শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব-১৫

0
546

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৫||

★বাড়ি প্রবেশের পরই ফারহিন জানতে পেরেছে বিগত ৫দিন আগে তার বাবা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। হাসপাতাল থাকাকালীন একবারও তার বাবা তাকে দেখতে যায়নি বলে সোজা নিজের বাপের বাড়ি আসার জেদ ধরেছিলো সে। আরশ ও নিয়ে এলো। কিন্তু এখানে এসে ফারহিনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মত অবস্থা হলো। সে বিশ্বাসই করতে পারছেনা সবাই তাকে মিথ্যে বলেছে। সবচেয়ে বড় কথা বাবাকে শেষ বারের মত সে দেখতেও পেল না। পাগলের মত আচরণ শুরু করলো সে। ঘরের সমস্ত জিনিস পত্র এলোমেলো করে দিলো। অসুস্থ শরীরে তার পা টলছে। তাকে সামলানোর জন্য যারা এগিয়ে যাচ্ছে তারাই তার ক্ষিপ্তা আচরণে পিছিয়ে আসছে। তার চাহনী, তার ব্যবহার রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। আরশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো। সে একটুও বাধা দিলো না ফারহিন কে। ফারহিন পুরো ঘরের জিনিসপত্র ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো। ফারহিনের গগন কাঁপানো সেই কান্না সবার চোখে পানি আনতে বাধ্য করলো। তীব্র এমন পরিস্থিতি সইতে না পেরে এগিয়ে গেল দ্রুত। ফারহিন কে স্পর্শ করতেই ফারহিন ঘুরে দাঁড়িয়ে চড় বসিয়ে দিলো তীব্রের গালে,
“-সাহস কি করে হলো আমাকে ছোঁয়ার? কে হও তুমি?
“-ফারহিন শান্ত হও।
“-চুপ, একদম চুপ। আমি শান্ত হবো নাকি অশান্ত থাকবো তা তোমার না ভাবলেও চলবে। আর তাছাড়া তোমার তো এখানে থাকার কথা না। বেরিয়ে যাও। এই মুহুর্তে,এক্ষুণি বেরিয়ে যাও।
“-ফারহিন আমার কথাটা তো শোনো।
ফারহিন তীব্রের আর কোনো কথাই শুনলো না। তীব্র কে ধাক্কা দিলো। তীব্র বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেল। এগিয়ে এসে আরো একটি ধাক্কা দিয়ে বলল-
“-তোমার মুখও দেখতে চাইনা আমি। বের হও..
বলেই সেন্টার টেবিল ধাক্কা দিলো সে। ফারহিনের পেট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। অতিরিক্ত উত্তেজনায়, অস্থিরতায় ফারহিনের ক্ষত জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হলো তাতে ফারহিনের খেয়াল নেই।
সালমা এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আরশ আটকালো। ইশারায় নিষেধ করে নিজে এগিয়ে গেল। মাটিতে হাটু গেড়ে বসে কাঁদছে ফারহিন। আরশ পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে ডাকলো-
“-ফারহিন..!
ফারহিন ক্ষেপে গেল। তীব্র ভেবে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ে থাকা ফ্লাওয়ার ভাস ছুড়ে মারলো। ফ্লাওয়ার ভাস আরশের কপালে লেগে ভেঙে যায়। আরশের কপাল কিছুটা কেটে যায়। আরশ কপাল সাথে সাথে চেপে ধরে। রক্ত দেখলে পাছে ফারহিন আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে এই ভেবে। আরশের কপাল থেকে রক্ত গড়াতে দেখে সালমা এগিয়ে গেল। মেয়েকে শক্ত করে দুহাতে ধরে বলল-
“-কি করলে এটা তুমি? আরশকে আঘাত কেন করলে?
ফারহিন অশ্রুসিক্ত নয়নে আরশের দিকে তাকিয়ে রইল। আরশ এখনো কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সালমা আবারও বলে উঠলো-
“-তুমি অসুস্থ ছিলে বলেই জানানো হয়নি৷ কিন্তু তুমি এটা হয়তো জানোনা তোমার বাবার পর আরশের নিজের বাবাও মারা গেছে। আরশ নিজের বাবাকে শেষবারের মত দেখতেও পারেনি। কারণ হসপিটালে তোমার দেখাশোনা করছিলো। নিজের বাবার দাফনের এক মুহুর্ত আগেও তাকে দেখলো না আরশ। তোমার তো আমি বেঁচে আছি ফারহিন। কিন্তু আরশ? সে তো এতিম হয়ে গেল। আরশের আর কেউই রইলো না। তবুও নিজের সমস্ত শোক চাপা দিয়ে তোমার খেয়াল রেখেছে ছেলেটা। একদিকে তোমার আঘাত অন্যদিকে নিজের বাবাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার শোক। তোমাকেই বেছে নিলো সে। নিজের বাবার শোক নিজের মনের মাঝেই চাপা দিলো। আর তুমি কিনা ওকেই আঘাত করলে? কার জন্য এসব করেছে সে? ফারহিন তোমার বাবা ফিরে আসবেনা আর কিন্তু তুমি যে আছে তাকে এভাবে কষ্ট দিতে পারো না।

মায়ের কথা শুনে ফারহিনের পাগলামি বন্ধ হয়ে গেল। দুচোখ বেয়ে অনবরত গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। ফারহিন মায়ের হাত ছাড়িয়ে আরশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কাঁপা কন্ঠে প্রশ্ন করলো-
“-বা..বাব..বাবা ও?
আরশ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানান দিলো। ফারহিন আঁতকে উঠলো। নিশ্বাস যেন তার বন্ধ হয়ে এল। বিগত ৪ দিনে একবারও বুঝতে পারলো না ফারহিন। আরশ বুঝতেই দিলো না। এত বড় কষ্ট চাপা দিয়ে মানুষটা ওর সামনে স্বাভাবিক আচরণ করছিলো। আর ও কি না…
আরশের খুব কাছে গিয়ে দাঁড়ালো ফারহিন। একহাতে আরশের কপালে থাকা হাত টেনে সরিয়ে দিতেই রক্ত চোখে পড়লো। নিজের মুখ চেপে ধরলো সে। চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে বলল-
“-আ…আম..আমার জন্য আপ..আপনি..
আরশ দু’পাশে মাথা নেড়ে বার বার বারণ করছে। ফারহিনের এত কষ্ট তার সহ্য হচ্ছেনা। ফারহিনের চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে এলো। আরশ তা বুঝতে পেরে জড়িয়ে ধরতে যাওয়ার আগেই ফারহিন সেন্স হারালো। নিজের বুকে ফারহিনকে শক্ত করে চেপে ধরলো আরশ। অস্ফুটস্বরে বলল-
“-সরি!

★কাদের শিকদারের মেডিকেল রিপোর্ট তীব্রের হাতে। মৃত্যুর আগে সবই ঠিক ছিল। ইঞ্জুরি ছাড়া বাকি সব। তাহলে মৃত্যু হলো করে? ২ টার চেকাপেও সব ঠিক ছিলো। ৩টার চেকাপে আচমকা মৃত্যু কেন হলো? তীব্র তখনকার ডিউটিরত ডাক্তার এর সামনে বসে আছে। রিপোর্ট বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। ডক্টর বলল-
“-এমন খুব কম কেসেই হয়, সব ঠিকঠাক থাকার পরও মৃত্যুটা অস্বাভাবিকভাবেই আসে।
“-কোনো রিজন নেই? কোনো রিজন ছাড়া কিভাবে ডেথ পসিবল? কিছুতো থাকবে, হার্ট ফেইল, স্ট্রোক, কিছুতো..
“-ওহ্ হ্যাঁ, ওনার শ্বাসরোধ হওয়ায় উনি মারা গেছেন। যতটা আমরা আন্দাজ করতে পেরেছি।
“-হোয়াট!
অবাক হলো তীব্র।
“-ওনার তো অক্সিজেন চলছিলো..
“-হ্যাঁ, কিন্তু তারপরও উই ডোন্ট নো কিভাবে এসব হলো।
তীব্র আবারও হেলান দিয়ে বসলো। কাদের শিকদারের মুখের সেই দাগ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। তীব্র হুট করে সোজা হয়ে বসলো। বলল-
“-তখন ডিউটিরত নার্স কে ছিল?
“-সে তো আপাতত অফ ডিউটিতে।
“-আজকে তার ডিউটি নেই?
“-ইভনিং শিফট।
“-আপনি প্লিজ সে এলে আমায় একটু ইনফর্ম করবেন, ইটস আর্জেন্ট।
“-ওকে আমি ইনফর্ম করবো।
“-থ্যাংক ইউ। আমি অপেক্ষায় থাকবো আপনার ফোনের।
“-ওকে মি. চৌধুরী।

★সেন্স ফিরতেই উঠে বসলো ফারহিন। সামনেই আরশ বসা। আরশকে দেখে কান্না চাপা রইলো না। কেঁদে দিলো আবারও। আরশের কপালে ব্যান্ডেজ। আরশ তা দেখে সোফা ছেড়ে উঠে এসে ফারহিনের সামনে বসলো। ফারহিন দুহাতে মুখ ঢেকে সমানে কেঁদে যাচ্ছে। আরশ হাত দুটো সরিয়ে চোখের পানি মুছে দিলো। শান্ত স্বরে বলল-
“-তুমি এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
“-বা..বাপি।
“-আমি বুঝতে পারছি। ফারহিন আমার যদি ক্ষমতা থাকতো আমি ওনাকে নিয়ে আসতাম। কিন্তু আমায় সে ক্ষমতা উপরওয়ালা দেন নি। দিলে তোমায় অন্তত এভাবে কষ্ট পেতে দিতাম না।
ফারহিন মুখ তুলে তাকালো। নিজেকে স্বার্থপর লাগছে। সামনের মানুষটাও তো তার বাবা হারিয়েছে আর ফারহিন কি না নিজেই নিজের টা ভাবছে? মনে এমন প্রশ্নের উদয় হতেই ফারহিন নিজের উপর রেগে গেল। আরশ কে বলল-
“-বাবা..
“-মৃত মানুষ ফিরে আসেনা ফারহিন। এই পৃথিবীতে যে এসেছে তাকে একদিন না একদিন যেতেই হবে। কেউ অমর না। আমি নিজেও না। কেউ মারা গেছে তাই বলে তাদের শোকে ডুবে যারা বেঁচে আছে তাদের অগ্রাহ্য, অবহেলা করার মত মানুষ আমি না। আমি নিজেকে এটা বুঝিয়েছি, যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে। তাই আমার কাছে সেই চলে যাওয়া মানুষ গুলোর চেয়ে যারা আছে তারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কষ্ট হয়, কোথাও না কোথাও কষ্ট তবুও থেকে যায়। কষ্ট গোপনে আঁকড়ে ধরতে হয়, প্রকাশ করতে নেই। যারা গেছে তাদের জন্য এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তাদের আত্মাও শান্তি পাবেনা, তাই আমি চাই আমার মানুষ গুলো ওপারে ভালো থাকুক। তাদের রেখে যাওয়া মানুষ গুলোর বিলাপ, আর্তনাদ তাদের একটুও অশান্তির মুখে না ফেলুক।
“-আমি আপনার মত এত স্ট্রং কেন হলাম না?
আরশের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ফারহিন। আরশ ফারহিনের চোখ মুখ মুছে দিয়ে বলল-
“-পৃথিবীতে কেউ কারো মত হয় না। আমার মত তোমার হতেও হবেনা। তুমি তোমার মত থাকো। শুধু এইটুকু বলবো, তোমার আমার চেয়ে একজনের কষ্ট অনেক বেশি। তার আজীবনের সঙ্গী, প্রেমের মানুষ, একমাত্র ভালোবাসা, তার স্বামী মারা গেছে। এই মুহুর্তে তার পাশে আমাদের থাকা উচিত। তার মানসিক শক্তি আমাদেরই হতে হবে।
“-মা..
“-হুম! আমি মা কে আমাদের সাথেই নিয়ে যেতে চাই। কিন্তু তোমার সুস্থ হতে হবে। তুমি সুস্থ না হলে মায়ের খেয়াল রাখতে পারবেনা। তাই নিজেকে শক্ত রাখো, সুস্থ হয়ে ওঠো। বাবা কখনো চাইতেন না তার প্রিন্সেস সামান্যতম অসুস্থ থাকুক। বাবার জন্য হলেও সুস্থ হয়ে ওঠো।
বাবার কথা বলতেই কেঁদে দিলো ফারহিন। আরশের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে দিলো। আরশ মাথায় হাত রাখলো। পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিলো। মৃদুস্বরে বলল-
“-ফারহিন?
“-জি!
কান্না ভেজা কন্ঠে জবাব দিলো ফারহিন।
“-আমি তোমার চোখের পানি সইতে পারিনা। তোমার কষ্ট ও না। আজীবন কষ্ট পাওয়ার চেয়ে একবার পাওয়া শ্রেয়। শেষবারের মত আজকেই কেঁদে নাও। কারণ এর পর আমি তোমাকে কাঁদতে দেব না আর। তোমার চোখের প্রতিটা পানির মূল্য আমার কাছে অনেক। আমি তা এত সহজেই ঝরানোর অনুমতি দেব না।

দরজায় নক পরতেই আরশ ফিরে তাকালো। সালমা দরজায় দাঁড়িয়ে।
“-আসুন মা।
সালমা ভেতরে প্রবেশ করে বলল-
“-তোমাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত।
“-কিন্তু মা?
“-আরশ ও বাড়িতেও কারো মৃত্যু হয়েছে। এই মুহুর্তে ওখানে থাকা উচিত। ফারহিন কে নিয়ে তুমি যাও।
“-কিন্তু মা তুমি এখানে একা, আমি তোমায় একা রেখে কীভাবে যাবো?
সালমা মেয়ের পাশে বসলো। বলল-
“-আমি এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবো না ফারহিন। তোমার বাবার এই শেষ স্মৃতি ছেড়ে কোথাও গিয়ে আমি শান্তিও পাবো না। প্লিজ আমায় জোর করো না। তৈরি হয়ে নাও আস্তে ধীরর তোমায় ফিরতে হবে।
“-কিন্তু মা…
“-ফারহিন তোমার শশুর মারা গেছেন। তোমার ওখানেই থাকা উচিত। যাও!

ফারহিন আর আরশ আর কিছু বলল না। সালমা দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এলো।

★হাসপাতাল থেকে তীব্রকে ফোন করেছে। সেদিন রাতের ডিউটিরত সেই নার্সের সাথে দেখা করতে তীব্র ছুটলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

চলমান….

||ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।||

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে