ পান খালার গায়ে। সবাই খুব খুশি।
নিয়াজ মোহাম্মদ সব সন্তানদের উদ্দেশ্য করে বললেন,জানোতো,আমরা সবাই স্বার্থপর। তোমরা নিজেদের সুখ,শান্তির কথা ভেবে আমাকে আর তোমাদের মাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিলে।ভাগ্যবতী নারীরা নাকি স্বামীর আগে মৃত্যু বরন করে। আর তাই তোমার মাও আমাকে কাঁদিয়ে চলে গেলো আমার দোয়া পাওয়ার জন্য।সেও স্বার্থপর।তবে আমি কেন একজন সঙ্গী নিয়ে বাকী জীবন নিঃসঙ্গ থাকার দুঃসহ বেদনার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে এতটুকু স্বার্থপর হতে পারবো না বলো?