#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_এপ্রিল_২০২১
#গল্পের নামঃ- শোষণ
#লেখিকাঃ- ফারিয়া তাবাসসুম
#পোস্ট নংঃ- ১
বাজান? ও বাজান? বড়লোকগো খাওনের টেবিলে আপেল-কমলা থাহে, তাও তারা খায় না ক্যা?
– তাগো মুখে ওইগুলান বিস্বাদ ঠ্যাকে।
– কী কও তুমি? আপেল, কমলা বিস্বাদ ঠ্যাকবো ক্যান?
– তোর মুখে জৈষ্ঠ্যমাসে আমগো গাছের কাঁঠল বিস্বাদ লাগে না?
– সারাদিনই কাঁঠল খাইতে ভাল্লাগে কি? সকালে কাঁঠল, দুপুরে কাঁঠল। মা তো রাইতেও খাইতে কয়।
– বড়লোকগো কাছে আপেল, কমলাও ওমন। খাইতে খাইতে তাগো মুখে সবই কাঁঠলের মত লাগে।
আট বছর বয়সী গুলুর বাবার উত্তরটা মনে ধরে। সে সিনেমায় বহুবার দেখেছে খাওয়ার টেবিলে হরেক রকম ফল থাকলেও যারা খেতে বসে তারা না খেয়েই উঠে যায়। না খেয়ে উঠে যায় কেন গুলু তা বুঝে না। আরও কত কিছুই বুঝে উঠতে পারে না গুলু। বাবাকে প্রশ্ন করতে থাকে একের পর এক।
– বাজান? তারা যদি নাই খাইব তাইলে টেবিলে ওমন কইরা সাজাইয়া রাখে ক্যান? কত রকম মাছ, মাংসও তো থাহে!
ফজর আলী যে সবসময় গুলুর সবরকম প্রশ্নের যুতসই জবাব দিতে পারে, তা নয়। তখন ধমক দিয়ে বলে, বড় ত্যক্ত করস পোলা! চুপ কইরা না থাকলে কি মাছ আইব?
বর্ষার শুরুতেই জল ঢুকে তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ। নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওর ডুবে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ছোটো বড়ো নানা রকমের মাছ। গ্রামের কেউ কেউ ঠেলাজাল, বিটে, পলো, আন্টা নিয়ে এসেছে মাছ ধরতে। ফজর আলী এসেছে ধর্মজাল নিয়ে। টেংরা, পুটি যেমন ধরা পড়ছে তেমনি রুই, কাতলাও আটকা পড়ছে কারও কারও জালে। ফজর আলীর জালে এখনও বড় মাছ ধরা পড়েনি। বাড়ি থেকে জাল নিয়ে বের হওয়ার সময় গুলুকে নিয়ে একরকম পালিয়েই এসেছে সে। কেননা ছোটো ছেলে টুনু দেখে ফেললে তাকে রেখে আসার কোনো উপায় ছিল না।
টুনুর বয়স ছয়। পিঠাপিঠি এই দুই ভাই কেউ কাউকে ছাড়া বেশি সময় থাকতে পারে না। তবু মাছ ধরার লোভ সামলাতে না পেরে গুলু টুনুর মায়া ত্যাগ করেই বাবার পিছু নিয়েছে। গুলু ভালো করেই জানে ছোটোর জ্বর, মা তাকে কিছুতেই আসতে দিবে না। ফজর আলী মনে মনে স্ত্রী সালেহার কথা ভাবে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে টুনু গুলুর খোঁজ নিতে নিতে সালেহাকে অস্থির করে তুলেছে।
– বাজান? ও বাজান? মাছে পানির মইধ্যে ঘুমায় কেমনে? তাকাইয়া তাকাইয়া ঘুমায় কি?
ফজর আলী নিজেও জানে না, মাছ কিভাবে ঘুমায় কিংবা আদৌ ঘুমায় কিনা। গুলুর এতশত প্রশ্নের কী জবাব দিবে সে? তার জ্ঞানের পরিধি বড় সীমিত। আকাশের দিকে তাকায় ফজর আলী। মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে, যে কোন সময় শুরু হতে পারে বর্ষণ। গুলুকে বলে,
– তোরে যে কইলাম বৃষ্টি নামবার পারে। তাও আইলি। এহন নামলে কই যাবি? কই খাড়াবি?
– তুমি কই যাইবা?
– আমি ভিজলে সমস্যা নাই। তুই ভিজলে তো জ্বর আইবো।
গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে বাপের শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে গুলু। ফজর আলী কিছু দূরেই একটা ঝোঁপ থেকে মানকচুর পাতা কেটে এনে ছাতার মত করে পুত্রের মাথায় ধরে। বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে টুপটুপ বৃষ্টি পতনের ছন্দ গুলুর কাছে দারুণ এক ব্যাপার। এর মধ্যেই হঠাৎ হঠাৎ মাছ ধরতে আসা মানুষগুলো উল্লসিত হয়ে পড়ে, যে কারও জালে একটা বড় মাছ ধরা পড়লেই।
গুলু মনে মনে কথা গুছিয়ে রাখে। বাড়ি ফিরেই সে টুনুকে মাছ ধরার বিবরণ দিবে, বৃষ্টি শুরু হলে কী করলো সবাই, কার জালে কত বড় মাছ ধরা পড়লো, সেটা নিয়ে কেমন উৎফুল্ল হলো সবাই,
আরও কত কী! কিন্তু গুলুদের জালে একটা বড় মাছ ধরা না পড়লে গল্প কী ঠিক জমবে?
– বাজান? ও বাজান? একটা বড় মাছও কি আইবো না আমগো জালে?
এমন বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ওতটুকু ছেলের একটা বড় মাছের আকাঙ্ক্ষা পিতার বুকেও বিঁধে। একটা বড় মাছ তো আটকা পড়াই উচিত; সকলের জালেই ধরা পড়ছে। কিন্তু অদৃষ্ট কখনোই ফজর আলীর প্রতি সুবিচার করেনি। নিত্য অভাব অনটনের সংসারে ফজর আলীর উদ্বৃত্ত হয়নি কিছুই। কিছু জমাতে পারলেও সেই সম্বল কখনোই টিকেনি তার বরং নানা রকম বিপদ-আপদে জড়িয়ে সঞ্চয়টুকু হারিয়ে আরও বেশি দেনা হয়েছে সে। বছর দশেক আগে ভিটেমাটি পর্যন্ত এ গ্রামেরই তরফদার সাহেবের কাছে গচ্ছিত রেখে টাকা এনে অসুস্থ পিতার চিকিৎসা করেছিল ফজর আলী। তবু বাবাকে ফেরাতে পারেনি সে , আজ অবধি চক্রবৃদ্ধির সুদও!
প্রথম যৌবনে সালেহাকে বিয়ে করে আনার পর তবু হুটহাট দু একটা বড় মাছ কিনে আনার দুঃসাহস দেখিয়েছে সে। এখন আর পারে না। কত রকম হিসাব নিকাশ করে চলতে হয়। ছেলেরা বড় হচ্ছে, স্কুলের মাইনে, বই খাতা পত্র, ঋণের সুদ, চাল ডাল নুন তেল, একটা সংসারে কত কিছুই না লাগে! সামান্য কৃষিকাজে ক’টাকা আর আয় হয়? হিমশিম খেতে হয় ফজর আলীর।
সালেহার কথা বাদ দিলেও দুটো সন্তানের মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে না পারার দুঃখ ভেতরে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খায় তাকে।
– বাজান? ও বাজান? জাল তুলবা না?
সম্বিৎ ফিরে পায় ফজর আলী।
বৃষ্টি থেমে গেছে।
কাকভেজা হয়ে বাপ-বেটা দুজনেই বাড়ি ফেরার পথে আনন্দের সীমা নেই। মাছ ধরার শেষের দিকে এসে দুই হাত সাইজের একটা কাতল মাছ ধরা পড়েছে জালে। এত বড় সাইজের মাছ গুলু তার এই জীবনে আগে কখনও দেখেনি। তবে ওত সহজেই পাকড়াও করা যায়নি এ মাছ। মাছটা ধরার সময় মানকচুর পাতা কোথায় ভেসে গেছে সেদিকে খেয়াল ছিল না বাপবেটার। বাকিটা সময় দুজনেই ভিজেছে।
– বাজান? ও বাজান? মাছডা তাইলে টুনুর সমান অইব?
– বাড়ি যাইয়া টুনুর লগে মাপ দিয়া দেখিস।
– মাছডা তো তোমার কোমর ছোঁয় ছোঁয় বাজান।
– হ। কই থাইক্যা যে বানের জলে ভাইস্যা আইছে কেডায় জানে!
– বাজান, মাছের মুড়োডা কইলাম তাইলে আমি খামু?
– খাইস! খাইস!
পরক্ষণেই টুনুর কথা মনে পড়ে গুলুর। দীর্ঘ সময় অনুজকে না দেখতে পেয়ে মায়া হয় টুনুর প্রতি। এ সময়টায় কতই না ভাই ভাই করে খুঁজেছে টুনু! গুলুরও কম মনে পড়েনি ছোটো ভাইয়ের কথা। মাছটা ধরার সময় টুনু পাশে থাকলে কত আনন্দই না পেতো!
– বাজান মাছের মুড়োডা তো বড় অইবো অনেক?
না?
– হ, তা তো অইবোই।
-আধেকখান তাইলে টুনুকে দিবনি।
পুত্রের মুখের দিকে তাকায় ফজর আলী। পিতার এক জীবনে সন্তানদের নিকট এরচেয়ে বেশি আর কী বা চাওয়ার থাকে? খুশি মনে আবার হাঁটা শুরু করে সে।
গ্রামের পথ, বৃষ্টি শেষে কর্দমাক্ত পিচ্ছিল রাস্তায় গুলু পা ফেলে মেপে মেপে। তবুও পায়ে পায়ে তাল মেলায় বাবার সাথে। দ্রুত ফেরার তাড়া তারও। টুনুকে এই মাছ না দেখানো অবধি মনে স্বস্তি নেই এতখানি।
– বাজান, আমি আইছিলাম দেইখাই কিন্তু এত বড় মাছ আইছে জালে! তাই না বাজান?
– হ, রে বাপধন। আমার বাপধনের কপাল আছে। আমার মত না আমার বাপধনের….
কথা শেষ হয় না ফজর আলীর।
বিপরীত দিক তরফদার সাহেব তার সাত বছরের নাতনি সুইটিকে নিয়ে এইদিকেই আসে। দেখা হয় পথের ওপর। বৃষ্টি থেমে গেলেও তরফদার সাহেবের লাঠিয়াল জমশেদ ভূস্বামীর মাথা থেকে ছাতা নামায়নি এখনও। প্রথমেই মাছটা দেখে আশ্চর্যান্বিত হয় সুইটি।
– দাদু! দাদু! কত বড় মাছ!
আ্যঁ, সত্যিই তো! তরফদার সাহেব নিজেও কম অবাক হয় না। এত বড় মাছ সচরাচর চোখে পড়ে না। ফজর আলীকে জিজ্ঞেস করে,
– ফজর! কই থেকে ধরলা মাছটা?
এক মুহূর্তেই দমে যায় ফজর আলী। এত সাধের মাছটা হাতছাড়া হওয়ার শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মুখে কৃত্রিম হাসি এনে জবাব দেয় ফজর আলী,
– ভাটচান্দা বিলের কাছে থিইক্যা মাতবর সাব।
– ভাটচান্দা বিলে এত বড় মাছ? উঁহু! মাছটা মনে হয় অন্য কোন জায়গা থেকে বানের জলে ভাইসা আইছে।
– তাই অইব মাতবর সাব।
জমশেদের চাটুবৃত্তি স্বভাব। দীর্ঘদিন ধরে তরফদার সাহেবের লাঠিয়াল। কোন পরিস্থিতিতে কি করতে হয় খুব ভালো করেই জানে। জমশেদ বলে,
– মাতবর সাব। মাছডা মনে হয় আপামণির পছন্দ অইছে অনেক। ঢাকা থিইক্যা আইছে। শহর বন্দরে তো আর খাঁটি জিনিশ পাওন যায় না!
-আ্যঁ! কস তুই? ফজর এত কষ্ট কইরা ধরছে!
– আবার ধরবনি। কেবল বানের পানি আসা শুরু অইছে। ওর ছাওয়ালকে টেহা পয়সা দিয়া দেইন কিছু।
-আ্যাঁ! কস তুই?
তরফদার সাহেব তার পরনের গেরুয়া রঙের ফতুয়ার পকেট থেকে একশত টাকার দুইখানা নোট গুলুর হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলে, রাখো!ফজর আলীর উদ্দেশে বলে,
-তোমার পোলাকে কিছু কিনে দিও ফজর! পড়ালেখা করাইও ঠিকমতো। পড়ালেখা ছাড়া উপায় নাই। আর শোনো ফজর,সুদের টেকা তো বাকি পড়ছে মেলা। দিন কয়েক হইলো হিসাবের খাতা নিয়া বসি না। আইসো একসময়। ওত চাপ নাই তোমার জন্য, তুমি অইলা আমার আপনা লোক।
জমশেদ রে, নে তাইলে। মাছটা নিয়া আয়।
দাদুমণি খাইব আমার।
ফজর আলী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। তারপর চলা শুরু করে আবার। সামনের পথটুকু ঝাপসা মনে হয়। কিছুক্ষণ আগেও যে ফেরায় আনন্দ ছিল মুহূর্তেই সে উৎফুল্লতা হারিয়ে গিয়ে বাড়ির পথে পা যেন আর এগুতে চায় না কিছুতেই। পাশেই সমস্ত উত্তেজেনা বিসর্জন দিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে হেঁটে চলে ছোটো গুলুও। এই মুহূর্তে প্রিয় সন্তানের দিকে একটিবার তাকাবার মতো দুঃসাহসও হারিয়ে ফেলে পরাজিত, শোষিত, দলিত এক জনক। বোধকরি ওতটুকু শিশুও বাবার মনের অবস্থা উপলব্ধি করতে পারে। দীর্ঘ সময় নীরব থাকা জনকের হাতের আঙুল ছুঁয়ে কিছু একটা বলে নীরবতা ভাঙা উচিত ভেবেই বলে হয়তো,
-বাজান? তরফদার সাবরা তো ধনী মানুষ।
নিত্য দিন মাছ-মাংস খায়
তাদের মুখে বিস্বাদ ঠ্যাকে না কোনোদিন?