শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব-১৮

0
580

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৮||

★শাড়ির কুঁচিগুলো ভাজ করে গুজে দিয়ে সোজা হতেই আয়নার দিকে চোখ পড়লো ফারহিনের। পেটের দিকটায় অজান্তেই হাত চলে গেল। দ্রুত আঁচল ভাজ করে পেটে হাত রাখলো। পেটে হাত দুটো উপরনিচ করে রেখে সমানে বুলিয়ে যাচ্ছে। এপাশ ওপাশ ফিরে নিজেকে বার বার দেখছে। এলোমেলো হয়ে থাকা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। পেট বড় হয়েছে কি না তা দেখতেই ব্যস্ত সে।
টাওয়েলে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো আরশ। ওয়াশরুমের দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ আটকে গেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহিনের দিকে। আরশ চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো তাকে। তার রঙঢঙ দেখে হেসে দিলো আরশ। হাতের টাওয়েল ডিভানে রেখে এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। ফারহিনের পেছনে দাঁড়িয়ে পেটের উপর হাত রাখলো। শাড়ির নিচে পেটের উপর আরশের ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেতেই ফারহিন দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। আরশ এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করতে করতে প্রশ্ন করলো-
“-কি দেখছিলে?
“-পেট! বড় হয়েছে কি না…
আরশ উচ্চস্বরে হেসে দিলো। আরশকে হাসতে দেখে ফারহিন ভ্রু কুঁচকালো।
“-হাসলেন কেন?
“-একদিনে পেট বড় হয় নাকি? পেট বড় হয় বাবু বড় হলে। বাবু তো এখনো ছোট..
“-ওহ্। অনেক সময় লাগবে তাই না?
“-তাতো লাগবে।
কানের পাশে চুল গুজে দিয়ে ঘাড়ে হাত রাখতেই ফারহিন সরে যেতে চাইলো। আরশ সরতে দিলো না। ফারহিন বলল-
“-প্লিজ ধরবেন না কেমন সুড়সুড়ি লাগে।
“-এত দিনেও সুড়সুড়ি ভাঙলো না? এটা তো ভালো লক্ষ্মণ নয়..
ভ্রু কুঁচকে বলল আরশ। আরশের কথা শুনে ফারহিন অবাক হলো, বলল-
“-কেন?
“-তোমার সুড়সুড়ি দূর করার উপায় আছে।
“-যেমন?
“-আমি যদি সারাদিন তোমার সাথে থাকি তো….
“-সরুন।
বলেই আরশ কে ধাক্কা দিলো। আরশ বিছানায় বসে পড়লো। ফারহিন চলে যাওয়ার আগেই ফারহিনের হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো আরশ। ফারহিন বিছানায় শুয়ে পড়লো। আরশ তার দিকে ঝুকে বলল-
“-এত দৌড়াদৌড়ি করবেনা।
“-কেন?
“-বাবু আছে যে।
“-আচ্ছা।
“-ফারহিন..
“-জি..
“-বাবু আসাতে একটা জিনিস ভালো হলো।
“-কি?
“-এইযে আমার আর তোমার পিছু ছুটতে হবে না তুমি ইজিলি আমায় ধরা দিয়ে দেবে।
ফারহিনের ঠোঁটে আঙুল ঘষে বলল আরশ। ফারহিন উঠতে চাইলো। আরশ উঠতে দিলো না।

আরশ আর ফারহিনকে নাস্তা খেতে ডাকতে এসে থেমে গেল সালমা। ভেতর থেকে হাসির শব্দ আসছে। দুজনেই হাসছে উচ্চস্বরে। সালমা হাসলো। দরজায় নক না করেই ফিরে এলো। নিচে নামতেই দেখলো তীব্র এসেছে। তীব্র কে দেখে সালমা দ্রুত এগিয়ে এলো।
“-তুমি এখানে?
“-তোমাকে নিতে এসেছি খালামনি..
“-আমি কোথাও যাবো না তীব্র। ফারহিনের সাথে থাকাটা দরকার।
“-ফারহিনকে সহ নিয়ে চলো, ওখানে গেলে সবটা বলো।
“-কি বলবো তীব্র? কি বলার কথা বলছো তুমি?
“-কালকে রাতেই তো বললাম তোমাকে।
“-এসব নিয়ে আর আলোচনা করো না তীব্র। আমি এখান থেকে যাবোনা। কয়েকদিন থাকবো..
“-কিন্তু খালামনি ফারহিন…
“-প্রেগন্যান্ট!
অবাক হলো তীব্র। একটু পিছিয়ে গেল সে। বলল-
“-কিহ?
“-হ্যাঁ! ফারহিন প্রেগন্যান্ট। আর আমি চাইনা ও এসব জানুক, বা কোনো প্রকার দুশ্চিন্তায় ভুগুক।
“-এসব কিভাবে..
“-হওয়াটাই স্বাভাবিক তীব্র।
“-কিন্তু…
তীব্র কিছু বলার আগেই ফারহিনের আওয়াজ কানে এলো। উপরে তাকাতেই দেখলো আরশ ফারহিনকে কোলে করে নিচে নেমে আসছে। ফারহিনের চেহারায় হাসি লেপ্টে আছে। দুজনেই কথা বলতে বলতে নেমে আসছে।
“-মা দেখলে কি ভাববে?
“-কিছু ভাববে না। এই অবস্থায় সিড়ি বেয়ে ওঠা নামার দরকার নেই। আমি আছি না?
“-তাই বলে এখন থেকে?
“-ছোট থেকেই যত্ন করতে হয়।
বলেই আরশ সামনে তাকাতেই দেখলো তীব্র। ফারহিনকে নামিয়ে দিলো। ফারহিন কে ইশারায় ভেতরে যেতে বলে সালমা কে সালাম দিলো-
“-আসসালামু আলাইকুম, গুড মর্নিং মা।
“-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। গুড মর্নিং..
“-তুই কখন এলি?
“-মাত্র এসেছে। তোমরা কথা বলো আমি নাস্তা রেডি করছি।
বলেই সালমা চলে গেল। আরশ সালমা যাওয়ার পর তীব্রের সামনে এসে দাঁড়ালো। দু হাত পকেটে রেখে বলল-
“-এখানে হঠাৎ কি মনে করে?
“-কেন ভয় হচ্ছে নাকি?
আরশ হাসলো, তাচ্ছিল্যের হাসি।
“-এসেছিস ভালো হয়েছে। নাস্তা খেয়ে যা, মিষ্টি মুখ করে যা। তারপর বিদেয় হ। উল্টো পাল্টা কিছু মাথায় ও আনিস না।
“-আনলে কি করবি? আমাকেও মেরে ফেলবি নাকি?
তীব্রের কথায় আরশ ভ্রু কুঁচকালো। তীব্রকে উপর থেকে নিচ একবার দেখলো তারপর বলল-
“-এখন অবধি এমন কিছুই ভাবিনি, কিন্তু যদি উল্টো পাল্টা কিছু করেছিস তাহলে সত্যি সত্যিই করে বসবো যা তুই ভাবছিস তা।
“-হুমকি দিচ্ছিস?
এগিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল তীব্র। আরশ হাসলো। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল-
“-হুমকি দিই না আমি, অভ্যস্ত নই।
“-ফারহিন কে আটকানোর আর কোনো পথ পেলি না? শেষে কিনা বাচ্চা?
“-হুশ! আমার বাচ্চাকে নিয়ে একটা কথাও নয়। এসেছিস ভালোই ভালোই নাস্তা করে নে।
“-এই বাড়িতে পানিও খাবোনা। আর নাস্তা..
“-তাহলে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করিস না। গেট আউট!!
“-ফারহিনকে একদিন সব জানিয়ে দেব। যেই ভালোবাসা তোকে দিয়েছিলাম তা আমি আবার নিয়ে নেব। তুই তোর শাস্তির জন্য প্রস্তুত থাকিস। আমার ফারহিনকে খুব শীগ্রই নিয়ে যাবো।
আরশ তীব্রের কলার ধরে বসলো-
“-আর একবার যদি ‘আমার ফারহিন’ এই শব্দ উচ্চারণ করেছিস তাহলে তোর জীভ আমি টেনে ছিড়ে ফেলব। ও শুধু আমার। তোর কখনো হবেনা আর না ছিলো, না আছে।
“-মিথ্যে ভালোবাসার পট্টি বেঁধে আর কত দিন? একদিন না একদিন সে জানবে, আর তোকে ছেড়ে চলে যাবে। ঘৃণা ছাড়া কিছু পাবিনা। কারণ আমার ফারহিন অন্যায়ের সাথে আপোষ করবেনা।
আরশ ছেড়ে দিলো তীব্রের কলার। তীব্র বেরিয়ে গেল। আরশ সোফায় ধপ করে বসে পড়লো। মনে মনে আওড়ালো-
“-ফারহিন সত্যিই ছেড়ে চলে যাবে না তো?
পরক্ষণেই নিজের মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিলো।
“-কখনো না, ও আমাকে ছেড়ে কখনো যাবেনা। ও আমাকে ভালোবাসে শুধু আমাকে। ও আমাকে ঘৃণা করতে পারেনা। অন্যের কথা ধরে কখনো না।

★ফারহানার সাথে বেরিয়ে গেল ফারহিন। আরশ এত করে বলার পরও আরশ কে সাথে নিয়ে গেল না। প্রায় দু ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরও ফারহিন ফিরে এলো না। ড্রয়িংরুমে অনবরত পায়চারি করছে আরশ। বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। ঘড়ির ঘন্টা বেজে উঠতেই ত্রস্তনয়নে তাকালো আরশ। রাত ৯টা বাজছে। আরশ অস্থির হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। এত রাত হয়ে গেল অথচ ফারহিন বাহিরে.! কেঁপে উঠলো হৃদয়। আরশ দরজার দিকে আরো একবার তাকালো। সালমা অনেক্ষণ যাবত আরশের অস্থিরতা লক্ষ্য করছে। আরশের বেচয়েন ভাব দেখে এগিয়ে গিয়ে আরশের পাশে দাঁড়ালো। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি আরশের দিকে এগিয়ে দিলো। আরশ পানি খেয়ে গ্লাস ফিরিয়ে দিতেই সালমা আরশের হাত ধরে নিলো। আরশ পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। সালমা ইশারায় ডেকে সোফায় বসিয়ে দিলো। আরশের মাথায় হাত রেখে বলল-
“-ঠিক আছো?
“-মা ফারহিন…
“-এসে যাবে। তুমি এত অস্থির না হয়ে একটু বোসো। সে এসে যাবে!
আরশ চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পর সালমার দিকে তাকালো। আরশের চোখ লাল হয়ে এসেছে। চোখে পানি চিক চিক করছে। আরশ কাঁপা কন্ঠে বলল-
“-মা?
“-বলো?
“-ফারহিন আমাকে ভুল বুঝবে না তো? আমায় কখনো ছেড়ে চলে যাবে না তো?
“-তুমি এমন কিছু করেছো যা জানলে ফারহিন চলে যাবে বা ভুল বুঝবে?
আরশ ত্রস্তনয়নে তাকালো। অসহায় চাহনি তার। সালমা আবারও বলল-
“-পৃথিবীতে সবাই সব দিক দিয়ে সম্পুর্ণ হয়না আরশ। আর সত্য-মিথ্যের এই দুনিয়ায় সত্য খুব বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। সত্য সামনে আসলে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তবে এই পরিস্থিতি সামলানোর একটা ছোট্ট উপায় আছে। যদি আমরা নিজেই নিজের ভুল স্বীকার করি। আমরা যদি নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারি তা স্বীকার করি তাহলে সামনের ব্যাক্তি আমাদের শাস্তি কিছুটা কমিয়ে দিবে এই ভেবে যে, অন্তত যাইহোক সে তার ভুলটা বুঝেছে।
“-আম..আমি ভুল করিনি মা।
“-আরশ! ভুল আমরা করিনা। আমরা প্রত্যেকেই ভাবি এই কাজটা সঠিক। কিন্তু অপরের চোখে তা সঠিক না ও হতে পারে। তোমার চোখে যা ঠিক অন্যের চোখে ও তা ঠিক হবে এমনটা নয় আব্বু। তুমি বুঝেছো আমি কি বলেছি? তোমার করা ভুল ফারহিন অন্যের মুখ থেকে শুনে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে তুমি নিজেই তা স্বীকার করে তাকে করা আঘাতে প্রলেপ লাগাও। আজ না হয় কাল সব ঠিক হয়ে যাবে।

আরশ ধীর গতিতে মাটিতে বসে পড়লো। সালমার কোলে মাথা রেখে বলল-
“-সে আমায় ভুল বুঝবেনা তো সবটা জানার পর? আমার কাউকে লাগবেনা, কিন্তু আমি তাকে না পেলে চলতে পারবোনা মা। তাকে ছাড়া আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে সে। আমি তাকে এক মুহুর্তের জন্যও আলাদা করতে পারব না। সেখানে তাকে ছাড়া থাকবো এটা ভাবতেও আর কলিজা ছিড়ে রক্তক্ষরণ হয়।
“-কিচ্ছু হবে না আমি আছি। তোমার ফারহিন কোথাও যাবেনা তোমাকে ছেড়ে।

চলমান….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে