Monday, October 6, 2025







শেষ রাত পর্ব-৩৩

#শেষ_রাত
#পর্বঃ৩৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

মিথ্যে বলার সাথে এসবের কি সম্পর্ক?’

আমার করা প্রশ্নে ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। সকলের মন কেড়ে নেওয়ার মতো সুন্দর মুখখানায় সব সময়ের মতো তার সেই বিখ্যাত সরল হাসিটা আজ নেই। মুখশ্রীতে আঁধার নামানো দুঃখি দুঃখি চেহারা। উদাসীন ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ চুপ থেকে মলিন কন্ঠে শুধালেন,

‘লিনার ডিভোর্স হয়েছে কিছুদিন হলো। সে-রাতে ঢাকা থেকে অফিসে ফেরার পথেই লিনার সাথে দেখা। বাসার বাহিরে বসে কান্না করছিল। গাড়ি থেকে নেমে ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করার পর আমাকে সবটা খুলে বলে৷ বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই লিনার গায়ে হাত তোলা শুরু হয়। সেদিন রাতেও লিনার গায়ে হাত তুলেছিল। এমনকি ডিভোর্সের কথা বলে বাসা থেকে বের করে দেয় ওর হাসবেন্ড। আমি তখন কোনো উপায় না পেয়ে ওর হাসবেন্ডকে বুঝিয়ে লিনাকে সেই বাসায় রেখে আসি৷ আর ডিভোর্স দেওয়ার কথাও ফাইনাল হয় সেই রাতেই। বিয়ের পর অভাবের সংসারে ক্ষনিকের প্রেম ভালোবাসার মৃ’ত্যু হয়েছিল নিখুঁতভাবে,ধিরে ধিরে। তুলতুলকে যেদিন হসপিটাল থেকে বাসায় আনা হয়েছে সেদিনই লিনার ডিভোর্স হয়। আর ওর হাসবেন্ডের নামে নারী নির্যাতনের মামলাও করা হয়েছে। লিনা এসব ঝামেলায় জড়াতে না চাইলেও শেষমেশ আমার কথায় রাজি হয়। আর সেদিনই প্রথম আমি আপনাকে মিথ্যা বলেছিলাম যে আমি অফিসে আছি আর কাজের চাপ বেশি থাকায় তুলতুলের কাছে যেতে পারিনি। তুলতুল আপনার কাছে ভালো থাকবে কিন্তু লিনার পাশে ছিল না তাই নিশ্চিন্তে তুলতুলকে আপনার একার দায়িত্বে রেখে গেছি।’

আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম- ‘সেদিন-ই আমি আপনাদের দেখেছিলাম।’

‘দেখেছিলে!! তাহলে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো নি কেন? কোনো কিছু জানতে চাওনি কেন?’

ধ্রুব বেশ উৎকন্ঠিত হয়েই প্রশ্ন গুলো আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। আমি জবাব দিলাম না। ধ্রুবর প্রশ্ন গুলোকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পালটা প্রশ্ন করলাম,

‘এত কিছু হওয়ার পরেও উনি বাসায় ফিরে যায়নি কেন? আর আপনিই বা সবার কাছে এসব লুকিয়েছেন কি কারণে?’

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে রেলিঙের হেলান দিয়ে দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাঁজ করে দাঁড়ালেন। আমার দিকে চেয়ে বিষন্ন গলায় বললেন-

‘ওর পরিবারের কেউ বিয়েতে রাজি ছিল না। লিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ওর সাথে সবার যোগাযোগই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ তাই এত কিছুর পরেও বাসায় ফিরে যাওয়ার সাহস পায়নি। নিজের ভুল সিদ্ধানের জন্য লজ্জিত ছিল। আর আমি এসব লুকিয়েছে কারণ আমি লিনাকে কথা দিয়েছি এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলবো না৷ বিশেষ করে আম্মুকে।’

আমি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে তাকালাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আমার প্রশ্নাত্মক চাহনির মানে বুঝতে পেরে বললেন-

‘আম্মু লিনাকে অনেক বার বুঝিয়েছিল ছেলেটা ভালো না। কিন্তু লিনা মানতে নারাজ। এমনকি আম্মুর সাথে রাগারাগি করেছিল ওই ছেলের জন্য। তাই অপরাধ বোধের জন্য লিনা এখন আর আম্মুর সামনে আসতে চায় না। এই কারণেই তখন মার্কেট থেকে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছিল।’

‘হুম বুঝলাম। কিন্তু এখন উনি কোথায় থাকেন?’

‘এতদিন হোস্টেলে ছিল। তবে আজ ওকে নিপা আন্টির কাছে দিয়ে এসেছি। আন্টি এসব শুনে অনেকটা উত্তেজিত হয়ে পরেছিল। কিন্তু পরে নিজেকে সামলে নেয় আর লিনাকেও মেনে নিয়েছে। আর এসব ঝামেলা মেটাতে গিয়েই আমার এই নাজেহাল অবস্থা।’

ধ্রুব উদাসীন গলায় কথা গুলো বলেই ফুস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসলাম। ঠিক তখনই আমার অবচেতন মন বেশ ফুরফুরে মেজাজে আমাকে বলল- ‘আজ আমার মন ভালো। ভীষণ ভীষণ ভীষণ রকমের ভালো।’ হঠাৎ করেই মনে হতে লাগলো পৃথিবীটা খুব সুন্দর। আমি খুব সুখী মানুষ। আমার কোনো দুঃখ নেই। মন খারাপের কোনো কারণ নেই। ভেতরটা অদ্ভুত কারণেই সুখের সাগরের ভাসতে লাগল। আমি মুগ্ধ নয়নে তাকালাম আকাশের দিকে৷ মাথার উপরের এই বিশাল আকাশটা ধ্রুবর মতোই স্নিগ্ধ, শুদ্ধ, পবিত্র। এই বিশাল আকাশের মতোই ধ্রুবর আমার মনে খুব সাবধানে নিজের জন্য বিশাল এক জায়গায় তৈরি করে নিয়েছেন। আমার অজান্তেই আমি তাকে খুব খুব খুব বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি। অসময়ে ঠিক সঠিক মানুষটাকেই আমি ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি। আর সেই বিশ্বাস ধ্রুব খুব ভালো করেই রক্ষা করেছে। তিনি আমাকে ঠকায়নি, অযথা মিথ্যাও বলেনি। মিথ্যে বলার কিংবা সারাদিন ব্যস্ত থাকার অযুহাত দেখানোর যথেষ্ট কারণ ছিল ওনার। অন্যকে সাহায্য করতেই তিনি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। আমাকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে না।

‘আচ্ছা ওইটা কি ছিল?’

ধ্রুবর প্রশ্নে আমি ভাবনার দেয়ালে পেরিয়ে বাস্তবে এলাম। অনিচ্ছা স্বত্তেও কপালে মৃদু ভাঁজ পরলো। প্রশ্নের জবাবে পালটা প্রশ্ন করলাম আমি,

‘কোনটা কি ছিল?”

ধ্রুব নিজের গালে হাত দিয়ে শুকনো ঢোক গিললেন। আশ্চর্য! ওনার সারা মুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পরেছে। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা গোলাকার চাঁদটা এবার আস্তে আস্তে করে উঁকি দিতে লাগলো। জ্যোৎস্নার তীব্র আলোয় ঝলমলিয়ে উঠলো ধ্রুবর মুখ। আমি বুঝলাম ধ্রুব দুপুরের ঘটনাটা নিয়ে কথা বলতে চাইছেন। আর এই কারণেই তিনি লজ্জা পাচ্ছেন। কিছুটা সময় ইতস্তত করে বললেন-

‘ওই যে দুপুরে দিয়েছিলেন এখানে।’

ধ্রুবর কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভীষণ হাসি পেল। তবুই হাসিটা নিজের ভেতরেই চেপে রাখলাম। চোখেমুখে গাম্ভীর্যতা এনে ভারী গলায় বললাম-

‘কেন আপনি জানেন না কি ছিল?’

‘না মানে… হ্যাঁ জানি তবে ওটা কি সত্যি ছিল? কীভাবে কি হলো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।’

আমি ধ্রুবর একদম কাছে এগিয়ে গেলাম। খানিকটা উঁচু হয়ে ওনার বিস্ময় ভরা মুখখানার দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে শীতল কন্ঠে বললাম-

‘তাহলে কি বোঝার জন্য আবারও দিতে হবে ওটা!’

আমার কথা ধ্রুব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। কিছুটা পেছনে সরে গিয়ে হকচকিত অবস্থায় বললেন-

‘আপনার কি আজ কিছু হয়েছে? এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন? আগে তো এমন ছিলেন না।’

আমি মৃদু হাসলাম। মুখের হাসি ধরে রেখে বললাম-

‘কেন আপনি তো প্রতিদিন এমনই ব্যবহারই করেন। তাহলে আমি করলে কি অসুবিধে?’

‘আমি আর আপনি এক না। আপনি আমার বউ। আমি আমার বউয়ের সাথে এমন করতেই পারি না।’

ধ্রুব কথায় আমি ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললাম-

‘আপনিও আমার স্বামী। আমিও আমার স্বামীর এমন করতেই পারি। তবে আপনি যে এতটা লজ্জাশীল স্বামী তা আগে জানতাম না। ভালোই হলো জেনে নিলাম।’

আমি রুমের দিকে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে ধ্রুব হড়বড়িয়ে বললেন-

‘আমি মোটেও আপনার মতো লজ্জাবতী না। হঠাৎ করে আপনার এমন পরিবর্তনে কিছুটা না অনেকটা-ই বিস্মিত হয়েছি।’

আমি কিছু বললাম না। পেছন ফিরে ওনার দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

দেখতে দেখতেই ভাইয়ার বিয়ের দিন চলে এলো। বাড়ির প্রতিটি আনাচেকানাচে শুধুই উল্লাস। সবার হাসি মুখের উজ্জ্বলতায় ঝলমলিয়ে উঠে সারা বাড়ি। বেশ আনন্দ নিয়ে পরিবারের প্রতিটা মানুষ বিয়ের কাজ করছে। এতগুলো মেহমান আর বিয়ে বাড়ির ব্যস্ততায় ধ্রুবর দেখা পাওয়া মুশকিল হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বরযাত্রী বেরিয়ে পরবে কমিটি সেন্টারের উদ্দেশ্যে। ধ্রুব রেডি হয়েছে কি-না তা-ও আমার জানা নেই। সকাল থেকেই নানান কাজ নিয়ে এখানে ওখানে ছুটোছুটি করছেন তিনি। বাড়ির এক মাত্র জামাই বলে কথা। সব দায়িত্বই তিনি নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন। সবার প্রতি যত্নশীল হলেও নিজের বেলায় মানুষটা বড্ড বেখেয়ালি।

‘তুলতুলের আম্মু! যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। রেডি হয়েছেন আপনি?’

তুলতুলকে কোলে নিয়ে ধ্রুব রুমে ঢুকেলেন। তুলতুলের জামা ঠিক করতে করতে কথা বলেছেন তিনি। তুলতুলের জামা ঠিক করা হলে মাথা তুলে আমার দিকে চেয়েই অবাক হলেন। অবাক হয়েছি আমি নিজেও। তাদের দু’জনকে দেখেই আমি হতবাক হয়ে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। কাকতালীয় ভাবে আমাদের তিনজনের ড্রেসের কালারই এক রকম। ধ্রুবর গায়ে কালো শার্ট, কালো প্যান্ট এমনকি ব্লেজারটাও কালো রঙের৷ তারচেয়েও অবাক করার বিষয় হলো তুলতুলের ড্রেসও কালো রঙের। ধ্রুব কখন তার মার্কেট করেছে তা আমি জানি না। তবে তুলতুলের মার্কেট ভাইয়া আগেই করে রেখেছিল তবে আমাকে দেখায় নি। তাই তাদের মার্কেট সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।
ধ্রুব আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে অবাক কন্ঠে বললেন-

‘আপনিও আজ কালো শাড়ি পরেছেন?’

আমি নিজের হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম- ‘আব্বু পছন্দ করে কিনে দিয়েছে এই শাড়ি। কিন্তু আপনাদের টা কীভাবে?’

ধ্রুব অদ্ভুত ভাবে হাসলেন। ছাড়া ছাড়া গলায় বললেন-

‘কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে। তবে যাইহোক আপনাকে দেখতে মাশাআল্লাহ পুরো ধ্রুবর বউ লাগছে। আর তুলতুলকেও আপনার মতোই সুন্দর লাগছে।’

ধ্রুব প্রসংশায় শুনে আমি কপাল কুচকে ফেললাম। সরু সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব আমার দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বললেন-

‘আমি জানি আমাকেও সুন্দর লাগছে। তবে আমাকে দেখার আরও সময় আছে কিন্তু শাকিলের বিয়ের বেশি সময় নেই। তাই তাড়াতাড়ি আসুন। আমাদের যেতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে গাড়িতে।’

আমি তীক্ষ্ণ চোখে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। কিছু বলার আগেই ধ্রুর আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করলেন। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই কমিটি সেন্টারে পৌঁছে গেলাম৷ তার কিছুক্ষণ পরেই সানিয়া এসে উপস্থিত হলো আমাদের সামনে।

‘বাহ দোস্ত আজ তো তোদের পুরো ফাটাফাটি লাগছে। তিনজনেই তো একদম ম্যাচিং করে ড্রেস পরেছিস। বাই দ্যা রাস্তা তুই কবে থেকে ড্রেস ম্যাচিং করে পরা শিখলি! তোর ড্রেসিং সেন্স এমন তুখোড় হলো কি করে অনু?’

সানিয়া ভ্রু নাচিয়ে কথা গুলো বলেই তুলতুলকে কোলে তুলে নিলো। আমি ধ্রুবর দিকে আড় চোখে চাইলাম। ঠোঁটের কোণে তার সহজাত হাসি ঝুলিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘জানি না কীভাবে ম্যাচিং হয়েছে। আলাদা আলাদা-ই তো মার্কেট করা হয়েছিল।’

আমার কথায় সানিয়া দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল-

‘এটাকে-ই বলে ভালোবাসা। সত্যিকারের ভালোবাসা।’

‘এত বুদ্ধিমান শালি থাকতে আমার বউটা এখনও বোকা রয়ে গেল কিভাবে?’

ধ্রুবর প্রশ্নে সানিয়া সশব্দে হেসে ফেলল৷ রসিকতা করে বলল-

‘হয়তো আপনার অপেক্ষায় দুলাভাই।’

আমি জ্বলন্ত চোখে সানিয়ার দিকে তাকালাম। এটা আদোও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না-কি শত্রু! আমাকে খ্যাপানোর জন্য সব সময় হয়তো সুযোগের অপেক্ষায় হা করে বসেই থাকে। আমি রাগান্বিত হয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই ধ্রুব সানিয়ার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগল। বেশ কিছুটা সময় তাদের এই অহেতুক হাসি সহ্য করার পর হাল ছেড়ে দিলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বললাম-

‘হাসি থামাবেন নাকি মনি মা’কে বলতে হবে!’

ধ্রুব সঙ্গে সঙ্গেই তার হাসি গিলে ফেললেন। মুখ অন্ধকার করে মিনমিন করে বললেন-

‘আমার মেয়েটাও কিছু হলে এমন মা মা করে না যতটা তুমি করো।’

ঠিক তখনই তুলতুল স্পষ্ট গলায় পর পর কয়েকবার ‘ভালোবাসা’ শব্দটা উচ্চারণ করলো। তুলতুলের কথায় ধ্রুব আর সানিয়ার হাসির পরিমাণ কমার বদলে আরও দিগুণ বেড়ে গেল। ঝংকার তুলে হাসছেন তারা দু’জন। তাদের হাসি দেখে তুলতুলও উৎসাহ পেয়ে হাতে তালিয়ে অনবরত ভালোবাসা ভালোবাসা বলেই যাচ্ছে। আমি তীরের মতো তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করলাম ধ্রুব দিকে। ধ্রুব বুকে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে আর্তনাদ করে বললেন-

‘আহহ! আবারও বুকে যন্ত্রণা শুরু হলো।’

ধ্রুবর কথায় আমি কিছু বলবো তার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন সুরেলা কণ্ঠে ধ্রুবকে ডাকলো। এই কন্ঠ আমি এর আগেও শুনেছি। খুব পরিচিত না হলেও কন্ঠটা একদম মাথায় গেঁথে গেছে।

‘ধ্রুব! তুমি এখানে!’

আমরা সবাই কৌতুহল ঘেরা চোখে সামনের দিকে চাইলাম। লাল রঙের শাড়ি গায়ে জড়ানো লিনা দাঁড়িয়ে আছে ঠিক আমাদের দৃষ্টির সামনেই। ঠোঁটে সেই আগের মতোই মনকাড়া হাসি ঝুলানো। আমার মস্তিষ্ককে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো- লিনা এখানে কি করছে?

ধ্রুব অবাক কন্ঠে পালটা প্রশ্ন করলেন লিনাকে,

‘তুমি এখানে কীভাবে?’

‘তোমাকে বলেছিলাম তো আমার ফ্রেন্ডের বিয়ে। এখানেই তো ওর বিয়ে কিন্তু তোমরা!!’

লিনার জবাবে ধ্রুব দারুণ আগ্রহ নিয়ে শুধালেন- ‘এখানে তো শাকিলের বিয়ে তার মানে কি শাকিলের বউ মানে লাবিবা তোমার ফ্রেন্ড?’

লিনা দ্রুতগতিতে মাথা ঝাঁকালো। খানিক্ষন ধ্রুবর সাথে কুশল বিনিময় করে কারও একজনের ডাকে সেখান থেকে লিনা চলে যায়। আর ধ্রুব চলে যায় স্টেজে ভাইয়ার কাছে। আমি দূর থেকেই ধ্রুবর দিকে তাকিয়ে আছি। ভাইয়ার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন তিনি৷

‘অনু মেয়েটা কে ছিল রে?’

সানিয়ার প্রশ্নে আমি নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম- ‘ধ্রুবর কাজিন।’

সানিয়া কিছুটা সময় চুপ থেকে সন্দেহের গলায় বলল-

‘মেয়েটাকে আমার ঠিক সুবিধার মনে হলো না। তুই ধ্রুব ভাইয়ের সাথেই ছিলি অথচ তোকে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। আর একটু বেশিই হাসি হাসি মুখে কথা বলছিল ধ্রুব ভাইয়ের সঙ্গে। কেমন যেন আমার কাছে ভাল্লাগে নাই।’

আমি থমকে গেলাম। আমার নিজেরও ভালো লাগে না ধ্রুবর পাশে মেয়েটাকে দেখতে৷ অস্থির অস্থির লাগে। ঈর্ষান্বিত বোধ করি। বিনাকারণেই মেয়েটাকে অসহ্যকর মনে হয়। ধ্রুব থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সানির দিকে চাইলাম৷ নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে হাল্কা হেসে বললাম-

‘তুই একটু বেশিই ভাবছিস সানি। চল এখন তুলতুলকে কিছু খাওয়াতে হবে।’

সানিয়া আবারও কিছু বলতে চাইলো তবে আমি বলার সুযোগ দিলাম না৷ খুব সাবধানে এড়িয়ে গেলাম বিষয়টা।

চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমে আসতেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলো। বিদায় বেলা সকলের কান্নাকাটির পাঠ চুকিয়ে নতুন বউ নিয়ে উপস্তিত হলাম আমাদের বাসায়৷ নতুন বউয়ের সাথে সঙ্গী হয়ে এলো তার ছোট দুই ভাই-বোন আর লিনা। আনন্দমুখর পরিবেশেও কেন যেন কিছুটা সংকোচিত বোধ করছি। মনটা বিনা কারণেই অস্থির হয়ে উঠছে। বাসায় পৌঁছে হাসিঠাট্টা আর হৈ-হুল্লোড়ের কেটে গেল অনেকটা সময়। তুলতুল ঘুমিয়ে পরেছে সানিয়ার কাছেই। রাত প্রায় বারোটা। অনেকেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। আবার অনেকে এখনও আড্ডা দিচ্ছে। সানিয়ার রুম থেকে বেরিয়ে ধ্রুবকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আমি রান্নাঘরে এলাম। আম্মু আর মনি মা সব কিছু গুছিয়ে রাখছে। আমি তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘মনি মা উনি কোথায় দেখেছো?’

মনি মা ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে বললেন- ‘কার উনি!’

আমি কপাল কুচকে ফেললাম। এই সময় মনি মা আমার সাথে রসিকতা করছে! মা ছেলে সব একই রকম হয়েছে। আড় চোখে আম্মুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম আম্মু ঠোঁট চেপে হাসছে। আমি হতাশ গলায় বললাম-

‘আমার উনি। তুলতুলের আব্বু।’

মনি হাসতে হাসতে বললেন- ‘সবাই মিলে ছাদে আড্ডা দিবে শুনেছিলাম। গিয়ে দেখ ওখানে কি না।’

আমি বিনাবাক্য ব্যয়ে স্থান ত্যাগ করলাম। আম্মু আর মনি মা বান্ধবীর মতোই সব সময় এক সাথে জোড়া লেগে থাকে। না জানি কখন কি আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয় বিশ্বাস নেই। তার চেয়ে বরং এখানে চলে যাওয়াই ভালো। ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। আমি ওনাদের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলাম-

‘রাহাত ভাই আপনি কি তুলতুলের আব্বুকে দেখেছেন?’

রাহাত ভাই অলস ভঙ্গিতে সিড়ির শেষ ধাপে এসে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললেন-

‘আমাদের সাথেই তো ছাদে আড্ডা দিচ্ছিলো। নিচে এসেছে কিনা খেয়াল নেই। তুমি দাঁড়াও আমি দেখে আসি।’

‘নাহ নাহ.. আপনারা যান ঘুমিয়ে পরুন আমি দেখছি।’

রাহাত ভাই মাথা দুলিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন-

‘আচ্ছা ঠিক আছে। ভয় পেও না। পুরো ছাদ লাইটিং করা আছে।’

আমি হাল্কা হেসে চলে এলাম। ছাদের দরজার কাছে এসেই আমি থমকে গেলাম। বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম। অসহনীয় তীব্র ব্যথা। মুহুর্তেই এলোমেলো হয়ে গেল আমার সারা পৃথিবী। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বয়ে গেল ভয়ংকর রাগ। রাগ হলো ভীষণ রাগ৷ অতিরিক্ত রাগে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই৷ চোখদুটো ঝাপসা হয়ে এলো ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণের জন্য মস্তিষ্কটা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

চলবে…

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ