#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – আট
-‘রুহান কি ঘুমিয়েছে?’
রাত ঠিক দশটা। মাত্রই অফিস শেষে বাড়ি ফিরেছে রুদিতা। এরমধ্যেই উষাদের ফোন। রুহানের জন্যই কল করে সে। তার খাওয়াদাওয়া ও পড়াশোনার খোঁজ নেয়। মাঝখানে তিনদিন পেরিয়ে গেছে। দু’জনার মধ্যকার দূরত্ব দূর হয়নি এখনও, সম্পর্কও এগোয়নি। যেভাবে দু’জন দু’প্রান্তে ছিল, সেভাবেই আছে। তবে রুহানের সাথে উষাদের সম্পর্কটা এগিয়েছে। রুহান এখন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে। ভীষণ সুন্দর সম্পর্ক দু’জনার। আদুরে ও বিশ্বাসে মোড়ানো। কল রিসিভ করে এমন কথা শোনে হাতের ভ্যানিটিব্যাগ বিছানায় রাখল রুদিতা। ওয়ারড্রব খুলে টাওয়েল ও জামাকাপড় বের করল। ওপাশের ব্যক্তিকে বলল,
-‘মাত্র ফিরলাম। এখনও রুহানের সাথে দেখা হয়নি।’
-‘ওহ। একজন সাইকিয়াট্রিস্টের সিরিয়াল পেয়েছি। আগামীকাল বিকেলের দিকে চেম্বারে বসবেন উনি।’
-‘আচ্ছা। ছুটি ম্যানেজ করে নেব।’
এরপর নীরবতায় কেটে গেল আরও কয়েক সেকেন্ড। কেউ-ই কোনো কথা বলল না। রুদিতা প্রথম মুখ খুলল,
-‘আর কিছু বলবেন?’
-‘কেন? বিরক্ত করলাম?’
কেমন যেন অভিমানী একটা স্বর শুনতে পেল রুদিতা। তবে গায়ে মাখল না। এড়িয়ে গেল। উষাদ বলল,
-‘আমাদের নিজেদের কি কোনো কথা নেই?’
প্রথমে অভিমান, এরপর মায়া, এমন কণ্ঠস্বর শোনে কেঁপে উঠল রুদিতা। দু’চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসে রইল। জড়ানো স্বরে বলল,
-‘কী… কথা থাকবে?’
-‘খুবই সাধারণ কথাবার্তা। এই যেমন, কার কী পছন্দ অপছন্দ এসব জানা। ভালোমন্দ ও সুখ-দুঃখের কথা শেয়ার করা। থাকতেই তো পারে, তাই না?’
-‘সব কথা, সবার সাথে শেয়ার করতে পারি না আমি।’
-‘সবার সাথে আমার তুলনা চলে?’
-‘দেখুন, এসব আমার অসহ্য লাগে। ন্যাকামো লাগে। নিজেকে টিনএজ মনে হয়। বয়স এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছে, যেখান থেকে নতুনভাবে আবেগকে প্রশ্রয় দেয়া সম্ভব নয়।’
উষাদ থতমত খেয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ রইল। সে এইভাবে ভেবে বলেনি। শুধু সাধারণ আলাপচারিতা ও সম্পর্কটাকে একটু পাকাপোক্ত করার জন্য, সম্পর্কে বিশ্বাস ও ভরসা টেনে আনার জন্যই বলেছিল। রুদিতা যে এত চটে যাবে, বুঝেনি। বুঝলে বলত না। সে কিছুটা আহতস্বরে বলল,
-‘আপনার কেন মনে হলো, আমি আপনাকে টিনএজ ভেবে এই কথা বলছি?’
ক্লান্ত থাকায় রুদিতা সত্যিই এবার ভীষণ বিরক্ত হলো। অধৈর্য গলায় বলল,
-‘বাইরে থেকে এসেছি। শাওয়ার নিব। রাখছি।’
ওপাশের মানুষটার মনে কী চলছে, সেটা খুঁজে বের করে বোঝার মতো পর্যাপ্ত ধৈর্য নেই রুদিতার মধ্যে। মহাবিরক্ত সে এসবে। উষাদ ফোন করলেই মনে হয়, এই বুঝি অধিকার খাটাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই কারণে, ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলে সে। প্রয়োজনের বেশি একটাও বাড়তি কথা বলতে ভালো লাগে না। ফোন রেখে জামাকাপড় হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। লম্বা শাওয়ার শেষ করে রুহামার রুমে গিয়ে দেখল, রুহান গভীরঘুমে ডুবে আছে। ঘুমন্ত রুহানের মাথায় দু’চারটে চুমু খেল। চুলে হাত বুলাল। রুহামা বলল,
-‘রাত অনেক হলো আপু, খেয়ে নিই চলো।’
-‘তুই যা। আমি আসছি।’
আরও কয়েক মিনিট ছেলের পাশে বসল রুদিতা। এরপর খাবার টেবিলের সামনে গেল। সবার খাওয়া শেষ। শুধু দুই বোনের খাওয়া বাকি। দু’জনে একসাথে বসে গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। দূর থেকে এসব দেখে শর্মী বলল,
-‘একটা ভালো পাত্রের খোঁজ কর রাহা। এবার রুহামার বিয়ের ঝামেলাটাও শেষ করে নিই। যদি বিয়াতা পুরুষ মিলে, তাতেও অসুবিধা নেই। ঘাড়ের বোঝা দূর করতে পারলেই শান্তি। কুড়ি পেরিয়ে সে-ই কবে বুড়ি হয়ে বসে আছে। আর কত ভাইয়ের ঘাড় ভাঙবে?’
খাবার রেখে কড়া চোখে তাকাল রুহামা। উঠে গিয়ে কিছু বলতে চাইছিল সে। রুদিতা হাত ধরে আটকে বলল,
-‘বাদ দে। এসব আজাইরা কথায় কান দিস্ না। মাস্টার্স শেষ কর। নিজের পায়ে দাঁড়া। বিয়ের জন্য ভাবতে হবে না। আল্লাহ্ চাইলে, ভালো পাত্রের খোঁজ অবশ্যই মিলবে।’
রুহামা হাসি ফুটাল ঠোঁটে। এসব কথায় সে কোনোকালেই কেঁদে গাল ভাসায় না। উলটে দু’চারটে অদৃশ্য চড় ছুঁড়ে মারে। এখন খেতে বসেছে। তাই মুখ খারাপ করে খাবারে অরুচি আনার সাহস পেল না। বোনের কথার উত্তরে বলল,
-‘ঠিকই বলেছ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে ভালো পাত্রের খোঁজ অবশ্যই মিলবে। একদম উষাদ ভাইয়ার মতো। তবে আমি বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। আমি ভাবছি, পড়াশোনা শেষ হলে একটা চাকরি করব। একটা বাড়ি করব। মা’কে নিয়ে সেই বাড়িতে থাকব। আমাদের দিন হাসি-আনন্দে কেটে যাবে।’
শর্মী সেই কথা শোনে মুখ বাঁকাল। বলল,
-‘আকাশের চাঁদ ধরার স্বপ্ন তোর স্বপ্নই থাকবে। পরের দাসীগিরি করবি, তোরা। এই কপাল নিয়েই জন্মেছিস।’
-‘হ্যাঁ, তো। রাজরানী তো কেবল তুমি-ই। আমার ভাইয়াটাকে গোলাম বানিয়ে রেখেছ। বুঝতেই পারি না, একটা মানুষ এত স্বার্থপর হয় কী করে!’
-‘মুখ সামলে কথা বল।’
-‘আমার মুখ সামলেই রাখি। তুমি-ই নিজেকে সামলাতে পারো না। এজন্য যেচেপড়ে ঝগড়া করতে চাও।’
-‘রুহামা.. খুব বেড়েছিস্।’
এমন ছোটোখাটো ধমক তার কানের পাশ দিয়ে যায়। এখনও গেল। হাসিমুখে বলল,
-‘হ্যাঁ, বেড়েছি তো। প্রয়োজনে আরও বাড়ব। আজ তর্ক করছি। কাল হয়তো…।’
-‘কী বললি তুই?’
-‘যা বলেছি, শুনেছ। ঢং কোরো না তো।’
-‘তোর সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। দাঁড়া, এখুনি তোর ভাইকে বলছি।’
-‘ওই এক কাজই ভালোমতো পারো। যাও। বলো। কার কী?’
রুদিতা চোখ রাঙিয়ে বোনকে থামতে ইশারা করল। রুহামা থামল না। পালটা হাসি দিয়ে মনোযোগ দিয়ে মাছের কাঁটা বেছে ভাতের নলা মুখে নিয়ে শান্তিতে চিবাতে লাগল। শর্মী রাগে গজগজ করতে করতে প্রস্থান করল। রুদিতা বলল,
-‘তুই পারিস্ও বটে। জানিস্ ও পাগলা ষাঁড়। ক্ষ্যাপানোর কী দরকার?’
রুহামা হাসতে হাসতে বলল,
-‘ক্ষ্যাপালে পাগলা ষাঁড়কেই ক্ষ্যাপাও। নিরীহ্, গোবেচারা ষাঁড়কে ক্ষ্যাপিয়ে আনন্দ নেই।’
***
রাতে ঘুমোতে গেল রুদিতা। কিন্তু ওই সময়েই বাঁধল গণ্ডগোল। বালিশে মাথা ঠেকিয়েছিল সবে, তখনই দরজায় শব্দ হলো। অফিসের কাজ যেটুকু বাকি ছিল, সেটুকু সারতে গিয়ে রাত বারোটা বেজে গেল। সে ঘুমজড়ানো চোখে বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে দেখল, রুহামা দাঁড়িয়ে আছে। বলল,
-‘কী হয়েছে? এখনও ঘুমাসনি?’
-‘উমা ঘুমোচ্ছে না। কথা বলতে চাইছে। সারাদিনে তোমার সাথে কথা বলেনি একবারও। একটু সামলে নাও না।’
রুহামা ফোন বাড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। রুদিতা একবার বিছানার দিকে দৃষ্টি দিল। তার ফোনটা বালিশের কাছেই আছে। দরকার হলে তো উষাদ তাকেই কল করতে পারত। রুহামার ফোনে এত রাতে, কেন কল করবে! সন্দেহ না জাগলেও কোথা থেকে যেন একটা সুক্ষ্ম অধিকারবোধ জন্ম নিল মনে। ফোন কানে ঠেকিয়ে চুপ করে রইল। সে জানে, লাইনের ওপাশে তখনও উষাদ আছে। শুধু নিজের উপস্থিতি বুঝাতে, কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে এক গ্লাস পানি পান করল।
রুদিতার নীরবতা ও বিরক্তি দুটোই বেশ বুঝতে পারল উষাদ। বলল,
-‘এত রাতে বিরক্ত করতে চাইনি। উমাকে কিছুতেই মানাতে পারছি না। আ’ম এ্যাক্সট্রিমলি স্যরি।’
-‘অসুবিধা নেই। ফোনটা ওর কাছে দিন।’
দুই সেকেন্ডের মধ্যেই ওপাশ থেকে উমামা আদুরে গলায় বলল,
-‘মাম্মাম তুমি কবে আসবে? ঘুম আসে না আমার। আমি তোমার কোলে ঘুমাব।’
ফুড়ুৎ করে চোখের সব ঘুম হারিয়ে গেল রুদিতার। ফোন কানে বালিশে মাথা রেখে আধশোয়া হয়ে বলল,
-‘একটু তো সময় লাগবে, সোনা। আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে তোমায়।’
-‘আরও অপেক্ষা করব? একটু তাড়াতাড়ি আসো না।’
-‘সময় আসুক। আসব। এখন তুমি লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমোও।’
-‘ঘুমাব না।’
উমামার জেদ ও অভিমান বুঝতে পেরে রুদিতা বলল,
-‘বেশি রাত জাগলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। বাবাইয়ের কষ্ট বেড়ে যাবে। উমা কি তার বাবাইকে কষ্ট দিতে চায়?’
-‘না। উমা বাবাইকে ভালোবাসে।’
-‘তাহলে সে চুপটি করে ফোন কানে নিয়ে বাবাই’র বুকে মাথা রাখুক। মাম্মাম আজ সারারাত গল্প শোনাবে।’
-‘সত্যিই? তুমি গল্প শোনাবে? রাজকন্যার গল্প শোনাবে? চাঁদেরবুড়ির গল্প শোনাবে?’
-‘হ্যাঁ। শোনাব। আগে তুমি শোও, তারপর।’
রুদিতার কথামতো কাজ করল উমামা। ঝটপট উষাদের কোলে উঠে গেল। একদম বুকের কাছে মিশে গিয়ে বলল,
-‘আমি মাম্মামের গল্প শোনে ঘুমাব। তুমি ফোন ধরো।’
উমামা বুকে মাথা রাখার পর ফোনের লাউডস্পিকার বাড়িয়ে দিল উষাদ। কানের কাছে ফোন রাখা উচিত হবে না। এতে বাচ্চাটার ক্ষতি হবে। এজন্য বালিশের একপাশে ফোন রেখে মেয়ের মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। উমামা ঘুমজড়ানো গলায় বলল,
-‘মাম্মাম, গল্প শোনাও। আমি ঘুমাচ্ছি।’
উমামা চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। রুদিতা বলল,
-‘এক রাজ্যে ছিল এক অলস রাজকন্যা। তার সব আলসেমি ছিল, ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে। সে সারাদিন প্রচুর দুষ্টুমি করত, রাতেরবেলা রাজা ও রানীকে সারারাত না ঘুমোনোর ছলে জাগিয়ে রাখত, এজন্য সে কখনওই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারত না। এসব আলসেমি ও অতিরিক্ত রাতজাগার ফলে, রাজকন্যা খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার সেই অসুস্থতা দিনদিন মাত্রাতিরিক্ত আকার ধারণ করল। রাজ্যের যত বৈদ্য-কবিরাজ ছিল, সবাই এসে রাজকন্যার চিকিৎসা শুরু করল। কিন্তু সবার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। রাজকন্যা সুস্থ হলো না। তার দুষ্টুমি, চঞ্চলতা সব কমে গেল। স্বাস্থ্যের অবনতি হতে লাগল। চোখ বসে গেল। মুখ শুকিয়ে গেল। মুখের হাসি হারিয়ে গেল। তা দেখে রাজা-রানী দিনরাত এক করে মেয়ের সেবাযত্ন করতে লাগল। সব সেবাযত্ন বৃথা গেল, কারণ এতকিছুর পরও রাজকন্যা সুস্থ হয়নি।’
উমামা আঁৎকে উঠে বলল,
-‘রাজকন্যা আর সুস্থ হয়নি, মাম্মাম?’
-‘হয়েছিল তো। তবে সে একটা চমৎকার ঔষধের খোঁজ পেয়েছিল।’
-‘তাই? কী ঔষধ ওটা?’
-‘দূর দেশের এক বৈদ্য এসে জানাল, সে যদি রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোয়, এবং ভোরে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে, তবেই তার শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক হয়ে যাবে। বুঝেছ?’
উমামা কিছু বুঝেনি, এজন্য ঠোঁট উলটে উষাদের দিকে তাকিয়ে দু’দিকে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল। তার নীরব থাকা দেখে রুদিতা বলল,
-‘উমা যদি সুস্থ থাকতে চায়, তাহলে তার কী করা উচিত?’
-‘জানি না তো।’
-‘তুমি এই কবিতাটা পড়োনি? ‘আর্লি টু বেড্ এন্ড্ আর্লি টু রাইজ্। মেইকস্ অ্যা ম্যান্ হেলদি, ওয়েলদি এন্ড্ ওয়াইজ্।’ কী, পড়োনি?’
-‘পড়েছি।’
-‘তাহলে তোমার তো এটা জানার কথা যে, সকাল সকাল ঘুমোয় যারা এবং সকাল সকাল ওঠে যারা, ধনে-জ্ঞানে ও স্বাস্থ্যের দিক থেকে তারা সেরাদের সেরা হয়। জেগে জেগে শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট করার চেয়ে, তাড়াতাড়ি ঘুমোনো উচিত না, তোমার? যেন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে পারো আর, সুস্থ থাকতে পারো। তুমি কি নিজেকে সুস্থ রাখতে চাও না?’
-‘খুব চাই।’
-‘তাহলে এক্ষুণি চোখ বন্ধ করে, চুপটি করে ঘুমোও।’
উমামা ঘুমোলো না। উলটে ঘুমকাতুরে গলায় আবদার করল,
-‘আরেকটা রাজকন্যার গল্প বোলো।’
-‘একদিনে সব গল্প শোনে ফেলতে চাও?’
-‘আমার তো ঘুমই আসছে না।’
উষাদ দেখল, ঢুলুঢুলু চোখ উমামার। আঙুল দিয়ে চোখ ঘষে যাচ্ছে তবুও বলছে ঘুম আসছে না। রুদিতা গল্প বাদ দিয়ে বলল,
-‘আসবে। মাম্মাম একটা গান শোনাব। দেখবে, ঘুম চলে আসবে। তুমি চোখ বন্ধ করে রাখো। একদম চোখ খোলা রাখবে না।’
উমামা সায় জানিয়ে চোখ বন্ধ করল। রুদিতা ফিসফিস কণ্ঠে গান শোনাল,
আয় ঘুম আয়রে, সোনার চোখে আয়।
জাগে তারা ঝিকিমিকি, সোনা যে ঘুমায়।।
আয় চাঁদ আয় নীল জোছনা ছড়িয়ে যা।
আমার সোনার চোখে আয় ঘুম দিয়ে যা।
সোনা যে চাঁদের কণা…
আয় আয় রে ঘুম আয় রে…
আয় আয় রে ঘুম আয় রে…
আয় আয় রে ঘুম আয়রে আয়…
***
গান শেষ হওয়ার আগেই উমামা গভীরঘুমে হারিয়ে গেল। উষাদ মেয়েকে ভালোমতো বিছানায় শুইয়ে রাখল। দুই পা ও হাতের মাঝখানে পাশবালিশ রেখে সাউন্ড কমিয়ে ফোন কানে ঠেকিয়ে বলল,
-‘থ্যাংক য়্যু সো মাচ্। উমা মাত্রই ঘুমিয়েছে।’
গানের মাঝখানে বাবা-মেয়ে কারও কোনো সাড়াশব্দ পায়নি রুদিতা। উমামার নীরবতাতেই বুঝে গিয়েছিল, সে ঘুমিয়ে পড়েছে। এজন্য নিজেই গান থামিয়ে অপেক্ষা করছিল দু’জনের মধ্যে থেকে কেউ একজনের কথা শোনার জন্য। উষাদের গলা শোনে পুরোটা নিশ্চিত হতে পেরে হাই তুলতে তুলতে বলল,
-‘ভীষণ প্যারা দিয়েছে আজ! রোজ এমন করে?’
-‘ও দশটার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজই বায়না জুড়ে দিল। ম্যানেজ করতে পারলাম না। নিরুপায় হয়ে মাঝরাতে আপনাকে বিরক্ত করতে হলো।’
-‘আমি বিরক্ত হইনি। বরং ভালো লেগেছে ওর সাথে কথা বলে। রুহান এভাবে আমার কাছে আসে না। কোনোপ্রকার আবদারও শোনায় না।’
বড্ড বিষণ্ণতায় মোড়ানো কণ্ঠস্বর রুদিতার। এলোমেলো, জড়ানো আওয়াজ। চারপাশ বিষাদে ভরপুর। হুট করে এইভাবে কথা বলে রুদিতা নিজেই চমকে গেল। অতীতের দৃশ্যটা মনে হলেই বুকের ভেতর কষ্টের বন্যা বয়ে যায়। এতকিছু থাকার পরও কিছু নেই, কেউ নেই, এমন অনুভূতি হয়। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-‘রাখছি। সকালে অফিস আছে।’
‘রাখছি’ বলেও ফোন কানে ঠেকিয়ে চুপ হয়ে রইল রুদিতা। তার মন কিছু একটার ইঙ্গিত দিচ্ছে। দু’সেকেন্ডের নীরবতার পরই উষাদ বলল,
-‘একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
-‘করুন।’
-‘রুহানের সাথে আপনার দূরত্বটা ঠিক কী নিয়ে?’
জঘন্য স্মৃতিতে ডুব দিতে চায় না রুদিতা। এজন্য পিছনের অধ্যায়কে সে খুব করে নিঃশেষ করে দিয়েছে। সবটুকু অনুভূতিকে বিলীন করে দিয়েছে। সংসার, ভালোবাসা এসবের প্রতি একসময় এক আকাশসম আগ্রহ থাকার পরও সংসার তার হয়নি। হয়নি কাউকে ভালোবাসাও। তবুও মনে-মস্তিষ্কে কোথাও না কোথাও ইফতি ছিল। তার পুরো দিন, পুরো রাত, এমনকি প্রতিমুহূর্তে সে ইফতিকে ভালোবেসে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছিল। ভাগ্য তার সহায় হয়নি। লাতি মেরে সব সুখ ও ভালোবাসা থেকে তাকে বিতাড়িত করেছে। এই ভাগ্যের চরম নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হয় রুদিতার। যার কারণে, কষ্টকর ওই মুহূর্তটাকে কোনোদিন স্মরণ করতে চায় না। উষাদের কথা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল,
-‘ও আমার কাছে ছিল না তো। এজন্য।’
-‘কেন ছিল না?’
-‘বিয়ের তিন বছরের মাথায় ইফতির সাথে ডিভোর্স হয় আমার। রুহান তখন দুই বছরের মাত্র।’
-‘বলেন কী? ডিভোর্স হয়েছিল কেন?’
-‘বলতে পারব না। প্লিজ, এই নিয়ে আর একটা প্রশ্নও করবেন না, আপনি। আমি চাই না, পুরনো কথা মনে করে ওই অমানুষটার স্মৃতি নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাই।’
ব্যক্তিগত প্রশ্নটা এইভাবে করা উচিত হলো না। সব কথা জানার উপযুক্ত সময় এটা নয়। বিষয়টা মাথায় আসতেই উষাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কৌতুকের স্বরে বলল,
-‘কী আশ্চর্য! আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। কীভাবে ভাবতে পারেন এসব?’
-‘মানে? কীসের সাহস? কী বলছেন? আপনি বোধহয় আমার কথা বুঝতে পারেননি।’
হতভম্ব হয়ে নিজের দিক পরিষ্কার করতে চাইল রুদিতা। উষাদ সেই সুযোগ তাকে দিল না। ঝটপট বলল,
-‘থাক্, যথেষ্ট বুঝেছি আর বুঝতে হবে না। আমি কিছু বলি…।’
-‘কী বলবেন?’
-‘ডানে-বামে, সামনে-পিছনে, যত পুরুষ আপনার মনে ছিল, বা আগামীতে যত পুরুষ আসবে, সবাই পরপুরুষ এবং তাদেরকে মনে করে নির্ঘুম রাত কাটানোটাও আপনার জন্য হারাম। আপনি কেবল দিনরাত একটা চেহারা ও একটা নাম মনের ভেতরে লালন করে চলবেন। আর সেটা হলো, আবু উষাদ তালুকদার। আপনার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ। কথা ক্লিয়ার?’
টাস্কি খেল রুদিতা। চোখদুটো আপনা হতেই বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বলল,
-‘কী বললেন?’
-‘ঠিকই তো বললাম। হক্ব কথা বললাম। না বোঝার মতো এতটা বোকা আপনি নোন।’
মুখ টিপে হাসল উষাদ। তার হাসির শব্দ রুদিতা শুনতে পেল না। সে রেগেমেগে বলল,
-‘একটু ভালো করে কথা বলছি বলে মাথায় উঠে যাচ্ছেন।’
-‘অসুবিধা নেই। আবার যখন খুশি তখন নেমে যাব।’
-‘আপনি একটা যা তা লোক।’
দাঁত কটমট করে বলল রুদিতা। উষাদ শব্দ করেই হাসল। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার যোগাড় হলো। রুদিতা তার মনোভাব বুঝল না। হাসির কারণও খুঁজে পেল না। বিরক্তির স্বরে বলল,
-‘আশ্চর্য! আপনি তো মহাফাজিল।’
-‘এই মহাফাজিলকে নিয়েই জীবন কাটাতে হবে। মৃত্যু না আসা পর্যন্ত হাত ছাড়ব না, বলে দিচ্ছি। কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নিন, আপনারই ভালো। এতে ডানে-বামে সহজেই চোখ পড়বে না। পরপুরুষকে দেখতে গিয়ে, তাদের নিয়ে ভাবতে গিয়ে অহেতুক গোনাহ্’র বোঝা বাড়বে না। কতদিক থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি আপনাকে, ভাবুন তো একবার। আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত তো।’
-‘দূর, আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। কোথাকার কথা, কোনদিকে নিয়ে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছেন। অসহ্য। রাখুন ফোন।’
উষাদ ভীষণ কৌতুকের মুডে আছে। সে একইভাবে রসিয়ে রসিয়ে রুদিতাকে রাগাতে বলল,
-‘সে-ই কখন ফোন রেখে দিতে চাইলেন। যদি রাখতেই চান, তাহলে এতক্ষণ বেকার কথা বলে সময় নষ্ট করলেন কেন? আমি কি আপনাকে জোর করেছি? না-কি বাধ্য করেছি? কসম-টসম কিচ্ছু কিন্তু দিইনি।’
‘ইয়া আল্লাহ্, রহম কোরো’ – এতটুকু বিড়বিড় করে দাঁত দিয়ে ঠোঁটের চারপাশ চেপে চেপে উদ্ভট সব ভাবনায় মজে গেল রুদিতা। তার সামান্য কথায় যে সে এভাবে ফেঁসে যাবে, বুঝেনি। অথচ তখন মন চাইছিল, একটু কথা হোক। আলাপ হোক। রাতটা চমৎকার কাটুক। আর এখন। এখন এসব মনে হওয়াতেই ধরা পড়ার ভয় জেগে উঠল। সে কথা ঘুরাতে ইনিয়েবিনিয়ে ফোন রাখার বাহানায় বলল,
-‘আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।’
-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আর বিরক্ত করব না। ঘুমিয়ে পড়ুন। এমনিতেও আপনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে অনেকক্ষণ জাগিয়ে রেখেছি আপনাকে। আবারও দুঃখিত। ভালো থাকবেন। আল্লাহ্ হাফেজ।’
রুদিতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল উষাদ। রুদিতা হতবাক চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা তাকে ইগনোর করল? এইভাবে? এত অপমান! দাঁতে দাঁত চাপল রুদিতা। ফোন রেখে বিড়বিড় করল,
-‘বুড়ো হয়ে যাচ্ছে তা-ও ভাব গেল না। এই বয়সে এসে এখন তিনি মান-অভিমানের বহর দেখাচ্ছেন। আমাকে ফাঁদে ফেলা এত সহজ না-কি? ওসব সস্তা টেকনিককে এই রাহা মোটেও ভয় পায় না। প্রেম-ভালোবাসা, সংসার, স্বামী এসব নিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর না। আর কোনো অভিজ্ঞতার দরকার নেই। সম্পর্ক নিয়ে আর কোনো সুখকর ভাবনাকে মনে ঠাঁই দিব না। একদমই দিব না।’
***
চলবে…