Monday, October 6, 2025







সুতোয় বাঁধা জীবন পর্ব-১১

#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – এগারো

মৃত্যু চিরন্তন সত্য। এই সত্যকে অনুধাবন করা, সানন্দে গ্রহণ করে নেয়া খুব কঠিন ও যন্ত্রণার। মৃত্যু যেমনই হোক, ইহলোকের সাথে এই বিচ্ছেদটা প্রত্যেকটা মানুষের জন্য যন্ত্রণাদায়ক। রুদিতা কখনও ভাবেনি, এই একটা শব্দ তাকে পুরোপুরি কাঁপিয়ে দিবে। তার অন্তরে ভয় জাগিয়ে দিবে। ছোট্ট একটা কথাতে যতখানি বুক ধড়ফড় শুরু হলো তার, তা এর আগে কখনও হয়নি। ইফতির সাথে ডিভোর্স ও তার মৃত্যুর পর মনে হয়েছিল, সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে, সৃষ্টিকর্তা কিছু মানুষের পরীক্ষা নিতে বড্ড বেশি ভালোবাসেন। নয়তো হুট করে এমন কথা উষাদ কেন বলবে?

নিঃশব্দের এই সময়টা বড্ড অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে রুদিতার মনে। মুখফুটে কিছু কথা বলার ক্ষমতা ও ধৈর্যশক্তি নেই বলেই হয়তো চুপ করে থাকা। তার চুপ থাকা ও দীর্ঘশ্বাসটুকু টের পেয়ে উষাদ বলল,

-‘কী হলো? কথা বলছ না কেন? আমি না থাকলে ওদের দেখবে না? ওদের জন্য সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ তৈরী করে করতে পারবে না?’

রুদিতা টের পেল ভয়ে তার গায়ের লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বিপাশাকেও এত ভয় হয়নি। যত ভয় হচ্ছে উষাদের কথাতে। বুক ধড়ফড়, অস্থির, অশান্ত অবস্থা সামলে নিয়ে বলল,

-‘আপনি এমন কথা আর বলবেন না, প্লিজ।’

-‘কেন? ভয় পাচ্ছ?’

-‘জানি না।’

-‘তুমি তো একা পথ চলতে জানো, তাই না?’

আনমনেই ফুঁপিয়ে উঠল রুদিতা। কম্পনরত স্বরে বলল,
-‘না জানি না। কিচ্ছু জানি না আমি। আমি শুধু জানি, আমার পাশে আপনাকে প্রয়োজন। এতদিন ভয় হয়নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, একা পথচলা সম্ভব নয়। যদি এমন হয়, নির্ঘাত পথ হারাব আমি।’

কথা শেষ করে আচমকাই লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিল রুদিতা। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ভর করল হাজারও দুঃশ্চিন্তা। রুহানকে সাপোর্ট দেয়া, উমামাকে মায়ের আদর-ভালোবাসা দেয়া, দুটো বাচ্চাকে সুন্দর ভবিষ্যৎ দেয়া, নিজের মায়ের পায়ের তলার মাটিকে শক্ত করা। রুহামাকে সঠিক, স্বচ্ছ ও সুন্দর পাত্র দেখে বিয়ে দেয়া। এতকিছু তার একার দ্বারা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না কোনোদিন। কীভাবে সামলাবে সবকিছু? ইফতি কখনও বলেনি, আমি না থাকলে বাচ্চাকে আগলে রেখো! কখনও বলেনি, বাচ্চার জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরী করে দিও। অথচ যে মানুষ তাকে প্রতিমুহূর্তে সাহস দেয়ার, পাশে থাকার গল্প শোনাচ্ছে, আজ সে-ই কি-না বলছে, যখন থাকবে না তখন একা পথ চলতে! এ-ও সম্ভব হবে? নীড় হারা পাখি যখন একটু একটু করে নীড়ের দেখা পেতে যাচ্ছে, মনে সাহস সঞ্চয় করে যখন সুখেদের দু’হাতের মুঠোয় বন্দী করার স্বপ্ন দেখছে, তখনই উষাদ তাকে দুর্বল করে দিতেই এমন কথা টেনে আনল। দুঃশ্চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে যেতে লাগল রুদিতার। ফোন রেখে ভেবেছিল একটু ঘুমাবে। ঘুম তো হলোই না, উল্টে মন-মেজাজের বারোটা বেজে গেল।

তাকদীরের এই হিসাব মিলাতে গিয়েছিল সবে। ঠিক তখনই ফোনটা আগের মতো কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে ভাসল উষাদের নম্বর। না চাইতেও রিসিভ করতে হলো। নয়তো একাধারে বেজেই যাবে। ওপাশের মানুষটাও নির্ঘুম রাত কাটাবে। কারও সময় অশান্তিতে কাটুক সেটা চাইল না রুদিতা। মোবাইল কানে ঠেকিয়ে চুপ করে রইল। ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,

-‘আশ্চর্য! এভাবে মুখের ওপর ফোন রেখে দেয়ার সাহস তুমি কোথায় পেয়েছ? বলেছি না, আজ সারারাত আমরা ফোনে কথা বলব। কথা কানে যায়নি?’

রুদিতা আওয়াজ করল না। উষাদ বলল,
-‘এটা একটা সাধারণ কথা। যে কেউ যখন-তখন মারা যেতে পারে। এই কথা নিয়ে এত চটে যাওয়ার কিছু নেই।’

-‘আমি মোটেও চটে যাইনি।’

-‘তাহলে দুম করে ফোন রেখে দিলে কেন? ফের যদি এমন করেছ, মাঝরাতে তোমার বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব। তুমি কি চাও লোকজন আমাকে বউপাগল বলুক?’

-‘আপনি কি কখনও সিরিয়াস মুডে থাকেন না?’

-‘হ্যাঁ, খুব সিরিয়াস। আর এই সিরিয়াস মুহূর্তে একটা সিরিয়াস কথা বলি। শুনবে?’

-‘কী?’

রাগকুমারীর রাগকে বাড়িয়ে দেয়ার জন্যই উষাদ কৌতুকের স্বরে বলল,
-‘তুমি কি আমাদের সম্পর্কটাকে নিয়ে পজেটিভ? আই মিন, আমায় নিয়ে চিন্তিত?’

রুদিতা উত্তর দিতে পারল না। ভয়ের কারণও বলতে পারল না। রাগ দেখাতে গিয়েও নিজের রাগ ও মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে বলল,

-‘ঘুম পাচ্ছে, ঘুমোব।’

-‘তুমি ভীষণ চালাক আছো, জানো? যখনই যে কথা জিজ্ঞেস করি, টুপ করে এড়িয়ে যাও। আমি বোধহয় তোমার বিরক্তির কারণ হয়ে যাচ্ছি দিনদিন।’

-‘আমি কি সে কথা বলেছি?’

-‘তাহলে ফোন রেখে দিতে চাইছ কেন?’

-‘দুর্বল লাগছে। মাথাব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঘুমোনো দরকার।’

উষাদ বিশ্বাস করতে চাইল না। তার বদ্ধমূল ধারণা, রুদিতা ফোন রাখার বাহানা করছে। সে জোরপূর্বক তাকে জাগিয়ে রাখতে বলল,

-‘উঁহু, আজ কোনো বাহানা শুনছি না।’

-‘যেভাবে কথা বলছেন, মনে হচ্ছে সদ্য প্রেমে পড়া কোনো পাগলাটে প্রেমিক।’

-‘প্রেমই তো করছি। করছি না?’

-‘একদমই না।’

-‘বউ-ই তো হও, প্রেমিকাতো নও। বউয়ের সাথে রাত জেগে বৈধপ্রেমে শান্তি-সুখ সবটাই আছে। বিশ্বাস না হলে তুমিও আমার প্রেমে পড়ে দেখতে পারো। এতে কোনো পাপ হবে না। বরং আমাদের বৈধপ্রেম দেখে সৃষ্টিকর্তা রহমত ঢেলে দিবেন। সেই রহমতে আমার সংসারটা একটা দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনে পরিণত হবে। যে বন্ধন আমৃত্যু অটুট থাকবে।’

-‘নির্ঘুম রাত কাটিয়ে এসব স্বপ্ন দেখছেন?’

-‘ক্ষতি কী? আমার স্বপ্নে তো কোনো পরনারী আসছে না। যে আসছে, সে শুধু তুমি। এমন স্বপ্ন দেখাতেও শান্তি আছে। কেন, তুমি শান্তি পাচ্ছ না?’

রুদিতা এবারও উত্তর দিল না। উষাদ বলল,
-‘আমি পাচ্ছি, রাহা। ভীষণ শান্তি পাচ্ছি। এমন একটা রাত জীবনে আসবে, কাউকে নিয়ে আবারও ভাবনা সাজাব, একটা বিশ্বস্ত ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখব, সুখ-দুঃখের আলাপ করব, খুঁনসুটি করব কল্পনাও করিনি। অথচ আজ মনে হচ্ছে, এই রাত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠরাত হতে যাচ্ছে। আমি বোধহয় তোমার মাঝে পুরোটাই ডুবে যাচ্ছি, রাহা।’

হাজারও দুর্বলতা, হাজারও মাথাব্যথা শরীরে নিয়েই নিঃশব্দে হেসে ফেলল রুদিতা। ভয় কিছুটা দূর হয়েছে। তখন ওই কথাতে মারাত্মক ভয় জেগেছিল। মনে হচ্ছিল, বিশ্বস্ত নীড় তৈরীর আগেই বুঝি নীড় ভেঙে গেল। তার ভাগ্য যে খুব খারাপ। পরিপূর্ণ ঘর ও সুখ সবটাই তো সে চেয়েছিল, কিছুই পায়নি। অকূলে কূল হারানোর মতো দিশেহারা অবস্থা হয়েছিল তার। তখনকার ওই সামান্য কথায় যেমন ভয় পেয়েছিল, এখন আবার এরূপ প্রেমময় কথা শোনে সব ভয় পালিয়ে গেল। নির্ভয়ে বলল,

-‘তাই? এত প্রেম?’

-‘হুম, অনেক প্রেম।’

-‘কোথা থেকে আসলো শুনি?’

-‘সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন। বলেছেন, বউয়ের সাথে বেশি বেশি প্রেম করতে। যেন বউয়ের মান-অভিমান সব ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়।’

রুদিতা শব্দ করে হেসে ফেলল। জীবনে ইফতির মতো নারীলোভী প্রেমিক যেমন দেখেছে, তেমনি দেখছে উষাদের মতো বিশ্বস্ত প্রেমিকও। হাসতে হাসতে বলল,

-‘আপনাকে সেরা প্রেমিকের একটা অ্যাওয়ার্ড দিতে পারলে ভালো হতো।’

-‘দিয়ে দাও। মানা করল কে? তোমার হাতের অ্যাওয়ার্ড আমি সানন্দে গ্রহণ করব। বৈধপ্রেমিকা বলে কথা।’

-‘প্রেমিকা আবার বৈধ হয়? আপনি না, দিনদিন পাগল হয়ে যাচ্ছেন।’

-‘সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার এই পাগলামি তুমি-ই থামাতে পারো।’

রুদিতা খিলখিলিয়ে হাসল। অনেকদিন পর নির্ভয়ের হাসির সাথে কিছু চমৎকার মুহূর্তকে সঙ্গী করে রাত কাটতে লাগল তার। হাজারও খুঁনসুটি, দুষ্টুমি, হাজারও মন আনচান করা গল্প শোনে সে অনুভব করল, জীবনে এমন মানুষের সান্নিধ্যের প্রয়োজন আছে।

***

মাথার ওপর একটা নির্ভরতার হাত। ক্ষণে ক্ষণে সেই হাতটা চুলের ফাঁকে আঙুল চালিয়ে যাচ্ছে। কপালে হাত রেখে শরীরের তাপমাত্রা বুঝার চেষ্টা করছে। ঘুমন্ত অবস্থায়ও রুদিতা উপলব্ধি করল, এই হাতটা ভীষণ আদুরে। ভরসার। বিশ্বাসের। একদম মায়ের হাতের মতোন। কিন্তু অদ্ভুত। এটা যে মায়ের হাত নয়, সেটা বুঝেও চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। শীত লাগছে তার। শরীরে নকশিকাঁথা থাকার পরও মৃদু কাঁপছে। আচমকা এই জ্বর, তাকে বড্ড নাজেহাল অবস্থায় ফেলে দিল। চিকন গলার আওয়াজ তুলে উমামা সুধাল,

-‘মাম্মাম, ওঠো না। আর কতক্ষণ ঘুমাবে?’

আদুরে আওয়াজ শোনে জোরপূর্বক চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করল রুদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চমকে গেল। তার থেকে ঠিক এক হাত দূরে বসে আছে উষাদ। মাথায় রাখা সেই নির্ভরতা ও বিশ্বাসের হাতটা উষাদের। স্বপ্ন না-কি সত্যি, সেটাও বোধগম্য হলো না তার অথচ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা নোনাজল। উষাদ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,

-‘তুমি তো দেখি জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছো। শরীর এতটা দুর্বল বলোনি কেন?’

আওয়াজ করতে গিয়েও থেমে গেল রুদিতা। কণ্ঠস্বর কাঁপছে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, উষাদ তার সামনে বসে আছে। আবার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে অনবরত। এটা যে রূপকথার গল্পের মতো মনে হচ্ছে তার কাছে। সে কথা বলবে কীভাবে? তার অশ্রুসিক্ত চোখের পানি আঙুলের আলতো স্পর্শে মুছে নিল উষাদ। বলল,

-‘তুমি কি এখানে থাকবে বলেই পণ করেছ? আমাদের সংসার তোমার পথচেয়ে আছে, রাহা। তুমি যাবে না সেখানে? আগামীকালই কিন্তু শুক্রবার। বিদায়ের দিন। অথচ তুমি আজকেই অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছো।’

মাম্মামকে দুর্বল ও অসুস্থ দেখে রুহান ও উমামা স্কুলে যায়নি। সকাল থেকে মাম্মামের পাশে বসে আছে। উষাদ এসেছিল, দু’জনকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এসে দেখল, রুদিতা এখনও বিছানায় পড়ে আছে। ভয় পেয়ে গেল খানিকটা। রাতের কথা মনে হলো। মেয়েটা বলেছিল, শরীর দুর্বল লাগছে। সে-ই বুঝেনি। পাত্তা দেয়নি। নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের কথা মনে হতেই অনুশোচনা শুরু হলো। বলল,

-‘ওঠো। ফ্রেশ হও। কিছু খাও। তারপর ঔষধ খেয়ে নিবে। এসব জ্বর তুফানের মতো দৌড়াবে। ওঠো তো।’

এমন আদুরে হুকুমের কাছে জ্বরকে হারিয়ে দিতে সাহস নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল রুদিতা। একটু টালমাটাল লাগছে, তবে খুব বেশি না। হাত-পা ব্যথা ধরে গেছে ইতিমধ্যে। মাথায়ও চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। সে দুর্বল কণ্ঠে বলল,

-‘আপনি কখন এসেছেন?’

-‘একঘণ্টার মতো হবে।’

-‘বাচ্চাদের নিয়ে বসুন, আমি চা-নাশতা দিই।’

-‘তোমাকে কিছু করতে হবে না। বসে থাকো এখানে।’

-‘আমি খানিকটা দুর্বল, কিন্তু বেহুঁশ নই। বসুন আপনি।’

ধীরপায়ে বিছানা ছেড়ে নামল রুদিতা। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেল। মাথায় পানি দিয়ে তারপর রুমে এলো। ভেজা টাওয়েল দিয়ে হাত-পা মুছে নিল। বাচ্চাদের কাছে গিয়ে বলল,

-‘আজ মাম্মামের একটু দেরী হয়ে গেল। এসো, আমরা নাশতা তৈরী করি। তোমরা স্কুলে যাবে না? দেরী হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’

শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে দরজা অবধি-ই এগোতে পারল রুদিতা। রুম ক্রস করে রান্নাঘর পর্যন্ত এগোবার শক্তি পেল না। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রুহান তার জামার কোণ ধরে বলল,

-‘মাম্মাম, খুব ক্ষিধে পেয়েছে।’

দাঁড়িয়ে না থেকে আবারও এগোতে চাইল রুদিতা, শরীর হাল ছেড়ে দিল। পড়ে যাওয়ার আগেই তাকে দু’হাত দিয়ে আগলে নিল উষাদ। বাড়াবাড়ি রকমের সাহস দেখে হাসল। বলল,

-‘ধৈর্য তো দেখছি এখানেই শেষ। বাকিটুকু এগোবে কী করে?’

-‘মজা নিচ্ছেন?’

-‘একদমই নয়। বলেছি, বসে থাকো। শুনছ না। কথা না শুনলে এমনই হবে, বুঝেছ?’

-‘অভিশাপ দিচ্ছেন বোধহয়।’

উষাদ শান্তচোখে তাকিয়ে হাসল। রুদিতাকে বিছানায় বসিয়ে পিঠে বালিশ ঠেকিয়ে, আলগোছে তাকে বালিশ পর্যন্ত রেখে বলল,

-‘দোয়া দিচ্ছি দোয়া। সুস্থ হও তাড়াতাড়ি। যদি বেশি বকবক করো, এক্ষুণি কোলে তুলে নিয়ে যাব।’

রুদিতা বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘বাচ্চারা খাবে তো।’

-‘ওদের জন্য আমি আছি। তুমি চিন্তা করো না। বিশ্রাম নাও। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। ততক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকবে। একদম নিচে পা ফেলবে না।’

উষাদ বাইরে যাওয়ার পরপরই নাশতা নিয়ে আসলো রুহামা। বাচ্চাদের একপাশে বসিয়ে রেখে খাইয়ে দিল। খেতে খেতে দু’জনেই হাসছে। টুকরো টুকরো কথার ঝুড়ি খুলে বসেছে। রুদিতা তৃপ্তিভরে দু’জনকে দেখল। মনে মনে অন্তহীন প্রার্থনায় ডুব দিল।

-‘ওরা এইভাবেই থাকুক। একসাথে বাঁচুক। হাসি-আনন্দ আর ভালোবাসা ঘিরে থাকুক ওদের। পৃথিবীর সমস্ত সুখ এসে ছুঁয়ে যাক ওদের নিষ্পাপ মুখখানি।’

***

উষাদের এরূপ হুটহাট পাগলামিতে বড্ড বিব্রতবোধ করছে রুদিতা। কখনও কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। কখনও খাবার খাইয়ে দিচ্ছে। কখনও ঔষধ খাইয়ে দিচ্ছে। হাত-পা মুছে দিচ্ছে বার বার। জ্বর বাবাজি আর থাকবে শরীরে? কাঁথাবালিশসহ দৌড়াবে। এসব দেখে শর্মীর শরীর রীতিমতো জ্বলছে। তবে আতিকা জাহান ভীষণ স্বস্তি পাচ্ছেন। অবশেষে মেয়ের জীবনে বিশ্বস্ত কাউকে এনে দিতে পেরেছেন, এটাই এখন আনন্দের। তিনি দূরে থেকে দেখে আবার সরে পড়লেন। রুদিতা চরম অসহায় চেহারায় বলল,

-‘আপনি এক্ষুণি বাড়ি যাবেন। এখানে আর একমুহূর্তও নয়। প্লিজ…।’

-‘কেন? আমি থাকলে কী সমস্যা?’

-‘খুব সমস্যা। যান তো।’

গালে হাত কিছু ভাবল উষাদ। পরক্ষণেই ঝুঁকে গেল একদম কাছাকাছি। নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্ব থেকে বলল,

-‘কী সমস্যা বলো! প্রেমে পড়ে যাচ্ছ? তাহলে তাড়াতাড়ি পড়ো প্লিজ। তুমি আমার প্রেমে পড়ছ, এটা আমার জন্য ভীষণ সৌভাগ্যের হবে।’

-‘ধ্যাত্তেরি, অসহ্য।’

রুদিতা মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। নিঃশ্বাসটা একদম মুখে এসে পড়ছে। এইভাবে এত কাছে আসে কেউ? কেলেঙ্কারি একটা হয়ে যাবে নির্ঘাত। জান বাঁচাতে মুখ লুকানোই শ্রেয়। এজন্যই নিজেকে আড়াল করে নেয়া। উষাদ চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে দেখল, বাচ্চারা কেউ এখানে নেই। সুযোগ পেয়ে সে আরেকটু কাছে এগিয়ে রুদিতাকে জ্বালাতেই ফিসফিস করে বলল,

-‘কতক্ষণ মুখ ঘুরিয়ে থাকবে। আর দুই সেকেন্ড যদি ওইদিকে তাকিয়ে থাকো, তাহলে নিশ্চিত আগামী তিন সেকেন্ডের মধ্যে বিরাট দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলব। তখন আমাকে নির্লজ্জ উপাধি দিতে এসো না। ওয়ার্নিং কেন দেইনি, সেই অভিযোগও কানে তুলব না।’

ভয়ে গলার পানি শুকিয়ে এলো রুদিতার। বলল,
-‘আপনি যে এত নির্লজ্জ জানা ছিল না।’

-‘বউয়ের কাছে একশোবার নির্লজ্জ হতে পারি। এতে পাপ হবে না, এটা তো জানোই।’

-‘আপনি কি যাবেন?’

-‘যাব তো। আমি এখানে থাকতে আসিনি। শুধু আমার বউ-বাচ্চাকে দেখতে এসেছি।’

-‘দেখা শেষ, এবার যান।’

-‘তুমি মুখ ফিরিয়ে রেখেছ তো।’

-‘এভাবেই থাকব।’

-‘তাহলে আমি আরেকটু নির্লজ্জ হই?’

-‘আপনি যাবেন?’

-‘স্বাভাবিকভাবে তাকাও, চলে যাব। ওয়ান, টু…।’

তিন সেকেন্ড পেরোনোর আগেই স্বাভাবিক হয়ে তাকাল রুদিতা। চোখাচোখি হলো। মুহূর্তেই জ্বরতপ্ত কপালে নেমে এলো বৈধ সম্পর্কের প্রথম ও একটুকরো প্রশান্তির আদর। থমকে গেল বেচারী। বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল। ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে রইল শুধু। উষাদ বলল,

-‘চিন্তা নেই, এবার সেরে যাবে। আমি ছুঁয়ে দিয়েছি তো।’

বোবা হয়ে বসে রইল রুদিতা। উষাদ আবারও বলল,
-‘উমাকে নিয়ে যাচ্ছি। উর্মি এসেছে। বাড়িতে কিছু কাজও আছে। নয়তো আমি আবার আসতাম।’

রুদিতা রয়েসয়ে কোনোমতে উচ্চারণ করল,
-‘আর আসতে হবে না। আমি ঠিক আছি।’

উষাদ তার হাতটা নিজের দু’হাতের মাঝখানে চেপে ধরল ভীষণ যত্নে। আদরে। আবেগঘন কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি আমার স্ত্রী। আমার জীবনসঙ্গিনী। তুমি অসুস্থ হয়ে যতখানি কষ্ট পাচ্ছ, ততখানি কষ্ট ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকেও। একফোঁটাও শান্তি পাচ্ছি না আমি। আরও একটাদিন ধৈর্য্য ধরো। কাল-ই তোমাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাব। তখন তুমি অসুস্থ হলেও সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকবে, এইটুকু আমার জন্য স্বস্তির দিবে। তোমাকে এখানে রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। তবুও যেতে হবে।’

পুরুষ মানুষ এত আবেগী হয়, এত চমৎকার করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে, জানা ছিল না রুদিতার। নিজেকে তার ভাগ্যবতী ভাবতে বড্ড ইচ্ছে করছে। কিন্তু কোথাও না কোথাও সর্বাঙ্গে আজও ইফতির অস্তিত্ব বেজে উঠছে। যে মানুষ শুধু অত্যা//চার করেছে, দিনের পর দিন সম্পর্কটার বৈধ তকমা ব্যবহার করে ক্ষমতা জাহির করেছে, তার স্মৃতি কেন তাকে ভয় দেখাবে? কেন প্রতিক্ষণে মনে করিয়ে দিবে, পুরুষ মানুষ ভালোবাসতে জানে না? কেন বুঝিয়ে দিবে, পুরুষ মানুষ মন বুঝতে পারে না? একজন দোষ করলে দশজন দোষী হয়, এটা রুদিতা বুঝতে পারল স্পষ্ট। এজন্যই ভয় এসে জড়ো হয়েছে মনে। সমস্ত ভয়ভীতিকে দূরে সরিয়ে বলল,

-‘ভদ্রলোকেরা এমন আবেগমিশ্রিত কথা বলতে পারে, জানতাম না তো।’

-‘এখন তো জেনেছ।’

-‘আপনি ভীষণ অদ্ভুত রকমের একজন মানুষ।’

-‘তাই? এখানে অদ্ভুত হওয়ার মতো কী দেখলে?’

-‘খালি চোখে তাকালে আপনাকে পুরোপুরি অস্পষ্ট মনে হয় আবার খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করলে মনে হয়, আপনি একটা স্বচ্ছ আয়না। কয়েকদিন আগের আপনি আর আজকের আপনির মধ্যে ভীষণ তফাৎ। সেদিন ছিলেন একজন দায়িত্বশীল পুরুষ আর আজ হয়ে উঠছেন একজন প্রকৃত প্রেমিক। কেন বলুন তো?’

উষাদ নির্ভার হাসিতে চোখমুখ উজ্জ্বল করে ফেলল। প্রশান্তির ঢেউ বয়ে হৃদয়পুরে। বলল,
-‘প্রেমে পড়েছি যে, এজন্য। তুমিও কি পড়েছ?’

-‘ইশ, না। বয়েই গেছে আমার, আপনার প্রেমে পড়তে।’

-‘বুঝি, বুঝি, আমি সবই বুঝি।’

-‘যতটুকু বুঝেছেন, ইনাফ। আর বুঝতে হবে না। কাল কখন আসবেন?’

-‘তুমি যখন চাইবে, তখন।’

-‘তাহলে বিকেলেই আসুন। ভাইয়া-ভাবীর সাথে আমার কিছু দরকারী আলাপ আছে।’

সবার থেকে বিদায় নিল উষাদ। উমামা সেই ফাঁকে ছুটে এলো রুদিতার কাছে। গালে-কপালে অসংখ্য চুমু দিয়ে বলল,
-‘তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও, মাম্মাম।’

রুদিতা নিজেও বাচ্চাটাকে আদর করল। বিদায়বেলা উষাদ পরম আদরে রুহানকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
-‘কাল তুমি তোমার বাড়িতে যাচ্ছ। তৈরী থেকো।’

-‘আমার বাড়ি?’

-‘হ্যাঁ। যে বাড়িটা বাবাই’র, সেটা কাল থেকে তোমারও বাড়ি হয়ে যাবে। আমরা সবাই একসাথে থাকব।’

ভীষণ খুশি দেখাল রুহানকে। উষাদ ও উমামা চলে যাওয়ার পর পিকলু ও মৌমির সাথে খেলতে লাগল রুহান। আজ স্কুল যায়নি। তাই পড়াশোনার চাপ নেই এখন। সে অবিরত ছুটছে, দৌড়াচ্ছে। হাসিমুখে। একদম চঞ্চল, চটপটে পাখির ন্যায়। বাচ্চাটার মুখের উপচেপড়া হাসি দেখে হাসছে রুদিতাও। শর্মী তা লক্ষ্য করছে। জ্বলছে। পুড়ছে। রুদিতার জীবনের এই সুখটুকু তার সহ্য হচ্ছে না। দ্বিতীয় বিয়ে, দ্বিতীয় শুরু, দ্বিতীয় বন্ধন, তবুও কেউ কেন এত সুখী হবে? সে রুদিতার হাসি-হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘সুখের খুঁজে যাচ্ছিস্ ভালো কথা, যাওয়ার আগে ফুপির কথা ভেবে রাখিস্।’

***

চলবে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ