Monday, October 6, 2025







শেষ রাত পর্ব-৪+৫

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৪
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘কি হলো! এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন?’

আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম সামনের মানুষটার দিকে। অপরিচিত একটা মেয়েকে কত সুন্দর নির্দ্বিধায় ‘তুই’ সম্মোধন করে কথা বলছে। যেন আমি তার চিরচেনা খুবই কাছের একজন মানুষ। আমি এবার সত্যিই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। জানালা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে সূর্যের আলো এসে পরেছে তার গায়ে। হাল্কা ব্রাউন কালারের চোখ দুটো চিকচিক করছে আলোতে। অগোছালো চুল আর হাল্কা ভাজ পরা সাদা শার্টটে কি অদ্ভুতই না দেখাচ্ছে তাকে। গাল ভর্তি দাঁড়ি গুলোও একদম অবাঞ্চিত মনে হচ্ছে। যেন বহু অবহেলায় বেড়ে উঠেছে তারা। বেপরোয়া একজন মানুষ। এই মানুষটাকে আমি আগে কখনই দেখিনি। দেখেছি বলে মনেও পরছে না আমার।

‘তোকে কি এখন নিমন্ত্রণ দিতে হবে বসার জন্য! আম্মু তো আমাকে বলেনি একথা৷ আমার জানা থাকলে অবশ্যই একটা নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে আসতাম। এখন যেহেতু আনিনি তাই চুপচাপ বসে পর অনু।’

লোকটার কথায় বুঝলাম তিনিই ধ্রুব। আমার মনে থাকা ক্ষীণ সন্দেহ দূর হলো। আমি আমার হতচকিত ভাব কাটিয়ে উঠলাম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তার সামনের চেয়ারে বসলাম মূর্তির মতো। আমি বসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আবারও কথা বলা শুরু করলেন। কন্ঠে হতাশা প্রকাশ করে বললেন-

‘আমি লাস্ট তোকে দেখেছিলাম তখন তোর বয়স ছয় কিংবা সাত বছর ছিল। তবুও আমি তোকে দেখা মাত্রই চিনে ফেললাম। আর আমি তো তখন কত বড় ছিলাম তারপরও তুই আমাকে চিনতে পারলি না। এটা কেমন কথা!’

আমি সরু চোখে তার দিকে তাকালাম। বেশ স্বাভাবিক ভাবে নরম সুরে বললাম-

‘আপনার মুখভর্তি দাঁডি কিংবা এমন অগোছালো ভাব আগে ছিল না তো তাই চিনতে পারিনি। আর হ্যাঁ আপনি যে বার বার আমাকে ‘তুই’ সম্মোধন করছেন, এটা আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্যই করছেন। তা আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি।’

‘কিভাবে বুঝলি!’

আমি নিজেকে যথাসাধ্য গম্ভীর করে তুললাম। চাহনি তীক্ষ্ণ করে কড়া গলায় বললাম-

‘আপনার সাথে কোনো কালেই আমার এতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো না। যে এতদিন পর দেখা হওয়ায় এভাবে আন্তরিক ভঙ্গিতে কথা বলতে হবে। তাই দয়া করে আমার সাথে এভাবে কথা না বললেই আমি খুশি হবো।’

‘ওকে ওকে রেগে যেতে হবে না। আমি তো জাস্ট আপনার সাথে মজা করছিলাম। তবে আমি কিন্তু আগে আপনাকে তুই করেই বলতাম। তা হয়তো আপনার মনে নেই।’

ধ্রুবর কথায় আমি গম্ভীরমুখে বললাম-

‘ছোট ছিলাম তাই এসব মনে না থাকারই কথা।’

ধ্রুব নির্বিকার ভঙ্গিতে চেয়ারে গাঁ এলিয়ে দিলেন। ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে স্থির তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। কি দেখছেন এভাবে? যাকে বিয়ে করবে তার রূপ আছে কি-না! নাকি কোনো খুঁত খুঁজে বের করতে চাচ্ছেন! উনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন কোনো রূপবতী মেয়ে হবে ওনার বউ। ওনার জীবনসঙ্গী। তবে আমি সেই রূপবতী নই। এখন হয়তো আমার মতো শ্যামবর্ণা মেয়ে দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছেন। আফসোস হচ্ছে নিশ্চয়ই!!

‘এই যে সানসাইন! দয়া করে আপনার ঘড়িটা একটু খুলে রাখুন। রোদের আলো আপনার ঘড়িতে পরছে। আর সেখান থেকে তীর্যক রশ্মি এসে আমার চোখে পরছে। ঠিক মতো চোখে দেখতে পারছি না আমি।’

আমি নিঃশব্দে টেবিলের উপর থেকে হাত নিচে নামিয়ে ফেললাম। কথা বাড়ালাম না। ইচ্ছে করছে না কথা বলতে। মাথাটা বড্ড এলোমেলো লাগছে। সাদাফের কথা ওনাকে বলে দিতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। ওনাকে আগে থেকে সব বলে রাখাই হয়তো উচিত হবে।

‘শুনুন মিস, আমি সোজাসাপ্টা কথা বলার মানুষ। কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলা আমার স্বভাবের মধ্যে নেই। তাই আমি কিছু কথা বলছি মনোযোগ দিয়ে শুনুন।’

‘জ্বি বলুন আমি শুনছি।’

ধ্রুব সোজা হয়ে বসলেন। ওয়েটার এসে দু মগ ধোঁয়া ওঠানো কফি দিয়ে গেলেন। ধ্রুব কফির মগের দিকে তাকিয়ে খুবই সহজ গলায় বলতে লাগলেন-

‘এই মুহুর্তে বিয়ে করার কোনো ইচ্ছেই আমার ছিল না। কিন্তু আম্মু নিজে থেকেই সব কিছু ঠিক করেছে ফেলেছেন। আর ওনার অমতে যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব না। তাই বিয়েতে রাজি হয়েছি। আর তুলতুলের ব্যাপারটাও আমার মাথায় আছে।’

ধ্রুবর কথায় আমি কোনো প্রতিক্রিয়া করলাম না। ভ্রুক্ষেপহীন গলায় প্রশ্ন করলাম-

‘তো আমাকে কি করতে বলছেন?’

ধ্রুব একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। কপালে ভাজ পরেছে। চোখদুটো এখন আর চিকচিক করছে না আগের মতো। সূর্যের আলো এখন আর নেই। আমি এবার টেবিলের উপরে হাত তুলে রাখলাম। ধ্রব আবারও নির্লিপ্ততার সঙ্গে বললেন-

‘আমি স্বাধীন ভাবে চলার মানুষ। আমার দ্বারা বিয়ে নামক সম্পর্কের এত দায়বদ্ধতার মধ্যে থাকা অসম্ভব। এত এত দায়িত্ব কিংবা নিজের স্বাধীনতাকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া। কোনো কিছু করার আগে অন্য আরেকজনের পারমিশন নেওয়া৷ এটা করলাম কেন! ওটা করলাম কেন! এসবের কৈফিয়ত দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না৷ তাই আমি আগেই বলে রাখছি বিয়ের পর আমার উপর কোনো প্রকার জোর খাটাতে পারবেন না। আমি এটা পছন্দ করি না। আমি আমার মতো চলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি কি করবো না করবো তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে অন্য কারো অধিকার খাটানো সহ্য করবো না। এটা আপনি বিয়ের শর্ত হিসেবে ভাববেন না-কি অন্য কিছু তা আপনার ব্যাপার।

আমি মনে মনে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। আমার অবচেতন মন বলছে আমার সামনে সাদাফ বসে আছে। সাদাফের সেই হাসি হাসি মুখটা ভাসছে আমার চোখের সামনে। কিন্তু না আমার সচল মস্তিষ্ক ধ্রুবকে আবিষ্কার করলো আমার সামনে। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকা মানুষটা ঠিক যেন সাদাফের মতোই মুক্ত পাখির মতো থাকতে চায়৷ সাদাফের মতোই অন্যকারো কোনো কথা শুনবে না। নিজের মতো চলবে, ঘুরবে, খাবে সব করবে। তাকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও থাকবে না।
আমি মৃদু হেসে নরম গলায় বললাম-

‘কারও উপর অধিকার খাটানোর ইচ্ছে আমার নেই। আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি একমাত্র তুলতুলের জন্য আর মনি আন্টির কথা রাখার জন্য। আপনি কে! আপনি কি করেন বা ভবিষ্যতে কি করবেন এসব দেখার বিষয় আমার না।’

‘যাক তাহলে আর কোনো চিন্তা নেই। এবার নিশ্চিন্তে আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি। তবে এই শর্ত গুলো যেন সব সময় মনে থাকে। বিয়ের পর আবার প্যারাময় স্ত্রী হয়ে আমাকে প্যারা দেওয়ার কথা চিন্তা করবেন না।’

আমি হাল্কা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ধ্রুব আর কোনো কথা বললেন না। আমি বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শক্ত করলাম। নিম্ন স্বরে বললাম-

‘আমারও কিছু কথা বলার ছিল আপনাকে।’

ধ্রুবর নির্লিপ্ত চাহনি এবার আমার মাঝে নিবদ্ধ হলো। নিঃশব্দে চেয়ে রইলো মিনিট খানেক সময়। কফির মগ হাতে নিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘নিশ্চয়ই আপনার রিলেশন আর প্রেমিকের কথা তাই তো!’

বিস্ময়ে আমি হতবাক। অবাক দৃষ্টিতে ধ্রুবর দিকে তাকালাম। বুঝতে চেষ্টা করলাম তার ভাবাবেগ। তিনি আগে থেকে কিভাবে বুঝলেন আমি এসব বলতে চাই! উনি কি মানুষের মন পড়তে জানেন! নাকি আমার বিষয়ে আগে থেকে খোঁজ খবর নিতে এসেছেন! আমার মনে প্রশ্নের খেল চলছে। সেই খেলা থামিয়ে দিতে ধ্রুব শান্ত গলায় বললেন-

‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। আপনাকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে আপনি মানসিক চাপের মধ্যে আছেন। দুঃশ্চিন্তা অথবা নির্ঘুমে আপনার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেছে। আর চোখের অবস্থা না-ই বা বললাম। সবাই হয়তো ভাবছে বিয়ের চিন্তায় এমন হচ্ছে তাই কেউ কিছু বলছে না। তবে আমার মনে হচ্ছে এ বিয়ে নিয়ে আপনার এতটা মানসিক চাপ থাকার কথা না। বাকি আরেকটা কারণ থাকতে পারে তা হলো প্রেমিকের কথা। এখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার ধারনাটাই ঠিক।’

আমি ফুস করে শ্বাস ছাড়লাম। দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম তার থেকে। লোকটাকে বেপরোয়া মনে হলেও তিনি আসলে বেপরোয়া নন। হয়তো কিছু কিছু জিনিস খুব নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারেন। খুব মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন তার আশেপাশের সবটা। আর আমি না বললেও হয়তো তিনি সব বুঝে যেতেন।

‘হ্যাঁ আপনার ধারণাই ঠিক। আর আমি আমার অতীত লুকিয়ে রেখে আপনাকে অন্ধকারে রাখতে চাই না। আমি চাইনা পরে অন্য কারও কাছ থেকে এসব শুনে আপনার মনে হোক যে আমি আপনাকে ধোঁকা দিয়েছে, মিথ্যা বলেছি। তাই আমি আমার দিক থেকে সব কিছু ক্লিয়ার করতে চাই।’

ধ্রুব হাসলেন। খুবই সহজ সরল হাসি৷ কফির মগে চুমুক দিয়েই কপাল কুচকে ফেললেন। হয়তো কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। কফির তিক্ত স্বাদেই মুখ এমন বিকৃতি হয়েছে তার।পরক্ষণেই তিনি কফির মগ রেখে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললেন-

‘আপনার সাহস দেখে মুগ্ধ হলাম। তবে যাইহোক আপনার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। নিশ্চিন্তে থাকুন। তিনদিন পর বিয়ে তা নিয়ে চিন্তা করুন।’

আমি আর কিছু বললাম না। মিনিট পাঁচেক নিঃশব্দে কাটিয়ে দিলাম দুজনে। খানিকক্ষণ পর আমি ধ্রুবর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ধ্রুব ডাকলেন-

‘এই যে শুনুন!’

আমি ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ওনার দিকে। উনি বরাবরের মতোই সহজ গলায় বললেন-

‘আপনি একদম তুলতুলের মতো হয়েছেন। সরি মানে তুলতুল দেখতে আপনার মতো হয়েছে। তুলতুলের ঠোঁটের উপরেও আপনার মতো তিল আছে। যদিও তুলতুলের তিলটা ততটা-ও স্পষ্ট এখনও হয়নি তবে আমি খেয়াল করেছি। আর আমার কাছে ওই তিলটা খুব ভালো লাগে। তবে এখন আপনার থুতনির নিচের বড় তিলটা ভালো লাগছে। আই থিংক তুলতুলের থাকলেও ভালো লাগতো।’

আমি হতবিহ্বল চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলাম। এই লোক এতক্ষণ ধরে আমার মুখের তিল গুলো নিয়ে গবেষণা করেছে!! এইজন্যই কি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন! ওনার কথার প্রতিত্তোরে কি বলা উচিত তা আমার মস্তিষ্ক খুঁজে বের করতে পারলো না। মস্তিষ্ক ব্যর্থ হলো তার কথার জবাব দিতে। আমি মলিন হেসে পা বাড়ালাম রেস্টুরেন্টের সদর দরজার দিকে। পেছন ফিরে তাকালম না। ধ্রুবকে দেখ যতটুকু ধারণা হয়েছে তা অনুযায়ী ধ্রুবর কোনো মাথা ব্যথা নেই আমার নিঃশব্দে চলে আসা নিয়ে। ধ্রুবর গাঁ ছাড়া ভাব সাদাফের মতোই প্রখর। অবশেষে কি তাহলে সাদাফের মতো একজনকে আমার বিয়ে করতে হবে! আমি কি এটা মেনে নিতে পারবো! সারাজীবন কি তাহলে সাদাফের এই বেপরোয়া স্বভাবটা আমাকে ধ্রুবর মাঝে দেখতে হবে! যে স্বভাবের জন্য আমি আজ আমার সুখ হারিয়েছে, আমার ভালোবাসা হারিয়েছে। নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি সাদাফের অপেক্ষায়। আমি জানি সাদাফ আসবে না। তবুও ব্যর্থ অপেক্ষা করে নিজেকে স্বান্তনা দিচ্ছি। আমি জানি আমার বিয়ের আগে কিছুতেই আসবে না। আর আমিও পারবো না তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। সাদাফ হয়তো কোনো এক অচেনা দেশে ট্যুর দিয়ে বেড়াচ্ছে বন্ধুদের সাথে। বেপরোয়া ভাবে। মুক্ত পাখির মতো। তার চিন্তা নেই তার ভালোবাসা নিয়ে। তার অনুপাখিকে নিয়ে। সাদাফ এবার নিজের অজান্তে তার অনু পাখিকে হারিয়ে ফেলল। এই তিক্ত সত্যটা কি মানতে পারবে সাদাফ?

বর্তমান,

‘তুলতুলের আম্মু আপনি ঠিক আছেন তো! দরজাটা খুলুন।’

ধ্রুব কথা গুলো বলার সাথে সাথেই বারান্দার দরজায় আস্তে করে আঘাত করলেন। আমার ধ্যান ফিরলো। খানিকটা নেড়েচেড়ে বসলাম আমি। হাতের উল্টো পিঠে চোখের জল মুছে নিলাম। এখন আর নিজের মধ্যে কোনো প্রকার রাগের উপস্থিতি টের পেলাম না। সকল রাগ এখন মন খারাপে পরিনত হয়েছে।

‘আচ্ছা তুলতুলের আম্মু আমি সরি। আমার ভুল হয়েছে আপনার পারমিশন ছাড়া ডায়েরি ধরা। আমি আমার ভুল স্বীকার করছি। আপনি দয়া করে রুমে আসুন প্লিজ।’

আচমকাই খেয়াল করলাম ধ্রুব বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমাকে ‘তুলতুলের আম্মু’ বলে ডাকছে। অতিরিক্ত রাগের কারণে এতক্ষণ খেয়াল করিনি৷ কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে ডাকছেন কেন? আন্টির সামনে তুলতুলকে আমাদের মেয়ে বলে পরিচয় দিয়েছি তাই!!
আমি ডায়েরিটা সামনে নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে বারান্দার দরজা খুলে দিলাম। ধ্রুব হয়তো দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাই দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই ধ্রুব হুড়মুড়িয়ে আমার উপর এসে পরলো। আমি এক হাতে তার বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম-

‘কি করছেন কি! সোজা হয়ে দাঁড়ান।’

ধ্রুব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত গলায় বললেন-

‘সরি আসলে খেয়াল করিনি আপনি দরজা খুলে দিয়েছেন।’

ধ্রুব কিছুটা থেমে আবারও বললেন-

‘সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি তো। এবার আপনি হাত সরান আমার পারসোনাল বুক থেকে।’

ধ্রুবর কথা শুনতেই খেয়াল হলো আমার এক হাত এখনও তার বুকে রাখা। আমি চট করে হাত সরিয়ে ফেললাম। খানিকটা লজ্জাও পেলাম। তারচেয়েও বেশি বিস্মিত হলাম ওনার কথায়। পারসোনাল বুক মানে কি! এসব কি ধরনের উদ্ভব কথাবার্তা! আমাকে চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব শান্ত গলায় বললেন-

‘আমি সরি। আমার উচিত হয়নি আপনার পারসোনাল ডায়েরি পড়া। আর আপনার প্রাক্তনকে নিয়ে ওসব কথা বলাও ঠিক হয়নি। আমি সরি তুলতুলের আম্মু।’

আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওনার দিকে চেয়ে থেমে থেমে বললাম-

‘ইটস ওকে তুলতুলের আব্বু।’

আমি ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে রুমে আসলাম। পেছন থেকে ওনার মৃদু হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। আমিও স্মিত হাসলাম।

চলবে..

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তোর ফোন বন্ধ কেন অনু! খেয়াল কই থাকে তোর?’

আমি ভাইয়ার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে তুলতুলকে কোলে তুলে নিলাম। সাথে সাথেই মেয়েটা খিলখিল করে হাসতে লাগল। কত সুন্দর প্রাণবন্ত হাসি। ওর এই হাসি দেখেই যেন পুরো ধরনী প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। তবে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো তুলতুল কিছুটা আমার মতো দেখতে হয়েছে। ধ্রুবর কথা মতো তুলতুলের ঠোঁটের উপরের তিলটাও একদম আমার সাথে মিলে যায়। যে কেউ দেখলেই বিশ্বাস করে নিবে তুলতুল আমার মেয়ে। হ্যাঁ, আমারই তো মেয়ে৷

‘সানি তোকে কল দিয়েছিল৷ তোর ফোন বন্ধ পেয়ে আমার কাছে কল দিয়েছে। এই নে ফোন। কল দিয়ে এখন কথা বলে নে সানির সাথে।’

আমি হাত বাড়িয়ে ভাইয়ার কাছ থেকে ফোন নিয়ে বললাম-

‘তুই এখন যা। আমার কথা বলা শেষ হলে তোকে ফোন দিয়ে আসবো।’

‘এত তাড়া নেই। তোর যখন ইচ্ছে ফোন দিয়ে আসিস। এখন আমি যাই ফ্রেশ হয়ে আসি। ধ্রুব ভাইকে পাঠিয়ে দিস নাস্তার জন্য।’

ভাইয়া ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। আমি সেদিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে তুলতুলের উদ্দেশ্যে আদুরে গলায় বললাম-

‘তোমার ঘুম ভালো হয়েছে মামুনি?’

তুলতুল হাসতে হাসতে দুই হাতে একত্র করে তালি দিতে লাগলো। আমার গালে নাকমুখ লাগিয়ে ঘষতে ঘষতে পর পর কয়েকবার মাম্মা মাম্মা বলল। বেশির ভাগ ছোট বাচ্চারাই ঘুম থেকে উঠে সাধারণত কান্নাকাটি করে৷ কিন্তু তার ক্ষেত্রে ভিন্ন। তুলতুলের মেজাজ দেখাচ্ছে ফুরফুরে। আমি পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখলাম ধ্রুব ঘুম থেকে উঠে আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। তার শান্ত শীতল চাহনি আমার দিকেই স্থির। আমার চোখাচোখি হতেই তিনি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। অগোছালো চুল গুলো হাতের সাহায্যে পেছনে ঢেলে দিলেন যত্ন করে। বিছানা থেকে নেমে নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে গেলেন তিনি। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেললাম। তুলতুলকে কোলে নিয়েই বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ভাইয়ার ফোন দিয়েই কল দিলাম সানিয়াকে। এক বার রিং বাজতেই ফোন রিসিভ হলো।

‘হ্যালো অনু!’

‘হ্যাঁ শুনছি বল।’

সানিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে নিম্ন স্বরে প্রশ্ন করল-

‘কেমন আছিস অনু?’

সানিয়ার কথায় আমার ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে এলো। কিছুটা বিস্মিত হলাম মনে মনে। এই মেয়ে সাতসকালে ফোন দিয়েছে আমি কেমন আছি তা জানার জন্য? আমাদের দুজনের মধ্যে তো কখনই এমন ফর্মালিটি দেখানোর মতো সম্পর্ক ছিল না। কেমন আছি না আছি এসব অহেতুক প্রশ্ন করে কখনই সৌজন্যতা রক্ষা করিনি। আমাদের কথা শুরু হতো ঝগড়াঝাটি আর গা’লি দিয়ে। আমি সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন করলাম-

‘তুই সকাল সকাল ভাইয়ার ফোনে কল করেছিস আমি কেমন আছি তা জিজ্ঞেস করার জন্য?’

আমার প্রশ্নের প্রতিত্তোরে ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ভেসে আসলো। চুপ করে রইলো অপরপ্রান্তের মানুষটা। সানিয়ার নিশ্চুপ থাকা দেখে বুঝতে পারলাম ও কিছু একটা নিয়ে ইতস্তত বোধ করছে। আমার সাথে কিভাবে কথা বলবে তা নিয়ে ভাবছে। আমার সাথে কথা বলতে ওর এখন ভেবেচিন্তে বলতে হচ্ছে!! তবে কি আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে জড়তা এসেছে পরেছে! কোনো কারনে কি আমি দূরে সরে যাচ্ছি আমার আশেপাশের মানুষদের থেকে? সবার সাথে আমার সম্পর্ক পালটে যাচ্ছে!

‘তোর ফোন হয়তো অফ করে রেখেছিস। তোকে কল দিয়ে ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম তাই ভাইয়ার ফোনে কল দিয়েছি।’

সানিয়ার কথায় মনে পরল গত পাঁচ দিন যাবত আমার ফোন বন্ধ। সাদাফকে কল দিতে দিতে ক্লান্ত হয়েই ফোন অফ করেছি। খুব যত্ন করে আলমারিতে তালা দিয়ে রেখেছি। ফোনটা চোখের সামনে দেখলেই আমার মন অস্থির হয়ে ওঠে। বেহায়া হয়ে ওঠে আমার মন। নিরাশ হতে হবে জেনেও আমার এই বেহায়া মন বার বার সাদাফকে কল দিতে চায়। নিজের বেহায়া মনের প্রতি অসহ্য হয়েই ফোনকে বন্দী করে রেখেছি চোখের আড়াল করে। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে তুলতুলের দিকে চাইলাম। তুলতল আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললাম-

‘হ্যাঁ ফোন এখনও বন্ধ করে রেখেছি। এসব বাদ দিয়ে বল কল করেছিস কেন?’

‘তুই ঠিক আছিস তো অনু! সব কিছু জেনেও তোকে এই প্রশ্ন করাটা এক প্রকার বোকামি আমি জানি। তবুও জিজ্ঞেস করছি তুই কেমন আছিস?’

তুলতুল আমার কোল থেকে নেমে রুমে চলে গেল। আমি সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রেলিঙের উপর হাত রেখে অলস ভঙ্গিতে দাঁড়ালাম। দূর আকাশে আমার ক্লান্ত চাহনি স্থির করে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আমি ভালো আছি কি-না জানি না৷ তবে আমার উপর অনেক দায়িত্ব আছে এখন। দু পরিবারের সবাইকে ভালো রাখতে হবে৷ তুলতুলকে ভালো রাখতে হবে। তাদের জন্য হলেও আমার নিজেকে শক্ত করতে হবে সানি৷ তুলতুলের জন্য হলেও আমার বাঁচতে হবে।’

‘সাদাফ ভাই ফিরে আসলে কি হবে দোস্ত? ওনাকে শান্তশিষ্ট মানুষ দেখা যায় কিন্তু তোকে কি অন্যকারো পাশে দেখে ঠিক থাকতে পারবে?’

আমি কন্ঠে চাপা রাগ নিয়ে বললা-

‘সেটা ওর আগে ভাবার উচিত ছিলো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি ওর সাথে যোগাযোগ করার কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছি। সম্পর্ক কখনও একজনের প্রচেষ্টায় টিকে না। দু পক্ষ থেকেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। সাদাফের উড়নচণ্ডী স্বভাবের জন্যই আজ আমাদের এই পরিনতি। আমি এখন অন্য কারও কিন্তু এখনও এই খবর সাদাফ জানে না। ওর কি উচিত ছিল না আমার প্রতি আর এই সম্পর্কে প্রতি একটু দায়িত্ববান হওয়া!’

—————

‘সানি কে? তোমার প্রাক্তন না-কি অন্য কেউ?’

ধ্রুবর কথায় আমি সরু চোখে তাকালাম তার দিকে। তার কোলেই তুলতুল বসে আছে। আর তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে তুলতুলের চুলে জুটি বেধে দিচ্ছেন। তাদের দু’জনের দৃশ্যটা দেখে ভালো লাগলো। তবে ওনার প্রশ্নটা মাথা থেকে বের হলো না৷ আমি টেবিলের উপর ভাইয়ার ফোনটা রাখতে রাখতে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘বিয়েতে আমার পাশে যে মেয়েটা ছিল ওর নাম সানিয়া। আমি সানি বলে ডাকি।’

ধ্রুব মাথা তুলে পূর্নাঙ্গ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়। বরাবরের মতোই শান্ত শীতল চোখ তার। খানিকক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে ছোট করে ‘অহহ’ বলে আবারও ব্যস্ত হয়ে পরলেন তুলতুলের চুল বাধতে। আমি ধীর পায়ে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে আসলাম। ওনার পাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসে বললাম-

‘তুলতুলকে আমার কাছে দিন। আমি ওর চুল বেধে দিচ্ছি।’

ধ্রুব কপাল কুচকে তাকায়। চোখ ছোট ছোট করে সন্দিহান কন্ঠে বলে,

‘আপনার কি মনে হচ্ছে আমি ওর চুল বাধতে পারবো না!’

‘নাহ তা কেন মনে হবে! তুলতুল তো এতদিন আপনার কাছেই ছিল এসবে আপনি অভ্যস্ত হতেই পারেন। কিন্তু এখন তো আমি আছি তাই আমার কাছে দিন আমি ওর চুল বেধে দিচ্ছি। আপনি বরং এখন যান। সবাই হয়তো আপনার জন্য অপেক্ষা করছে নাস্তার টেবিলে।’

ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে তুলতুলকে আমার কলে দিয়ে দিলেন। আমার দিকে চেয়ে হাল্কা হেসে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

‘বউ পানির গ্লাসটা একটু দাও তো।’

ধ্রুবর কথায় আমি বিষম খেলাম। গলার মাধ্যেই খাবার আটকে গেল। আমি আড়চোখে আশেপাশে তাকাল। আম্মু তুলতুলকে খাওয়াচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। আব্বু আর ভাইয়াও দেখছি ঠোঁট চেপে হাসছে। লজ্জায় আমার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ধ্রুব আগের মতোই স্বাভাবিক। চোখের ইশারায় আবারও পানির গ্লাস চাইলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে ধ্রুবর দিকে পানির গ্লাস বাড়িয়ে দিলাম। তিনি গটগট করে পানি খেয়ে বেসিনে হাত তুলে চলে গেলেন। আর আমাকে ফেলে গেলেন লজ্জা আর অস্বস্তির বিশাল সমুদ্রে। আমি ঝটপট করে নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে চলে আসলাম। রুমে এসেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তখনই পেছন থেকে ধ্রুব শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললেন-

‘সরি তখন তুমি করে বলার জন্য। আমি চাই না আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে আশেপাশের মানুষ মন খারাপ করুক। তাই এখন থেকে তুমিও চেষ্টা করো সবার সামনে স্বাভাবিক বউদের মতো আচরণ করতে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। ধ্রুব এবার চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ডাকল,

‘শোনো বউ!’

ওনার ডাকে বিস্ময়ে আমার চোখজোড়া বড় বড় হলো। ধড়ফড়িয়ে উঠলো আমার বুক। আমার লজ্জা দেখেই হয়তো ধ্রুব ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতে অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘একটা কথা না বলে পারছি না। লজ্জা পেলে তোমাকে ভীষণ কিউট লাগে। তুলতুল একদম তোমার মতোই কিউট হয়েছে।’

কথাটা বলে উনি হাসতে হাসতেই রুম থেকে চলে গেলেন। আমি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম৷ আমার হতচকিত ভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। এই লোকটা ইচ্ছে করেই আমাকে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছেন। তার ভেতরের চঞ্চলতার রূপ এখন আস্তে আস্তে বের হতে লাগল।

ফাল্গুনের গোধূলি বিকেল। দুপুরের উত্তপ্ত সূর্যটা শান্ত হয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিম আকাশে ঢলে পরতে শুরু করেছে। প্রাণচঞ্চল শহরটাতে নেমেছে মানুষের হুল্লোড়। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে পার্কের সর্বত্র জুড়ে৷ চারপাশ মেতে উঠেছে তাদের প্রাণোচ্ছল হাসির শব্দে। পার্কের রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটছে কিছু লাজুক প্রেমিক-প্রেমিকা। বেঞ্চি গুলো দখল করে মধ্যবয়স্ক কিছু মানুষ কথার ঝুড়ি খুলেছে। এত হাসিঠাট্টার আর আনন্দমুখর পরিবেশে আমি হাঁটছি ভাবলেশহীন ভাবে। আমার পাশেই সানিয়া তুলতুলকে কোলে নিয়ে হাঁটছে। কিছুটা সামনে ভাইয়া আর ধ্রুব এটা ওটা নিয়ে কথা বলতে বলতে এগুচ্ছে। হাল্কা বাতাস এসে উড়িয়ে দিচ্ছে আমার উন্মুক্ত চুল। তা দেখেই তুলতুল একটু পর পর খিলখিল করে হেসে উঠছে। আমার চুলের প্রতি মেয়েটার ভীষণ ঝোঁক এসেছে। সব সময়ই আমার চুলের প্রতি তার আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই আমি থামকে দাঁড়ালাম। স্তম্ভিত হয়ে স্থির চেয়ে রইলো সামনের বেঞ্চিটার দিকে। এই বেঞ্চিতে বসেই সাদাফের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল৷ এখানেই সমাপ্তি হয়েছিলো সব কিছুর। এই জায়গাটা জুড়ে আছে আমাদের বিচ্ছেদের স্মৃতি। আমি আর হাঁটার মতো শক্তি পেলাম না। পুরো শরীরে নেমে আসলো অসাড়তা। আচমকাই তুলতুল চেচিয়ে উঠলো। পার্কের পাশের দাঁড়িয়ে থাকা ফেরিওয়ালার কাছে বেলুন দেখে অস্থির হয়ে একনাগাড়ে বলতে লাগল-

‘মাম্মা আমি চায়, আমি চায়…’

বেলুন চেয়ে বায়না করতে করতেই সানির কোল থেকে নেমে গেল। ছোট ছোট পদক্ষেপ ফেলে ছুটে যেতে লাগলো সেই দিকে। সানিও তুলতুলের পেছন পেছন যাচ্ছে। আমি আগের মতোই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। নির্বিকারভাবে দেখছি তুলতুলের বায়না করা। তুলতুল কিছুটা দূরে যেতেই দেখলাম ধ্রুবও সেদিকে যাচ্ছে। আমি স্থির তাকিয়ে রইলাম। আচমকাই আমার কাধে কারও হাতের স্পর্শ পেলাম৷ আমি ঘাড় বাকিয়ে পাশে তাকালাম। ভাইয়া উদাসীন ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। তার চোখদুটো যেন কিছু বলতে চাইছে। আমি মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। ভাইয়া আমার হাত ধরে সামনের সেই বেঞ্চিটাতে গিয়ে বসলেন। মিনিট খানেক সময় পাড় হলো নিরবতায়। অবশেষে ভাইয়া নিরবতা ভেঙে মলিন কন্ঠে বললো-

‘হাতে গুনে পুরোপুরি তিন বছর একদিনের বড় আমি তোর থেকে৷ তবুও সব সময় চেয়েছি তোর সাথে ফ্রেন্ডলি চলতে৷ হ্যাঁ আমি মানছি ছোট থেকেই আমরা অনেক ফ্রেন্ডলি ছিলাম। বড় ছোট ব্যাপারটা কখনোই আমাদের মাঝে ছিল না। কিন্তু তুই তোর জীবনের সব থেকে বড় কথাটাই আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলি। কি ভেবেছিলি তুই তোর ভাই বেপরোয়া! সারাক্ষণ তোর সাথে দুষ্টুমি করি, ঝগড়া করি, তোকে রাগাই। তাই বলে কি আমি আমার বোনের দিকে নজর রাখবো না! আমার বোন কি করছে না করছে তার খোঁজ খবর নিবো না!’

ভাইয়া থামলো। আমি আগের মতোই মাথা নিচু করে বসে আছি। ভাইয়া কি বলতে চাচ্ছে তা হয়তো আমার মস্তিষ্ক কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছে। ভাইয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় বলল-

‘আমি অনেক আগেই সাদাফের সঙ্গে তোকে এখানে বসে থাকতে দেখেছি। সেদিনই আমি ওই ছেলে সম্পর্কে সব খোঁজ খোঁজ খবর নিয়েছি৷ যতটুকু জেনেছি সাদাফ খুব ভালো ছেলে। তেমন কোনো বাজে স্বভাব কিংবা বাজে কোনো রেকর্ড নেই। তাই আমি তোর সাথে এই বিষয়ে কোনো প্রকার কথা বলিনি। আমি অপেক্ষা করছিলাম তুই নিজেই আমাকে সব কিছু বলবি সেদিনের। কিন্তু তার আগেই তোর বিয়ের কথা শুরু হলো। আর আমাকে অবাক করে দিয়ে তুই নিজেও বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি। আমি সানির কাছে থেকে সব জেনেছি। ও বলতে চাচ্ছিলো না। তবুও আমার জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না সাদাফের মতো শিক্ষিত মানুষ এতটা বেপরোয়া কিভাবে হয়। এত কিছু হয়ে গেল অথচ এখনও তার কোনো খোঁজ খবর নেই। যাইহোক সেই কথা। আমি জানি তুই এই বিয়েটা শুধু মাত্র তুলতুলের জন্য করেছিস। তবুও আমি চাই তুই সব কিছু ভুলে নতুন করে শুরু কর। ধ্রুব ভাই খুব ভালো একজন মানুষ। উনি তোকে ভালো রাখবেন নিশ্চিত। অতীত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর অনু।’

আমি মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলাম। ভাইয়া তো জানেই না ধ্রুব আর সাদাফ একই ধাঁচের মানুষ। যে কিনা বিয়ের আগেই আমাকে নানান রকম শর্তে বেধে দিয়েছেন সে কিভাবে আমাকে ভালো রাখবেন?

‘বাহ! দুলাভাইয়ের প্রশংসা হচ্ছে এখানে?’

সানিয়ার কন্ঠে আমি পেছন ফিরে চাইলাম। সানিয়া হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে ওর পাশেই ধ্রুব তুলতুলকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো।

চলবে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ