স্বপ্নপুরে পর্ব : ৪

0
1010

স্বপ্নপুরে পর্ব : ৪
গল্পবিলাসী – নিশি

-“আরে আরে কি করছেন? লোকে দেখলে কি বলবে? ”
-” যে মেয়ে কিনা এতো মানুষের সামনে আমায় জড়িয়ে ধরতে পারে আর আমিতো শুধু একটু কোলে তুলে নিলাম। ভয় করছেনা তোমার? “কোলে থেকেই ফাহাদের গলা থেকে সানগ্লাস নিয়ে নিজের চোখে পরে নিয়ে,
-” নো ডিয়ার। যাকে এতো ভালোবাসি তার সাথে থাকতে কিসের ভয় শুনি ?”
-” আচ্ছা এতো ভালোবাসা?”
-” হুম।অন্নেক। ”
-“আর তোমার ফ্রেন্ডস? ”
-“ওহ শিট।আমাকে এখনি হোটেলে ব্যাক করতে হবে।”
-“এক্ষনি?”
-“হুম। আমিতো ভূলেই গিয়েছিলাম। ক্যবলাকান্ত নিশ্চয়ই তার পেয়ারি বানুকে নিয়ে খুঁজতে বেড়িয়ে গেছে। আপমি নামান না আমাকে।”
-” এতো লাফাচ্ছো কেনো? চুপ করে থাকো তো। “ফাহাদের দিক তাকিয়ে
-” ব্যাপারটা ক্যাবলাকান্তের কানে গেলে ক্যবলাকান্ত টিসি হাতে ধরিয়ে দিবে। ”
-“সরি? ক্যবলাকান্ত মানে?”
” আরে আমাদের প্রিন্সিপাল। তাকে আমি ক্যবলাকান্ত বলেই ডাকি।” উপমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলো ফাহাদ।
-“কেনো?”
-” ও ক্যাবলার মতো হো হো করে হাসে শুধু তাই।”
-” আর পেয়ারি বানু?”
-” ওনার বউ। যেখানে যায় লেজ একটা নিয়া বাইর হয়। আমারতো মনেহয় ওয়াশরুমেও ওরা একসাথে যায়। ” দুষ্টু হাসি হেসে
-“তো কি প্রবলেম হাজব্যান্ড ওয়াইফ ইতো। ”
-“ছিঃ কি খারাপ আপনি।”
-” বাহ রে আপনি? মন্দ লাগছে না।” কিছুটা ইমোশনাল হয়ে
-“আমি মাত্র আধ ঘন্টা সময় নিয়ে নূপুরটা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। এখনত দু ঘন্টা হয়ে যাচ্ছে। ”
-“আচ্ছা ঠিকাছে।কোন হোটেলে উঠেছো তোমরা? ”
-“আমরা হোটেল গ্র‍্যান্ড হিলশাইয়ে ওঠেছি।রুম দুইশ আট। ”
-“আচ্ছা।”
-“হুম।তোমার সাথে কন্ট্রাক্ট কিভাবে করবো?”
-” বাসরঘরে বসে। ”
-“কিহ?”
-“।আর বকা শুনতে পারবোনা। তোমার শ্বাশুড়ি তোমাকে বরন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ”
-“ইশ ।”বলেই লজ্জায় দুহাতে মুখ ঢেকে নিলো উপমা।
-” ওরে লজ্জাবতী ” হো হো করে হেসে উঠলো উপমা। ততোক্ষনে উপমার ফ্রেন্ডদের কাছে এনে নামিয়ে দিলো ফাহাদ। ওদের উদ্দ্যেশে,
-” হাই আম ফাহাদ।”
” হ্যালো আমি সামি। আর ও ইশা।” ইশা হাতের ইশারায় হ্যালো বলে। উপমা কাউকে কল করতে ব্যস্ত।দূর থেকেই তাকে নোটিসড করছে ইশা। উপমার খুশিটা যেনো তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। এতোটা হাসিখুশি উপমাকে আগে কখনো দেখেছে বলে মনেহয়না তার। এতোটা নরমাল বিহেভিয়ার দুজনের কিভাবে সম্ভব? দেখে তো মনেহয় যেনো পুরো চার পাঁচ বছরের পুরানো কোনো কাপল।দুজনেই হাসিখুশি। সত্যিই কি ওদের কোনো কানেকশন আছে স্বপ্নে? মোবাইলে কথা শেষ করে ওদের দিকে এগিয়ে আছে উপমা। ফাহাদকে উদ্দ্যেশ্য করে,
-” মিট মাই ফ্রেন্ডস।”
-” হ্যা। পরিচয় হয়েছে আমাদের। ”
-“ইশা দেখ! আমার ভালোবাসা।শুনেছিস কি মিষ্টি ভয়েজ? একদম আমি যেমন চেয়েছিলাম না? আর ঐ মানুষটাই ও। আচ্ছা চল ক্যবলাকান্ত মনেহয় ফায়ার হয়ে আছে। দেখি যাওয়াটা কোনোভাবে মিস করতে পারি কিনা।” ইশা রেগে গিয়ে কিছুটা দূরে উপমাকে টেনে নিয়ে,
-“একটা মেয়ে বিয়ের পরওতো একটা ছেলেকে এতোটা ভরশা করতে পারেনা। আর মাত্র কয়েকঘন্টার পরিচয়ে এতোটা নরমাল বিহেভ কিভাবে সম্ভব উপো? বাড়ি ফেরাই ক্যান্সেল? “হালকা হেসে
-“তুই জানিস না ইশ্যূ ও আমার কতোটা জুড়েঁ? আমি তাকে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করতে পারি। আর তুইতো জানিস আমি মানুষ চিনতে কখনো ভূল করিনা।”
-” হ্যা জানি। কিন্তু ওভার হয়ে যাচ্ছেনা ব্যাপারটা?”
-” নাহ। একদম না।আমিতো সম্ভব হলে আজকেই বিয়ে করে নিতাম ওকে।ওকে এক মূহুর্তেরর জন্যও ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা আমার। ভয় হয় যদি আবার হারিয়ে যায় মা বাবার মতো।
-” আমি জানি কিন্তু তারপরও।”
-” আচ্ছা চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
-” হুম। “ফাহাদ তাদের কে হোটেলের নিচে পৌছে দিয়ে আবারো বেরিয়ে আসে। রুমে আসতেই ঝড়ের মুখোমুখি হয় ইশা উপমা আর সামি। সবাই চিন্তা করছিলো আমাদের জন্য। আমি সরি বলেই রুমে চলে এলাম। ফাহাদের সাথে থেকে এতোটাই বেহাল হয়েগিয়েছিলো যে তার নাম্বারটাও নিতে ভূলে গেছি। নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই বকছি। হঠাৎ করেই মোবাইলটা বেজে উঠলো,
-“হ্যা ফুপ্পি বলো ”
-“কি রে কন্ঠ এমন ভারী শুনাচ্ছে কেনো? ”
-“ফুপি আমি ওর নাম্বারটাই নিতে ভূলে গেছি। ”
-“ওহ। মন খারাপ করিস না। তোর রুম নাম্বার বলিস নি?”
-“হ্যা বলেছিতো।”
-” তাহলে ঠিক আসবে। আচ্ছা খেয়েছিস তুই?”
-” নাহ খাবো একটু পরে। আঙ্কেল কি এসেছে অফিস থেকে?”
-” হ্যা এসেছে। ”
-“আচ্ছা তোমরা খেয়ে ঘুমিয়ে পরো আমি ভোরেই রওনা হচ্ছি।”
পাগলের মতো ছটফট করতে লাগলো উপমা। রুমের সামনে দিয়ে কেউ হেটে যাওয়ার শব্দ শুনেই বারবার দরজা খুলে দেখছে।আচ্ছা এমন কেনো লোকটা একটা বারও কি আসতে পারেনা।
উপমাকে রুমে দিয়ে এসে নিচেই অপেক্ষা করছে ইশা। ছেলেটাকে দেখে বেশ উচ্চবংশীয় মনেহচ্ছে।তাহলে নিশ্চয়ই এই হোটেলেই উঠবে। কারন এমন জাঁকজমকপূর্ণ হোটেল ছেড়ে নিশ্চয়ই কোনো টেন্ট করে বেড়াবেনা। তার কেনো জানি মনেহচ্ছে ছেলেটা উপমার দূর্বলতাকেই শিকার করে নিয়েছে। উপমা যেভাবে গায়ে পরেছে নিশ্চয়ই হাভাগোভা ভেবে ওর কথা মতোই নিজেকে প্রেজেন্ট করেছে। আরে সামনাসামনি থেকেই ভালোবাসা টিকেনা আর স্বপ্নে। সে শিয়র এমন ভালোবাসা কোনোভাবেই সম্ভব না। কিন্তু কিভাবে উপমাকে বাঁচাবে। মেয়েটাযে বড্ড আবেগি। হঠাৎ করেই এগারোটার দিকে ফাহাদকে দেখা গেলো। লিফটের কাছে যাওয়ার আগেই ফাহাদকে ডেকে উঠলো ইশা।
-“ফাহাদ? ”
-“আরে আপনি ইশা রাইট!”
-” হ্যা। ”
-“থ্যাংকস গড আপনাকে পেয়ে গেছি। তখন কথা বলতে বলতে উপমার নাম্বারটা নিতেই ভূলে গিয়েছিলাম।”
-“ওহ। আপনার কি একটু সময় হবে? কিছু কথা বলার ছিলো। ”
-“ইয়াহ শিয়র।”
-” ঐখানে বসে কথা বলি?”
-” হুম চলুন।”
দুজনেই মুখোমুখি বসে আছে।কিভাবে শুরু করবে তা বুঝতে পারছেনা ইশা।
-” মি ফাহাদ! আমি জানিনা আপনি আমার কথাগুলো ঠিক কিভাবে নিবেন। কিন্তু তারপরও আমি বলবো।”
-” আগে বলুন আমি শুনি তারপর বিবেচনা করবো এমনি না শুনেতো কিছু বিবেচনা করতে পারিনা তাইনা।”
-” ওকে তাহলে বলছি। ”

“আমরা তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। উপমার ছোট ফুপ্পি আমার মেজো চাচ্চি। সেদিক থেকেই আমরা খুব ঘনিষ্ঠ। প্রচন্ড চঞ্চল ছিলো উপমা।আমরা যখন রাস্তা দিয়ে হেটে যেতাম আমাদের হাসি দেখে সবসময়ই আশেপাশের মানুষ অবাক হয়ে থাকতো।কখনো পিচ্চি বাচ্চা দেখলে মুখ ভেঙচি কাটা, চোখ রাঙানো, ছেলেদের দেখলে জোড়ে সিটি মারা, সবচেয়ে আকর্ষনীয় যেটা ছিলো আমাদের ছেলে বন্ধু।আমরা দুইজন সবসময়ই ছেলেদের সাথে বেশি মিশতাম।যেখানে দশজন ছেলে তাদের লিডার আমরা দুজন।মোটকথা পুরাই দুষ্টু। অনেক মজা মাস্তির পাশাপাশি লেখাপড়াটাও তেমন ভাবেই চলছিলো। একদিন টিফিন পিরিয়ডে সবাই মিলে নাস্তা করছিলাম। হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেনো ইমন ছুটে আসে।
-“উপমা তোদ তোদের বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে।” বলেই বড় বড় নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো। ইমনের কথা শুনে দৌড়েঁ ছুটে গেছি উপমাদের বাসায়।কিন্তু ততোক্ষনে সব শেষ হয়ে গেছে। আগুনটা উপমাদের ফ্ল্যাটেই লেগেছিলো। যার কারনে সুতো পরিমান কোনো কিছুই রক্ষা পায়নি। এমনকি আন্টি আঙ্কেল ও না। পরে জানা গেছে কারেন্টের মাধ্যমেই এই অগ্নিকান্ড হয়েছিলো। দিনটা ছিলো শনিবার। আঙ্কেলের অফিস বন্ধ ছিলো। সেদিক থেকে সবাই বাসায়। শুধু উপমা ছাড়া।উপমা যেনো কান্না করতেই ভূলে গিয়েছিলো। সেদিন তাকে বুকে আগলে নিয়েছিলো তার ছোট ফুপি রেহেনা বেগম। উপমা একদম চুপচাপ হয়ে গেলো। লোকে বলে বেশি শোকে মানুষ নাকি পাথরে পরিনত হয়ে যায়।হয়তো তাই উপমাও হয়ে গেছে। হাসি খুশি কান্না কোনোকিছুই যেনো তাকে স্পর্শ করতে পারতোনা। সারাক্ষন ঘর অন্ধকার করে রাখতো। মাঝরাতে ছাদে গিয়ে বসে থাকতো। সেই চঞ্চলে মেয়েটা কেমন গুমরে গেলো। সবার মধ্য থেকে নিজেকে আড়াল করে নিলো। যে মেয়ের সামনে কারোর সাধ্য ছিলোনা মন খারাপ করে থাকার সেই মেয়েই সারাক্ষন মনমরা হয়ে বসে থাকতো। হাজার চেষ্টা করেও রুম থেকে বের করতে পারছিলাম না।চাচ্চিও তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে কেটে গেলো প্রায় ছ মাস। স্কুলেও যায়না।কি মনেকরে যেনো হঠাৎ একদিন রেডি হয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে এলো। দরজা খুলে আম্মু উপোকে দেখে অবাক হয়ে যায়।
-“কে আসছে মা? ”
-“উপমা এসেছে।” আমি তখন খাবার খাচ্ছিলাম সেখান থেকে ছুটে এলাম। আমাকে দেখে,
-” এখনো রেডি হোস নি। ক্লাসে দেরি হয়ে যাবে তো। ”
-“এইতো হচ্ছি। আয় ভিতরে আয়। ” কলেজে গেলাম। আমি যা জিজ্ঞাসা করি হু হা ছাড়া তেমন কিছুই জবাব দিতোনা উপমা। ক্লাস করছে। ততোদিনে স্যাররাও এই ব্যাপারটা নিয়ে অবগত হয়ে গেলেন। তেমন কোনো প্রেশার দিতোনা। এভাবেই চলছে। ধীরে ধীরে ফ্রি হলো। একদিন বসে ফুচকা খাচ্ছিলাম ও বলে উঠলো,
-“জানিস ইশ্যূ আমি একজনকে খুব ভালোবাসি। সেও আমাকে অনেক ভালোবাসে। ”
-“তাই? কখনো বলিস নিতো? কে সে? কোথায় থাকে?”
-” জানিনা। সে আমার একলা জীবনের সঙ্গী।আমি যখন একা থাকি আমার মনেহয় তখন সে আমার সাথে কথা বলে।” আমি অবাক হয়ে ভাবতে থাকি কোনো ভূত প্রেদাত্তা ভর করেনিতো উপমাকে।তখন আবার বললো।
-” জানিস তার সাথে আমার স্বপ্নেই কথা হয়। কি মিষ্টি তার কথার স্বর। কিরকম হেসে হেসে কথা বলে।তার কন্ঠটা আমার খুব ভালোলাগে।” আমি চাচ্চিকে ব্যাপারটা জানালে চাচ্চি আমাকে চুপ থাকতে বলে। সেদিনের পর থেকে উপমার আড্ডা টপিক শুধু তার স্বপ্নের রাজকুমার।সে কিভাবে কথা বলে কি বলেছে সব। ইন্টারমিডিয়েট কমপ্লিট হলো এখন অনার্সে পড়ছি কিন্তু তারপরও তার মন থেকে সেই স্বপ্নের পুরুষ দূর হয়নি। তার বিশ্বাস সে লোকটাকে সে পাবে। তাকে ভালোবাসবে।ঠিক উপমার মনের মতো করে।রাতে চন্দ্র বিলাস, ভোরের কুয়াশায় দুজন ভেজা সবুজ কোমল ঘাসে পা ভিজিয়ে হাটবে। যার কাছে থাকবে হাজারো বায়না।তাকে পাহাড়ে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া, সমুদ্রে নিয়ে যাওয়া এমন আরো হাজারো বায়না জুড়েঁ দিবে মানুষটার কাছে। সেই মানুষটার নাকি তার পায়ের নূপুরটা বেশি পছন্দ। এই নূপুরটা পুরানো হয়ে গিয়েছে তাই খুলে ফেলেছিলো সেদিন নাকি সেই মানুষটা তার সাথে কথাই বলেনি। তাই সে সবসময় এই নূপুরটা পরে থাকতো।আজকে যখন ওর পায়ের নূপুরটা হারিয়ে যায় তখন ও পুরো পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলো।মানুষ স্বর্ণের জিনিস হারালেও হয়তো এতোটা ব্যাকুল হয়না যতোটানা এই সামান্য নূপুর হারিয়ে হয়েছে। আমি জানিনা আপনি উপমাকে কি ভেবেছেন আদৌ কি আপনি তার স্বপ্নের সেই সুরেলা পুরুষ কিনা আমি জানিনা। যদি না হয়ে থাকেন আমি বলবো আপনি কেটে পরুন। মা বাবা হারা মেয়েটা নিজেকে খুব কষ্টে সামলে নিয়েছে।আমি চাইনা আর কোনো ভাবেই ও কোনো কষ্ট পাক। উপমাকে ডিপ্রেশন থেকে বের করে আনতে চাচ্চির ঠিক কি পরিমান কষ্ট হয়েছে তা আমি দেখেছি। সব কথা চুপচাপ শুনছিলো ফাহাদ। সবশুনে ফাহাদ এমন এক কথা বললো যা শুনে অবাক হয়ে রইলো ইশা।
চলবে,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে