শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে পর্ব-০২

0
555

#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
আর্শি ও আরিয়াকে ওদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে নাহিদ আবার গাড়ি স্টার্ট করছিল তখন আরিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
“আপনি গাড়ি স্টার্ট করছেন কেন? বাড়ির ভিতরে যাবেন না?”

নাহিদ আর্শিকে একবার দেখে আরিয়ার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলে,
“তোমাকে বলেছিলাম তো আমার একটা কাজ আছে। আই অ্যাম অলরেডি লেইট।”

আরিয়া মন খারাপ করে বলে,
“ওহ আচ্ছা। তাহলে আর কী! যান।”

নাহিদ মুচকি হেসে বলে,
“দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইউ। এখন রেস্ট করো গিয়ে। বায়।”

আরিয়া মৃদু হাসলো। অতঃপর নাহিদ গাড়ি স্টার্ট করে চলে গেলো। পুরো বিষয়টা আর্শি দাঁড়িয়ে থেকেই দেখলো। যখন নাহিদ বললো, ‘দ্যাটস হোয়াই আই লাভ ইউ।’ তখন আর্শির মনে হলো নাহিদ কথাটা আর্শিকে নিচু দেখাতে বলেছে। কিন্তু আরিয়ার মুখের খুশির লাবণ্য দেখে আর্শি ভাবতে শুরু করেছে, তার ভুলটা ঠিক কোথায় ছিল? এই প্রশ্নের জবাব অন্তত সে ডিজার্ভ করে।
ভাবনার সুতো ছিঁ*ড়ে আরিয়ার ডাকে।

“কী হলো আপু? কি ভাবছো? ভেতরে চলো। মা-বাবা, ভাইয়া, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

আর্শি কৃতিম হাসে। দুই বোন বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই যেন এক আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর্শিকে নিয়ে নানান তোড়জোড় শুরু হলো। এরমধ্যে আরিয়া রাগ করে বলল,

“দেখে মনে হচ্ছে সাত দিন পর আপুর বিয়ে, আর আপু ঘর ছেড়ে যাচ্ছে!”

মিসেস আশালতা ও মিস্টার রিয়াজউদ্দীন, ছোটো মেয়ের কথা শুনে হেসে ফেললেন। মিসেস আশালতা বললেন,

“সাত দিন পর তুই তো ঘর ছেড়ে যাবি, আর আর্শি তো দেশ ছেড়ে যাবে আবার। আমাদের ছাড়া থাকা তো শিখে গেছে। এখন তো…”

বলতে বলতেই মিসেস আশালতার চোখ ভরে এলো, কণ্ঠ ধরে এলো। আরিয়া ও আর্শি উঠে মায়ের কাছে যায়। আর্শি মায়ের কাঁধে মাথা এলিয়ে মলিন কণ্ঠে বলে,

“প্লিজ মা, কেঁদো না। আর এক বছর পর তো আমি চলে আসব।”

আরিয়াও মায়ের আরেক কাঁধে মাথা এলিয়ে বলে,
“আমি তো মজা করে বলেছি। তুমি কষ্ট পেয়ো না তো। তুমি যদি এখনি এতো কান্না করো তাহলে আমার ও আপুর বিয়েতে তোমার চোখের পানি কম পড়ে যাবে না?”

মিসেস আশালতা কান্নারত অবস্থায় হেসে ফেলেন। ছোটো মেয়ের হাতে মৃদু চ**ড় মে**রে বলেন,
“ফা*জিল মেয়ে, সব জায়গায় তার হাসি-ঠাট্টা করতে হয়।”

“ওমা! আমি আবার কই হাসি-ঠাট্টা করি? তোমার বড়ো মেয়ের কাছে তো এসব বিষয়ে আমি চু*নোপুঁটি। আমি হলাম শান্তশিষ্ট, লাজুক স্বভাবের মেয়ে।”

“হয়েছে হয়েছে থাম। খেয়ে নাও এখন।

________

গভীর রাত। অন্ধকার পুরো শহর নিস্তব্ধ। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দ হচ্ছে। আর্শির রুমের শখের দেয়াল ঘড়িটা কিছুক্ষণ আগেই জানান দিলো তিনটা বেজেছে। প্রায় আধঘণ্টা যাবত ব্যালকনির ফ্লোরে বসে এক দৃষ্টিতে রাতের আকাশ দেখছে। মাঝেসাঝে আকাশে বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। এখন তো বৃষ্টির কোনো নির্দিষ্ট রুটিন নেই। শ্রাবণ মাস যে। হঠাৎই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। তুমুল বৃষ্টি। ব্যালকনির গ্রিল গ*লিয়ে বৃষ্টির তীব্র ছাঁট ব্যালকনির ফ্লোর অবধি ভিজিয়ে দিচ্ছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে আর্শিকেও। কিন্তু সবসময়ের মতো বৃষ্টি দেখে ছুটে ঘরে চলে যাওয়া মেয়েটা আজ এক চুলও নড়ছে না। ঠায় বসে আছে নিজের জায়গায়। যেন ফ্লোর ও আর্শির মধ্যে তীব্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করছে। আর্শি এখনও নিষ্পলক অম্বরপানে চেয়ে। তার নিষ্প্রাণ আঁখিযুগল তার রবের কাছে আর্জি জানাচ্ছে ‘আমার প্রাণোচ্ছলতা কেন হারিয়ে গেল?’। বৃষ্টিতে ও নেত্রজলে অক্ষিপল্লব ভিজে ভারী হয়ে আসছে। বৃষ্টিতে পুরোপুরি ভিজে এখন শীতে থরথর করে কাঁপছে আর্শি।

তীব্র বৃষ্টির শব্দ ও ঠান্ডা লাগার কারণে আরিয়ার ঘুম ভেঙে যায়। জলদি করে ফ্যান বন্ধ করে ব্যালকনির দিকে চেয়ে দেখে হাট করে দরজা খোলা। পাশে তার বোন নেই। আরিয়া প্রথমে বুঝতে পারলো না যে, তার বোন কোথায় গেছে। রুমের দরজা তো লাগানো। ভাবলো হয়তো বাথরুমে গেছে। কিন্তু তার মস্তিষ্কে এটা কোনো ভাবেই আসলো না যে তার বোন ব্যালকনিতে থাকতে পারে। আরিয়া উঠে বাথরুমের দিকে নজর গেলে দেখে বাথরুমের লাইট জ্বালানো থাকলে নিচ দিয়ে সামান্য রশ্নি বুঝা যায়, কিন্তু তা বুঝা যাচ্ছে না। তাহলে গেলো কোথায়? চিন্তায় পড়ে গেলো আরিয়া। সে এবার রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখলো রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ মানে বাহিরে যায়নি। কৌতুহলের বশে ব্যালকনিতে উুঁকি দিয়ে দেখে একদম ভিজে চুবচুবা হয়ে ব্যকলকনির ফ্লোরে বসে আছে আর্শি! আঁতকে উঠে আরিয়া। দ্রুত করে বোনের কাছে গিয়ে জোড় করে উঠিয়ে টেনে রুমে নিয়ে আসে। ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে গামছা নিয়ে নিজেই বোনের চুল ও হাত, ঘাড় মুছতে মুছতে বলে,

“তুমি কি পা*গল, আপু? এই গভীর রাতে বৃষ্টিতে ভিজছিলে?”

জবাব দেয় না আর্শি। আরিয়া ফের বলে,
“তুমি তো বৃষ্টি পছন্দ করো না। তোমার শরীরে বৃষ্টির এক ফোঁটা পড়লেও তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সেই তুমি বৃষ্টিতে ভিজছিলে? কী হয়েছে তোমার?”

“কিছু না।”

এই বলে আর্শি জামা-কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। প্রায় পনেরো মিনিট পর শাওয়ার নিয়ে বের হয়। বের হতেই আরিয়া তাকে চেপে ধরে,

“তুমি যাকে ভালোবাসতে, সেই লোকটা তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি এক মাসের ব্যাবধানে ইটালি চলে গেলে। তুমি চুপচাপও হয়ে গিয়েছিলে অনেক। কে ছিল লোকটা? তখন কতোবার তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, বলোনি। আজ তো বলো। কে ছিল লোকটা? যার জন্য তুমি এখনও কষ্ট পাও।”

“যেই ছিল সে আর নেই। সে এখন অন্যকাউকে ভালোবাসে।”

“নাম কি তার?”

“তার নাম জানার দরকার নেই। আমি তাকে আমার জীবনে ফিরে পেতেও চাই না। কোনোভাবেই না।”

আরিয়া কিয়ৎ মৌন রইলো। আর্শি ব্যাগ থেকে দুইটা প্যা*রাসি*টেমল বের করে খেয়ে নিলো। আরিয়া ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তাহলে ভিজছিলে কেন?”

আর্শি তাচ্ছিল্য হেসে জবাবে বলল,
“কেন? বৃষ্টিতে ভেজার জন্য কি ওই লোকটাকে ফিরে পেতে চাওয়ার কোনো কানেকশন আছে? আমি তো তা মনে করি না। সে যদি আমার পায়ের তলে ফুলের গালিচাও বিছিয়ে দেয়, আমি তাও তার জীবনে ফিরে যেতে চাইব না। আমার সেল্ফ রেসপেক্ট আছে অন্তত। সে শুধু আমার মনকে হার্ট করেনি, আমার সেল্ফ রেসপেক্টেও আ*ঘা*ত করেছে।”

“আপু…”

“ঘুমা, আরু। কথা বলিস না বেশি। আর সকালে যেন মা এই বিষয়ে না জানে। আব্বু-আম্মু, ভাইয়া কেউ জানেনা আমি কাউকে ভালোবাসতাম। আমি জানাতেও চাই না।”

কথাটা বলেই আর্শি বিছানার সাইডে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আরিয়াও লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়লো।

পুরোনো স্মৃতিগুচ্ছ আর্শির মনের দরজায় ভেসে উঠতে শুরু করলো। নাহিদের সাথে আর্শির পরিচয় সুন্দরবন ট্যুরে। আর্শির বন্ধুদের সাথে অনার্সের ফেয়ারওয়েল ট্যুর ছিল সুন্দরবন। সেখানেই নাহিদ তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ট্রিপে গিয়েছিল।

ফ্ল্যাশব্যাক,,
সুন্দরবনের জন্য খুলনা লঞ্চঘাট থেকে ছোটো লঞ্চে আর্শিরা উঠেছিল সেটাতে নাহিদরাও উঠেছিল। সেখানেই পরিচয়। লঞ্চ ছাড়ার পর আর্শি খোলা চুলে লঞ্চের সামনে ডেগে হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তখনি নাহিদের সাথে কথা শুরু। নাহিদ নিজ থেকে এসে বলে,

“আপনি পড়ে যেতে পারেন, মিস। মেয়েদের ব্যালেন্স কম হয়।”

আর্শি ভ্রুকুটি করে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
“সরি!”

“বললাম, আপনি পড়ে যেতে পারেন। ওখান থেকে চলে আসুন।”

কথাটা আর্শির পছন্দ হয়নি। তার চলে আসতে ইচ্ছে করলেও সে জেদ করে আরও কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর তার এক ফ্রেন্ড এসে ডেকে নিয়ে যায়। লঞ্চের ছাদে উঠার জন্য খাড়া, সরু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে আর্শি তার লম্বার গোল জামার সাথে পা বেজে পড়ে যেতে নিলে নিচ থেকে নাহিদ আর্শিকে ধরে ফেলে। তারপর বলে,,

“বলেছিলাম না? মেয়েদের ব্যালেন্স কম! পড়ে গেলেন তো। একটু কেয়ারফুল হোন।”

আর্শি তখন ঘাবড়ে ছিল। তাই নাহিদকে প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারেনি। আর্শির এক বান্ধবী এসে নাহিদকে ধন্যবাদ জানিয়ে ও-কে নিয়ে যায়। আর্শিদের গ্রুপে আর্শি সহ আট জন মেয়ে আর ৬ জন ছেলে। তারমধ্যে আবার একটা কাপল। যারা রিসেন্টলি বিয়ে করেছে। আর্শিকে ওর বান্ধবী নিতু বলে,

“দোস্ত, ছেলেটা কিন্তু খারাপ না। তুই যে আমাদেরকে এসে বলেছিলি ছেলেটা রুড। তেমন কিন্তু না। তুই ভাব শুধু, তুই যদি পড়ে যেতিস?”

আরেক বান্ধবী রুহি বলে,
“ঠিক বলেছিস নিতু। যদি পড়ে যেত তবে কুমিড় বুঝি ও-কে ছেড়ে দিতো? তারউপর সাঁতার জানেনা।”

আরেকজন বান্ধবী কলি বলে,
“দিতো দিতো। কুমিড়ের পেটে একটা পরী হজম হতো না!”

আর্শি কপট রেগে কলিকে দুই ঘা বসিয়ে দেয়। বন্ধুদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। আর্শি ভাবতে থাকে সে ছেলেটাকে সরি বলবে ও ধন্যবাদ জানাবে।

চলবে ইন শা আল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে