Sunday, October 5, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"সৌরকলঙ্কসৌরকলঙ্ক পর্ব-২৩+২৪+২৫

সৌরকলঙ্ক পর্ব-২৩+২৪+২৫

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৩

-আপনার জন্য আমার সাজানো জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে। আপনার জন্য আমি পরিবার থাকতেও অনাথের মতো জীবন কাটিয়েছি। আপনার জন্য আমি আমার মায়ের শেষ সময়টাতে তার সাথে থাকতে পারিনি। আপনার জন্য—শুধু আপনার জন্য!

জাহানারা উঠে দাঁড়ালো। রাগে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে সজোরে ধাক্কা মারল আদিবের বুকে। জাহানারার আচমকা আক্রমণে টালমাটাল হলো আদিব, পিছিয়ে গেল এক পা। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তার, চোখে ভেসে উঠল কঠোরতা। নিজেকে সামলে নিয়ে শীতল অথচ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সে জাহানারার দিকে।

জাহানারার চোখে তখন উন্মাদনা। মানসপটে ঘূর্ণায়মান বীভৎস স্মৃতিগুলো যেন একেকটা আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হচ্ছে। চোখ ভিজে উঠেছে, কিন্তু তাতে আগুন নেভেনি। আদিবের মুখটা দুঃসহ লাগছে তার কাছে।

-”আই হেইট ইউ! আই হেইট ইউ! আই হেইট ইউ! ঘৃণা করি আমি আপনাকে, ঘৃণা করি!”

চিৎকার করে উঠল জাহানারা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ফের বলল,

-কি ক্ষতি করেছিলাম আমি আপনার? কেন আমার এত বড় সর্বনাশ করলেন? কেন আমাকে অপরাধী করলেন? আপনাকে একটু ভালোবেসেছিলাম, আর তো কিছু করিনি। আমার অন্তহীন ভালোবাসার বিনিময়ে একটুখানি ভালোলাগা চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনি! আপনি কি করলেন? অপবাদ দিলেন? নিজের কাছের মানুষটার মৃত্যুর জন্য আমাকে কাঠগড়ায় তুললেন! কেন?

সাইড টেবিলে থাকা পানির জগটা আছড়ে ফেলল জাহানারা। কাঁচের জগটা টাইলসের মেঝেতে আছড়ে পড়ার সাথে সাথে চূর্ণ-বিচূর্ণ হলো। সেই শব্দে যেন টনক নড়ল আদিবের। থমকালো সে ক্ষণিকের জন্য। বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক সময় নিল না জাহানারার কথার তাৎপর্য বুঝতে। মনে পড়ল দাদির মৃত্যুর দিন, বাবা যখন মাকে দাদির মৃত্যুর জন্য দায়ী করে তালাক দিতে বদ্ধপরিকর, তখন নিজের পরিবারের আসন্ন ভাঙনের ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল সে। রাগ হয়েছিল জাহানারার উপর। অপরিপক্ব মস্তিষ্ক বুঝিয়েছিল, জাহানারা তাকে পাওয়ার জেদ না করলে এত অশান্তি হতো না। সেই মুহূর্তে রাগে অন্ধ মন বলে উঠেছিল—সব কিছুর জন্য জাহানারা দায়ী। একমাত্র জাহানারা। মনে হওয়া কথাটা সে নির্দ্বিধায় বলেছিল সবার সামনে। পরবর্তীতে নিজের বলা কথার জন্য অনেকবার মনে মনে অনুতপ্ত হয়েছে, কিন্তু কখনো ভাবেনি তার ঐ কথার উপর ভিত্তি করে জাহানারার জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে!

একটা শুকনো ঢোক গিলল আদিব। নিজের স্বপক্ষে বলল,

-বাবা মাকে তালাক দিতে যাচ্ছিল। পরিবার ভেঙে যাচ্ছিল আমার। তখন সেই মুহূর্তে আমার যা মনে হয়েছে, তাই বলেছি। অত কিছু ভাবিনি।

আদিবের কথা শেষ না হতেই তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে গেল জাহানারার মুখে। সে আদিবের দিকে এগিয়ে এলো এক পা। সাথে সাথে আহত পাটা ব্যথায় শিরশির করে উঠলো, জানান দিল—শরীরের ভর নিতে অপারগ সে। ব্যথায় জাহানারার চোখ-মুখ কুঁচকে গেল আপনা-আপনি। বসে পড়ল বিছানায়।

জাহানারার মুখের ব্যথাতুর অভিব্যক্তি দেখে ছুটে এল আদিব। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, “কি হয়েছে?” জাহানারা কোনো প্রতিউত্তর করল না, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল যন্ত্রণা। জাহানারার এমন একগুঁয়েমি দেখে ধৈর্য্য হারাল আদিব।

-জিজ্ঞেস করছি, কিছু? উত্তর দাও না কেন?

আদিবের রাগান্বিত কণ্ঠস্বর। জাহানারা অশ্রুশিক্ত চোখ দুটো মেলে তার চোখে তাকালো। ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলল,

-আপনাকে ভালোবেসে যে পাপ করেছিলাম, সে পাপের শাস্তি পাচ্ছি।

-দেখো জাহানারা, তোমার অনুভূতি নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। একদিন তুমিই ভালোবাসার দাবি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিলে, আজ আবার তুমিই ঘৃণার দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছ। আমাকে তুমি ভালোবাসলে কি ঘৃণা করলে—আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার। তবে আমার কোনো কথা কিংবা কাজের জন্য তুমি সাফার করেছ বা করছ—এই কথাটা আমাকে ভাবাচ্ছে। তুমি প্লিজ স্পষ্ট করে কথা বলো?

– বলবো না।

-এত অসহ্য কেন তুমি!

ফুঁসে উঠল আদিব। সজোরে লাথি মারল খাটের পায়ায়। আদিবের এমন অভিব্যক্তি দেখে এত কষ্টের মধ্যেও জাহানারার মুখে হাসির রেখা দেখা দিল। আদিব সেটা দেখে তিক্ত বিরক্ত হলো। বলল,

-বুলশিট! তোমার অবস্থার জন্য তুমি নিজে দায়ী, আমি নই।”

-আমার অবস্থার জন্য আমি যতটা দায়ী, আপনিও ততটা দায়ী। এতদিন আমি একা সবটা ভোগ করেছি, এবার দুজন একসাথে ভোগ করবো। ভালো হবে না?

-হুম! খুব ভালো হবে—মেন্টাল একটা!

কথাটা বলতে বলতে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল আদিব। ফাস্ট এইড বক্স বের করে জাহানারার সামনে মেঝেতে বসলো। জাহানারা আহত পাটা নিজের হাঁটুর উপর রেখে রক্তে ভেজা ব্যান্ডেজটা সাবধানে খুলল। রক্তে ভিজে চটচটে হয়ে আছে সেটা। আদিব সেটা দেখে মাথা নাড়ালো। একটা হতাশ শ্বাস ফেলে। ক্ষত পরিষ্কার করতে করতে বলল,

-এর পরে পায়ের উপর ভর দেওয়ার ইচ্ছা জাগলে ল্যাংড়া হওয়ার কথা মনে করে নিও।

ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে উঠে দাঁড়াল আদিব। একটা পেইন কিলার জাহানারার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

-ইচ্ছা হলে খেয়ে নিও।

কথাটা বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল আদিব, তারপর কি মনে করে আবার থামলো। পিছন ফিরে বলল,

-“তোমার হয়তো অনেক টাকা আছে, কিন্তু আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ। ঘরের একটা জিনিস নষ্ট হলেও আমাদের খারাপ লাগে। সুতরাং, এর পরের বার আমার বাড়িতে কিছু ভাঙার আগে দ্বিতীয় বার ভেবে নেবে। আর যদি ভাবাভাবির সময় না পাও, তাহলে যেটা ভাঙবে, সেই রকম একটা কিনে আনবে। ঠিক আছে?

বেরিয়ে গেল আদিব। জাহানারা তার প্রস্থানরত পথের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলল, বিড়বিড় করে বলল,

-গোঁয়ার!

-তুমি ভুল ছিলে, চাচু। তোমার ভাতিজি ঘৃণা করে আমাকে। আমার ভুল হয়েছে তোমার কথা শুনে ওকে বিয়ে করা।

-এতো সংলাপ না শুনিয়ে কি হয়েছে সেটা খুলে বলো।

শাহেদের সোজাসাপ্টা কথা। আদিবের সাথে আজ তিন দিন পর কথা হচ্ছে তার। আদিবের বিয়ের আগে শেষবার কথা হয়েছিল তাদের। জাহানারার সত্যিটা জানতে পেরেই সবার প্রথম ছোট চাচার কাছে ফোন করেছিল আদিব। চাচুকে জানিয়েছিল জাহানারার সত্যিটা। সব শুনে শাহেদ বলেছিল, জাহানারাকে একটা সুযোগ দিতে। মেয়েটা এত বছর পরেও তাকে আগের মতোই ভালোবাসে—সেটা বুঝিয়েছিল আদিবকে। আদিব তখন মায়ের কাজে এমনিতেই রেগে ছিল, চাচুর কথা শুনে মনে হয়েছিল, মায়ের কথা ভেবেই তো এতদিন জাহানারার ভালোবাসা নজরআন্দাজ করেছে সে। মা যখন তার সাথে এত বড় একটা নাটক করতে পারলো, তখন আর সে মায়ের কথা কেন ভাববে? জাহানারাকে দেবে তার প্রাপ্য সুযোগ। এসব ভেবেই চাচুর কথায় রাজি হয়েছিল আদিব। সুযোগ দিতে চেয়েছিল জাহানারাকে। কিন্তু তাদের চাচা-ভাতিজার ভাবনা যে জাহানারা এভাবে উল্টে দেবে—সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি তারা।

বিয়ের দিন থেকে আজ পর্যন্ত সমস্তটা খুলে বলল আদিব শাহেদকে। সব শুনে শাহেদের কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ পড়লো।

জাহানারা বেগমের মৃত্যুর দিন আদিব যে কথাগুলো বলেছিল, সেই কথাগুলো তারা তেমন গুরুত্ব না দিলেও জায়েদ ভালোভাবেই মনে নিয়েছিল। আদিবের কথা সমর্থন করে সবার সামনে মেয়েকে ত্যাগ করেছিল সে। সালেহা তার কথার বিরোধিতা করায় গায়ে হাত তুলেছিল তার। জাহানারা তখন দাদির শোকে অচেতন, বসার ঘরে এতকিছু হচ্ছে—সেটা তার অজানা। জ্ঞান ফেরার পর বাবা তার জন্য মায়ের গায়ে হাত তুলেছে—একথা শুনে আরো ভেঙে পড়ে সে। আবারো চেষ্টা করে আত্মহত্যার। ডাক্তার জানায়, জাহানারার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। জায়েদের পাগলামো আর বাড়ির পরিবেশ দেখে শাহেদ স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় জাহানারাকে তাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার। জাহানারা তখনো জানে না, তার গায়ে দাদির মৃত্যুর জন্য যে দায় চেপেছে, সেটা আদিবের দেওয়া। এর ঠিক দুই-তিন মাস পর নাফিজা মুখ ফসকে বলে ফেলে কথাটা। আদিব তাকে এই অপবাদ দিয়েছে—কথাটা জানতে পেরে কেমন স্থবির হয়ে যায় জাহানারা। যে মানুষটাকে ভালোবেসে সব উজাড় করে দিলো, সেই মানুষটা তাকে এত বড় অপবাদ দিয়েছে—মেনে নিতে পারে না সে। মুষড়ে পড়ে একদম। এরপর একদিন হঠাৎ শাহেদের সামনে এসে বলে, “চাচু, আমি বাঁচতে চাই। তুমি আমাকে প্লিজ বাঁচাও।”

সময়ের ব্যবধানে সব ভুলে বসেছিল শাহেদ। আজ আদিবের কথা শুনে পুরোনো স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। বুকটা হুঁ করে উঠল জাহানারার সেই বিধ্বস্ত দশা মনে করে। বুক চিরে বেরিয়ে এল একটা দীর্ঘশ্বাস। মনে হলো, ভুল হয়েছে একটা। তার উচিত হয়নি আদিবকে জাহানারার দিকে ঠেলে দেওয়া। মেয়েটা মনে মনে ছেলেটার জন্য যে ঘৃণা পুষে রেখেছে—ছেলেটার জীবন তো জাহান্নাম বানিয়ে দেবে।

-“কি হলো? চুপ করে আছো কেন? কিছু বলো?

শাহেদের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল আদিব। শাহেদের ভাবনায় ছেদ পড়ল আদিবের কণ্ঠে।

-“কি বলবো, ভেবে পাচ্ছি না তো। জাহানারাকে আমি যতদূর চিনি, ও তো তোকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। এতদিনের হিসাব সব কড়ায়-গণ্ডায় নেবে। সেদিন কেন যে ও কথা বলতে গিয়েছিলি, বাপ! এ জন্যই কথা-বার্তা বলার আগে ভেবে-চিন্তে বলতে হয়।

-তোমার ভাই আমার মাকে তালাক দিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে ভাবনা-চিন্তার অবস্থায় ছিলাম না আমি। যা মনে এসেছে, তাই বলেছি। সেই কথা নিয়ে সেজ চাচা এমন জল ঘোলা করবে—কে জানতো! কি করেছি, কি বলেছি—ওসব বাদ দিয়ে এখন সমাধান বলো। তোমার ভাতিজির রাগ-বাগ সহ্য হচ্ছে না আমার।

-সমাধান বলতে আমার কাছে একটাই উপদেশ আছে—তোর জন্য একটু ধৈর্য্য ধর, ধৈর্য্য ধরে হ্যান্ডেল কর। মেয়েটার উপর এত বছর যা গিয়েছে—”

-“চাচু, থামো তো। তোমার এই কথার চক্করে আমি ফেঁসে গেছি। মেয়েটা অসহায় হ্যান ত্যান—ও অসহায় না, আমি অসহায়। ওর তো শুধু অতীত নষ্ট হয়েছে—নষ্ট বললেও ভুল হবে, টাকা-পয়সা, চেহারা-ছবি, নাম-ডাক—সব আছে ওর। আমার থেকে ভালো পজিশনে আছে ও। হ্যাঁ, মানছি, পরিবার থেকে দূরে থেকেছে—সেটা আমিও থেকেছি। ও তো তাও তোমাদের মধ্যে ছিল।

একটু থামল আদিব, দম ফেলল। জাহানারার অসহায়ত্বের গান শুনতে ইচ্ছে করেছে না তার।বুক ভরে দম নিয়ে আবার বলল,

-চাচু শোন, আমি সহজ-সরল মানুষ, এতো প্যাঁচ-ঘোঁচ বুঝি না। দীপ্তি আপুর বিয়ের পর থেকে পরিবারে অশান্তি দেখছি। মা বলেছে আমার কথা শোনো, বা বলেছে আমাকে বোঝ—বোনেরা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। আমি নিজের দিকটা বোঝানোর মতো কোনো মানুষ পাইনি। ইচ্ছা ছিল এমন একটা মানুষকে বিয়ে করবো যে আমার দিকটা বুঝবে, আমাকে স্বস্তি দিবে। কিন্তু এমন একজনকে বিয়ে করলাম যে ঘাড় ধরে পুঁ’তে দিতে পারলে বাঁচে!”

-সব দোষ আমাকে দিবি না। আমি তোকে বললাম, জাহানারাকে একটা সুযোগ দে। তুই দিনের দিন বিয়ে করতে গেলি কেন?

-তোমার ভাতিজি ফকিরের মতো এসে দাঁড়ালো, নাটক করতে লাগলো। তো কি করতাম! আমি কি জানতাম তোমার ভাতিজির পেটে এতো শয়তানি? শালা… দেশে আসায় ভুল হয়েছে আমার।”

ফোন কাটল আদিব। রাগে গজগজ করতে করতে হাঁটা দিল বাড়ির উল্টো দিকে। ঠিক করল, আজ আর বাড়ি ফিরবে না।

রাত বাড়ার সাথে সাথে চিন্তা বাড়ল তানিয়ার। ছেলে সেই ভর সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থেকে বের হয়েছে, যাওয়ার সময় কিছু বলে যায়নি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, দমকা বাতাস বইছে। দুই-দুই বার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এমন দুর্যোগের সময় ছেলে বাইরে কোথায়, কেমন আছে—ভেবেই ছটফটিয়ে উঠল মন। নিজে ফোন করে ক্লান্ত হয়ে শেষমেষ আশরাফকে বলল ছেলেকে ফোন করতে। আশরাফ প্রথমে তানিয়ার কথায় গুরুত্ব না দিলেও রাত বাড়ার সাথে সাথে তার মনে চিন্তার দানা বাঁধলো। কল করল সে ছেলের নাম্বারে, কিন্তু কল ঢুকল না। এক যান্ত্রিক নারীকণ্ঠ জানালো—ফোন বন্ধ। আদিবের ফোন বন্ধ পেতেই চিন্তিত হলো আশরাফ।

এগারোটার পরে বাড়ি ঢুকল আদিব। তাকে দেখতেই তানিয়া একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল—কি হয়েছে? কোথায় গিয়েছিলে? এতো দেরি হলো কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। আদিব মায়ের উপর রেগে থাকলেও ধৈর্য্য নিয়ে উত্তর দিল। মানুষ হিসাবে মহান না হলেও, মা হিসাবে অনন্য মানুষটা।

আদিবের জবাবে স্বস্তি পেল দুইজন। আদিবকে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আসতে বলল আশরাফ। ছেলের অপেক্ষায় এখনো খাওয়া হয়নি তাদের। আদিব মাথা নেড়ে নিজের ঘরের দিকে বাড়ালো। ঘরের সামনে আসতেই চোখ পড়ল নেহার উপর—সে দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আদিব যাওয়ার সময় তাকে যেভাবে দেখে গিয়েছিল, ফিরে এসেও সেভাবে দেখে ভ্রতে মোটা ভাঁজ ফেলল। জিজ্ঞেস করল,

-আপনি এখনো এখানে?

-আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, স্যার।

-আমার জন্য? কিছু বলবেন?

-জি, স্যার।

একটু থেমে নিজ মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিল নেহা। আদিবের সামনে কথা বলতে গেলে কেন জানি জিভ নড়বড় করে তার, অকারণেই ভয় লাগে।

-ম্যামের স্মৃতিশক্তি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেটাও একেবারে কম না। ডাক্তার ম্যামকে মানসিক চাপমুক্ত রাখতে বলেছে, না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। তাই—

-আপনার ম্যাম পাগল হয়ে যাক তো! এই হাফ পাগল সামলানোর থেকে ফুল পাগল সামলানো সহজ হবে আমার জন্য। যতসব!

স্বগতোক্ত করে কথাটা বলল আদিব। তারপর ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। আদিবের প্রতিক্রিয়ায় হতবুদ্ধ হলো নেহা। জাহানারার ভালোর কথা ভেবে আদিবকে কথাগুলো বলছিল সে, কিন্তু আদিব তার কথা শেষ না করতেই দিয়ে যেভাবে মেজাজ দেখালো—তাতে বেশ নিরাশ হলো নেহা। তার ম্যাডাম একটু রগচটা হলেও মানুষ খারাপ না। এত বছর ধরে তার সাথে আছে, কোনোদিন তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। হ্যাঁ, রাগের মাথায় একটু ঝাড়ি দিয়েছে, কিন্তু রাগ ঠান্ডা হলেই আবার কাছে টেনে নিয়েছে। মানুষটা যেভাবে তার বিপদে-আপদে পাশে থেকেছে, তার জন্য কৃতজ্ঞ নেহা। পেশাদারিত্ব পার করে মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছে জাহানারার। সেই জন্য তো তার ভালো-খারাপে মন দুলে ওঠে।

নেহার আজ হঠাৎ মনে হচ্ছে, আদিবের সাথে বিয়ে না হয়ে যদি তার ম্যাডামের রাকিব সারোয়ারের সাথে বিয়ে হতো, তাহলে ভালো হতো। লোকটা ম্যাডামের জন্য জান বাজি রাখে। অথচ ম্যাডাম তার ভালোবাসা বুঝল না। যার জন্য জীবনে এতো ঠোকর খেল, আবার তার কাছে হাজির হলো। হতাশামিশ্রিত শ্বাস ফেলল নেহা। জাহানারার ভবিষ্যৎ চিন্তায় চিন্তিত হয়ে পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে—যেটা এ বাড়িতে তার থাকার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।

ঘরে ঢুকতেই আদিবের চোখ পড়ল বিছানায়। জাহানারা সেখানে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। জাহানারার দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখেই শার্ট খুলল সে। জাহানারাকে গভীর ঘুমে দেখে নিঃশব্দে ঢুকল বাথরুমে। ফ্রেশ হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল জাহানারার দিকে। লক্ষ্য করে দেখল, সাইড টেবিলে তার দেওয়া ওষুধটা পড়েছে—মানে খায়নি তিনি। রাতের খাবারটাও টেবিলের উপর ঢাকা, নেহা দিয়ে গিয়েছিল হয়তো—যেটাও ছুঁয়ে দেখেনি মেয়েটা। অথচ ম্যাডামের রাতের ভারী কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো না খেলে সুস্থতায় ব্যাঘাত পড়বে তার।

একটা উষ্ণ শ্বাস ফেলল আদিব। দুইবার ডাকল জাহানারাকে, কিন্তু জাহানারার কোনো সাড়া নেই। বাধ্য হয়ে ঝুঁকল আদিব, হাত রাখল বাহুতে। বাহুতে হাত রাখতেই বুঝল, ম্যাডামের জ্বর এসেছে। ছোটবেলায় প্রায় এমন জ্বর বাধিয়ে বিছানা নিত ম্যাডাম। তার এই জ্বরকে সেজ চাচি বলত “ভালুকে জ্বর”—যেটা না কি পড়ার ভয়ে ইচ্ছে করে বাঁধাত ইনি।

সেজ চাচি! সেজ চাচির কথা মনে হতেই মন ভারী হলো আদিবের। মনে হলো, মানুষটা বেঁচে থাকলে এই মেয়েটাকে সহজে সামলানো যেত। সেই সাথে তার অপরাধবোধও কম হতো। ছোট চাচাকে যতই যাই বলুক সে ,কিন্তু মন তো মানছে না। মন বলছে, জাহানারা ঠিকই বলেছে—তার জন্য সেজ চাচির শেষ সময় মেয়েটা তার পাশে থাকতে পারেনি। কথাটা যতবার মনে হচ্ছে, ভেতরটা লজ্জা-অপরাধে মুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি করার? যা হয়েছে, সেটা তো আর বদলানো যাবে না। এখন অতীত বাদ দিয়ে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে, সেই সাথে মেয়েটাকেও তার অতীত থেকে বের করতে হবে। কি এক জ্বালা—নিজের ক্যারিয়ার গোছানোর সময় তাকে বউ গোছাতে হচ্ছে!

নিজের ভাবনা-চিন্তার মাঝে আরো কয়েকবার নরম স্বরে ডাকল সে জাহানারাকে।একসময় আদিবের ডাকে সাড়া দিল জাহানারা, চোখ পিটপিট করে তাকাল। ক্লান্ত দৃষ্টি তার।আদিব বুঝলো জ্বরে ইতিমধ্যে কুপোকাত করেছে ম্যাডাম কে।আদিবের ভাবনার মাঝেই জাহানারা হাত বাড়িয়ে আচমকা জড়িয়ে ধরল তাকে। জাহানারার আকস্মিক কাজে হকচকিয়ে গেল আদিব, পড়তে পড়তে হাতের ভরে নিজেকে সামলে নিল। জাহানারা তাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কাতর কণ্ঠে অভিযোগের সুরে বলে উঠল,

-“আমাকে একটুখানি ভালোবাসলে কি ক্ষতি হতো আপনার?”

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৪

জাহানারার কথাগুলো কানে পৌঁছাতেই আদিবের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠল—শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল এক শীতল শিহরণ। মেয়েটার কাতর কণ্ঠ নাড়া দিল ভেতরটা। কয়েক ঘণ্টা পূর্বে জাহানারার করা অভিযোগগুলোর জন্য মনের মাঝে যে অশান্তির ঝড় শুরু হয়েছিল, সেটা যেন এই উষ্ণ আলিঙ্গনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অজানা এক ভালোলাগায় ভেতরটা খলখলিয়ে উঠলো। কী হলো আদিবের? কে জানে! সে এক হাতের ভরে নিজেকে সামলে অন্য হাত দিয়ে জাহানারাকে নিজের সাথে আরও নিবিড় করে জড়ালো। আদিবের শীতল হাতের নিবিড় স্পর্শে কেঁপে উঠল জাহানারা। ঘোর কাটল তার। বুঝতে পারল, জ্বরের ঘোরে কল্পনা আর বাস্তবতা গুলিয়ে ফেলেছে সে। আদিবকে জড়িয়ে ধরা হাত দুটো তৎক্ষণাৎ শিথিল করল। একটা শ্বাস টেনে ঢোক গিলল। নিজেকে ধাতস্থ করে আদিবের বুকে হাত রেখে তাকে নিজের থেকে দূরে ঠেলল। জ্বরাগ্রস্ত দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠল—

-আদিব, সরুন।

আচমকা এমন প্রত্যাখ্যানে থমকে গেল আদিব। এক নিঃশব্দ অপমানে মুখটা শক্ত হয়ে উঠল তার। মুহূর্তেই নিজেকে সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। জাহানারার এই দ্বিমুখী আচরণ—কাছে টেনে নিয়ে দূরে ঠেলে দেওয়া—এ ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ হলো না তার। অপমানিত বোধ করল সে, ভিতরে ভিতরে রাগে ফেটে পড়ল। মুখের ভঙ্গি কঠোর হলো। নিজের থমথমে মুখটা ঘুরিয়ে নিল জাহানারার বিপরীতে। ঘনঘন শ্বাস টেনে নিজের রাগ দমাতে চাইল, কিন্তু সফল হলো না। অজান্তেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থান ত্যাগ করল। ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। যাওয়ার সময় স্বশব্দে দরজা দিয়ে নিজের উদ্বেলিত রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে ভুলল না।

দরজা দেওয়ার বিকট শব্দে কেঁপে উঠল জাহানারা। চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নিল। আদিবের গভীর স্পর্শে মনের মাঝে যে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল, সেটা দমানোর চেষ্টা করল। একটু সময় লাগল, তবে নিজেকে সামলে নিল জাহানারা। ধাতস্থ হয়ে উঠে বসল শোয়া থেকে।

আদিবকে কল্পনা করে তার সাথে কথোপকথনের এই অভ্যাস অনেক পুরোনো জাহানারার। সেই অভ্যাসবশত আজ বাস্তব আর কল্পনার মাঝের পার্থক্যটা বুঝতে পারেনি সে। জ্বরের ঘোরে আদিবের বাস্তব সত্তাকে অবাস্তব ভেবে নিজের মনের অভিযোগ ব্যক্ত করছে নির্দ্বিধায়! নিজের এই বোকামির জন্য নিজের উপর রাগ হলো জাহানারার। তিক্ত বিরক্ত হয়ে ফুঁসে একটা শ্বাস ফেলল। সাইড টেবিল থেকে পানি ভর্তি গ্লাস নিয়ে এক নিশ্বাসে সবটুকু পানি শেষ করল। খালি গ্লাসটা আবার সাইড টেবিলে রাখতে গিয়ে চোখ পড়ল নতুন জগটায়। আদিব চলে যাওয়ার পর নেহাকে ডেকে বলেছিল, আদিবের ঘরে যেমন জগ ছিল, তেমন একটা জগ কিনে আনতে। জাহানারা লক্ষ্য করে দেখল, নেহা তার কথা মতোই আগের জগটার অনুরূপ একটা জগ নিয়ে এসেছে। নেহা ফিরে আসার আগে ঘুমিয়ে পড়ায় সেটা দেখা হয়নি জাহানারার। এখন জগটা দেখে নেহার উপর সন্তুষ্ট হলো সে। মনে মনে ঠিক করল, নেহার যে ফোনটা আজ সন্ধ্যায় সে নিজ হাতে ভেঙেছে, তার বদলে মার্কেটে সদ্য আসা আইফোনের নতুন ভার্সনটা কিনে দেবে নেহাকে। নিজ মনে কথাটা ভাবতে ভাবতে অর্ধেক পানি ভর্তি জগটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল জাহানারা। জগের সূক্ষ্ম কারুকার্যের ভাজে ভুলে গেল কিছুক্ষণ পূর্বের ঘটনা।

সেদিন রাতে আর নিজের ঘরে ফিরল না আদিব। দুই তলার একটা গেস্ট রুমে সকলের অলক্ষ্যে কাটিয়ে দিল রাত। পরের দিন খুব ভোরে আস্তে ধীরে নিজের ঘরে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকে জাহানারাকে সজাগ দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো, তবে কিছু বলল না। জাহানারাও কিছু জিজ্ঞেস করল না। আদিব প্রতিদিনের মতো নিজের কাপড় নিয়ে ঢুকল ওয়াশরুমে। অনেকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হলো। তোয়ালেটা বারান্দার রেলিংয়ে শুকাতে দিয়ে ফিরে এল ঘরে। জাহানারা তার প্রতিটি পদক্ষেপ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লক্ষ্য করল। নিজেকে পরিপাটি করে জাহানারার সামনে বিছানায় বসল আদিব। আজ আর চেয়ার টানল না। জাহানারা তাকে নিজের সামনে বসতে দেখে লম্বা করে ছড়িয়ে রাখা পা গুটিয়ে নিল। সোজা হয়ে বসল। আদিব তার চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো ভণিতা ছাড়া স্পষ্ট কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—

-জাহানারা, তুমি ঠিক কী চাও?

আদিবের গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা শোনামাত্রই বুকের ভেতর ধক করে উঠল জাহানারার। হৃদয়ের একটুখানি স্পন্দন যেন হারিয়ে গেল। দৃষ্টি নত হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল—

-আপনার জীবনে অশান্তি।

কটাক্ষ করে বলল জাহানারা। মুখে তার গা জ্বালানো হাসি।

-তাছাড়া আর কিছু না? নাথিং?

অন্যরকম কণ্ঠ আদিবের। মুখের ভঙ্গিও শীতল।

-না। অন্য কিছু না।

ফোঁশ করে একটা শ্বাস ফেলল আদিব। তারপর বলল—

-তোমার সিদ্ধান্ত যদি এই হয়, তাহলে আমাদের সম্পর্কটা এখানেই ইতি টানা দরকার। দেখো, আমার একটা কথার জন্য তোমার জীবনে কী কী হয়েছে, সেটা আমি জানি না। তবে এটা বুঝেছি, আমার জন্য তোমার জীবনের অনেক অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, যার ক্ষতিপূরণ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।

একটু থামল আদিব। তারপর অন্যদিকে একপলক তাকিয়ে আবার জাহানারার দিকে তাকাল। জাহানারা তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে তার দিকে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে তার। আদিব সেই জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে ফের বলল—

-আমার জন্য তোমাকে যে সাফার করতে হয়েছে, জাহানারা, তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি হাত জোড় করে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।

-আপনার ক্ষমা চাওয়া-না-চাওয়াতে আমার কিছু যায় আসে না, আদিব।

-তোমার যায় না আসলেও আমার যায় আসে। আমাকে আমার কথা শেষ করতে দাও। গতকাল রাতে তোমার কথা শুনে আমি যেটুকু বুঝেছি, তা থেকে এটা স্পষ্ট যে আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব না। তোমার উগ্রতা, তোমার ঘৃণা—এসব আমার কাছে অসহনীয়।

-আপনি কি আমাকে ডিভোর্সের কথা বলতে চাইছেন?

আদিবের কথা কেটে বলল জাহানারা। নিজের কথায় বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় চোয়াল শক্ত হলো আদিবের। নিজেকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে রাখছিল সে। ধৈর্য ধরে কথা বলার চেষ্টা করছিল। একটা সুস্থ আলোচনা করতে চাইছিল। কিন্তু এই মেয়ের জন্য সেটা সম্ভব হওয়ার নয়। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টানল আদিব। গতকাল সারারাত ভেবেছে সে তাদের এই প্যাঁচানো-ঘোচানো সম্পর্ক নিয়ে, তার প্রতি জাহানারার বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব নিয়ে। শেষমেষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, জাহানারা যদি সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে তার সাথে সম্পর্কটা কনটিনিউ না করতে চায়, তাহলে এ সম্পর্ক থেকে অব্যাহতি দেবে তাকে। একটা সম্পর্কে গুমরে গুমরে থাকার চেয়ে নিজেদের পথ আলাদা করে নেওয়া ঢের ভালো।

-আপনি যদি ডিভোর্সের কথা ভুলেও মাথায় এনে থাকেন, তাহলে সেটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন, আদিব ভাই। আমি বেঁচে থাকতে আপনাকে সুখ অনুভব করতে দেব না।

দাঁতে দাঁত পিষল আদিব। জাহানারার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে রইল কতক্ষণ। তার এই রাগান্বিত মূর্তি দেখে জাহানারা স্বস্তি পেল। ঠোঁটের কোণে উঁকি দিল মিটমিটে হাসি। আদিব সেটা দেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলল—

-সাইকো একটা!

মুখ ঘুরিয়ে নিল আদিব। জাহানারা তার কথা শুনে শব্দ করে হেসে উঠল। বলল—

-আপনি আজ জানলেন বুঝি সেটা!

জাহানারার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা। আদিব বুঝল, মেয়েটার সাথে কথা বলে লাভ নেই। যা করার, তাকেই করতে হবে। আদিবকে উঠে যেতে দেখে পিছু ডাকল জাহানারা। কণ্ঠে হাসির ছাপ রেখেই বলল—

-প্রত্যাখ্যান সহ্য হয়নি না?

কথাটা কানে যেতেই পা জোড়া থেমে গেল আদিবের। হাতের মুঠি বদ্ধ হলো। তড়িৎ পিছনে ঘুরে তীরের বেগে এগিয়ে এল জাহানারার দিকে। আঙুল উঁচিয়ে বলল—

-নিজের সীমা অতিক্রম করো না, জাহানারা! ফল ভালো হবে না কিন্তু!

-ফল ভালো হোক বা খারাপ, দুটোই মেনে নেওয়ার সাহস আছে আমার। আমি ভাবছি, আপনার কথা—আপনি তো চড়ুইর ঘায়ে কাত হচ্ছেন!

উপহাসের সুর জাহানারার। আদিব যেন এবার নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাল। জাহানারার চোয়াল চেপে ধরে বলল—

-মুখ সামলে! নাহলে—

-নাহলে কী করবেন? মারবেন?

সেভাবেই বলল জাহানারা। ঝাঁকা মেরে ছেড়ে দিল তাকে আদিব। আহত সিংহের মতো গর্জে উঠে বলল—

-সমস্যা কী তোমার? তোমার কী ক্ষতি করেছি আমি? মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি? ভালোবাসার অভিনয় করেছি? ঠকিয়েছি? কেন শুধু শুধু আমার জীবনটা নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছ? কেন?

জাহানারা নীরব। দৃষ্টি ঘোলাটে তার।

-কী হলো? জবাব দাও।

জাহানারাকে চুপ থাকতে দেখে ধমকে উঠল আদিব। জাহানারা তার ধমকে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল, কিন্তু দমল না। গোঁ ধরে বলল—

-আপনার সাথে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না আমি। বুঝতে পারছেন না?

-বুঝছি, খুব ভালোভাবেই বুঝছি। তোমার তো বলার মতো কিছু নেই। তুমি নিজেকে অসহায় ভিক্টিম দেখিয়ে এতদিন সবার কাছ থেকে যে সহানুভূতি নিয়েছো, সেগুলো তো তোমার চাল ছিল—আমাকে নিচু করার, আমাকে ছোট দেখানোর! তাছাড়া কিছু না। নিজেকে অসহায় দেখাতে গেলে একজনকে জালিম তো বানাতেই হবে। তো আমাকে জালিম বানিয়ে দিলে। আমাকে ভালোবাসার দাবি করে এতদিন যে প্যানপ্যানানি করলে, সেসব তো তোমার নাটক ছিল। আসলে আমাকে কোনোদিন ভালোবাসোই নি তুমি। আমাকে পাওয়া তোমার জেদ ছিল। তার থেকে বড়, নিজেকে খুব সুন্দরী মনে করতে—তখনই তোমার মাথা নষ্ট হলো, যখন দেখলে এই ‘কোনোরকম দেখতে’ ছেলেটা তোমাকে দাম দিচ্ছে না। আমাকে নিজের সামনে নত করার জন্য যা নয়, তাই করতে লাগলে।

-মুখ সামলে কথা বলবেন, আদিব। যা জানেন না, তা নিয়ে কথা বলবেন না। আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না।

চিৎকার করে উঠল জাহানারা। আদিব সেটা দেখে ঠেস দিয়ে বলল—

-একশোবার তুলব? কেমন ভালোবাসা তোমার? হ্যাঁ? যে ভালোবাসা পাওয়া-না-পাওয়ার মাঝে ঝুলে থাকে! ভালোবাসা পাওয়া-না-পাওয়ার ঊর্ধ্বে, বুঝেছো?

-আপনার ভালোবাসার ডেফিনিশন আপনার কাছেই রাখুন। আমার ভালোবাসা মানে পাওয়া। যেকোনো মূল্যে পাওয়া।

তীব্র আক্রোশের সাথে বলল জাহানারা। আদিব থামল। অবাক চোখে তাকাল মেয়েটার দিকে, যার চোখে-মুখে আগুনের ঝলকানি। ভ্রুতে ভাঁজ ফেলল সে। সন্দেহাতীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল—

-“তুমি আমাকে এখনো ভালোবাসো, জাহানারা?

আদিবের প্রশ্নে থতমত খেল জাহানারা। মুহূর্তে ফ্যাকাশে হলো মুখ। বুঝতে পারল, রাগের মাথায় খুব বেশি কথা বলে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিল সে। মুখে ফিকরে হাসি এনে বলল—

-আমি আপনাকে ভালোবাসি কি না বাসি, সেটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন, বলুন তো? আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন বুঝি?”

-ইন ইউর ড্রিমস। আমার এত খারাপ দিন আসেনি যে তোমাকে ভালোবাসতে যাব।

-খারাপ দিনই তো চলছে আপনার। না হলে, যাকে নিজের অযোগ্য বলে পায়ে ঠেলেছিলেন, তার কাছে একটা সুস্থ-স্বাভাবিক সংসারের ভিক্ষা চান? নাকি এই জাহানারা নাম-ডাক আছে বলে—

-তুমি সেদিনও যেমন আমার অযোগ্য ছিলে, আজও তেমনই আমার অযোগ্য। শুধু এতটুকু পার্থক্য—সেদিন অন্তত তোমার মাঝে একটা শুদ্ধতা ছিল। আর এখন পুরোপুরিভাবে অশুদ্ধ তুমি। নিজের নাম-ডাকের রোয়াব নিজের কাছে রাখো। এই আদিব আহসান তোমার মতো সো-কল্ড নামি-দামি লোককে গোনায় রাখে না।”

জাহানারা কথা শেষ হতে না দিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়ল আদিব। আদিবের বলা কথাগুলো বুকের মাঝে তীক্ষ্ণ ফালার মতো বিঁধল জাহানারার। মুখে মুখে যতই বলুক সে ছেলেটাকে ঘৃণা করে, মন তো জানে, তার কতটা জুড়ে আছে এই অহংকারী ছেলেটা। আজ এতদিন পরে নিজের এত এত প্রাপ্তি ঠুনকো লাগল জাহানারার কাছে। মনে হলো, চাচু তাকে যে তেজস্বী সূর্য হতে বলেছিল, তার এক চিকন রশ্মিও হতে পারেনি সে। না হলে এই ছেলের কথা কেন গায়ে বাধছে তার? কেন ভেতরটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে? চোখ ভিজে উঠল জাহানারার। আদিব অবশ্য সেসব লক্ষ্য করল না। সে রাগে অন্ধ হয়ে গজগজ করে ফুঁসতে লাগল।

বাবা আর সেজ চাচার কথা ভেবে বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে চাইছিল সে। সেই জন্য মেয়েটাকে বারবার সুযোগ দিচ্ছিল। ভেবেছিল, তার কথাতেই যখন মেয়েটা এত আঘাত পেয়েছে, তাহলে সেই না হয় সেই আঘাতেই ঔষুধ লাগাক। কিন্তু এখন মেয়েটার কথা শুনে আদিব স্পষ্ট বুঝতে পারছে, মেয়েটা তার এই বিনয়ী ভাবকে লোভ মনে করছে। ভাবছে, তার নাম-ডাক-অর্থ-সম্পদের লোভে তাকে আটকাতে চাইছে আদিব। আচ্ছা, তাহলে এই ঠিক! আর আটকাবে না আদিব তাকে। ভাববে না আর কারো কথা। তার যা মনে হয়, তাই করবে।

-“তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখব না আমি, জাহানারা। তুমি যদি মিউচুয়ালি যেতে না চাও, তাহলে আমাকে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। চয়েস ইজ ইয়োর।”

চলে গেল আদিব। জাহানারার দৃষ্টি ঝাপসা হলো। এতক্ষণ আটকে রাখা অশ্রু সব বাধ ভাঙল। আদিবের গমনরত পথের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে ছাড়বে না আদিবকে। ছেলেটা কী করে, সেও দেখে নেবে।

এরপরের দিনগুলো বেশ দ্রুত অতিবাহিত হলো। আদিব জাহানারার সাথে সব কথা-বার্তা বন্ধ করল। জাহানারাও অবশ্য খুব একটা চেষ্টা করল না তার সাথে কথা বলার।

আদিব আর জাহানারা এমন রেষারেষির মধ্যে খবর এল, দীপ্তির একটা ছেলে বাবু হয়েছে। আল্লাহর রহমতে মা-ছেলে দুইজনেই ভালো আছে। তানিয়া নাতি হওয়ার খুশিতে সারা পাড়া মিষ্টি বিতরণ করল। এমনকি এতদিনের রাগ-অভিমান ভুলে আশরাফের সাথে ঢাকার পথে রওনা হলো মেয়ে আর নাতিকে দেখতে। আদিব যেতে চেয়েছিল তাদের সাথে, কিন্তু জাহানারা একা থাকবে বাড়িতে—সেই কথা বলে আশরাফ তাকে রেখে গেল। আদিব এত করে বলল, নেহা আছে, কাজের লোক আছে, কিন্তু আশরাফ তার কথা কানে তুলল না। অগত্যা তাকে থেকে যেতে হলো। জাহানারা অবশ্য আদিবের সামনে এমন ভাব করল যে আদিবের থাকা-না-থাকায় তার কিছু যায় আসে না। অথচ মনে মনে এটা ভেবে খুশি হলো যে ছেলেটাকে একা পেয়ে এবার ইচ্ছা মতো শায়েস্তা করতে পারবে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

#সৌরকলঙ্ক
#উম্মে_প্রভা
#পর্ব_২৫

জাহানারা ভেবেছিল আদিবকে একা পেয়ে ইচ্ছেমতো নাস্তানাবুদ করবে। কিন্তু জাহানারার ভাবনার গুড়ে একমুঠো বালি চেলে আদিবই যেন তাকে জব্দ করতে লাগল। এই যেমন, আশরাফ আর তানিয়া ঢাকায় যাওয়ার পরদিনই কাকতালীয়ভাবে সব কাজের লোক ছুটিতে চলে গেল। এমনকি রাবেয়া খালা, যে দীর্ঘ দুই বছর এই বাড়ি ছেড়ে নিজের বাড়ি যায়নি, সেও হঠাৎ মনের টানে বাড়ি ছুটল। জাহানারার কপাল ভালো, নেহা ছিল সাথে, তাই খাওয়া-দাওয়ায় কোনো অসুবিধা হলো না। কিন্তু নেহাকে যখন জরুরি প্রয়োজনে ঢাকা যেতে হলো, তখনই বাধল বিপত্তি। রান্না-বান্না, মাজা-ঘসা—কোনো কালেই শেখা হয়নি জাহানারার। ছোটবেলায় সালেহা বকাঝকা করে যা দুটো-একটা কাজ করাতো, কিন্তু বাড়ি ছেড়ে ছোট চাচার সাথে ঢাকায় যাওয়ার পর ছোট চাচি তাকে যতটা সম্ভব আদরে-আহ্লাদে রেখেছে। খড়কুটো ভাঙতে পর্যন্ত দেয়নি। তাছাড়া, সে মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত ছিল যে তাকে কিছু বলার আগে শাহেদ কিংবা তার স্ত্রী দুইবার ভাবতো। এরপর আঠারো গড়াতে না গড়াতেই শোবিজের দুনিয়ায় পা রাখল। ঝকমকে জগতে মেকআপ, ক্যামেরা, অভিনয়ের গোলকধাঁধায় গৃহস্থালি পিছনে পড়ে রইল অবহেলায়। শেখা হয়ে উঠল না নিত্যপ্রয়োজনীয় ঘরের কাজ!

নেহা যতদিন ছিল আরামেই ছিল জাহানারা।নেহা চলে যেতেই সে পড়ল বিপাকে। খাবার-দাবার রাবেয়া যা রান্না করে গিয়েছিল, সেগুলো যোগেযোগে দুই-তিন দিন চলল তার। আদিব অবশ্য ফ্রিজের খাবার ছুঁয়েও দেখেনি। সে সর্বগুণে গুণান্বিত পুরুষ! নিজে রাঁধতে-বাড়তে পারে। নিজের রান্না সে নিজেই করে খেয়েছে। এবং শুধু নিজের জন্যই রান্না করেছে। জাহানারাকে তার রান্না খাবার থেকে এক চা-চামচ পরিমাণও দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। এমনকি যে পাত্রে রান্না করেছে, সেটাও মেজে ঘষে রেখে দিয়েছে। জাহানারা দুই দিন নিজে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছে বিষয়টা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এটো বাসন দেখে জীবনে প্রথমবার তার এত কষ্ট লেগেছে, যেটা বলে বোঝানো সম্ভব না। অনলাইনে কিছু অর্ডার করবে, তারও উপায় নেই। দেশে করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। ইতিমধ্যে চারজন মারা গেছে, শতাধিক আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। গণমাধ্যমগুলো বেশ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। এমন অবস্থায় দেশের একজন সচেতন ভীতু নাগরিক হিসেবে সে কিভাবে বাইরে থেকে খাবার এনে খাবে?

ফ্রিজের দরজা বন্ধ করে মুখ লটকিয়ে আদিবের দিকে তাকালো জাহানারা। আদিব তার খাবার প্রস্তুত করছে। আজ চারদিন ধরে এভাবেই নিজের খাবার নিজে রান্না করে আসছে সে। খুব বেশি কিছু খায় না ছেলেটা। এক বাটি ভাত, একটা সাধারণ সবজি (যেটাতে মাছ থাকবেই), আর একটা ডিম সিদ্ধ—বাস, এই তার খাওয়া। তবে এটা শুধু রাতের জন্য। দুপুর আর সকালের মেনু আবার আলাদা। সে যাই হোক, খাবার অল্প খেলেও জোগাড় করে রাঁধতে তো হয়। এখন জাহানারার কথা হচ্ছে—এত কষ্ট করে জোগাড়-টোগাড় করে যখন রান্না করছেই, তখন তার কথা ভেবে একটু পরিমাণে বেশি রান্না করলে কি হয়! কিন্তু না, তা তো করবে না ছেলেটা। সে তো জাহানারাকে শায়েস্তা করতে চায়। সেই জন্য তো বাড়ি থেকে সবাইকে তাড়িয়ে তাকে এমন ফাঁদে ফেলেছে। জাহানারা বুঝি বোঝে না! সে সব বোঝে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ফোনের দিকে তাকালো। একদিনের নাম করে গিয়েছিল নেহা, দুই দিন হয়ে গেল, তার দেখা নেই। ফিরে আসা তো দূরের কথা, ফোনটাও তুলছে না। জাহানারার রাগ হলো ভীষণ মেয়েটার ওপর। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নেহার উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠালো, *”তোমাকে আর আসতে হবে না। রেজিগনেশন লেটারটা মেইল করে দিও।”* সেন্ড বাটনে ক্লিক করে মেসেজটা পাঠিয়ে আদিবের দিকে আরো একবার তাকালো। আদিব তখনো তার কাজে ব্যস্ত জাহানারা দিকে তাকানোর সময় নেই তার।

আদিবের রান্না খাবারের গন্ধ ইতিমধ্যে পাত্র থেকে বের হয়ে হাওয়ায় দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করেছে। জাহানারার নাকে এসে লাগল সেই ঘ্রাণ। খাবারের সুগন্ধে ক্ষুধা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তার। একটা ঢোক গিলল সে। আদিবের রান্না শেষ। জাহানারা গন্ধ শুঁকে বুঝলো—মুরগির মাংস রান্না করেছে ছেলেটা। জাহানারাকে অগ্রাহ্য করে সবটুকু খাবার বাটিতে ঢেলে নিল আদিব। খাবারের প্লেটে খাবার সাজিয়ে এটো বাসনগুলো সিংকে ফেলল। সাথে সাথে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল জাহানারার। আদিব রান্নাঘর থেকে বের হতেই সে কিচেন ক্যাবিনেটের দিকে হাঁটা দিল। পায়ের ক্ষতটা প্রায় সেরে গেছে। একটু ব্যথা আছে, তবে সেটা গায়ে সওয়া। ক্যাবিনেট থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে সেটা নিয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসল। আদিব তখন মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে। রান্নাঘরে ঘেমে-নেয়ে রান্না করার পরেও ফ্রেশ হয়নি ছ্যাঁড়টা। সাথে সাথে গিলতে বসেছে! পিচাস! নিজের মনে কথাটা বলে টিভির রিমোটে হাত দিল জাহানারা। টিভি অন করতেই মাথায় বাজ পড়ল তার। *”২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। এই সময় জরুরি সেবা ছাড়া সকল সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।”*

এর মানে নেহা চাইলেও খুলনা আসতে পারবে না। চিন্তিত হলো জাহানারা। একবার ভাবলো, খুলনায় মেইড এজেন্সি বলে যে সংস্থাটা আছে, সেখান থেকে কাউকে রান্নার জন্য ডেকে নিতে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, এই সময় কাকে না কাকে পাঠাবে এজেন্সি—সে দেখা গেল কাজ করতে এসে ভাইরাস বাঁধিয়ে দিল। এসব চিন্তাভাবনার মধ্যে একবার তারিনের কথাও মাথায় এলো, কিন্তু বাবার সাথে সেদিন ওভাবে কথা বলা পর আবার আকিবের ফোন উপেক্ষা করায় ওই বাড়ি থেকে সামান্য সাহায্য চাইতেও বিবেকে বাধল তার। তাই তারিনের কাছে সাহায্য নেওয়ার চিন্তা তৎক্ষণাৎ বাদ দিল।

আদিবের প্লেট-বাটির টুংটাং শব্দে ভাবনা ছুটল জাহানারার। খাওয়া-দাওয়া শেষ ছেলেটার। থালা-বাসন পরিষ্কার করছে সে। আজকেও তার জন্য কিছু রাখেনি। কথাটা মনে হতেই রাগে-দুঃখে ঠোঁট বেঁকে গেল তার। বিস্কুটের প্যাকেটটা শব্দ করে টি-টেবিলের ওপর রেখে নিজের ঘরে গেল।

ঘরে ঢুকে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সাইড টেবিলের ওপর রাখা পানির জগটা হাতে নিল। গ্লাসে পানি ঢেলে জগটা আবার রাখতে গিয়ে কিছু একটা মনে করে থামল। তারপর সময় নষ্ট না করে আদিবের শোয়ার জায়গায় সুন্দর করে পানি ভর্তি জগের পানি ঢেলে দিল। কাজটা করতে গিয়ে তার মুখে খেলে গেল এক পৈশাচিক হাসি। জগের পানি শেষ করে জগটা তার জায়গায় রেখে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল। ঘুমের ভান করে চোখ বুজে পড়ে রইল আদিবের অপেক্ষায়।

আদিব এল আরো কিছুক্ষণ পর। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে বিছানার দিকে যেতেই চোখ পড়ল ভেজা অংশে। বুঝতে অসুবিধা হলো না—কাজটা সুনিপুণ হস্তে ইচ্ছাকৃতভাবে করা। শীতল দৃষ্টি ফেলল সে আপদমস্তক কাঁথায় মোড়া লতানো শরীরটার দিকে। ফুঁস করে একটা শ্বাস ফেলল। নিজের ল্যাপটপ আর ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাওয়ার সময় শব্দ তুলে দরজা দিয়ে বুঝিয়ে গেল সে চলে যাচ্ছে। আদিব চলে যেতেই মুখের ওপর থেকে কাঁথা সরাল জাহানারা। খেয়াল করল আদিব যাওয়ার সময় লাইট বন্ধ করে ডিম লাইট জ্বেলে গেছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন নিঃশব্দ ঘরটা যেন গিলে নিতে চাইল জাহানারাকে। তড়াক করে উঠে বসল সে। তাড়াতাড়ি লাইট জ্বালাল। একা থাকার অভিজ্ঞতা থাকলেও এই অপরিচিত জায়গায় হঠাৎ করেই ভয় হতে লাগল তার। বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আদিব যে ঘরে আছে, সে ঘরের দরজায় উকি দিয়ে দেখল—সে ল্যাপটপ খুলে বসেছে, কাজে মগ্ন। জাহানারা ভেবে পায় না—ডাক্তার মানুষ সারাদিন ল্যাপটপে কী করে?

আদিবকে নিজের কাজে মগ্ন দেখে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল সে। উদ্দেশ্য রান্নাঘর। পুরো বাড়িতে এখনো আলো জ্বলছে। আদিব ঘুমানোর আগে এই আলো বন্ধ করে অল্প পাওয়ারের ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। জাহানারা অবশ্য আদিব ঘরে যাওয়ার আগেই তার ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়ে। কেমন জানি গা ছমছম করে তার এই ফাঁকা বাড়িতে। শিউলি আর রাবেয়া খালাকে অকারণে বাড়ি থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আদিবের ওপর রাগ হয় তার। মনে হয়, আদিবকে কাঁচা গিলে খেতে পারলে ভালো হতো। খাওয়ার কথা মনে হতেই পেটের ভেতর অদ্ভুত শব্দ করে উঠল জাহানারার। ক্ষুধা নিবারণে এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। ফ্রিজে ফল আছে, ডিম আছে—সেগুলোই এখন ভরসা। হাতসাফ মুখে ফ্রিজের দরজা খুলল জাহানারা। সাথে সাথে দুটো নতুন টিফিন বক্স চোখে পড়ল। বাইরে থেকে দেখেই সে আন্দাজ করল—ভেতরে আদিবের রান্না মাংস ও ভাত আছে। সাথে সাথে ভেতরটা খুশিতে ডগমগ করে উঠল। টিফিন বক্স দুটো খুলে দেখল—ভেতরে বেশ অনেকটা ভাত ও মাংস আছে। এখান থেকে এক টুকরো মাংস আর এক চামচ ভাত নিলে আদিব বুঝবে না। যেমন ভাবা তেমন কাজ—একটা প্লেটে একটুখানি ভাত আর এক পিস মাংস তুলে নিল জাহানারা। তারপর টিফিন বক্স দুটো যেমন ছিল তেমনভাবে রেখে দিল ফ্রিজে। রান্নাঘরে থাকা টুল টেনে বসে খাবারে হাত দিল। খাবারে হাত দিতেই লক্ষ করল—খাবার ঠান্ডা। এই ঠান্ডা খাবার খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তাদের ওভেন নষ্ট, দুই দিন যাবৎ। তানিয়া না আসা পর্যন্ত ঠিক হবে না হয়তো। অগ্নিচুলোর দিকে এগাল জাহানারা। চুলো জ্বালাতে, খাবার গরম করতে—এইটুকু পারে সে।

ফ্রাইং প্যান চুলায় দিয়ে তার মনে হলো—ছোটবেলায় সালেহা যেমন তেল, লঙ্কা দিয়ে ভাত ভেজে দিতো, তেমন কিছু ট্রাই করতে। রান্নাঘরের কোণায় রাখা বাস্কেটে মরিচ-পেঁয়াজ পেয়ে গেল সে। পেঁয়াজ কুঁচি করা ঝামেলা বিধায় গ্রেটার দিয়ে গ্রেট করে নিল। নিজের এমন বুদ্ধিমত্তা দেখে নিজেই নিজের ওপর গর্বিত হলো খানিক। যাই হোক, মরিচ-পেঁয়াজ কাটা হলে চুলো জ্বালিয়ে ফ্রাইং প্যানে তেল ঢেলে সেটা একটু গরম হতে দিল। সালেহা যেমন করতো, সবটা মনে রেখে কাজ করতে লাগল। কিন্তু গরম তেলে পেঁয়াজ-মরিচ দিতেই বাধল বিপত্তি। পানিসহ পেঁয়াজ যেমন চড়বড় করে উঠল, মরিচের বিচগুলোও তেমন সমানতালে ফুটতে লাগল। চুলোর আঁচ বেশি থাকায় মুহূর্তের মধ্যে কী দিয়ে কী হয়ে প্যানে আগুন উঠল। সেই দেখে জাহানারা হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে চিৎকার করতে লাগল।

আদিব তখন নিচে নামছিল। রান্নাঘরের খুটখট আওয়াজ কানে যেতেই সে ভেবেছিল বিড়াল ঢুকেছে কিনা। জাহানারার চিৎকার শুনে অনেকটা দৌড়ে এল সে। রান্নাঘরে তখন যাচ্ছেস তাই অবস্থা। আদিব সবার প্রথমে গ্যাস বন্ধ করল। তারপর ফ্রাইং প্যান সিংকে ফেলে ট্যাপ ছেড়ে রুদ্ধশ্বাসে বলল,

—”পাগল তুমি! চুলা বন্ধ করতে পারোনি?”

—”আমার চোখ জ্বলছে, আদিব ভাই! আহ…!”

আদিবের কথা উপেক্ষা করে বলে উঠল জাহানারা। ছটফট করতে লাগল সে। মরিচ কাটা হাত না ধুয়ে কখন যে চোখে ঘষেছে, নিজেও জানে না মেয়েটা। ওর কথা শুনে এগিয়ে এল আদিব। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,

—”দেখি কী হয়েছে।”

জাহানারা চোখ মেলে তাকাতে পারল না। ছটফট করতে লাগলো। আদিব লক্ষ করল—মরিচের বিচ লেগে আছে হাতে। তার বুঝতে বাকি রইল না—আহাম্মক মেয়ে করেছে কী! রান্নাঘরের পাশে থাকা বাথরুমে নিয়ে গেল সে জাহানারাকে। নিজের হাত পরিষ্কার করে জাহানারার চোখে পানির ঝাপটা দিল। একদম জ্বালা বন্ধ না হলেও কিছুটা আরাম পেল জাহানারা। আদিব তার হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে তাকে বসাল। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে সেটা এক বাটিতে ঢেলে পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে জাহানারার চোখে রাখল। ভেজা কাপড় চোখে দিতেই আরাম বোধ করল জাহানারা। সেভাবেই কিছুক্ষণ কাটল। একসময় দাপাদাপি বন্ধ হলো জাহানারার। আদিব স্বস্তি পেল। জিজ্ঞেস করল,

—”এখন ঠিক আছো?”

—”হুম।”

—”তুমি কাপড়টা ধরতে পারবে? রান্নাঘরের ট্যাপ খোলা, সবকিছু ছড়ানো-ছিটানো—আমি ওগুলো গুছিয়ে আসি?”

মাথা নাড়ল জাহানারা—যার অর্থ সে পারবে। আদিব আশ্বস্ত হয়ে রান্নাঘরে গেল। ছড়ানো-ছিটানো রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন করে ভাত আর মাংস গরম করে, জাহানারার জন্য প্লেটে খাবার নিয়ে তার সামনে টেবিলে রাখল। নরম কণ্ঠে বলল,

—”খেতে পারবে? না খাইয়ে দেব?”

আদিবের কথা শুনে লজ্জায়-দুঃখে চোখে পানি এল জাহানারার। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে। তেজ নিয়ে বলল,

—”এত দরদ দেখাতে হবে না। যান এখান থেকে।”

জাহানারার নাক ফুলানো কথা শুনে এই পরিস্থিতিতে হেসে ফেলল আদিব।নিশব্দ হাসিতে উজ্জ্বল হলো তার মুখ।চোখের উপর ভেজা কাপড় থাকায় জাহানারা তার হাসি দেখল না, সে সেভাবেই বলল,

—”আজ দুই দিন ধরে আধপেটা খেয়ে আছি। একবারো খোঁজ নেননি। আর আজ যখন পুড়ে-ধুড়ে মরতে বসেছিলাম, তখন আসছেন আহ্লাদ দেখাতে? আপনার আহ্লাদ আপনার কাছেই রাখুন।যান এখান থেকে!”

চেয়ার টেনে বসল আদিব। খাবারের প্লেট টেনে তাতে হাত লাগালো। মুরগির ঝোলে ভাত মাখাতে মাখাতে বলল,

—”আহ্লাদ দেখাচ্ছি না, মানবতা দেখাচ্ছি। আর রইল বাকি দুই দিনের কথা—তোমার জন্য পর্যাপ্ত খাবার ছিল ফ্রিজে।আমি জানি সেটা ।তাই খোঁজ নেয়নি।”

আদিবের কথায় থতমত খেল জাহানারা। ফ্রিজে সত্যিই তার জন্য পর্যাপ্ত খাবার ছিল আজ দুপুরে সেটা শেষ হয়েছে।সে তবুও হার মানলো না।নিজেকে সঠিক প্রমাণিত করতে আমতা আমতা করে বলল,

—”ফ্রিজের বাসি খাবার রোজ রোজ খাওয়া যায়? আপনার ওভেনও তো নষ্ট! কেন নিজে যখন রান্না করছিলেন, তখন আমার জন্য দু মুঠো চাল বেশি নেওয়া যায়নি?”

অভিযোগের সুর জাহানারার। আদিব একটা শ্বাস ফেলল। ফ্রিজে জাহানারার জন্য খাবার আছে এটা ভেবেই গত দুই দিন সে নিজের মতো রান্না করেছে। ম্যাডাম যে ফ্রিজের বাসি খাবার খাবে না, সেটা জানলে নিজের সাথে তার জন্য দু মুঠো রান্না করত। ঠিক আজ যেমনটা করেছিল।

—”তুমি তো আমাকে ঘৃণা করো। আমার তৈরি খাবার খেতে?”

ফিচলে হেসে বলল আদিব।তাদের সম্পর্কের সত্যতা মনে করিয়ে দিল জাহানারা কে।

—”খাওয়া খাওয়ার জায়গায়, ঘৃণা ঘৃণার জায়গায়।”

-স্বার্থপর!

আদিব বিড়বিড়ালো। জাহানারার কানে গেল কথাটা।সে তড়িৎ চেয়ারে এলিয়ে রাখা ঘাড় সোজা করলো চোখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে বলল,

-কি বললেন আপনি? আরেকবার বলুন?

—”কাপড় সরালে কেন? চোখ জ্বালা কমেছে?”

—”না, কমেনি। আপনার মুখ দেখে কথা না বললে শান্তি পাচ্ছি না।”

আদিব হতাশ শ্বাস ফেলল।দুই দিকে মাথা নাড়লো।নিজের বলা কথাটা কৌশলে আড়াল করে বলল,

—কিছু বলিনি।মুখ খোলো, নাও।”

জাহানারা তৎক্ষণাৎ মুখ খুলল না। ক্ষুধা আছে তার পেটে। ইচ্ছা করছে এখনই প্লেট ধরে গপাগপ সব খেয়ে নিতে, কিন্তু ভদ্রতা বলেও তো কথা আছে। এমনিতে একটু আগে যে কাণ্ড হলো, আদিব কিছু না বললেও সে জানে—তাকে ছ্যাঁচড়া ভাবছে ছেলেটা। একটু সময় নিয়ে মুখ খুলল জাহানারা। নিজের হাতে না খেলে শান্তি পায় না সে, কিন্তু আদিবের হাতে খেতে অন্যরকম একটা সুখ-সুখ অনুভূতি হয়। এই ব্যাপারটা সে আদিব যখন তার আদর্শ স্বামী হওয়ার অভিনয় করতো, তখন লক্ষ্য করেছে।আদিবের একটু যত্নআত্তি যেন ভেতরটা উৎফুল্ল করে তোলে ।

—”বাড়ির সব কাজের লোক তাড়িয়েছেন কেন আপনি? আমাকে জব্দ করার জন্য?”

মুখে ভাত নিয়েই জেরা করার সুরে বলল জাহানারা।আদিব ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিল,

—”রাবেয়া খালার মা অসুস্থ। মেয়ে ছাড়া তার আর কেউ নেই।”

—”আর শিউলি?”

—”তার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সে মায়ের সাথে কথা বলে গিয়েছে।”

—”সবাই একসাথে চলে গেল—ব্যাপারটা অদ্ভুত না, আদিব ভাই?”

চোখ সরু করল জাহানারা। আদিব ভাতের লোকমা তার মুখের সামনে ধরল। তারপর তারমতো করেই বলল,

—”তোমার নেহা, যে তুমি ওয়াশরুমে গেলেও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে, সে তোমার ফোনও তুলছে না—এটা আরো ইন্টারেস্টিং না জাহানারা?”

—”মানে?”

বিস্মিত কণ্ঠ জাহানারার।আদিব মুচকি হাসলো।বুঝলো মেয়েটা যতোই হম্বিতম্বি করুক না কেন।বুদ্ধির ঘট এখনো কিঞ্চিৎ ফাকা তার।না হলে তার ইশারা বুঝে নিতো।কথায় বলে বুদ্ধি মানের জন্য ইশরায় যথেষ্ট!

ছোট চাচু নিজের শিয়ালী বুদ্ধি খাটিয়ে বাড়ি ফাঁকা করেছে, উদ্দেশ্য যেন ফাঁকা বাড়িতে আদিব আর জাহানারা একে অপরের কাছাকাছি আসে।তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমে।এ ক্ষেত্রে ছোট চাচু বাবার সাহয্য‌ও নিয়েছে।বাবাও তার কথা মতো রাবেয়া খাল ও শিউলিকে অগ্রীম বেতন দিয়ে বাড়ি ছাড়া করেছে। হঠাৎ করে সবাই ছুটি নিয়ে কেটে পড়ায় সন্দেহ হয়েছিল আদিবের তবে মাথা ঘামায় নি সে। কিন্তু নেহা জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে যখন চলে গেল তখন টনক নড়লো আদিবের।বুঝলো এখানে কোন কিন্ত আছে। আদিবের সেই কিন্তুর পরন্তু জানতে পারলো তৃপ্তির পেট-পাতালা স্বভাবের কল্যাণে।নিজের মনের কথাগুলো ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো আদিব।

—”মানে কিছু না। তাড়াতাড়ি খাও। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

—”তা যান ঘুমান। আমি কি আপনাকে আটকে রেখেছি না কি?”

এক ভ্রূ উঁচিয়ে তাকাল আদিব। এঁটো হাতের দিকে দৃষ্টি ফেলল। জাহানারা বুঝলো নিজের ভুল।বোকা হেসে বলল,

—”ওভাবে তাকাবেন না। আপনাকে বিদঘুটে লাগে।”

—”তাতে তোমার কি?”

—”আমারই তো সব। আপনি আমার বর না?”

—”বর মানো আমাকে?”

—”ওমা, কি অদ্ভুত কথা বলছেন? বর মানবো না কেন? বিয়ে করছি আপনাকে, আর বর মানবো না?”

—”হুম, বিয়ে করেছো আমাকে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।”

কটাক্ষের সুর আদিবের।জাহানারা সন্দেহভরে তাকাল।আদিবের দিকে ভালো করে তাকাতেই লক্ষ্য করলো ছেলেটাকে আজ কেমন নিস্তেজ দেখাচ্ছে।কথা বার্তা কেমন প্রতিদিনের মতো ঝাঁজালো না। জাহানারা চিন্তিত হলো।বলল,

—”কি হয়েছে আপনার? বলুন তো। এমন অসুখ‌ওয়ালা মুরগির মতো ঝিমাচ্ছেন কেন?”

—”কিছু হয়নি। ক্লান্ত লাগছে। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।”

সত্যিই ক্লান্ত দেখাচ্ছে আদিবকে। চোখ দুটোও কেমন লাল হয়ে আছে।দেখেই মনে হচ্ছে শরীর ভালো না ছেলেটার। জাহানারা আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ খেয়ে নিল। জাহানারার খাওয়া শেষ হতেই আদিব থালা-বাসন নিয়ে রান্না ঘরে গেল।সেগুলো পরিষ্কার করে উপরের দিকে যেতে নিলেই জাহানারা পিছু ডেকে বলল,

—”আপনি ঐ ঘরে ঘুমাবেন প্লিজ। আমার ভয় করছে। আমি বিছানার চাদর পাল্টে দিচ্ছি।”

—”শরীর ভালো লাগছে না আমার। আমি যেটা ভাবছি, তেমন কিছু হলে আমার এখন তোমার থেকে দূরে থাকা ভালো।”

—”আপনার করোনা হয়েছে না কি?”

আৎকে উঠল জাহানারা। আদিব দায়সারা ভাবে বলল,

—”হতেও পারে।”

—”আরে যান বাইরে! কে বলেছিল আপনাকে বাইরে যেতে? দেখেছেন, দেশের এমন অবস্থা!আপনি না ডাক্তার!আপনি যদি এমন কান্ড জ্ঞানহীন হন তো আমারা কি করবো!”

চিন্তিত-রাগান্বিত কণ্ঠ জাহানারার। আদিব প্রতিউত্তর করল না।দোষ তার সুতরাং কথা বলা চলে না। জাহানারা কে উদ্বিগ্নত রেখে নিজের ঘরের দিকে আগালো। জাহানারাও তার কথার উত্তর না পেয়ে পিছু নিল আদিবের। আদিব ঘরে ঢুকতেই সেও ঢুকলো ঘরে।আদিবের অনুমতি ছাড়া চওড়া সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে বলল,

—”আমি এখানে ঘুমাবো, আপনি বিছানায় ঘুমান। কোনো সমস্যা হবে না।”

—”পাগলামি করো না, জাহানারা। নিজের ঘরে যাও। এ সময় সচেতন থাকা জরুরি।”

—”একটু আগে যে নিজে হাতে খাইয়ে দিলেন, তখন সচেতনতা কোথায় ছিল আপনার?”

—”তখন অত ভাবিনি। তাছাড়া তুমি আমার থেকে এক হাতের দূরত্বে ছিলে, আর আমি আমার হাত খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করেছিলাম তোমাকে খাওয়ানোর আগে।”

—”এখনো আমি আপনার থেকে দশ হাত দূরে আছি। আপনি ঘুমান।”

—”এত বিরক্তিকর কেন তুমি!”

তিক্ত বিরক্ত হয়ে বলল আদিব। চোখে-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। জাহানারা তার কথার জবাবে দাঁত বের করে হাসল। আদিব একটা হতাশ শ্বাস ফেলে পায়ের কাছে থাকা সবুজ-লাল সুতায় কাজ করা সাদা কাঁথাটা টেনে গায়ে দিল। শীত করছে তার। মনে হচ্ছে, নিয়াজের ডাকে বাইরে যাওয়াটা উচিত হয়নি। করোনা হলে খবর আছে। যেভাবে টপাটপ মানুষজন মরছে, মৃতের তালিকায় তার নাম না ওঠে।

—”জাহানারা, শোন। তোমার ঘরে যাও। বেশি ভয় করলে না হয় তোমাদের বাড়ি যাও। আকিব ভাই মাত্র বাড়ি ফিরল, আমি দেখেছি। ভাবি হয়তো জেগে আছে।”

—”চুপচাপ ঘুমান। আমাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।”

তেতে উঠে বলল জাহানারা। তবে আদিব দমল না। মেয়েটা এখনো ঔষুধের ওপর আছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণ মানুষের থেকে কম তার। আদিব যদিও শক্ত-সামর্থ্য, হয়তো এই ধাক্কাটা সামলে নেবে, কিন্তু মেয়েটা তা পারবে না।

—”জাহানারা, বোঝার চেষ্টা করো। ব্যাপারটা এত হালকাভাবে নিয়ো না।”

—”ব্যাপারটা আমি হালকা-ভারী কোনোভাবেই নিচ্ছি না।”

আদিবের কথা আবারও মাঝপথে কেটে বলল জাহানারা। আদিবের চোয়াল শক্ত হলো। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,

—”গো টু হেল।”

—”জাহান্নামে গেলেও আপনাকে সাথে নিয়ে যাব।”

শব্দ করে শ্বাস ফেলল আদিব।বুঝতে পারলো কথা বললেই এই মেয়ে সে কথা টেনে কথা বাড়াবে। সুতরাং চুপ থাকাই ভালো। মুখে কুলুপ এঁটে চোখ বন্ধ করল সে। ক্লান্ত শরীর বেশি সময় নিল না ঘুমে ডুবতে।

জাহানারাও আর বিরক্ত করল না তাকে। ঘুমানোর চেষ্টা করল। এই ঘরের সোফাটা বড় হলেও সোফা তো সোফাই, সে তো আর বিছানা হবে না। সোফার সংকীর্ণ জায়গায় জাহানারার চোখে ঘুম ধরতে বেগ পেতে হলো। তবে শেষমেশ ঘুম ধরা দিল চোখে।

জাহানারা সবেমাত্র তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছিল, ঠিক সেই সময় মৃদু গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল তার। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই মনে পড়ল—আদিব অসুস্থ। তড়াক করে উঠে বসল সে। দ্রুত এগিয়ে গেল আদিবের দিকে। আদিবের নিষেধ-বারণ উপেক্ষা করে গায়ে-মাথায় হাত দিল তার। বুঝতে পারল—জ্বরটা বেশ জাঁকিয়ে এসেছে ছেলেটার। আদিব তখন অচেতনপ্রায়, মাঝেমধ্যে গুঙ্গিয়ে উঠছে। জাহানারা ওর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। এই অসময়ে কাকে কী বলবে ভাবতেই সজীবের নাম মাথায় এল। সাথে সাথে ফোন করল তাকে।

জাহানারা স্মৃতিশক্তি হারানোর অভিনয় করেছে—এই কথা জানার পর থেকে সজীব কথা বলে না তার সাথে। এমনকি ফোনও ধরে না। তবে আজ কী মনে করে ফোন ধরল। গম্ভীর কণ্ঠে কাঠখোট্টা স্বরে বলল,

—”কি হয়েছে?”

জাহানারা সময় নষ্ট না করে আদিবের কথা বলল। আদিবের জ্বর এসেছে—এই কথা শুনে সজীবের মাথায় প্রথম যে কথাটা এল, সেটা হলো—ছেলেটা করোনায় আক্রান্ত হয়নি তো?

—”দেখ তো, আদিবের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক কি না?”

জাহানারা ঝুঁকে এল। নাকের কাছে হাত দিল, বুকে হাত রাখলো, অনুভব করল আদিবের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি-প্রকৃতি। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক আদিবের। কথাটা সজীব কে জানাতেই আরো কিছু প্রশ্ন করল সজীব।জাহানারা বাধ্য মেয়ের মতো তার সব প্রশ্নের উত্তর দিল। জাহানারার কথায় সজীব এতটুকু নিশ্চিত হলো যে—আদিব সিজনাল জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে।তবে পরক্ষণে কিছু একটা ভাবলো। তারপর জাহানারাকে তৎক্ষণাৎ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়ে বলল—আগামীকাল খুলনা মেডিকেল থেকে করোনা টেস্টের জন্য লোক পাঠাবে সে।আদিবের স্যাম্পল নিয়ে যাবে তারা।আদিবের করোনা টেস্টের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত জাহানারা যেন বিধি নিষেধ মেনে আদিবের কাছে যায়।এই দূর্বল সময়ে কোন কিছু হাল্কাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না!

চলবে, ইনশাআল্লাহ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ