Monday, October 6, 2025







বাড়ি"ধারাবাহিক গল্প"শেষ রাতশেষ রাত পর্ব-২৭+২৮+২৯

শেষ রাত পর্ব-২৭+২৮+২৯

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৭
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

বিষন্নতার ধূসর বর্নের চাদরে মুড়ি দিয়েছে আজ আকাশ। রৌদ্র নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে সেই ধূসর বর্ন মেঘের আড়ালে। ভ্যাপসা গরমে ফুলে-ফেঁপে ওঠেছে সারা শহর। স্তব্ধ হয়ে আছে চারপাশ। দুপুরে শেষ সময়। রাস্তাঘাট তখন মানুষের কোলাহলে গমগমে অবস্থা। বিদঘুটে নিমপাতার মতো তিক্ত একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমি। নিজের অসহায়, ব্যর্থ জীবনটা কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি রাস্তায় রাস্তায়। এই মুহুর্তে আমার বেঁচে থাকাটাও মরে যাওয়ার চেয়ে কষ্টকর মনে হচ্ছে। মস্তিষ্কে যেন ভয়াবহ জ্যাম লেগেছে। কি করা উচিত আর কি করা উচিত না কিছুই মাথায় খেলছে না। মাথায় তখন একটাই চিন্তা ঘুরছে ধ্রুবকে সবটা জানাতে হবে। উনি একমাত্র ব্যক্তি যে সব কিছু চোখের পলকেই ঠিক করতে পারে। আলাদীনের জিনির মতোই তার জাদু দিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে পারে। খুব সুন্দর ভাবে ঠান্ডা মাথায় সব কিছু সামলে নিতে পারে। কিন্তু এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় তিক্ত ও বিষাক্ত সত্য হলো আমি তাকে কাছে পাচ্ছি না। বার বার ফোন করেও তাকে পাচ্ছি না। আমি একা পরে গেছি। ভীষণ একা। কোলে থাকা মেয়েটাকে ছটফট করতে দেখেই যেন বার বার ভয়ে আঁতকে উঠছি। রাস্তায় বের হতেই বুঝলাম আমি কখনও হসপিটালের ধারের কাছেও যাইনি। হসপিটালে যাওয়ার দরকার পরেনি কখনও। এরকম পরিস্থিতিতে নিজেকে আগে কখনোই আবিস্কার করিনি। আমি এদিক ওদিক ঘুরছি সাহায্য পাওয়ার আশায়। একটা ভরসার হাত পাওয়ার আশায় কিন্তু কাউকে পাচ্ছি না। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে অবশেষে নিজেকে নিজের ভেতরে শামুকের মতো গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। তবে আফসোস শামুকের খোলস হিসেবে ধ্রুবকে খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন নিজেকে লুকিয়ে নিতে চাইলে তার মাঝেই লুকিয়ে নিতে হবে। আমি শামুক হলে তিনি হবেন আমার খোলস। তবে তিনি কথা রাখেননি। কথা রাখতে পারেন না। কথা রাখতে জানেন না। সব চেয়ে বড় তিক্ত সত্য তাকে আমি কাছে পাচ্ছি না।
ধ্রুবকে ফোনে পেলাম না। তিনি ফোন ধরছেন না। বার বার রিং বেজে কেটে যাচ্ছে। আমি হতাশ হলাম। আর কোনো উপায় না পেয়ে ফোন রেখে দিলাম ব্যাগে। আশেপাশে তাকিয়ে তুলতুলকে নিয়ে উঠে পরলাম থেমে থাকা একটা বাসে। সিটে বসার কিছুক্ষণ পরেই তুলতুল আরেক দফায় বমি করলো। আবারও সেই ছটফটিয়ে ওঠা। আমার ধারণা নেই মেয়েটার কি হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে! মেয়েটার এমন অবস্থা দেখে চোখের জল ফেলা ছাড়া আমি আর কিছুই করতে পারছি না। আমি হয়তো ব্যর্থ একজন মা। যে কি-না নিজের সন্তানের কোনো সাহায্য করতে পারছে না।

‘কি হইছে মা কানতাছো কেন? মাইয়ার শইল ভালা না?’

পাশ থেকে এক মধ্যবয়স্কা মহিলার কন্ঠস্বর শুনে আমি ক্ষীণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালাম। পাশের জানালার সাথের সিটে বসা পাঁক ধরানো চুলের ফর্সা বর্ণের মহিলা। প্রশ্নোত্তর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি মুখে কোনো প্রকার শব্দ না করে ডানে বায়ে আস্তে করে মাথা নাড়লাম। তিনি একবার তুলতুলের দিকে চেয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে আমার পাশের সিটে এসে বসলেন। তুলতুলের শরীর থেকে জামা কাপড় সরিয়ে দিতে দিতে অধৈর্য্যে সঙ্গে বললেন-

‘মাইয়ার তো দেখি খিঁচুনি উঠছে। শইল ডাইক্কা রাখা যাইবো না। জ্বর তো অনেক বাড়ছে। জলদি জ্বর নামাইতে না পারলে অসুবিধা হইবো।’

আমি এক হাতে চোখের পানি মুছে ওনার দিকে পূর্নাঙ্গ দৃষ্টিতে তাকালাম। তিনি আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন-

‘প্রথম বাচ্চা! তোমার বয়সও বেশি মনে হইতাছে না। বাড়ির কাউরে সাথে আনো নাই ক্যান? একলা একলা এই বাচ্চা নিয়া সব সামলাইতে পারবা? বাচ্চার বাপেরে জানাইছো?’

আমি মাথা দুলিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম- ‘ফোন দিয়েছি তবে…’

আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। গলার স্বর জড়িয়ে গেল। তিনি হয়তো বুঝলেন আমার অসম্পূর্ণ কথার মানে। তুলতুলকে আমার কোল থেকে নিজের কাছে নিয়ে চিন্তিত গলায় বললেন-

‘অন্য কাউরে কল দিয়া জানাও। আর চিন্তা কইরো না আমার বাড়ি হাসপাতালের সামনেই।’

আমি ওনার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। কি সুন্দর করে তুলতুলকে আগলে রেখেছেন। একদম মনি মা’র মতোই। তিনিও হয়তো আমার মনি মা’র মতোই একজন মমতাময়ী। যে কি-না নির্দ্বিধায় অন্যের সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পরেন। আমি জোড়ালো শ্বাস ফেললাম৷ ফোন বের করে ভাইয়াকে কল দিলাম। পর পর দু’বার রিং বাজতেই ফোন রিসিভ হলো। পরমুহূর্তেই ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,

‘আমাকে কল দিয়েছিস কেন তুই? আমার কাছে তোর কি প্রয়োজন?’

ভাইয়ার অভিমানী গলা শুনে আমার ভেতরটা যেন দুমড়েমুচড়ে যেতে শুরু করলো। অন্য সময় হলে ভাইয়ার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে কিছু ঝাঁঝালো কথা শুনিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ আমার কান্না পাচ্ছে। নিজেকে একা পেয়ে ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অবশ্য ভাইয়ার অভিমান করাটা-ই স্বাভাবিক। বেশি কিছু তো চায়নি। পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় তার সাথেই আমাকে থাকতে হবে এইটুকুই তো আবদার করেছিল। কিন্তু আমি নানানরকম অযুহাত দেখিয়ে ভাইয়ার সাথে যাওয়ার বিষয়টা এড়িয়ে গেছি। বড় ভাইয়ের আবদারটুকু রাখতে না পারা ব্যর্থ বোন আমি। ভাইয়ার ধমকে আমি যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে জড়ানো কন্ঠে বললাম-

‘ভাইয়া! তুই একটু আসবি!’

‘কি হয়েছে অনু? তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? কান্না করছিস!’

ভাইয়া অস্থির হয়ে প্রশ্ন গুলো করলো আমাকে। ভাইয়ার প্রশ্নে যেন আমি এবার আরও ভেঙে পরলাম। কান্না করতে করতে ধরা গলায় বললাম-

‘তুলতুল খুব অসুস্থ ভাইয়া। কেউ নেই আমার সাথে। তুই কি মনি মা’কে নিয়ে একটু আসবি! আমার খুব ভয় করছে।’

‘কি হয়েছে তুলতুলের? ধ্রুব ভাইকে কল করিস নি? আর এখন তুই কোথায়?’

ধ্রুবর ভাই শুনেই অভিমানে ভার হয়ে এলো আমার হৃদয়। ওনার বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে গাঢ় স্বরে বললাম-

‘আমি পপুলার হসপিটালে যাচ্ছি। এখন বাসে আছি।’

ভাইয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন- ‘আচ্ছা তুই সাবধানে যা। আমরা আসছি। চিন্তা করিস না।’

এত গুলো মানুষের মাঝেও নিজেকে বড্ড একা একা লাগছে। ভাইয়া, আম্মু, মনি মা সবাই হন্তদন্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। তুলতুলকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে। খুব সম্ভবত তিন দিনের জন্য রাখা হয়েছে। জ্বরের সাথেই খিঁচুনি উঠছে। বমির সময় কিছুটা শ্বাসনালীতে ডুকে গেছে। যে কারণে তুলতুলের অবস্থা আরও খারাপ দিকে চলে গেছে। তবে ঠিক সময়ে জ্বর কমে যাওয়ায় কিছুটা আশংকা মুক্ত হয়েছে এখন। আমি মূর্তির মতো বসে আছি কেবিনের বাহিরে। খানিকটা সময় পর মনি মা এসে আমার পাশে বসলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন-

‘ভয় পেয়েছিলি তাই না অনু? চিন্তা করিস না পূর্নতার কিছু হয়নি। তুই সময় মতোই ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিস।’

‘আজ যদি ওর কিছু হয়ে যেত মনি মা তখন আমি কি করতাম! আমি ঠিক মতো তুলতুলের খেয়াল রাখতে পারিনি। আমার জন্যই ওর এমন হয়েছে। মা হিসেবে আমি ব্যর্থ মনি মা।’

কথাগুলো বলতে বলতে আমার গলার স্বর ধরে এলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরলো নোনাজল। মনি মা আমাকে নিজের বুকে আগলে নিলেন। পরম মমতায় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-

‘ধুর পাগলি মেয়ে। এসব কেন ভাবছিস? বাচ্চাদের এই বয়সে প্রায়শই খিঁচুনি হয় এটা তেমন কিছু না। আর তুই ঠিক মতো পূর্নতার খেয়াল রাখতে পেরেছিস বলেই তো ঠিক সময় হাসপাতালে নিয়ে এসেছিস। তাই এসব আজেবাজে চিন্তা করিস না।’

মনি মা তার শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছে দিয়ে বললেন-

‘চল তো এখন। তোর সাথের ওই আপা-টা ওনার বাসা থেকে রান্না করে নিয়ে এসেছে সবার জন্য।’

আমি অবাক চোখে চাইলাম। অচেনা একজন মানুষ দুপুর থেকেই আমার সাহায্যে উঠে পরে লেগেছেন। এই পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এসে তুলতুলের খবর জেনে গেছেন। আর এখন কি-না রান্নাও করে নিয়ে এসেছেন। আশেপাশে এখনও কিছু নিঃস্বার্থ মনের মানুষ আছে মনি মা’র মতো।

রাত প্রায় বারোটা। হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে ছুটে আসলেন আব্বু। কেবিনে ঢুকেই তুলতুলকে কিছুক্ষন দেখলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আমার দিকে চেয়ে নিম্ন স্বরে বললেন-

‘আমি তো কিছুই জানতাম না। বাসায় যাওয়ার পর তোর মনি মা আমাকে এসব কিছু বলল। তোরা কেউ আমাকে একটু জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?’

আব্বু মুখ অন্ধকার করে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম। আম্মু মনি মা’কে নিয়ে চলে গেছে ঘন্টা খানেক আগেই। এত চিন্তার মধ্যে আব্বুকে জানানোর কথা মনেই ছিল না। আমি আব্বুর দিকে চেয়ে বললাম-

‘তুলতুলের এমন অবস্থা দেখে চিন্তায় আর কিছুই মনে ছিল না আব্বু। তা ছাড়া আমি তোমার ছেলেকে হাজার বার কল দিয়েছিলাম কিন্তু উনি কল রিসিভ করেননি।’

নিস্তব্ধ থমথমে একটা পরিবেশ। পুরো কেবিন জুড়ে শুধুই নিরবতা। তুলতুল ঘুমাচ্ছে। বসে থেকে শরীর অসার হয়ে যাওয়ায় ভাইয়া কেবিনের বাহিরে হাঁটাহাঁটি করতে গেছে। আব্বু চলে গেছেন ঘন্টাখানেক হবে। ভাইয়া জোর করেই ওনাকে বাসায় পাঠিয়েছে। এত কিছুর মাঝেও ধ্রুবর দেখা মেলেনি। একটি বারের জন্যেও তার কল আসেনি। আব্বু বলেছেন ধ্রুব অফিসে কাজে কোথাও গেছে কিন্তু এখনও ফেরেনি। ফোনও না-কি অফিসেই রেখে গেছেন। তার ভাষ্যমতে ওনার ছেলে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় গাধা, বেপরোয়া। এরকম গাধা ছেলে জন্ম দিয়ে তিনি লজ্জিত। আফসোস ছাড়া এখন আর তার কিছুই করার নেই। এই বেপরোয়া ছেলে তার নিজের সন্তান এটা নাকি ভাবতেই তার আফসোস হয়।
শেষ রাত। আচমকা মৃদু শব্দ করেই কেবিনের দরজা খুলে গেল। আমি সোফায় বসে থেকেই নির্লিপ্ত চোখে দরজার দিকে তাকালাম। ভীষণ ক্লান্ত মুখ। এলোমেলো চুল। শরীরে লেপ্টে থাকা ঘামে ভেজা শার্ট। দুর্ধর্ষ শরীর নিয়ে একটি মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হলো আমাদের। চাপা রাগ আর অভিমানের ভীড়ে হারিয়ে গেল আমার লজ্জা মিশ্রিত সকল অনুভূতি। বোঝার চেষ্টা করলাম না তার চাহনির গভীরতা। পড়তে চাইলাম না তার চোখের ভাষা। তাকে বোঝার, তাকে জানার সকল আগ্রহ আমি হারিয়ে ফেললাম। অনুভূতিহীন আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই নিজের চোখ সরিয়ে নিলাম। ঠিক আগের মতোই বসে রইলাম। মানুষটা থমথমে পায়ে এগিয়ে গেল তুলতুলের বেডের কাছে। খানিকক্ষণ সেখানেই চুপচাপ বসে থাকলেন। মিনিট পাঁচেক পর নিঃশব্দে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ আমার দৃষ্টি আগের মতোই ধবধবে সাদা মেঝেতে স্থির রইলো। ওনার দিকে মুখ তুলে তাকানোর ইচ্ছে জাগলো না।

‘তুলতুলের আম্মু আপনি কি রেগে….’

আমি মুখ তুলে তাকাতেই ধ্রুবর কথা থেমে গেল। আহত চোখে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ফোন নিয়ে কল লিস্ট বের করে ওনার সামনে ধরলাম। অত্যন্ত শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলাম-

‘কয়বার কল করেছি?’

ধ্রুব আমার ফোনের স্ক্রিন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে ক্লান্ত চোখে চাইলেন। শুকনো ঠোঁট জোড়া নাড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন-

‘আসলে আমি ফোন অফিসে ফেলে রেখেই চলে গিয়েছিলাম। খেয়াল ছিল না।’

আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। হঠাৎ করেই কিছু তিক্ত অনুভূতি এসে বিষিয়ে দিলো আমার সারা শরীর। শরীরে প্রতিটি শিরায় শিরায় বয়ে গেল তিক্ততা। ভয়াবহ জেদ চেপে বসলো আমার সর্বাঙ্গে। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বয়ে গেল ভয়ংকর রাগ। হাতের ফোনটা সজোরে আছাড় মারলাম মেঝেতে। থরথর করেই কেঁপে উঠলো রাগে জ্বলে ওঠা আমার শরীর। কঠিন চোখে ওনার দিকে চেয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বললাম-

‘খেয়াল ছিল না আপনার? এক বার দু’বার নয় বহুবার কল দিয়েছি আমি৷ তুলতুলের এমন অবস্থা দেখে দিশেহারা হয়ে বার বার আপনাকে খুঁজে পেতে চেয়েছি। কিন্তু আপনার তো খেয়ালই ছিল না।’

ধ্রুব নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি এক পা এগিয়ে গেলাম ওনার দিকে। তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম-

‘খুব তো বড় বড় কথা বলতেন। আপনি সব সময় আমার পাশে থাকবেন। আমার চোখেরজল ফেলার জন্য আপনার বুক সব সময় আমার সামনে থাকবে। এটা করবেন ওটা করবেন। তাহলে আজ কোথায় ছিলেন? যখন আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল তখন কেন আমি আপনাকে পাইনি? পাগলের মতো কল করে গেছি আপনাকে। কি করবো, না করবো কিছুই মাথায় ছিল না। শুধু জানতাম আপনাকে আমার পাশে লাগবে। আপনি সব সামলে নিবেন। কিন্তু আপনি ছিলেন না। একা পরে গিয়েছিলাম আমি। ভীষণ একা। দিশেহারা হয়ে শুধু এদিক ওদিক ছুটেছি। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আমার কি হাল হয়েছিল আপনি ভাবতে পারছেন ধ্রুব? যদি মেয়েটাকে ঠিক মতো হাসপাতালে না আনতে পারতাম তখন কি হতো! কোনো ধারণা আছে আপনার? জানি কোনো ধারণা নেই আপনার। আমি কেমন ছিলাম! আমার কখন আপনাকে প্রয়োজন! কে কখন আপনাকে পাশে চায়! এসব নিয়ে আপনার কোনো ধারণা নেই। আপনিও বেপরোয়া। বেখেয়ালি। নির্বিকার একজন মানুষ। আপনিও আপনার ফ্রেন্ডের মতোই। নিজের বাহিরে অন্য কাউকে নিয়েই আপনাদের চিন্তা থাকে না। আপনারা শুধু নিজের মতোই চলতে পছন্দ করেন। শুধু মুখেই ভালোবাসি বলতে পারেন তবে ভালোবাসার যন্ত নিতে কিংবা আগলে রাখতে জানেন না আপনারা। আপনিও সাদাফের মতোই ধ্রুব। আপনারা সব এক।’

ক্লান্ত হয়েই আমার গলারস্বর মিলিয়ে গেল। চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। বলহীন সারা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব কঠিন মনে হলো।

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৮
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ধ্রুব? বলুন কি বলবেন!’

ধ্রুব আমার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলেন। আমার সকল প্রশ্ন, রাগ, অভিমান কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করেই আলতো করে জড়িয়ে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অত্যন্ত নরম গলায় বললেন-

‘শান্ত হও তুলতুলের আম্মু।’

আমি থমকে গেলাম ক্ষনিকের জন্য। মনে জমে থাকা সকল রাগ আপনাআপনি-ই ধীরে ধীরে মাটি হয়ে যেতে লাগল। নিজের অজান্তেই আমি শান্ত হয়ে গেলাম। একদম শান্ত। রাগ, অভিমান, জেদ সব কিছু হঠাৎই কিভাবে মিলিয়ে গেল, কিছুতেই বোধগম্য হলো না। ভীষণ ক্লান্ত হয়েই ধ্রুবর বুকে মাথা এলিয়ে দিলাম। সারাদিনের ক্লান্তি গ্লানিগুলো চোখেরজল হয়ে নিঃশব্দে বিসর্জন হতে লাগলো ওনার ঘামার্ত বুকে। ধ্রুব আগলে নিলেন আমাকে। ওনার স্পর্শে কোনো মিথ্যা স্বান্তনা কিংবা মিথ্যে আশ্বাস নেই৷ আছে শুধু ভরসা, বিশ্বাস আর……। আর কি? ভালোবাসা!! হয়তো তা-ই হবে।

‘আমি জানি তুমি অনেকটা রেগে আছো। তোমার রাগ করাটা-ই স্বাভাবিক। তবে আমি চাই না তুমি রাগের মাথায় এমন কিছু বলে ফেলো যার কারণে রাগ কমলে তুমি নিজেই তার জন্য অনুতপ্ত হও। হ্যাঁ, আমি সাদাফের মতো বেখেয়ালি, বেপরোয়া সেটা আমি মানছি। তবে আমি কখনও তোমাকে নিয়ে বেপরোয়া ছিলাম না। কখনোই আমার কাছের মানুষদের প্রতি বেখেয়ালি হইনি। আমি নিজেকে বদলে নিয়েছি। বদলাতে বাধ্য হয়েছি। তোমাকে ভালোবাসার পর নিজের বেপরোয়া স্বভাবটা নিজের মধ্যে পুষে রাখার দুঃসাহস আমি দেখাতে পারিনি। কারণ আমি ভয় পাই। তোমাকে হারানোর ভয় পাই। সেই ভয় থেকেই নিজেকে আমি গুছিয়ে নিয়েছি। বাউন্ডুলেপনা বাদ দিয়ে একজন দায়িত্বশীল জীবনসঙ্গী আর একজন ভালো বাবা হওয়ার চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত।’

ধ্রুব থামলেন। ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বললেন-

‘তবে আজ কোনো এক কারণেই হয়তো আমি বেপরোয়া হয়ে গেছি। তুলতুলের এই অবস্থায় পাশে থাকতে পারিনি। এটা আমার ভুল। অনেক বড় ভুল। আর এই ভুলের জন্য তোমার রাগ করাই উচিত। মা হয়ে সন্তানের এমন অবস্থা দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। শুধু তুমি একা নও সব মায়ের জন্যই সন্তানের অসুস্থতা তার উপর ভয়ংকরভাবে প্রভাব ফেলে। দিশেহারা হয়ে যায়। তুমিও স্বাভাবিকভাবেই ভয়ে, চিন্তায় সেই সময় আমাকে খুঁজেছো কিন্তু পাশে পাওনি। তবে আমি জানি তুলতুল তোমার কাছে ভালো থাকবে। তোমার কাছে থাকা অবস্থায় কখনোই তুলতুলের কিছু হবে না। যেকোনো মা-ই তার সর্বস্ব দিয়ে সন্তানকে রক্ষা করে আগলে রাখে। তাই আমি না থাকালে তুলতুলের কি হবে সেই ধারনা আমি নিজের মাঝে আনতে চাচ্ছে না। আমি জানি তুমি আমাকে বুঝবে।’

আমি বুঝলাম। ধ্রুবর বলা প্রতিটি কথাতেই নিজেকে নিরব আর হিমালয়ের মতোই শান্ত শীতল হিসেবেই আবিষ্কার করলাম। কান্না থেমে গেল। প্রায় প্রচন্ড ক্লান্ত হয়েই থেমে গেলাম আমি। সকল ভয়, চিন্তা নিমিষেই কেটে গেল ধ্রুবর কথায়। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ধ্রুব আমাকে ছেড়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। দু হাতে আমার মুখ মুছে চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে শান্ত গলায় বললেন-

‘এখন চলো একটু ঘুমাবে। না ঘুমিয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পরবে।’

আমি মুখ দিয়ে টু শব্দও বের করলাম না। ধ্রুব নিজেই আমাকে ধরে নিয়ে সোফায় বসালেন। আমার মাথা ওনার কাধে রেখে খুব যত্নের সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমি চুপ থাকলাম পুরোটা সময়। কিছু বলার মতো শক্তি কিংবা কথা কিছুই নিজের মাঝে খুঁজে পেলাম না। মিনিট খানেকের মাঝেই রাজ্যের ঘুম এসে আমার চোখে ধরা দিলো। শেষ রাতে এসে একজন ভরসার মানুষ আর ভরসায় জায়গা হিসেবে তার বুকে নিজের আশ্রয় পেয়ে নির্ভয়েই ঘুমে তলিয়ে গেলাম। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলাম আমি।

‘নাহ.. আমি ডক্টরের সাথে কথা বলেছি। তুলতুলকে আপাতত চার দিন জন্য তাদের অবসেরভেশনে-ই রাখবে।’

আমি পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালাম। চোখ মেলেই সামনে তুলতুলের পাশে ভাইয়াকে বসে থাকতে দেখলাম। বুঝলাম ভাইয়াই এতক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলেছে। আমাকে সজাগ হতে দেখেই ভাইয়া বলল-

‘কিরে, এতক্ষণে তোর ঘুম ভেঙেছে!’

কপাল কুচকে আমার চাহনি তীক্ষ্ণ হলো। ঘুম থেকে ওঠার পর মানুষের মস্তিষ্ক সচল হতে কিছুক্ষণ সময় লাগে। আমারও সময় লাগলো। চোখ থেকে পুরোপুরি ঘুমের ঘোর কেটে যেতেই নিজের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলাম। পুরুষালী গাঁয়ের তীব্র গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। ঘাড় বাঁকিয়ে আমার বাহুতে পুরুষালী শক্তপোক্ত হাত দেখতে পেলাম। এটা ধ্রুবর হাত। আমার বলহীন শরীর পুরোটাই লেপ্টে আছে তার সাথে। আচমকাই কানের কাছে তীব্র এক ভূমিকম্প অনুভূত হলো। খুব নিষ্ঠুর ভাবে কিছু একটা লাফাচ্ছে। তৎক্ষনাৎ আমার হুশ ফিরলো। ভীষণ লজ্জা আর অস্বস্তি নিয়েই ছিটকে দূরে সরে আসলাম সেই নিষ্ঠুর বুক থেকে। অবিন্যস্ত দৃষ্টিতে বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। লজ্জায় ভাইয়ার দিকে তাকানোর মতো সাহস নিজের মাঝে খুঁজে পেলাম না। ধ্রুব গলা খেকরিয়ে হাত পা ঝেড়ে সোজা হয়ে বসলেন। আমি আড় চোখে চাইলাম ওনার দিকে। বরাবরের মতোই শান্ত তার মুখ। ঠোঁটের কোণে স্বভাবগত সরল হাসি। দারুণ আগ্রহ নিয়ে তিনিও আমার দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হলো। আবারও আগের মতোই অনুভূতিরা এসে ঝাপটে ধরলো আমাকে। লজ্জায় দৃষ্টি সরিয়ে নিতেই ভাইয়ার মুখোমুখি হলাম। সরু চোখে আমার দিকে চেয়ে সহজ গলায় বলল-

‘এত লজ্জা পাচ্ছিস ক্যান তুই? নিজের জামাইয়ের বুকেই ঘুমিয়েছিস অন্য কেউ তো আর না।’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম। ছোট থেকেই ভাইয়া আমার সাথে খুব ফ্রী। সারাক্ষণ মা’রামা’রি ঝগড়াঝাটি এসব আমাদের মধ্যে লেগেই থাকে। কিন্তু তাই বলে ধ্রুবর সামনে এমন কথা বলবে? ছিঃ লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। আমি না-হয় ঘুমিয়ে ছিলাম কিন্তু ধ্রুব! উনিই বা কেমন মানুষ! ভাইয়ার সামনেও কি আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা লাগে! ছেলে মানুষ বলতেই নির্লজ্জ। লজ্জার ছিটেফোঁটা তাদের মাঝে নেই। না আছে আমার ভাইয়ের মাঝে। আর না আছে ধ্রুবর মাঝে।

‘থাক থাক ভাই তোর আর লজ্জা পাইতে হইবো না। তুই এখন ধ্রুব ভাইয়ের সাথে বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আয়। কাল থেকে খাওয়াদাওয়া না করে এখানে পরে আছিস।’

ভাইয়ার কথা শুনে আমি অস্থির হয়ে বললাম- ‘নাহ নাহ আমি তুলতুলকে এখানে একা রেখে যাবো না।’

‘এত বেশি কথা বলিস ক্যান তুই? তুলতুল একা কোথায় আমি তো আছিই এখানে আর মা-ও আসতাছে। আমাকে ফোন করছে বলছে এখন রাস্তায় আছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে।’

ভাইয়ার ভারী গলার স্বর শুনে আমি খানিকক্ষণ চুপ থেকে নিম্ন স্বরে বললাম- ‘কিন্তু ভাইয়া…’

আমার কথায় মাঝেই ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। শার্টের কলার ঠিক করতে করতে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন- ‘শাকিল ঠিকই বলেছে। এখানে সারাক্ষণ এভাবে না খেয়েদেয়ে বসে থাকলে তুমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পরবে। তখন তুলতুলের খেয়াল কে রাখবে? তাই কথা না বাড়িয়ে এখন আমার সাথে বাসায় চল।’

আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। ধ্রুবর দিকে মলিন মুখে চেয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম। আর কোনো বাক্যব্যয় না করে থমথমে পায়ে তুলতুলের কাছে আসলাম। ভাইয়া তুলতুলের পাশ থেকে উঠে অন্য পাশে যেয়ে দাঁড়ালো। আমি শান্ত চোখে তুলতুলের দিকে চাইলাম। মেয়েটার দিকে তাকাতেই বুকে মোচড় দিয়ে চিনচিনে ব্যথা শুরু হলো। একদিনেই কি হাল হয়েছে মেয়েটার। ঠোঁট মুখ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে মুখ। ঠোঁটের কোণের হাসিটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। সব সময় খিলখিল করে হাসিতে মেতে থাকা মেয়েটা হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে গেল। এই নিস্তব্ধতা, নিশ্চুপ থাকা মেনে নেওয়ার মতো না। কিছুতেই না। এই নিরবতা যন্ত্রণার। তীব্র যন্ত্রণা আর হাহাকারের৷ আমি আলতো করেই তুলতুলের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। ধ্রুব এসেও তুলতুলকে চুমু দিয়ে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলেন। সারা রাস্তা আমি আর কোনো কথা বলিনি। ধ্রুবও কিছু বললেন নি। নিরবতায় কেটেছে সারা পথ।

‘আপনি রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি অন্য রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

ধ্রুব এই কথা টুকু বলেই অন্য রুমে চলে গেলেন। আমি স্থির চেয়ে রইলাম তার যাওয়ার পথে। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম মনি মা অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে মনি মা’র এই চাহনির মানে খুঁজতে লাগলাম। পরক্ষণেই বুঝলাম ধ্রুবর আপনি সম্মোধন করা নিয়েই তিনি অবাক হয়েছেন। ধ্রুব হয়তো কোনো কিছু খেয়াল না করেই আমাকে আপনি সম্মোধন করেছেন। আমি ইতস্তত করে বললাম-

‘আমি রুমে যাচ্ছি মনি মা।’

মনি মা যন্ত্রের মতোই মাথা নাড়লেন। আমি আর কোনো কথা না বলেই দ্রুত রুমে চলে আসলাম। ওনার কৌতূহল মেটানোর কোনো উপায় আমার জানা নেই। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজেকে মনি মা’র কৌতুহলী চোখের আড়াল করতে চাইলাম।

ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হতেই ধ্রুবর মুখোমুখি হলাম। দরজার কাছেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। বিস্ময়ের চাহনি স্থির করলাম ধ্রুবর নির্লিপ্ত মুখে। আধ ভেজা চুল গুলো লেপ্টে আছে তার কুঞ্চিত কপালে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ধূসর রঙের শার্টের কিছু কিছু জায়গা ভিজে আছে। আমি দৃষ্টি নামিয়ে নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করে নিলাম। তপ্ত শ্বাস ওনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আমার হাতে টান পরলো। আমি চমকে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধ্রুব আমার হাত টান দিয়ে ঝড়ের বেগে রুমে এনে দরজা লাগিয়ে দিলেন। আমাকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন-

‘এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন আমাকে?’

আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ধ্রুবর এহেন কাজে। ধ্রুবর চোখে মুখে বিরক্তি রেশ। আমি শুকনো ঢোক গিলে মাথা নিচু করে চলে যেতে নিলেই ধ্রুব আমার হাত চেপে ধরলেন। অন্য হাতে আমার মাথা তুলে খানিকটা ঝুঁকে এলেন আমার মুখের দিকে। খানিকক্ষণ স্থির চেয়ে থেকে চাপা কন্ঠে বললেন-

‘এখনও রেগে আছেন আমার উপর? আমি তো সব কিছুই খুলে বলেছি।’

আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। অস্বস্তিতে দম আটকে আসার উপক্রম হলো আমার। ধ্রুব নড়ছেন না। আগের মতোই এক দৃষ্টিতে ভ্রু কুচকে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। আবারও বললেন-

‘আচ্ছা রাগ থাকলে সেটা প্রকাশ করুন। বকা দিন, ধমক দিন। দরকার পরলে আমার গালে কয়েকটা চড় বসিয়ে দিন। তবুও এভাবে চুপচাপ থেকে আমাকে এড়িয়ে যাবেন না। দিন দিন এই গালেই একটা চড় দিয়ে নিজের রাগ মিটিয়ে নিন।’

ধ্রুব সত্যি সত্যিই তার ডান গাল আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমার বিস্ফোরিত চোখজোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। লোকটা কি পাগল না-কি! এসব কি ধরনের অদ্ভুত কথাবার্তা! নির্ঘাত মাথায় সমস্যা টমস্যা আছে। তা নাহলে কেউ কি নিজের বউকে এই কথা বলে? বউয়ের হাতে চড় খাওয়ার এতটাই শখ ওনার? আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ডান হাতে ওনার গাল সরিয়ে দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললাম-

‘আমি এখনও আপনার উপর রেগে নেই। আসলে কালকের কথা গুলোর জন্য আমি সরি। তুলতুলের ওমন অবস্থা দেখে মাথা ঠিক ছিল না। তাই রাগের বশে আপনাকে যা-তা বলে ফেলেছি। আর এই কারণেই কিছুটা লজ্জিত বোধ করছি বলে কথা বলতে পারছিলাম না। সরি আমার কালকে ওভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি।’

আমার কথা শেষ হতেই ধ্রুব অবাক চোখে আমার দিকে চাইলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকেই ঠোঁট প্রসারিত করে মনকাড়া একটা স্নিগ্ধ হাসি দিলেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ টেনেই মধুর কন্ঠে বললেন-

‘তাহলে একটা চুমু দাও।’

আমি চোখ বড় বড় করেই চাইলাম। ওনাকে ধাক্কা দিয়ে সরে যেতে চাইলেও পারলাম না। তিনি ঠিক আগের মতোই আমাকে ধরে রাখলেন। বাঁকা হেসে বললেন-

‘থাক তোমার কষ্ট করতে হবে না। আমি নিজেই নিয়ে নিচ্ছি।’

ধ্রুব ঝুঁকে তার মুখ এগিয়ে নিয়ে আসতে লাগলেন আমাত দিকে। আমি মূর্তির মতো জমে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুক ধড়ফড় করছে আমার। এখনই বুঝি বুক চিড়ে বেরিয়ে আসবে হৃদপিণ্ড। আচমকাই ধ্রুবর ফোন বেজে উঠল। ভীষণ বিরক্ত হয়েই তিনি সরে গেলেন। পকেট থেকে ফোন বের করে হতাশ চোখে তাকিয়ে থেকে রিসিভ করলেন। কি কথা হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিনি শুধু বললেন ‘আচ্ছা আমি আসছি।’ ধ্রুব ফোন কানে রেখেই আমার দিকে চাইলেন। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন-

‘আমার একটু জরুরি কাজে যেতে হবে। তুমি আম্মু আব্বুর সাথে তুলতুলের কাছে চলে যেও।’

আমার কথার কোনো অপেক্ষা না করেই ধ্রুব দরজা খুলে হনহনিয়ে চলে গেলেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম। ড্রয়িং রুমে আসতেই আব্বুর প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম।

‘কিরে মা ধ্রুব কই?’

আমি গাঢ় কন্ঠে বললাম- ‘অফিস থেকে হয়তো কোনো জরুরি কল এসেছে তাই কিছুক্ষণ আগেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন।’

আব্বু অবাক হয়ে বললেন- ‘আজ আবার কিসের অফিস? শুক্রবার আমাদের অফিস বন্ধ থাকে ভুলে গেলি! এই গাধা ছেলে জীবনেও মানুষ হবে না। আমি কোনো কাজ দেইনি তাহলে আবার কিসের জরুরি কাজ? আবারও হয়তো শুরু করেছে নিজের গাধামির পরিচয় দেওয়া।’

আব্বু রাগে চিড়বিড় করে একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছেন। আমি নিঃশব্দে শুনছি আব্বুর কথা। ধ্রুব কোথায় গেলেন? অফিস ছাড়া তো তার আর কোনো কাজ নেই তাহলে কিসের এত তাড়াহুড়ো? কি এমন কাজ যে তুলতুলের কাছে না যেয়ে ওখানে চলে গেলেন!

চলবে…

#শেষ_রাত
#পর্বঃ২৯
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘তুলতুল কেমন আছে ভাইয়া?’

কেবিনে ডুকেই গমগমে গলায় ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম। আচমকা আমার প্রশ্ন শুনে ভাইয়া কিঞ্চিৎ বিস্মিত হয়ে-ই পেছন ঘুরে তাকায়। আমার পেছন পেছনই মনি মা আর আব্বু কেবিনের দরজা ঢেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি তাদের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবারও ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। ভাইয়া তুলতুলকে আড়াল করে বসে থাকায় তুলতুলকে দেখা যাচ্ছে না। গম্ভীর মুখে আমার দিকে খানিকক্ষন চেয়ে থেকে গাঢ় স্বরে বলল-

‘তুই নিজেই দেখে নে।’

ভাইয়া তুলতুলের সামনে থেকে সরে এসে দাঁড়ালো। আমি সংকোচিত মনে তুলতুলের দিকে চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গেই জল তরঙ্গের মতো হাসির দেখা মেললো। তুলতুল হাসছে। প্রাণোচ্ছল তরল হাসি। মনে হচ্ছে লুকোচুরি খেলায় ধরা পরে ভীষণ খুশি হয়েছে। ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল-

‘আমাদের তুলতুল পাখি একদম ঠিক আছে। ঘুম থেকে উঠেই আমার সাথে খেলছে, হাসছে, দুষ্টুমি করছে। ডক্টর এসে ওকে দেখে অনেক খুশি হয়েছে। এই বয়সেও অসুস্থতায় এতটা হাসি খুশি দেখে উনি মুগ্ধ হয়েছেন। বলেছে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকলে শারীরিক অসুস্থ খুব জলদি বিদায় নিবে। বেশিদিন হসপিটালে রাখতে হবে না।’

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ম্লানমুখে তুলতুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। তুলতুল আমার দিকে ডাগরডাগর চোখে তাকিয়ে আছে। অসুস্থতার জন্য মুখ শুকিয়ে যাওয়ায় যেন চোখদুটো আরও বড় বড় মনে হচ্ছে। আমাকে হাসতে না দেখেই যেন তার চোখে কৌতূহল চিকচিক করছে। আমি তুলতুলের পাশে এসে বসতেই তুলতুল আধো আধো গলায় বলল-

‘মামু আস..’

ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে কয়েকবার একই কথা বলল তুলতুল। ভাইয়া এগিয়ে আসলো। আমি উঠে যেতেই ভাইয়া আবারও আগের জায়গায় বসলো। তুলতুল কিছুক্ষন ভাইয়ার আড়ালে চুপ করে লুকিয়ে থাকলো। আমি, মনি মা আর আব্বু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি সে দিকে। খানিকক্ষণ পর তুলতুল ভাইয়ার হাতের ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে ‘ভাও’ বলে চিৎকার দিলো। আমি অবাক চোখে তুলতুলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তুলতুল তার মামুর সাথেই তাল মিলিয়ে হেসে যাচ্ছে। মনি মা আর আব্বুও হেসে ফেলল। ভাইয়া আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল-

‘আমাকে দোষ দিবি না। আমি তো শুধু একবার এমন করেছিলাম। কিন্তু তারপর থেকেই তোর মেয়ে নার্স, ডাক্তার যে আসছে তাকেই এমন করে ভয় দেখাচ্ছে। তোর মতোই স্বভাব পেয়েছে। তুইও ছোট বেলা একটা কিছু শুনলে সেটা একনাগাড়ে বলা শুরু করতি।’

আমি হেসে ফেললাম। তুলতুলের হাসিতেই চারপাশে আপনা আপনি খুশিতে মেতে ওঠে। এই মেয়েটা চুপ থেকলেই যেন সব কিছুতে বিষাদ আর অবসন্নতার ছোঁয়া লেগে থেকে।

———————

‘অনু তোকে কিছু জিজ্ঞেস করবো। আশাকরি তুই আমাকে সত্যিটা-ই বলবি।’

আমি শুকনো ঢোক গিলে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। মনি মা আমার দিকে ঘুরে বসলেন। ভারী কন্ঠে একের পর এক প্রশ্নের তীর ছুড়তে লাগলেন আমার দিকে,

‘তোর আর ধ্রুবর মাঝে কি এখনও কিছুই ঠিক হয়নি? বিয়ের এতগুলো মাস পেরিয়ে গেছে অথচ ধ্রুব এখনও তোকে আপনি সম্মোধন করে এটা কেমন কথা! তোদের মাঝে কি এতটাই দূরত্ব যে একে অপরকে অপরিচিত মানুষদের মতো আপনি আপনি করে কথা বলতে হবে?’

যা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম ঠিক তা-ই হলো। মনি মা এত সহজে এই কথা মাথা থেকে ঝেরে ফেলার মানুষ না। ওনার প্রশ্নের মুখোমুখি আমাকে হতে হবে সেটা আমি জানতাম। কিন্তু এই প্রশ্ন গুলোর প্রতিত্তোরে আমি কি জবাব দিবো? ধ্রুব আর আমার মাঝে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কিন্তু উনি আমাকে প্রায়শই ‘আপনি’ সম্মোধন করে কথা বলেন। ওনার এসব কথা শুনেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আমিও এ বিষয় নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি। কিন্তু মনি মা’কে কি করে বুঝাবো?

‘বিয়ে করলেই বউকে তুমি তুমি করে ডাকতে হবে এমন তো কোনো নিয়ম নেই মা। তুলতুলের আম্মুকে আপনি করে সম্মোধন করতেই আমার ভালো লাগে। তাই আমি প্রায়শই তুলতুলের আম্মুকে আপনি আপনি করে কথা বলি।’

ধ্রুবর কন্ঠস্বর শুনে আমি চমকে গিয়ে দরজার দিকে চাইলাম। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মুখে কোনো সংকোচবোধ কিংবা অস্বস্তির চিহ্ন কিছুই নেই। সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন জরুরি কাজের কথা বলে। সারাদিন পেরিয়ে রাত নয়টা বাজে এসে তার দেখা মিলল। কি এমন জরুরি কাজ যে সারাদিনে একবারও তুলতুলের খোঁজ নেননি। অফিস নেই তাহলে আর কিসের এত কাজ! কিসের এত ব্যস্ততা? এসব প্রশ্ন করতে চাইলেও আমি করতে পারবো না। কোথাও যেন একটা অদৃশ্য বাধা কাজ করে। হয়তো রেস্টুরেন্টে বলা ধ্রুবর সেই কথা গুলোই আমার মনে গেঁথে গেছে।

মনি মা তিক্ত গলায় বললেন- ‘নিজের বউকে কেউ আপনি বলে সম্মোধন করে কখনও দেখেছিস?’

ধ্রুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন৷ আমি সোফা থেকে দাঁড়াতেই তিনি মনি মা’র পাশে বসে পরলেন৷ শার্টের উপরের একটা বোতাম খুলে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে বললেন-

‘কে কি করলো না করলো তা দেখার বিষয় আমার না। আমার যেভাবে ভালো লাগে আমি সেভাবেই নিজের বউয়ের সাথে কথা বলবো৷ তা ছাড়া আমি তো বেশিরভাগ সময়ই তুমি সম্মোধন করে কথা বলি৷ তুমি দেখো না!’

মনি মা প্রচন্ডরকম বিরক্ত হলেন। ধ্রুবর পাশ থেকে উঠে খানিকটা দূরে গিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। চোখমুখ শক্ত করে রাগী গলায় বললেন-

‘তোদের যা ভালো মনে হয় তোরা তা-ই কর। আমি আর কিছুই বলবো না। তবে হ্যাঁ সময় থেকতে যেভাবে সময়ের মূল্য দিতে শেখা লাগে। সেভাবেই মানুষ থাকা অবস্থায় তার মূল্য দিতে হয়। পরে হারিয়ে ফেললে আফসোস ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। আর ধ্রুব তুই! জরুরি কাজের কথা বলে বাহিরে ঘুরাঘুরি না করে সম্পর্কের যত্ন নে। যত্ন ছাড়া কোনো কিছুই বেশিদিন টিকে না। মাথায় রাখিস।’

মনি মা’র কথা শুনে বুক ধক করে উঠলো। হারিয়ে ফেললে মানে কি? ধ্রুবকে হারিয়ে ফেলার কথা তো আমি কখনোই ভাবিনি। ওনাকে হারিয়ে ফেললে কি শুধুই আফসোস হবে না-কি এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু! আমার সব কিছুতেই ওনার অস্তিত্ব খুঁজে পাই। আর উনি হারিয়ে গেলে হয়তো আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলবো।

‘আমি নিজেও হারিয়ে যাব না। আর অন্যকাউকেও হারিয়ে যেতে দিবো না। তোমার ছেলে এতটাও কাপুরষ না৷ আর বাকি রইলো সারাদিন এখানে না আসার কথা। তার কারণ হলো আমি কিছু পারসোনাল কাজে বিজি ছিলাম তাই সারাদিন আসতে পারিনি সরি।’

মনি মা আর কোনো কথা বাড়ালেন না। ধ্রুব আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে তুলতুলের কাছে চলে যায়। বেশ খানিকক্ষণ তুলতুলের সাথে সময় কাটানোর পর মনি মা কাঠকাঠ গলায় বললেন-

‘অনেক রাত হয়ে গেছে তোরা এখন বাসায় যা। আজ রাতে আমি আর আপা থাকবো এখানে।’

মনি মা’র কথায় আমি কিছু বলবো তার আগেই আম্মু রুমে এসে বললেন-

‘হ্যাঁ তোরা এখন বাসায় যা। তুলতুলকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আমরা আছি।’

আমি দমে গেলাম। তুলতুল আর ধ্রুবর হাসাহাসি করছে। ঘাড় বাঁকিয়ে তুলতুলের দিকে একনজর চেয়ে মনি মা’র গম্ভীরমুখের দিকে দৃষ্টি স্থির করলাম। ধ্রুবর উপর রেগে আছেন তিনি তা ওনার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হয়তো আমার উপরেও রেগে আছে। তাই আমাদের দুজনকেই বাসায় পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেললাম।

কৃষ্ণবর্ণের মেঘে ঢেকে আছে রাতের আকাশ। ক্ষনে ক্ষনে দূর আকাশে নিষ্ঠুর গর্জন দিয়ে আলোকিত করছে চারপাশ। পরক্ষণেই আবার ঘন অন্ধকারে ঘিরে নিচ্ছে শহরকে। ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়ার বেগ বেড়েছে প্রবলভাবে। প্রকৃতি জানান দিচ্ছে খানিকক্ষণ বাদেই ঝমঝমিয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পরবে বৃষ্টির কণা। গাছপালা এলোমেলো করে শুরু হবে বৃষ্টি কন্যার মনমাতানো নৃত্য। মিনিট খানেক পেরুতেই ধ্রুব নিঃশব্দে এসে আমার পাশে রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। আমি আড় চোখে পরক্ষ করলাম তাকে। সব সময়ের মতোই অতি স্বাভাবিক, শান্তস্বভাব তার। অদূর আকাশে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ নয়নে। চোখদুটোতে তার অসীম মুগ্ধতা। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতেই চিকচিক করে জ্বলে ওঠছে ওনার চোখ দুটো। ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ তরল হাসি। আমার দৃষ্টি থমকে গেল। থমকে গেলাম আমি নিজেও। অদ্ভুত ভালো লাগার অনুভূতি এসে হানা দিলো আমার মনের কোণে। অনুভূতিরা মিছিল করছে। তীব্র চিৎকার করে বলছে এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আমার চোখের সামনে। সব চেয়ে সুন্দর এবং শুদ্ধতম পুরুষ আমার দৃষ্টিতে নিবদ্ধ। ধ্রুব তাকালেন। ফ্যালফ্যাল করে আমাকে দেখছেন। আমি এখনও তাকিয়ে আছি। ধ্রুবর ভ্রু নাচানোতেই আমার হুশ ফিরলো। দারুণ অস্বস্তি নিয়ে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করলাম। পর পর কয়েকবার ঢোক দিয়ে গলা পরিষ্কার করে মিহি কন্ঠে বললাম-

‘আপনি এখনও আমাকে আপনি সম্মোধন করে কথা বলেন কেন?’

ধ্রুব মৃদু হাসলেন। সহজ গলায় বললেন- ‘আজ থেকে আরও পনেরো বছর আগে আপনাকে তুই করেই বলতাম। কিন্তু সেদিন রেস্টুরেন্টে আপনাকে তুই বলায় আপনার প্রতিবাদ দেখে মনে হলো নাহ, আর যা-ই হোক এই গম্ভীর চরিত্রের মেয়েকে তুই বলা ঠিক হবে না। এই মেয়ে এখন আর ছোট্ট নেই। গম্ভীর, চাপা স্বভাবের রসকষহীন একটা মেয়ে। সম্মান দিয়ে কথা না বললেই হয়তো আমার গলা চেপে ধরবে। তাই আরকি আপনাকে একটু সম্মান দিয়ে কথা বলি।’

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ধ্রুবর দিকে। ভ্রু জোড়া কুচকে কপালে সুক্ষ্ম বলিরেখা পরেছে আমার। ধ্রুবর চোখে মুখে দুষ্টু হাসি। আমার চাহনি আরও তীক্ষ্ণ হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম-

‘আমি রসকষহীন মেয়ে! সম্মান দিয়ে দিয়ে কথা না বললে আমি গলা চেপে ধরবো? আপনি তাহলে আমাকে নিয়ে এসব ভাবেন? আর এই হলো আপনার সম্মান দেওয়ার নমুনা!’

আমার কথা শেষ হতেই ধ্রুব শব্দ করে হেসে ফেললেন। ডান পাশের বাঁকা দাঁতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি ভ্রু কুচকে একদৃষ্টিতে ওনার হাসির দিকে তাকিয়ে আছি। আচমকাই উনি হাসি থামিয়ে ফেললেন। ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। হঠাৎ করেই ওনার হাসি থেমে যাওয়ায় আমি হকচকিয়ে গেলাম। অথচ তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই গাঢ় স্বরে বললেন-

‘আপনাকে তিনটা সত্য কথা বলার আছে।’

‘কিসের সত্যি কথা?’

‘এক, আমি সত্যিই আপনাকে মন থেকে সম্মান করি। দুই, আমার ভালো লাগে তাই আমি আপনি সম্মোধন করে কথা বলি৷ তা ছাড়া অন্যসব কাপলদের মতো আমাদের মাঝেও যদি একই জিনিস হয় তাহলে সেটা বোরিং বোরিং লাগবে। তাই আমরা না-হয় অন্য সবার থেকে একটু আলাদা হলাম। তিন, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর আপনিও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। খুব অসাবধানতার সাথেই নিজেকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে দু এক পা পিছিয়ে গেলাম। আমতা-আমতা করে বললাম-

‘এসব আপনি কি বলছেন?’

‘সত্যি কথাই বলছি। কেন আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার?’

ধ্রুব ভ্রু নাচিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন। আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। ইতস্তত করতে লাগলাম। আমি ধ্রুবকে ভালোবেসে ফেলেছি? সত্যি-ই কি তাই! ভালোবাসা কি বার বার হয়? এত তাড়াতাড়ি একজনের জায়গায় অন্যজনকে বসানো যায়? এটা কি সম্ভব! এসবের উত্তর আমার জানা নেই। ধ্রুব আমার হাতে হেঁচকা টান দিয়ে তার কাছে নিয়ে গেলেন। আমি কেঁপে উঠলাম ওনার স্পর্শে। চোখ বড় বড় ওনার দিকে চাইলাম। শহর তলিয়ে ঝমঝমে বৃষ্টি শুরু হলো। হিম শীতল বৃষ্টি কণার স্পর্শে আলাদা এক শিহরণ বয়ে গেল সর্বাঙ্গে। ঠিক এই শীতল আবহাওয়ার মতোই ধ্রুবর চাহনি। নিজেকে হারিয়ে ফেলার মতো এক অচেনা বৃষ্টিস্নাত শহর আছে ওই চোখে।

‘তোমার চোখদুটো-ই বলে দেয় তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছো। আমার দিকে তাকানোর ধরন আর তোমার চাহনি সবটাই বলে দেয় তুমি আমাতে আবদ্ধ হয়েছো। আমার স্পর্শে আগের মতো অস্বস্তি বোধ না করে লজ্জায় কেঁপে ওঠার সেই অনুভূতি বলে দেয় তুমি আমাকে অনুভব করো। এত কিছুর পরিবর্তন হলো অথচ তুমি তা লক্ষ্য করলে না। তবে আমি সবটাই লক্ষ্য করেছি। আর আমি এটাও জানি তুমি এই অনুভূতির মুখোমুখি হতে চাচ্ছো না। হয়তো ভয়ে নিজেকে আড়াল করে নিচ্ছো। আমি তোমাকে জোর করতে পারবো না। শুধু বলবো আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাবো না। আর তোমাকেও যেতে দিবো না। যতদিন না তুমি নিজের মুখে তোমার ভালোবাসার কথা বলবে ততদিন আমি শুধু অনুভব করবো তোমার না বলা অনুভূতি আর অপ্রকাশিত ভালোবাসা। অনেক কথা বলে ফেললাম টায়ার্ড হয়ে গেছি। এবার একটা চুমু দাও তো সানসাইন।’

ধ্রুবর শেষের কথাটা শুনেই আমি বিষম খেলাম। ধ্রুব ঝংকার তুলে হাসতে লাগলেন। বৃষ্টির শব্দের মতোই তার হাসির শব্দ ছড়িয়ে পরলো সর্বত্র। আমি একমনে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে। আমি সত্যিই ভয় পাচ্ছি। আবারও ভালোবাসে ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ধ্রুবকে হারিয়ে ফেলার ভয়। ভালোবাসার সম্পর্ক এক পর্যায়ে তিক্ততার সম্পর্কে পরিনত হয়ে যাওয়ার ভয়। হ্যাঁ আমি ভয় পাচ্ছি আমার অনুভূতির মুখোমুখি হতে। ধ্রুব সবটাই বুঝতে পারেন। আমি না বললেও তিনি বুঝতে পারেন।
ফোনের তবে তীক্ষ্ণ শব্দে আমি ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব ফোন হাতে নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। আমি কৌতূহলী চোখে চেয়ে রইলাম ধ্রুবর দিকে৷ ধ্রুব ম্লান হেসে বললেন-

‘বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। আপনি রুমে যান নাহলে পুরোপুরি ভিজে যাবেন।’

আমি বুঝলাম ধ্রুব স্পেস চাচ্ছে ফোনে কথা বলার জন্য। আমি নিঃশব্দে রুমে চলে আসলাম। কিছুটা দূর আসতেই ধ্রুবর চাপা কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

‘এত রাতে কল করেছো কেন?’

আমি থমকে গেলাম ধ্রুবর কথা বলার ধরন আর আন্তরিকতা শুনে। চিন্তিত শোনাচ্ছে তার গলার স্বর। কে ফোন করেছে? সকালেও এক ফোন কলেই সব কিছু ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। আর এখন এত রাতে!

চলবে…

[রিচেক করা হয়নি। ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ