স্বপ্ন হলেও সত্যি পর্বঃ-১৮
আফসানা মিমি
—“আপু প্লিজ কান্না থামাও। এভাবে ভেঙ্গে পড়ো না। নিজেকে একটু শক্ত করো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি ভাইয়া তোমার হবেই ইন শা আল্লাহ্।”
আপু কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললো
—“না সানা, কারো উপর জোর করে কোনকিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক না। দেখা গেলো তোমাদের চাপে পড়ে আমাকে ও বিয়ে করে নিল। কিন্তু ওর ভালবাসা আমি পেলাম না। তাতে লাভ কী হবে? সারাজীবন ভালবাসার অভাববোধ আমাকে কুরে কুরে খাবে। তখন এই সম্পর্কটাও আমার কাছে বোঝা বৈ অন্যকিছু মনে হবে না।”
আপুর হাতদুটো আমার হাতদ্বয়ের মুঠোয় নিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম
—“আমার ওপর ভরসা রাখো আপু। যা হবে ভালোর জন্যই হবে।”
আমাদের কথার মাঝখানে বাধা পড়লো মোবাইলের ভাইব্রেশনের আওয়াজে। দেখলাম আমার ফোনে ভাইয়ার কল এসেছে। দুপুরে ভাইয়ার সাথে কথা বলেই আপুদের বাসায় চলে এসেছিলাম। ফোন রিসিভড করার সাথে সাথেই ভাইয়ার কথার আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।
—“কিরে আফু, তুই কই? বাসায় নেই কেন তুই? না বলে কই গেছিস তুই, হ্যাঁ?”
আমি গলায় কিছুটা অভিমান ঢেলে বললাম
—“এখন আমাকে শুধুশুধু খুঁজছো কেন? আমি তো বলেছিলামই যে আমার কথা না মানলে আমি আপুদের বাসায় চলে আসবো এবং সেখানেই থাকবো। আমার কথা তুমি যেহেতু শুনোনি তাই আমি চলে এসেছি বাসা থেকে। এবার তুমি খুশি তো?”
—“মাকে বলে গেছিস সেখানে? আর আমার পারমিশন নিয়েছিস সেখানে যে গেছিস?”
—“হ্যাঁ, আম্মুকে বলেই আসছি। আর তোমার পারমিশন নেওয়ার কী আছে এখানে? তুমি যেহেতু তোমার একমাত্র ছোট বোনের কথা মানো না, তাহলে আমি কেন মানবো? আমি তো তোমার পর। আমার কথা মানতে যাবেই বা কেন?”
এবার বোধহয় ভাইয়া একটু নরম হলো। বললো
—“দ্যাখ লক্ষ্মী বোনটি, প্লিজ বাসায় চলে আয়! আমার সাথে রাগ করিস না প্লিজ! শুনেছি ভাইদের দুঃখ নাকি বোনেরা বুঝে। কিন্তু তুই আমাকে কেন বুঝতে পারছিস না?”
—“কিন্তু তুমিও বা গোঁ ধরে এক জায়গায় থেমে আছো কেন? সময়ের সাথে সাথে নাকি মানুষের আচার-আচরণ, চিন্তাভাবনা, মানসিকতা চেঞ্জ হয়। কিন্তু তুমি দেখি সেই কতদিন আগেকার ঘটনাতেই আঁটকে আছো। কেন আগে বাড়তে পারছো না ভাইয়া?” শেষ কথাটা অনেকটা আর্তনাদের মতো করেই বললাম।
—“দ্যাখ তুই তো আমার ছোট। তাছাড়া আমার আপন বোনও। তোর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হেজিটেট ফিল করি আমি। বুঝিস না তুই?”
—“দ্যাখো আমি নিজে ছোট হয়ে বড় ভাইয়ের এসব ব্যাপারে নাক গলাতে যে খুব একটা ভালো লাগে আমার, তা কিন্তু নয়। তুমি মেনে নিলেই তো ব্যাপারটা মিটে যায়। আমারও পরবর্তীতে এসব বলার দরকার পড়বে না, আর না তোমাকে এসব শুনতে হবে। আমি শুধু তোমাদের দুইজনের ভিতরের কষ্টটা লাঘব করে তোমাদের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখতে চেয়েছি। এটা কী আমার অপরাধ ছিল? ওকে, অপরাধই যদি হয়ে থাকে তবে তা-ই সই। তোমাকে নেক্সট টাইম কোনকিছু নিয়ে জোর করবো না। এমনকি কিছু বলবোও না তোমাকে। আমাকে তো চিনো না তুমি। একবার যা বলি তা করিই আমি।”
ভাইয়া একপেশে হেসে বললো
—“তোকেও চিনি না আমি! আমার চেয়ে বেশি তোকে কে চিনে আর? তুই…..”
ভাইয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে বললাম
—“ভুল চিনেছো এতদিন আমাকে। এখন থেকে চিনে রাখো আমাকে। রাখি… শান্তিতে থেকো একা বাসায়। আম্মুও তো চলে যাবে বাড়িতে। আর আমি তো আপুর সাথেই থাকবো। তোমার রাজ্যে তুমি একাই রাজত্ব করো গিয়ে। কেউ তাতে ভাগ বসাতে আসবে না। আল্লাহ্ হাফেজ।”
বলেই খট করে ফোনটা রেখে দিলাম। আপু উদাস গলায় বললো
—“এভাবে কথা না বললেও পারতে ওর সাথে। যদি রাগ করে আবার!”
আমি মুচকি হেসে বললাম
—“ভাইয়াকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। কী বললে, কী করলে যে ভাইয়ার মন নরম হবে সেটা খুব ভালো করেই জানি আমি। এবার শুধু দেখে যাও কী হয়। আরেকটা কথা, আঙ্কেল আন্টিকে বলে দাও এনগেজমেন্টের আয়োজন করতে। আম্মু মনে হয় খুব শীঘ্রই উনাদের সাথে যোগাযোগ করবেন এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য। এবার দেখি ভাইয়া কীভাবে পালিয়ে বেড়ায়!”
আপু চিন্তিত হয়ে বললো
—“যদি হিতে বিপরীত হয় এতে করে?”
আপুকে আশ্বস্ত করে বললাম
—“শুধু একটু ভরসা রাখো এই ছোট আপুটার ওপর। আর কিছু আশা করছি না আমি এই মুহূর্তে তোমার কাছ থেকে। সো নো চিন্তা, ডু ফুর্তি।”
…
ভাইয়ার জোরাজুরিতে বাসায় আসতে বাধ্য হলাম। এক প্রকার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বাসায় এনেছে আমাকে। আমিও মিথ্যে অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখলাম। ভাইয়া আমার কাছে এসে বললো
—“দ্যাখ আফু, আমি কিন্তু মায়ের কথা মেনে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। ইভেন আগামীকাল নাকি এনগেজমেন্টের ডেইটও ফিক্স করা হয়ে গেছে। সেটাও নীরবে মেনে নিয়েছি আমি। এবার তো আমার সাথে কথা বল!”
আমি তো মনে মনে বেজায় খুশি। তবে সেটা বাইরে প্রকাশ না করে বললাম
—“আমি তো তোমার কেউ না। তাই আমি একটা জিনিস চেয়েছিলাম তোমার কাছে সেটাই দিতে পারলা না আমাকে! ঠিক আছে এতে যদি তুমি খুশি থাকো তাহলে আমিও খুশি।”
—“প্লিজ আমার লক্ষ্মী বোনটি আর মন খারাপ করে থাকিস না। এবার তো একটুখানি হাসি উপহার দে!”
আমি হালকা হেসে বললাম
—“ঠিক আছে।”
আমার মুখে হাসি দেখে ভাইয়াও সামান্য হাসলো। তবে সেটা আমার কাছে মেকি হাসিই মনে হয়েছে। ভাইয়া সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর আম্মুর কাছে গিয়ে বললাম
—“আম্মু, আব্বু কখন আসছে?”
—“ট্রেনে উঠে ফোন দিয়েছিল, একটু আগেই নাকি রওয়ানা হয়েছে। দেরি লাগবে না বেশি।”
—“আব্বুকে বুঝিয়ে সব বলেছো তো?”
—“হ্যাঁ, সবই বলেছি।”
—“এতে আপত্তি নেই তো কোন?”
—“আরে না। যখন শুনেছে বন্ধুর মেয়ে, তখন তো খুশিতে একেবারে আটখানা। আপত্তি করার এত আজাইরা সময় কই!” হেসে উত্তর দিল আম্মু।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম
—“যাক, ভালোই ভালোই ব্যাপারটা মিটে গেলে তবেই শান্তি। পালিয়ে যাবে কোথায় তোমার ছেলে বেচারা!”
মা-মেয়ে দুজনেই হাসতে লাগলাম সমস্বরে।
…
ফাল্গুনী আপুদের বাসার সামনে এসে যখন গাড়ি থেকে নামলাম আমরা চারজন তখন ভাইয়ার মুখটা হয়েছিল দেখার মতো। আমি ভিতরে ভিতরে হেসে কুটিকুটি হচ্ছিলাম। আর আব্বু-আম্মু উনাদের মুখ যথেষ্ট গম্ভীর রাখার মিথ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে সফলও হচ্ছেন। ভাইয়া হঠাৎই বলে উঠলো
—“বাবা আমরা এখানে কেন এলাম?”
উত্তর দিল আম্মু
—“আজকে তোর বাবার বাল্যকালের বন্ধু আসলাম সাহেবের মেয়ে আরাদ্ধার বাগদান। তাই আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে আমরা এখানে এসেছি। গতকাল রাতেই আমাদের জানিয়েছে আজ নাকি আরাদ্ধার বাগদান হবে। খুব করে বলছিলেন তাই না করতে পারেনি তোর বাবা।”
আম্মুর এমন কথায় ভাইয়ার মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল। ক্ষণে ক্ষণে তার মুখের রঙ বদলাচ্ছিল। আমি শুধু তা-ই দেখে যাচ্ছিলাম নীরবে। এমন ফ্যাকাসে মুখ করেই বললো
—“কিন্তু তুমি যে গতকাল বললে আজ আমার এনগেজমেন্ট কার সাথে যেন!”
—“হ্যাঁ, সেটা তো হবেই। আমরা ওদের জানিয়ে দিয়েছি যে সেখানে যেতে একটু দেরি হবে। আসলে তোর বাবার বন্ধুর মেয়ের এত বড় একটা দিনে তোর বাবাকে থাকতে বলেছেন। তাই তোর বাবাও উনার কথাটা ফেলতে পারেননি। তাই…..”
ভাইয়া মাঝপথেই বলে উঠলো
—“কিন্তু আমাকে এখানে আনার কী দরকার ছিল? এখান থেকে বেরিয়ে আমাকে ফোন দিলেই আমি সেখানে পৌঁছে যেতাম। শুধুশুধু…..”
এবার আব্বু বললো
—“আসলাম আমার বন্ধু কম ভাই বেশি। আমাকে সপরিবারসহ আমন্ত্রণ করেছে। ওর কথাটা না রাখলে তার কাছে আমি ছোট হয়ে যেতাম না? তাছাড়া তোমার প্রবলেমটা কোথায় শুনি এখানে আসতে?”
আব্বু রেগে গেলে আমাদের দুই ভাইবোনকেই তুমি করে বলে। মনে হচ্ছে এখনো রেগে গেছে। ভাইয়া নিজেও আব্বুর এই স্বভাবের সাথে পরিচিত। তাই তো এত বড় হয়ে যাওয়া স্বত্তেও ভয় পায় সেই বাল্যকালের মতোই। মিনমিন করে বললো
—“না আমি তো শুধু বলছিলাম যে…..”
আব্বু ফের গমগম স্বরে বলে উঠলেন
—“এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে ভিতরে চলো। অযথা কথা বাড়িও না।”
কথাটা বলেই আব্বু আম্মুকে নিয়ে সামনে এগোলেন। বেচারা আমার ভাইটা পড়েছে মহা বিপাকে। না কিছু বলতে পারছে, আর না পারছে এসব সহ্য করতে। বড়ই মায়া হচ্ছে ভাইয়ার জন্য। সত্যিটা বলে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এতো বড় একটা শক খাওয়ার পর ভাইয়ার মুখটা কেমন হবে তা দেখার লোভ আমাকে বারবার বলে দেওয়া থেকে বিরত রাখছে।
…
আজ এ বাড়িতে ঢুকার পর কেমন একটা শীতল বাতাস আমাকে হঠাৎ করে ছুঁয়ে দিয়ে গেল। এবং সেই মুহূর্তে শ্রাবণের হাসিমাখা মুখ, রেগে যাওয়া মুখটা চোখের তারায় ভেসে উঠলো সম্পূর্ন আমার অনুমতি ব্যতিরেকে। কই সেদিনও তো এ বাড়িতে এসেছিলাম এমনটা তো ফিল করিনি। শ্রাবণকে তো এমন প্রবলভাবে মনে পড়েনি। তবে আজ কেন এমন লাগছে আমার কাছে! অকারণে এভাবে হৃৎপিণ্ড লাফানোর রহস্য কী? এর সাথে কী শ্রাবণের কোন যোগসূত্র আছে? নাকি কারণটা ভিন্নকিছু?
বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করেছিল আব্বু আম্মু। তারপর পরই ভাইয়া এবং ভাইয়ার কয়েক হাত পিছনে আমি। প্রবেশ করার মুহূর্তে কয়েক কদম এগোনোর পর আমার পা দুটো সেখানেই যেন মাটির সাথে আঁটকে গেছে আমার মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে। যেন মনে হচ্ছে অদৃশ্য কেউ এক প্রকারের অদৃশ্য শিকল দ্বারা আমার পা জোড়াকে বেঁধে ফেলেছে সে জায়গাটায়। তার সাথে সাথে আমার হৃৎপিণ্ডের বাতাস চলাচল কয়েকটা মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল মনে হয়। এবং তার পর পরই আচমকা আবারও শুরু হয়ে গেছে হাজার মাইলের গতির চেয়েও বেশি দ্রুতবেগে ছুটে চলা ঘূর্ণিঝড়ের মতো হার্টের গতি। বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখদুটি অজানা কারণেই কেমন কেঁপে উঠলো। আমি প্রবলবেগে তেড়ে আসা ধাক্কাটা সইতে না পেরে সেখানে দাঁড়িয়েই চোখ বন্ধ করে ডান হাত দিয়ে হার্ট লাফানো জায়গাটায় মুঠো করে চেপে ধরলাম। হাত পা কেমন তিরতির করে কাঁপছে আর শরীরটাও কেমন অসাড় লাগছে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে দোয়া করছি ‘ইম্পসিবল! এটা যেন সত্যি না হয়। এই অসম্ভবটা যেন কোনমতেই সম্ভব না হয়। হে আল্লাহ্! তোমার বান্দার এই আকুল আবেদনটা রাখো।’
চলবে……..
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন