শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে পর্ব-৩৯

0
443

#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৯
প্রায় সপ্তাহখানেকের কিছু বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মিসেস আশালতা ও মিস্টার রিয়াজউদ্দীনও দেশে ফিরে এসেছেন। উনারা দেশে ফেরা মাত্রই আরিয়াও তার বাবার বাড়িতে চলে এসেছে। তার এখন ছয় মাস পেরিয়েছে। থার্ড ট্রাইমেস্টার শুরু হয়েছে। এই সময়ে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। তাছড়া ডাক্তার আরিয়াকে আরও সতর্ক তো থাকতেই বলেছে। তাইজন্য আরিয়া তার বাবার বাড়ি চলে এসেছে। ইদানীং মিসেস নেহাও কেমন রুক্ষ মেজাজে থাকেন। নাহিদকে ইটালি পু*লিশ বাংলাদেশের পু*লিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। তারপর সেখান থেকে মে*ন্টাল এসাইলেমে! আরিয়া বুঝতে পারে এক মায়ের মনের অবস্থা। শেষ বয়সে এসে একমাত্র আদরের ছেলের এমন অবস্থা কোনো মায়ের জন্যই সুখকর নয়। মুশফিকাও ওই বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বেশ কয়েকদিন হয়েছে।

আজ দুপুরের দিকে আরিয়া নামাজ শেষে বসে বসে কোরআন পড়ছিল তখন তার ফোন বেজে উঠে। আরিয়া কোরআনের আয়াত শেষ করে বন্ধ করে ফোন উঠায়। রিসিভ করতেই আশিকের ভীত ও উৎকণ্ঠিত স্বর ভেসে আসে,

“আরিয়া, খালামণি স্ট্রো*ক করেছে!”

কথাটা শোনামাত্রই আরিয়া চমকে উঠে। সে হড়বড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কী বলছো? কখন? এখন কোথায় খালামণি? হসপিটালে নিয়েছো?”

“খালু নিচ্ছেন। আমি হসপিটালের দিকেই যাচ্ছি। হঠাৎ নাকি জোহরের আজানের সময় মুখ বাঁকা হতে শুরু করে, তারপর চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলো। তখন খালু মসজিদে যাবেন তখন দেখে ফেলে জলদি ছুটে এসে ধরে ফেলেন।”

“তুমি জলদি যাও। আমিও আব্বুকে নিয়ে আসছি।”

“তুমি এই অবস্থায় এসো না। তোমাকে জানাতে মানা করেছিল খালু। আমিই টেনশনে বলে ফেলেছি। আমার খুব হাঁসফাস লাগছে। খুব ভয় হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু হারিয়ে যাবে!”

বলতে বলতেই আশিক ঢুকরে কেঁদে ফেলে। আরিয়া ফোনের ওপাশ থেকে কী বলবে বলার শব্দ পাচ্ছে না। মা-হারা একটা ছেলে তার দ্বিতীয় মা-কেও হারানোর ভয় পাচ্ছে তাতে কী-ইবা স্বান্ত্বনা দেওয়া যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আরিয়া ধরাস্বরে বলে,
“তুমি সাবধানে যাও। কিছু হবে না খালামণির। আমি আসছি। কাঁদবে না। কাঁদলে তোমাকে বোকা বোকা লাগে। একটুও ভালো লাগে না।”

মিসেস আশালতা মেয়েকে খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে জায়নামাজে বসে কাঁদতে দেখে বিচলিত হন। অতঃপর তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে আরিয়া সবটা বলে। মিসেস আশালতা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে মেয়েকে অল্প পরিমাণে খাবার জোড় করে খাইয়ে তারপর স্বামী, ছেলের বউ ও আরিয়াকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।

________

আর্শিরন গতকাল কানাডায় এসে পৌঁছেছিল। আর্শির ফ্রেন্ডরা হোটেলে উঠেছে। আসার পর খুব ক্লান্ত থাকায় আর্শি ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। আজ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে মৃদু ভোরের আলোয় তুষারে আবৃত দৃশ্য দেখছে। তার বরাবরই তুষারে আবৃত প্রকৃতি পছন্দ। কিছুক্ষণ একইভাবে উপভোগ করে বিছানার পাশে খুব সাবধানে ফ্লোরে বসে ঘুমন্ত শ্রাবণকে দেখছে। অপলক দৃষ্টিতে শ্রাবণকে দেখে যেন চোখের তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে! ঘুমালে একটা মানুষকে এতো সুন্দর লাগতে হবে কেন? আর্শি শ্রাবণের কপালের চুলগুলো খানিক সরিয়ে সেখানে ঠোঁ*ট ছুঁইয়ে দিলো। তাতে শ্রাবণ নড়েচড়ে উঠলোও বটে! এভাবেই প্রায় কিছুক্ষণ বসে থেকে নামাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে বিধায় শ্রাবণকে ডেকে তুলল। ঘুমের মাঝে শ্রাবণ শুধায়,

“কয়টা বাজে?”

“পাঁচটা।”

“নামাজের সময় আছে আরও। ঘুমাও।”

“না। উঠো। আমি একটু বেরোবো নামাজ পড়ে।”

শ্রাবণ এবার চোখ আধো মেলে চাইলো। অতঃপর বলল,
“বাহিরের টেম্পারেচার জানো? এতো ভোরে বেরোবে! ঘুমাও, বৃষ্টি।”

আর্শি খুব আবদারের সুরে বলল,
“একটু বেরোবো। উঠো না। প্লিজ। পাঁচ মিনিট বেরোবো। প্লিজ প্লিজ!”

শ্রাবণ করুণ মুখ করে তাকিয়ে থেকে ফের চোখ বুজে ফেলে। কিন্তু আর্শি তো ছেড়ে দেওয়ার মতলবে ডাকেনি! অবশেষে শ্রাবণকে উঠিয়েই ছাড়ে। তারপর দুজনে নামাজ পড়ে গরম কাপড়ে আপাদমস্তক মুড়িয়ে বের হয়। আর্শি মোটা গ্লাভস পড়া হাতে মাটি থেকে বরফ নিয়ে গোল গোল করে শ্রাবণের দিকে ঢি*ল ছুঁড়ছে। শ্রাবণ ছুটতে ছুটতে নিজেও আর্শির সাথে এই বরফ নিয়ে খেলায় মেতে উঠে।

________
ডাক্তার জানিয়েছেন, মিসেস নেহার শরীরের এক পাশ প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। মেজর স্ট্রোকই করেছেন। মিস্টার হাসান এটা শোনার পর বেশ ভেঙে পড়েছেন। তাকে আশিক সামলাচ্ছে। আরিয়া ও তার ভাবি পাশেই বসা। আশিক মিস্টার হাসানকে সামলালেও নিজেও বারবার অন্য হাতে চোখ মুছছে। এদিকে মুশফিকা দুপুরেই খবরটা আরিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরে সিলেট থেকে রওনা হয়েছে। এখানে এসে পৌঁছাতে রাত হবে। সন্ধ্যার আগে প্লেনের টিকেট পায়নি। তাই অফিসের গাড়িতেই রওনা করেছে।

মিস্টার হাসানকে জোড় করে কিছু খাইয়ে তার ঔষুধ গুলো খাওয়ায় আশিক। তারপর উনাকে রেস্ট করতে কেবিন বুক করে। আশিক করিডোরে এসে বসতেই আরিয়া তার পাশে বসে। দুজনেই নিরব। আশিক আরিয়ার কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে থাকে।

রাত নয়টার পর মুশফিকা হসপিটালে এসে পৌঁছায়। রাতে মিসেস নেহার কাছে মুশফিকা থাকবে। আর মিস্টার হাসানের কাছে আশিক থাকবে। আরিয়া মুশফিকাকে বলে,

“আপু, তুমি যে এসেছ দেখবে খালামণি জলদি সুস্থ হয়ে যাবে।”

মুশফিকা প্রত্যুত্তরে মলিন হাসে। কিছুক্ষণ পর আরিয়াকে নিয়ে মিসেস আশালতা ও রিয়াজউদ্দীন বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করেন।

________

কানাডায় দুপুর বারোটা। আর্শি ও শ্রাবণ লাঞ্চের জন্য বেরিয়েছে। আর্শির ফ্রেন্ডরা ও শ্রাবণের ফ্রেন্ড গ্রিণ ও ইরিনাও থাকবে। আজ প্রথমবার ইরিনার সাথে আর্শির দেখা হবে। শ্রাবণ নিজের চুল ঠিক করতে করতে বলে,

“তুমি ইরিনাকে কেন ইনবাইট করলে? ও-কে এসব নিয়ে আর ঘাটানোর কী দরকার? নিজের মতো থাকুক।”

আর্শি বলে,
“এমনিতেই এতো ধৈর্যবতী মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আমাদের সব থেকেও কোনো একটা কিছু হারাতে বসলে দুনিয়া এক করে দুঃখবিলাস করি। আর ও! কিছুই নেই! দুনিয়াকে নিজের বলতে কেউ নেই, তারপরও যাদেরকে আপন করতে চায় তাদেরকেই হারায়। কীভাবে সহ্য করে? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তার কথাতে কী তার জাগতিক না পাওয়া মিশে আছে? তা জানতে ও বুঝতে ইচ্ছে করছে।”

শ্রাবণ মৃদু হেসে বলে,
“তোমার এখন হাসি-খুশি মানুষ দেখা উচিত। তা না করে তুমি ব্রোকেন কাউকে দেখতে চাইছো? যদিও ইরিনা খুব স্ট্রং গার্ল। সে তোমাকে বুঝতেই দিবে না।”

আর্শি কিছু বলল না। এগিয়ে গিয়ে শ্রাবণের বাহু জড়িয়ে মাথা এলিয়ে রাখলো। দুজনের দৃষ্টি সম্মুখের আরশিতে নিজেদের প্রতিবিম্বতে স্থির। কিয়ৎ মুহূর্ত এভাবেই থেকে শ্রাবণ বুকে হাত দিয়ে বলে,
“আরশিতে আমার আর্শিকে এখন একটু হাসি-খুশি দেখা দরকার। নয়তো বুকের বা পাশে বেশ লাগছে!”

তৎক্ষণাৎ আর্শি হেসে ফেলে। অতঃপর দুজনের সম্মিলিত হাসি আরশিতে ধরা পড়ে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে