শ্রাবণ রাতের বৃষ্টিতে পর্ব-১০

0
507

#copyrightalert❌🚫
#শ্রাবণ_রাতের_বৃষ্টিতে
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১০
বাড়ি ফিরে নাহিদ এতো বড়ো শ*ক পাবে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। আরিয়া আশিকের হাত ধরে বধূবেশেই সোফায় বসে আছে। নাহিদ আরিয়াকে দেখে প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। সে একপ্রকার ছুটে এসে আরিয়ার পাশ থেকে আশিককে উঠিয়ে নিজে বসে। অতঃপর অস্থির স্বরে আরিয়ার হাত ধরে বলে,

“তুমি এখানে? এদিকে আমি তোমার ফোন বন্ধ পাচ্ছি। তোমার ভাইয়াও ফোন পিক করছে না।”

আরিয়া এক ঝা*ড়া দিয়ে নাহিদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো স্বরে বলে,
“আমার হাত ধরার আগে আপনি আমার থেকে পারমিশন নিয়েছেন?”

নাহিদ হতবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড আরিয়ার মুখের দিকে চেয়ে থেকে নিজেও উঠে দাঁড়ায়। তারপর অবাক কণ্ঠে শুধায়,
“তুমি এভাবে কেন বলছো? আজ আমাদের বিয়ে। সরি আমার লেট হওয়ার জন্য। একটা কাজে সিলেট গিয়েছিলাম। তারপর কীভাবে যে ঘুমিয়ে পড়েছি।”

“খুব ভালো করেছেন যে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কারণ আমি তো আপনাকে বিয়ে করতাম না। তাছাড়া অলরেডি আমার বিয়ে হয়েও গেছে।”

“মানে? তুমি আমায় বিয়ে করতে না মানে? আর তোমার বিয়ে হয়ে গেছে মানেটা কী?”

নাহিদের বিস্ময়ে বিমূঢ় মুখশ্রীকে আরো একটু আশ্চর্যজনক করতে আরিয়া নাহিদকে পাশ কাটিয়ে আশিকের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। অতঃপর আশিকের হাত ধরে মুচকি হেসে বলে,

“মিট উইথ মাই হাসবেন্ড, মিস্টার আশিক জামান।”

নাহিদ হতভম্ব হয়ে যায়। আরিয়া মুখাবয়বে হাসির রেখা ফুটিয়ে রেখেই আশিকের হাত ধরে আশিকের রুমের দিকে যেতে থাকে। আশিক পিছু ফিরে নাহিদের প্রতিক্রিয়া দেখছে সেই সাথে খানিক ভয়ও পাচ্ছে।
আরিয়া আশিককে নিয়ে নিজেদের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলে নাহিদের হুঁশ ফিরে। সে উ*ন্মাদের ন্যায় নিজের চুল টেনে সেদিকে যেতে নিলে মিস্টার হাসান আহমেদ তার হাত টেনে ধরেন। মিস্টার হাসান আহমেদ প্রশ্ন ছুঁড়েন,

“তুমি ওইদিকে কোথায় যাচ্ছ?”

নাহিদের অসহনশীল জবাব,
“তুমি দেখতে পাচ্ছ না? আমি কোথায় যাচ্ছি!”

মিস্টার হাসানের বুলিতে নমনীয়তা নেই। তিনি কঠোর স্বরে প্রত্যুত্তরে বলেন,
“দেখতে পাচ্ছি বলেই জিজ্ঞাসা করছি। ওদিকে কেন যাচ্ছ? ওরা এখন স্বামী-স্ত্রী। ওদের মাঝখানে ঝামেলা তৈরি করার চেষ্টাও করো না।”

নাহিদ চিৎকার করে র*ক্তবর্ণ চোখে চেয়ে বলল,
“কী-সের স্বামী-স্ত্রী? আরিয়ার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ও আমারই স্ত্রী হবে।”

মিস্টার হাসান তাচ্ছিল্য হেসে বলেন,
“তোমার কি মনে হয়, আরিয়ার সাথে আশিকের বিয়ের কারণ তুমি সময় মতো এসে পৌঁছাওনি। এই কারণ?”

বাবার কথায় নাহিদ সন্দিগ্ধ ও প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে চাইলো। মিস্টার হাসান হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের স্ত্রীর ছেলের জন্য অসহায় বনে যাওয়া মুখটা দেখে নিলেন। অতঃপর বললেন,
“আরিয়ার সাথে আশিকের বিয়ে হয়েছে আরো সপ্তাহ খানেক আগে। এবং সেটা আরিয়ার মর্জিতেই হয়েছে।”

“হোয়াট!”

“ইয়েস, এন্ড দ্যা রিজন বিহাইন্ড ইট ইজ অনলি ইউ। বিকজ অফ ইউর ডিড, আরিয়া গট ম্যারিড টু আশিক।”

নাহিদ ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। মিস্টার হাসান কিয়ৎক্ষণ ছেলের দিকে চেয়ে থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সেখান থেকে চলে যান। মিসেস নেহা ছেলের পাশে এসে বসেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে অসহায়, হতাশচিত্তে বলেন,

“দোষটা আসলে আমার! আমিই তোমাকে শিক্ষা দিতে পারিনি, মেয়েদেরকে কীভাবে সম্মান করতে হয়। আমার অতিরিক্ত আদর, যত্ন, ভালোবাসা তোমার মনে কবে যে নিজেকে নিয়ে উচ্চাভিলাষ, অহংকার তৈরি হয়েছে, বুঝতেই পারিনি। মা হয়ে নিজেকে নিজের কাছেই ছোটো লাগছে আমার। যখন তোমার করা কাজগুলো অন্যের মুখে ঘৃণাবাক্যে শুনেছি, তখন তোমার থেকে বেশি নিজেকে দোষী লাগছিল। একমাত্র ছেলে বলে কখোনো তোমাকে শা*সন করিনি। এখন মনে হচ্ছে, যখন ছোটোবেলায় তোমার নামে স্কুল থেকে কমপ্লেন আসতো, তখন যদি শা*সন করতাম। তাহলে আজকে এই দিন না তোমার দেখা লাগতো, আর না আমার দেখা লাগতো।”

এই বলে মিসেস নেহাও স্থান ত্যাগ করেন। নাহিদ একা সেখানে বসে রয়। তার মনের মধ্যে নিজেকে নিয়েই যু*-দ্ধ চলছে।

________

আরিয়া শাড়ি বদলে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে,
“আশিক, আমার এখন ভীষণ খিদে পেয়েছে। মনে হচ্ছে পেটের মধ্যে ইঁ*দুর দৌড়াচ্ছে!”

আশিক এতক্ষণ বিছানার কর্নারে থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বসেছিল। আরিয়ার কথা শুনে তাকিয়ে হালকা হেসে বলে,
“তোমার জন্য আগে থেকে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা আছে। তুমি যে ফুডি, সেটা তো আমি ভালো করেই জানি। তাই আমি খাবার আগে থেকেই এনে রেখেছি। জানতাম তুমি তখন না খেলেও এমন সময় ক্ষুধা লাগবে যখন তুমি কাউকে বলতেও পারবে না।”

আরিয়া ভীষণ খুশি হয়ে বলে,
“থ্যাংকিউ। থ্যাংকিউ সো মাচ। আসলে তখন খিদে বুঝতে পারিনি। এখন যখন রিল্যাক্স হয়েছি, জোড় খিদে পেয়েছে।”

“ওই যে আমার স্টাডি ডেস্কে খাবার রাখা আছে।”

আরিয়া এক প্রকার ছুটে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। তাড়াতাড়ি খাবারের ঢাকনা উঠিয়ে আশিককে জিজ্ঞাসা করলো,
“এখানে তো একজনের খাবার। তুমি খাবে না?”

“আমি খেয়েছি। তুমি খাও এখন।”

“ওকে। তাহলে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমিও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব।”

আশিক কোনো জবাব দিলো না। আরিয়াও খেতে শুরু করলো।

_________

মধ্যরাতে আননওন নাম্বারের কলে ঘুম ভেঙে যায় আর্শির। সেই সাথে বাহিরে ঝড়ো বৃষ্টি। ব্যালকনির দরজা খোলা থাকায় ঠান্ডা বাতাসও আসছে। আর্শি ঘুমঘুম চোখে ফোনের স্ক্রিণে দেখে। আননওন নাম্বার তাই কল কেটে ব্যালকনির দরজা লাগাতে ওঠে। দরজা লাগিয়ে আবার বিছানায় আসতেই, আবার একই নাম্বার থেকে কল। আর্শি ভ্রু কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে নিজে নিজেই বলে,

“কী রকম বেয়াদব! দেখছে কল কে*টে দেওয়া হয়েছে, তারপরও আবার কেন কল করে? এটা কোনো কল করার সময়? রাত বাজে আড়াইটা! এখন আননওন নাম্বার থেকে কল আসে। আ*জব কমনসেন্স মানুষের!”

এই বলে আবার কল কে*টে দেয়। নাম্বার ব্লকলিস্টে দিতে যাবে, তার জন্য ফোনের লক খুলতে সামান্য দেরি হয়েছে হাত ভিজা থাকার কারণে। এটুকু সময়ে আবার কল আসে একই নাম্বার থেকে! আর্শি নাম্বারটার দিকে কয়েক সেকেন্ড বিরক্তি নিয়ে চেয়ে থেকে কী ভেবে শেষ মূহুর্তে রিসিভ করে চুপ করে থাকে। অপরপাশ থেকেও নীরবতা কিন্তু ঝমঝম বৃষ্টির ধ্বনি আসছে সাথে গিটারের থেমে থেমে মৃদু ঝংকার। আর্শি প্রায় মিনিট খানেক কিছু না বলে ফোন কানে ধরে রেখেছে। এবার সে জিজ্ঞাসা করে,

“এই মাঝরাতে আপনি আমাকে গিটার আর বৃষ্টির শব্দ শোনাতে ফোন করেছেন? শুধুমাত্র ভাইয়ার বন্ধু বলে আপনাকে কিছু বলছি না।”

এবার অপরপাশ থেকে মৃদু হাসির ধ্বনি শোনা গেলো। শ্রাবণ হিমানো স্বরে শুধালো,
“বুঝলে কীভাবে?”

“গিটারের আপনার সবচেয়ে প্রিয় টোন হচ্ছে, ‘তুম পাস আয়ে’ এই গানের টোন। যতোবার আমাকে গিটার শোনাতে ফোন করেছেন বা শুনিয়েছেন, ততোবার একই টোন। তারউপর বৃষ্টি। তাছাড়া রাতজাগা আপনার স্বভাব। অন্য কোনো পা*গলের তো খেয়ে-দেয়ে কোনো কাজ নেই যে মধ্যরাতে একটা অচেনা মেয়েকে গিটার বাজিয়ে শোনাবে, তাও বৃষ্টির রাতে!”

শ্রাবণ মুচকি হাসে। কাউচে বসে থেকে অবিরত বর্ষণমুখর আঁধার অম্বরে দৃষ্টি স্থির রেখে বলে,
“চিনেছো তো। চার বছরেও আমার স্বভাব মানে তোমার ভাষায় বাজে স্বভাব যে ভুলোনি, এইতো অনেক। মানুষ চার দিনে ভুলে যায়!”

আর্শি বালিশ বেডের হেডবোর্ডে ঠেকিয়ে আরাম করে বসে। অতঃপর বলে,
“আচ্ছা, ভাইয়া কি জানে? আপনি তার বোনকে এই মধ্যরাতে বৃষ্টি আর গিটারের শব্দ শোনাতে ফোন করেন।”

“ও জেনে কী করবে?”

“তাইতো! ভাইয়া জানলে তো আপনার থো*তমা আ*স্ত থাকবে না!”

আর্শি রম্যস্বরে কথাটা বলে ঠিক কিন্তু পরক্ষণেই চিন্তা করে, সেও তো কখোনো তার ভাইকে বিষয়টা বলার চেষ্টা করেনি। তাহলে প্রশ্রয় কী সে দিয়েছে?
আর্শির হঠাৎ নিশ্চুপতায় শ্রাবণ বলতে শুরু করে,
“পাঁচ বছর আগে গিটারটা কিন্তু আমি তোমার জন্যই কিনেছিলাম। যখন তোমার মুখ থেকে শুনেছিলাম, তোমাদের ভার্সিটিতে প্রতি বৃহস্পতিবার তোমাদের ক্লাস শেষ হওয়ার পরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করো ছাদে একদল তরুণের গিটারে গান শোনার জন্য।”

আর্শি সম্বিতে ফেরে। ফিচলে হেসে বলে,
“তাই! দেখুন, ওরা আমার জুনিয়র ছিল। সিনিয়রদের গিটার শুনতে আমরা যেতাম না। তাহলে উনারা কী না কী ভেবে বসবে!”

শ্রাবণ ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলে,
“তোমার ছেলেদের প্রতি এই স্ট্রিক্ট পার্সোনালিটির ভরসাতে চার বছর দূরে ছিলাম। চার বছর তোমাকে বিরক্তও করিনি। দুইবার কল করেছিলাম, এক বার রিসিভ করেছ। আরেকবার কেটে দিয়েছো। অভিমান জমেছিল কিন্তু বিশ্বাস ছিল তুমি অন্যকারও মায়ায় তো জড়াবে না। কিন্তু!”

আর্শির চোখে-মুখের হাসি উবে গেলো। এই লোকটা তাকে পছন্দ করে তা সে কিছুটা বুঝতো। কিন্তু কিছু কারণে লোকটাকে দেখলেই রাগ লাগতো। তারপর চার বছরের দূরত্ব। বিষয়টা নিয়ে সে নিজেও ভাবেনি। ছেলেদের প্রতি স্ট্রিক্ট পার্সোনালিটি তো তার ছিলোই। কিন্তু ওই একটা ছেলের বাহিরের কেয়ারিং আবরণে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে সে আজ এই স্থানে। আর্শি নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলে,

“ওহ! তাহলে সব জেনে গিয়েছেন। আমার ভাগ্যে ছিল আমি এমন একটা ধাক্কা খাব, খেয়েছি। মানুষের স্ট্রিক্ট পার্সোনালিটিও কারও কারও মিথ্যা খোলসের কাছে হার মানে। সে আমাকে বলেনি সে আমায় ভালোবাসে। সে বলেছিল, আমি তার খুব ভালো বন্ধু। এমনটাই ভালো বন্ধু ছিল যে ২৪ ঘন্টায় আমি কী করছি না, করছি সবকিছুর কৈফিয়ত আমার তাকে দিতে হতো! আমি বুঝতে পারিনি যে এগুলো সে সব করছে আমার বোনের খবর জানতে! জানলে অন্তত এই মিথ্যে মায়া জড়াতাম না।”

থামলো আর্শি। শ্রাবণও অপরপাশ নিরুত্তর। বৃষ্টির তেজও খানিক কমে আসছে। দুই পাশে আবারও শিতল নীরবতা।আরো কিছুক্ষণ সময় এভাবেই বেরিয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটায় তিনটার ঘণ্টা বাজতেই নীরবতা ভেঙে শ্রাবণ বলে,

“ঘুমাও, বৃষ্টি।”

অতঃপর অপরপাশ থেকে কল কাটার শব্দে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে কান থেকে ফোন নামায়। পর্দার আড়াল থেকে বৃষ্টি ভেজা জানালার কাচে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বসা অবস্থাতেই চোখ বন্ধ করে রয়।

চলবে ইন শা আল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে