#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
লঞ্চ থেকে নামার পর নাহিদ আর্শিকে ক্রশ করে সামনে এগুলে আর্শি নাহিদের সাথে কথা বলতে চাইলো। কিন্তু নাম তো জানে না। তাই ডাকে,
“এক্সকিউজ মি, মিস্টার।”
নাহিদ আর্শির থেকে দুই হাত সমান দূরত্বে সামনে ছিল। সে ডাক শুনেও ভাব নিয়ে পেছনে ফিরলো না। আর্শি পুনরায় ডাকলো। এবার নাহিদ পিছু ফিরে না জানার ভান করে বলে,
“আপনি বারবার কাকে ডাকছেন, মিস? আপনার কর্কশ কণ্ঠে আমার কানে পেইন হচ্ছে। আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ডাকছেন তো!”
সহসা আর্শির মন পরিবর্তণ হয়ে গেলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“একজনকে থ্যাংকিউ বলার ছিল। থ্যাংকিউ।”
“ওয়েলকাম, মিস!”
আর্শি এবার নাহিদকে ক্রস করে এগিয়ে যেতে নিলে নাহিদ বলে,
“আমি নাহিদ। বারবার ‘মিস্টার’ বলতে হবে না।”
আর্শি নাহিদের উদ্দেশ্যে বিরক্তিমিশ্রিত হাসি দিয়ে বলে,
“আপনাকে আর ডাকার কোনো প্রয়োজন হবে না। তাই নাম জানার ইচ্ছে নেই। গুড বায়।”
আর্শি তার বন্ধুদেরকে ডেকে চলে যায়। কিন্তু সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে, ট্যুর শেষ হতে না হতেই সে নাহিদকে ভালোবেসে ফেলবে। আর্শি স্বভাবতো চঞ্চল ও এক্সট্রোভার্ট। একা একা ঘুরতে ভিষণ ভালোবাসে। তিন দিনের ট্যুরে সে পৌঁছানোর পরদিন সকালে একা একা জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে পথ হারিয়ে বিপদে পড়ে গিয়েছিল। সেখানে নেটওয়ার্কও পাচ্ছিলো না। সেইসাথে সা*পের ভয়তো আছেই। সুন্দরবনের গাছের সাথে সা*প যেন মিশে থাকে। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে কাঁদতে বসেছে আর্শি। প্রায় অনেকক্ষণ পেরিয়ে যায়। অতঃপর সেখানে সেভিয়রের মতো উদয় হয় নাহিদ। নাহিদ ছুটে এসে আর্শিকে টেনে তুলে রেগে চিৎকার করে বলে,
“আর ইউ মে*ড? না বলে এসেছো কেন? তোমাকে সবাই দুই ঘণ্টা যাবত খুঁজছে।”
আর্শি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আ..আমি বুঝতে পারিনি। আমার ইচ্ছে ছিল একা একা এক্সপ্লোর করা।”
“সাট আপ! এখানে নেটওয়ার্ক প্রবলেম এটাতো মা*থায় থাকার কথা। নাকি মাথার ভেতরে শুধু রা*গ ভর্তি! বুদ্ধি বলতে কিছু নেই!”
আর্শি মাথা নিচু করে কাঁদছে। নাহিদ এরপর ধ*মকে বলে,
“চলো! এখন নাটক করো না। আছে শুধু বড়ো বড়ো কথা।”
আর্শি বিপরীতে একটা রা ও করে না। যতোই বলুক, দোষটা তো তার নিজেরই। বোঝা উচিত ছিল। তাই নাহিদের দেখানো পথ অনুসারে চলতে থাকে।
সেই ঘটনার পর থেকে ট্যুর শেষ হওয়া পর্যন্ত এই সময়টুকুতেই আর্শি নিজের অজান্তেই নাহিদকে ভালোবেসে ফেলে। জীবনে প্রথমবার কেউ তার মনে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে এসেছে। ফেরার পথেও ওরা সবাই ফিরেছে একই সাথে। খুলনা থেকে ট্রেনে করে ঢাকা এসেছে। গিয়েছিল দুটো গ্রুপ কিন্তু ফিরেছে একটা গ্রুপ হয়ে। আর্শির দুই বান্ধবী ও নাহিদের দুই বন্ধুর মধ্যেও খানিক প্রেম প্রেম ভাব!
কমলাপুর রেলস্টেশনে আর্শির ছোটোবোন আরিয়া ও বড়ো ভাই আবিদ এসেছে আর্শিকে রিসিভ করতে। রাত প্রায় নয়টার মতো বাজে। আরিয়া খুব শান্ত স্বভাবের। আর্শির ফ্রেন্ডদেরকে শুধু হ্যালো বলে কথা বাড়ায়নি। সম্পূর্ণ আর্শির বিপরীত নজর আসে নাহিদের কাছে। আরিয়া বারবার আর্শিকে সময়ের তাড়া দিচ্ছিলো, যা নাহিদের কাছে ভালো লাগে।
এরপর দেখতে দেখতে তিন মাস পেরিয়ে যায়। আজ আর্শির বান্ধবী রুহির বিয়ে নাহিদের ফ্রেন্ড জিসানের সাথে। আর্শি অনেক এক্সসাইটেড কারণ সে আজ নাহিদকে প্রপোজ করবে বলে ভেবেছে। তিনমাসে ফেসবুকে, হোয়াটসএপে নাহিদের সাথে তার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর্শির প্রতি নাহিদের কনসার্ন ও কেয়ার দেখে আর্শি সত্যি সত্যি ভেবে বসেছে, নাহিদও তাকে ভালোবাসে। আর্শি আজ খুব সুন্দর করে সেঁজেছে। মায়ের একটা কাঞ্জিভরম শাড়ির সাথে বড়ো গোল্ডেন ঝুমকো, কুন্দনের চুড়ি ও টিকলি ম্যাচিং করে। আর্শি এমনিতেও সুন্দর। সিম্পল মেকআপের সাথে আর্শিকে দারুণ লাগছে। রুহি নিজে আর্শিকে দেখে বলে,
“দেখ দোস্ত, মানুষ তোকেই না বউ ভাবে। যেভাবে সেঁজেছিস!”
আর্শি হেসে বলে,
“তুই পারিসও! বউতো তোকেই লাগবে। বউয়ের বান্ধবী হয়ে সাঁজবো না, তা কি হয়? বরের বন্ধুদের ভিমড়ি খাওয়াতে হবে না?”
নিতু কথার মাঝে বলে উঠে,
“কাকে? নাহিদ ভাইয়াকে? সে যেভাবে তোর কেয়ার করে, তাতে তার ভিমড়ি খাওয়া লাগবে না। সোজা অ্যা*টাক!”
বলেই হেসে ওঠলো। কলির সাথে বাকিরাও তাল মেলায়। আর্শি লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে উঠে চলে যায়।
________
বরপক্ষ সবে এসে পৌঁছালো। গেইট ধরা থেকে শুরু করে বরের জুতো চু*রি সবই করলো রুহির কাজিন ও বান্ধবীরক মিলে। আর্শি নাহিদকে কমিউনিটি সেন্টারের ছাদে নিয়ে আসে। সেখানে আগে থেকে আর্শির বন্ধু-বান্ধবীরা উপস্থিত ছিল। বিকেলের দিকে ছাদে বর-বধূর ছবি তোলার জন্য ডেকোরেশন করা আছে। আর্শি নাহিদকে বলে,
“আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।”
“হ্যাঁ বলো। জলদি বলো। জিসানরা গ্রুপ ছবি তুলবে।”
“একটু অপেক্ষা করো। বলছি তো।”
আর্শির ফ্রেন্ডরা ছাদের স্টেজের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। ওরা আড়াল থেকে আর্শিকে মোটিভেট করছে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আর্শি নাহিদকে বলেই ফেলে,
“আই লাভ ইউ। অন দ্যাট ডে, ইউ সেভ মি, আই ওয়াজ স্টার্টেড টু ফিল সামথিং টুয়ার্ডস ইউ। আই নেভার থট, আই উডবি ইন লাভ উইথ এন আননওন পার্সোন। আই থিংক উই হ্যাভ অ্যা কানেকশন…..”
আর্শির বলা শেষ হওয়ার আগেই নাহিদ তাকে থামিয়ে দেয়। বলে,
“ওয়েট ওয়েট। হোয়াট! ইউ লাভ মি? রিয়েলি? এন্ড ইউ কল মি হেয়ার টু প্রপোজ? আর ইউ মে*ড?”
আর্শি নিমিষেই থতমত খেয়ে যায়। নাহিদের এহেনো রিয়াকশন সে আশা করেনি। নাহিদ একটু থেমে আবার বলে,
“তুমি ভাবলে কী করে, আমি তোমাকে ভালোবাসি? রিয়েলি?”
আর্শি বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আর্শির থেকে জবাব না পেয়ে নাহিদ খানিক জোড়ে হেসে ওঠে। তারপর আর্শির চোখের দিকে চেয়ে বলে,
“তুমি সুন্দর, এটাকে ডাউট নেই কিন্তু আমার টাইপের না। আমি তোমার স্বভাবের মেয়ে পছন্দ করি না। তুমি বললে না যে, অপিরিচিত ছেলের প্রতি ফিলিংস আসবে তা ভাবতেও পারোনি! তুমি যদি এক অপিরিচিত ছেলেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভালোবাসতে পারলে পরিচিত ছেলেদেরকে….!”
নাহিদ কথাটা বলতেই আর্শির হাতের চ*ড় খেয়ে বসলো। রাগে কাঁপছে আর্শি। চোখের কোণ গড়িয়ে ঘৃণার অশ্রু ঝড়ছে। সে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“সাট ইউর মাউথ আপ! ইউর আর সো ডিজগাসটিং! ইউ হ্যাভ নো রাইট টু টক এবাউট মাই ক্যা*রেক্টার।”
নাহিদ বাঁকা হেসে বলে,
“দুইদিন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলাতেই ভেবে নিয়েছো, আমি তোমাকে ভালোবাসি! তার আবার ক্যা*রেক্টার!”
আর্শি প্রচন্ড রেগে গিয়ে নাহিদের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরতেই আর্শির ফ্রেন্ডরা সবাই বের হয়ে আসে। নিতু, কলি, সারা, আফরা সবাই আর্শিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। রাকিব, সাগর, অভি, সোহানরা মিলে নাহিদকে সরিয়ে নিয়ে যায়। সোহান বলে,
“দেখেন ভাই, আজকে আমাদের বান্ধবীর সাথে আপনার বন্ধুর বিয়ে। আমরা চাইলে এখানেই মে*রে আপনার মুখের নকশা বদল করে দিতে পারি! কিন্তু নিজেদের বান্ধবীর জন্য সেটা করছি না।”
রাকিব বলে,
“আরে সোহান, তুই এই ব্যাটাকে এত সম্মান দিয়ে কথা বলছিস কেন? এই ব্যাটা সম্মানের যোগ্য না। তোর যেহেতু আর্শিকে পছন্দ না, তাহলে পোলাইটলি না করে দিতি। ওর ক্যারেক্টারে প্রশ্ন তুললি কেন?”
রাকিব রেগে গেছে প্রচুর। সে নাহিদের দিকে তেড়েই যাচ্ছিলো, সাগর আটকে রেখেছে। অভি বলে,
“আপনি কতটুকু জানেন আর্শির ব্যাপারে? আপনার কি মনে হয় ওর ছেলে ফ্রেন্ড আছে বলেই ও খারাপ? আমাদের মধ্যে ‘ফ্রেন্ডস উইথ বেনিফিটের’ সম্পর্ক না। আমাদের এই ফ্রেন্ড গ্রুপটাতে ইতি আর সামির ভালোবেসে বিয়ে করেছে। কিন্তু বাকিদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া কোনো খারাপ সম্পর্ক নেই। আপনার নিজের কি ভার্সিটিতে মেয়ে ফ্রেন্ড ছিল না?”
নাহিদ কড়া কণ্ঠে বলে,
“ছিল কিন্তু তোমাদের মতো কয়েকজন ছেলে-মেয়েরা মিলে ট্যুরে যাইনি। ট্যুরের নামে বাহিরে আউটিং এসব!”
সোহান বলে,
“এবার কিন্তু বেশি বলতেছেন? আপনি যে কয়দিন আমাদের সাথে ট্যুরে ছিলেন, আমাদের দেখেছেন? আর্শি, কলিদের হাতটা পর্যন্ত ধরতে? তাহলে কীভাবে বলেন এসব? আর্শিকে পছন্দ না, সরাসরি পোলাইটলি বলে দিবেন। না বলার অধিকার আপনার আছে কিন্তু ক্যারেক্টারে প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই।”
“তোমাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নেই আমার। নিজেদের আরেক বান্ধবীর চোখে পানি দেখতে না চাইলে আমার সাথে লাগতে এসো না।”
এই বলে নাহিদ ছাদ থেকে নেমে যায়। রাকিব নিজেকে সাগরের থেকে ছাড়িয়ে আর্শির কাছে গিয়ে ও-কে ক*ষি*য়ে একটা থাপ্পড় দেয়। অতঃপর বলে,
“তুই সবসময় বলতি না? ছেলেদের তোর বিশ্বাস হয় না। তাই এসব প্রেম-ভালোবাসার ভিতরে তুই নাই। তাহলে এই লো মেন্টালিটির নাহিদকে কীভাবে ভালোবেসে ফেললি? আদিব ভাই জানলে এই নাহিদকে টু-করো টু*করো করে ফেলবে।”
কলি ভয় পেয়ে বলে,
“এটা করিস না ভাই। আদিব জানলে সত্যি ভীষণ ঝামেলা হয়ে যাবে।”
সাগর এতক্ষণ পর বলে,
“আমার মনে হয়, এসব বিষয় নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। অবশ্য কথা বলারও কিছু নেই। যার চিন্তা-ধারা যেমন। আমরা চাইলেও বদলাতে পারব না। নাহিদ ভাই যেমনটা বলেছেন, তেমন যে দুনিয়াতে নেই তেমনটাও তো না। অহরহ হচ্ছে। উনার উচিত হয়নি আর্শির ক্যারেক্টারে প্রশ্ন তোলা। কোনো মেয়ের ক্যারেক্টারে না জেনে প্রশ্ন তোলা উচিত না।”
“তুই চুপ কর। এরে উচিত জবাব দিতে তো হবেই। রুহির বিয়েটা মিটে যাক শুধু…”
রাকিবকে থামিয়ে আর্শি বলে,
“না। তোরা কিছু করবি না। এই বিষয়টা এখানেই ক্লোজ। এটা নিয়ে একটা শব্দও না।”
আফরাও তাতে তাল মেলায়। রাকিব আবারও কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু সোহান, অভি, সাগর ও-কে বলতে দেয় না।
এরপর ওরা স্বাভাবিক হয়ে নিচে নেমে যায়। রুহির বিয়েটাও আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই মিটে যায়।
ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড**
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতেই ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। আর্শি আরিয়াকে উঠিয়ে নামাজ পড়ে আবার ঘুমায়।
সকালের নাস্তার পর আর্শি ওর মাকে জিজ্ঞাসা করো,
“মা, আরুর বিয়ের অনুষ্ঠানতো সাতদিন পর থেকে শুরু হবে?”
“হ্যাঁ। একদিন মেহেদী ফাংশন, তার পরদিন হলুদ। তারপর বিয়ে।”
“আরিয়ার জন্য সম্বন্ধ কে এনেছিল?”
“ঘটক এনেছিল। ছেলের ছবি দেখে আরিয়া বলেছিল, নাহিদকে নাকি আগেও একবার দেখেছে। সুন্দরবন ট্যুরে নাকি এই ছেলেই তোকে বাঁচিয়েছিল। খুব ভালো ছেলে। পরিবারও খুব ভালো।”
মিসেস আশালতা কথাগুলো বলতে বলতে মেয়ের দিকে তাকায়। আর্শি মুখে কৃতিম হাসি ফুটিয়ে বলে,
“আমি একটু আসছি।”
আর্শি উঠে রুমে চলে আসে। বিয়ের মাত্র কিছুদিন বাকি, এখন কী বলবে সবাইকে?
চলবে ইন শা আল্লাহ,