#শেষ_রাত
#সূচনা_পর্ব
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
বাসর ঘরে প্রবেশ মাত্রই অস্পষ্ট গলায় ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পারল তুলতুল। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা তাল হারিয়ে ফেললাম। ক্লান্ত শরীরে আচমকা এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ায় নিজেকে সামলিয়ে নিতে মিনিট খানেক সময় লাগল। আমি চোখ তুলে চাইলাম সামনের মানুষটার দিকে। যার কোল থেকে তুলতুল অনায়াসে লাফিয়ে আমার কোলে এসেছে। তাকে দেখাচ্ছে নির্বিকার, নির্লিপ্ত এবং অতি স্বাভাবিক। মেরুন রঙের পাঞ্জাবি গাঁয়ে জড়ানো। ঠোঁটে স্বভাবগত মৃদু হাসি। দু’হাত আড়াআড়িভাবে ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন ধ্রুব। আমার স্বামী ধ্রুব। এ-তো কয়েক ঘন্টা আগেই তিনবার কবুল বলে ধ্রুবর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। সবার কাছে বিয়েটা স্বাভাবিক হলেও আমাদের দুজনের মধ্যে ছিল শখানেক শর্ত। এসব শর্ত মেনেই বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়েছে। অবশ্য বিয়ে হওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল কারণ হলো তুলতুল। পরি মতো দেখতে দেড় বছর বয়সী একটা মেয়ে। নাম তার পূর্নতা।
‘তুলতুল পাখি আমার কোলে আসো। ওনার গায়ে ময়লা জীবাণু আছে। আমার কাছে নাহলে জীবণু তোমাকে খেয়ে ফেলবে।’
ধ্রুবর আদুরে কন্ঠস্বর শুনে আমার মস্তিষ্ক সচল হলো। পরক্ষণে ওনার কথা গুলো বুঝে উঠতেই ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠলো আমার পুরো শরীর। ক্ষীণ রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চাইলাম ধ্রুবর দিকে। তার ঠোঁট জুড়ে সরল হাসি। দু হাত বাড়িয়ে তুলতুলকে নিজের কাছে নিতে চাইছেন। তবে ওনার কথায় কোনো লাভ হলো না। হয়েছে তার বিপরীত। তুলতুল আবারও ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে আমার গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। ওনার থেকে আড়াল হতে আমার ঘাড়ে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। মনে মনে কিছুটা আনন্দিত হলাম। ধ্রুব আবারও কিছু বলবেন তার আগেই মনি আন্টি মানে ওনার মা এসে রুমে উপস্থিত হলেন। আমার দিকে শান্ত চোখে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে রাগী চেহারায় তাকালেন ওনার ছেলের দিকে। গম্ভীরমুখ করে তেজি কন্ঠে বললেন-
‘বাবুকে ওর কোলে দিয়েছিস কেন! সারাদিন বিয়ের এত ঝামেলায় মেয়েটা ক্লান্ত হয়ে গেছে দেখছিস না!!’
‘আমি দিয়েছি না-কি! তোমার নাতনি নিজেই এই মেয়ের কোলে লাফিয়ে পরেছে।’
ধ্রুবর সহজ সরল স্বীকারোক্তি হয়তো মনি আন্টির পছন্দ হলো না। তাইতো ভীষণ রকম ক্ষেপে উঠলেন তিনি। চোখ গরম করে ধ্রুবকে এক রামধমক দিয়ে বললেন-
‘এক থাপ্পড় দিবো বেয়াদব। মেয়ে মেয়ে বলছিস কাকে! ও তোর বউ হয় ঠিকভাবে সম্মান দিয়ে কথা বল।’
আমি চুপচাপ এনাদের দুজনের তর্কবিতর্ক দেখছি। তুলতুলও মাথা তুলে তার ডাগর ডাগর চোখ দুটো দিয়ে তাদেরকে দেখছে। ধ্রুবর চেহারায় ভয়াবহ বিরক্তিতে আঁধার নেমে এসেছে। ভ্রু জোড়ার মাঝে পরেছে বিরক্তির সরল রেখা। হয়তো আমার সামনে এভাবে বকাবকি করায় অপমানিত বোধ করছেন। বাসর ঘরে নতুন বউয়ের সামনে মা’য়ের মুখে রামধমক খাওয়া এটা নিশ্চয়ই কোনো ছেলের জন্য গর্বে বুক ফুলানোর বিষয় না। প্রথম রাতেই ইজ্জতের ফালুদা হওয়ায় চোখেমুখে কাঠিন্যতা এনে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আর কোনো কথা বাড়ালেন না। মনি আন্টি এবার আমার সামনে এসে তুলতুলকে নিজের কাছে নিয়ে নিলেন। মনি আন্টির রাগ দেখেই হয়তো তুলতুল কিছু বলল না। তবে সাথে সাথেই তার মুখ গোমড়া হয়ে এলো। অন্ধকার হয়ে গেল তার মিষ্টি মুখখানা। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভীষণ অভিমান হয়েছে তার। আমি মনি আন্টির উদ্দেশ্যে নরম সুরে বললাম-
‘মনি আন্টি আজ না-হয় পূর্ণ আমার কাছেই থাকুক। আমার কোনো সমস্যা হবে না।’
কি অদ্ভুত! আমার কথাতেও তিনি ক্ষেপে গেলেন। আজ হয়তো কথায় কথায় ওনার রেগে যাওয়ার দিবস। মনি আন্টি বেশ রাগান্বিত হয়ে বললেন-
‘দিবো এক চড়। মনি আন্টি কাকে বলছি! আগে মনি আন্টি ডেকেছিস মানলাম কিন্তু এখন থেকে মনি মা বলবি। পরের বার যেন বলে দিতে না হয়। আর তুলতুল আমার কাছেই থাকবে। সারাদিনের বিয়ের এত ধকলে তোরা দু’জনেই ক্লান্ত তাই তোরা বিশ্রাম নে। আমি যাই। মহারানীর রাগ ভাঙিয়ে আবার ঘুম পাড়াতে হবে।’
মনি মা চলে গেলেন। এই মহিলাটা খুবই অদ্ভুত এক জাদুকরী মহিলা। অল্পতেই মানুষকে আপন করে ফেলার খুব ভালো জাদু জানেন তিনি। আমি নিজেও সেই জাদুর কবলে পরেছি। নিজের ভালোবাসা, অপেক্ষা আর মায়া সব কিছু বিসর্জন দিয়েছি এই বিয়ে নামক সম্পর্কের জন্য। শুধুমাত্র তুলতুল আর মনি মা’র মায়ায় জড়িয়ে বাধ্য হয়েছি বিয়েতে রাজি হতে। নিজের অতীতকে ছেড়ে দিয়েছি শুধুমাত্র তাদেরই জন্য।
‘এক্সকিউজ মি মিসেস! যান ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি এখন যাই আমার ফ্রেন্ডদের সাথে একটু দেখা করে আসি।’
আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম৷ ধ্রুব আমার দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই লোকটার সাথে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে খুবই কম। যদিওবা ওনারা আমাদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। তবে বিগত পনেরো বছরে আমাদের ফ্যামিলির মধ্যে কোনো প্রকার যোগাযোগ কিংবা পরিচয় ছিল না বললেই চলে। দু-এক মাস হলো ওনারা ঢাকায় শিফট করেছেন। বিশ দিন আগেই এক অপ্রত্যাশিত মুহুর্তে তুলতুল আর মনি মা’র সাথে আমার কাকতালীয়ভাবে দেখা। এই সামান্য দেখাই খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। আর এই সবটাই হয়েছে তুলতুলের ‘মাম্মা’ ডাকের কারণে।
বেশখানিকটা সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসলাম। পুরো রুম ফাঁকা। ধ্রুব সাহেব এখনও আসেননি। আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। শরীর থেকে ভারি শাড়ি খুলতেই যেন বেশ হাল্কা হাল্কা লাগছে নিজেকে। অলস ভঙ্গিতে বিছানায় এসে এলিয়ে দিলাম ক্লান্ত শরীরটা। পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে। পা ব্যথাটাও এখন আর অনুভব করতে পারছি না। আর মনের তীব্র ব্যথাটাও কেমন যেন মিলিয়ে গেল। অনেক গুলো নির্ঘুম রাতের পর আজ আমার চোখে ঘুম ধরা দিয়েছে। প্রচুর ঘুমে চোখ দুটো বুঁজে আসছে আমার। হঠাৎই দরজা লাগানোর শব্দে ঝট করে চোখ মেলে তাকালাম৷ ধ্রুব এসেছেন। ওনার হাতে খাবারের ট্রে৷ তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ ঝাটকা খাওয়ার মতোই দ্রুতগতিতে মনে পরলো আমার ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। ক্ষুধার্ত হওয়ার তীব্র জ্বালা অনুভব করলাম। সকাল থেকে কিছুই ঠিক মতো খাওয়া হয়নি। বিয়ের এত ঝামেলা আর দৌঁড়ঝাপে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসলাম৷ চোখ ছোট ছোট করে ধ্রুবর দিকে চেয়ে তাকে পরখ করতে লাগলাম। তবে আফসোস মানুষটা বরাবরের মতোই নির্বিকার। ধ্রুব এগিয়ে আসলেন। বিছানার পাশের টেবিলে খাবার প্লেট রেখে কন্ঠে নির্লিপ্ততা নিয়ে বললেন-
‘আমাকে বাহিরে দেখে আম্মু রাগারাগি করছিল তাই বলেছি আপনার জন্য খাবার আনতে বেরিয়েছি। আমি জানতাম আপনার নাম শুনলে রাগারাগি করবে না। ঠিক তা-ই হলো। চুপচাপ খাবার গরম করে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। আপনার ক্ষুধা থাকলে খেয়ে নিন আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
ধ্রুব আমার কোনো কথার অপেক্ষা না করেই ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি স্থির চোখে সে দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন। ইতিমধ্যে পেটে জ্বালাপোড়া শুরু হয়ে গেছে। খাবার দেখেই যেন ক্ষুধার পরিমাণ সেকেন্ডে সেকেন্ডে দ্বিগুণ হচ্ছে। আমি খাবারের ট্রে নিয়ে বিছানায় বসলাম। আস্তে-ধীরে খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার! ক্ষুধা থাকা শর্তেও বেশি কিছু খেতে পারছি না। অল্পতেই ক্ষুধা মিটে গেছে। খাবার রেখে দিতেই ধ্রুব রুমে আসলেন। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে খাবারের দিকে চেয়ে বিস্ময় নিয়ে বললেন-
‘খাবার কি আপনি খেয়েছেন না-কি কোনো ইঁদুর টিদুর এসে খেয়ে গেছে! দেখে তো মনে হচ্ছে ইঁদুর-ই খেয়েছে।’
আমি চোখ ছোট ছোট করে ওনার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। ওনার খোঁচা মারা কথা শুনে আমার ভীষণ রাগ হলো। তীব্র রাগ হওয়া শর্তেও আমার স্বভাবগত অভ্যাসের কারণে তা অপ্রকাশিতই রয়ে গেল। আমি সন্দিহান কন্ঠে বললাম-
‘আমিই খেয়েছি। আর আমি কোনো ইঁদুর না।’
‘সকালে আম্মু এসব দেখলে চিল্লাপাল্লা করে কান ঝালাপালা করে দিবে।’
ধ্রুব কথা শেষ করেই আমাকে চমকে দেওয়ার মতো একটা কাজ করলেন। বিছানায় বসে চামচ নিয়ে আমার এঁটো খাবার খেতে লাগলেন। ওনার এমন কাজ দেখে আমি চমকালাম। বিস্ময়ে রসগোল্লার মতো হলো আমার চোখ দুটো। উনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই খাবার খেয়ে যাচ্ছেন। যেন এটা খুবই স্বাভাবিক। উনি কি কোনো ভাবে বিয়েটা স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করছেন? কিন্তু এমনটা তো আমাদের শর্তে ছিল না তাহলে!! আমার মাথা এলোমেলো হলো। প্রশ্ন গুলো দিশেহারা অবস্থায় মাথার মধ্যে চরকির মতো ঘুরতে লাগল। আমি ক্ষীণস্বরে বললাম-
‘কি করছেন আপনি! আমার এঁটো খাবার খাচ্ছেন কেন?’
উনি খাবার খেতে খেতে আমার দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন-
‘আমারও একটু একটু ক্ষুধা লেগেছে তাই খাচ্ছি। আর তার চেয়েও বড় কারণ হলো খাবার অপচয় করা ভালো না।’
‘তাই বলে সবার এঁটো খাবার খাবেন?’
ধ্রুব আমার দিকে কপাল কুচকে তাকালেন। সন্দিহান কন্ঠে বললেন-
‘সবারটা কখন খেলাম? আমি কি প্রতিদিন বিয়ে করে না-কি যে প্রতিদিন নতুন নতুন বউ এসে খাবার খেয়ে আমার জন্যেও রেখে দিবে!’
আমি দমে গেলাম। হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম বিছানার এক কোণে। আর কোনো কথা বাড়ালাম না৷ উনি খাবার খেয়েই বিছানায় আমার পাশে শুয়ে পরলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আমি এক লাফে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। কয়েক পা পেছনে গিয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
‘আপনি এখানে ঘুমাবেন!’
ধ্রুব মাথা হাল্কা উঁচু করে আমার দিকে চাইলেন। আমার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলালেন। বেশ শান্ত গলায় বললেন-
‘আমার জানানামতে এটা কোনো হিন্দি সিরিয়াল না। তাদের মতো আমার রুমে আলাদা করে কোনো সোফাও রাখা হয়নি। যে আমি সোফায় ঘুমাবো আর আপনি বিছানায়। তবে আপনি চাইলে মেঝেতে ঘুমাতে পারেন। আই ডোন্ট মাইন্ড।’
আমি চোখ রাঙিয়ে চাইলাম। ধ্রুব তার ঠোঁটে সরল হাসির রেখে টেনে নিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন। আমি এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করবো না করবো কিছুই বুঝে আসছে না। মিনিট খানেক সময় পেরুতেই ধ্রুবর ঘুম জড়ানো কন্ঠ শোনা গেল।
‘ক্লান্ত শরীর নিয়ে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে পা ব্যথা শুরু হবে। তারচেয়ে বরং চুপচাপ শুয়ে পরুন। আর হ্যাঁ আমি এতটাও চিপ মাইন্ডের না যে নিজের স্ত্রীকে তার অগোচরে কিংবা তার অমতে বাজে ভাবে টাচ করবো। সো চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকুন। রিলেক্স।’
ওনার কন্ঠস্বর ধীরে ধীরে জড়িয়ে যাচ্ছে। হয়তো ঘুমিয়ে পরেছেন। আমি ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। ওনার কথা শুনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে পেলাম। আমি আর কোনো কিছু না ভেবে নিঃশব্দে শুয়ে পরলাম বিছানার অন্য পাশে। অচেনা এক লোকের সাথে একই রুমে একই বিছানায় ঘুমাতে অস্বস্তির আর সীমা রইলো না। এপাশ-ওপাশ করতে করতে মিনিট পাঁচেক পর ঘুমিয়ে গেলাম। অনেক গুলো নির্ঘুম রাতের পর ঘুম হলো আমার। ক্লান্তিতেই যেন বিচ্ছেদের তীব্র ব্যথাও ভুলে গেলাম। মনের ব্যথা ভুলে শান্তিতে ঘুমালাম আমি।
চলবে….