#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১৪||
★আরশ! আঙ্কেল আর নেই। রাত ৩টায় ওনার ডেথ হয়েছে।
কাপা কণ্ঠে কথাটা বলে আরশের দিকে তাকালো তীব্র। চেহারাটা মলিন হয়ে আছে। চুলগুলো এলোমেলো। পরপর দুজন মানুষের এভাবে আকস্মিক মৃত্যু বদলে দিয়েছে তীব্রের সাহস ও মনোবল। আরশ সম্পুর্ন একা হয়ে গেল, বাবা ছাড়া আরশের কেউ ছিলো না এখন সেও নেই। তীব্র আরশের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আরশ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করলো। বলল-
“-জানি! তোর আগেই আমাকে বলেছে ডক্টর।
আরশের এমন স্বাভাবিক কথায় তীব্র চমকালো। আরশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য বলল-
“-তুই এত নরমাল?
“-ভোর রাতে ফারহিনের সেন্স ফিরেছে। আমি রি মুহুর্তে কোনো দুঃসংবাদ ফারহিন কে শোনাতে চাইছিনা। আমাকে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে, নাহলে ফারহিন কে সামলানো যাবে না।
“-কিন্তু আঙ্কেল…
“-আর নেই! জানি আমি। আমি এই মুহুর্তে এখান থেকে যেতে পারবোনা তীব্র, তুই বাবার লাশ নিয়ে যা দাফনকাজের ব্যবস্থা কর। আমি সুযোগ বুঝে আসবো।
আরশের কথায় তীব্র অবাক হলো। কেমন ছেলে ও? নিজের বাবার শেষ কার্যক্রম বন্ধুর হাতে তুলে দিচ্ছে।
“-আরশ তোর বাবা মারা গেছে। তুই শুধু মাত্র ফারহিনের জন্য ওনার সমস্ত কাজ আমার হাতে তুলে দিচ্ছিস?
“-শুধু মাত্র না। ফারহিন আমার কাছে শুধুমাত্র না। সে পুরোপুরি সুস্থ হয়নি আর এই মুহুর্তে যে গেছে তার কথা ভাবতে গিয়ে যে আছে তাকে আমি হারাতে চাইনা। ফারহিনকে তো আরো না। আমার কাছে ফারহিন অনেক ইম্পর্ট্যান্ট! অনেক।
“-আর তোর বাবা? এখানে নার্স আছে, ডক্টর আছে। ওরা ফারহিন কে একবেলা দেখতে পারবে কিন্তু তুই তোর বাবাকে আজকের পর আর দেখতে পাবিনা, এটা ভুলে যাস না।
“-আমি জানি, মারা গেলে কেউ ব্যাক আসেনা। তাই আমি চাইনা ফারহিনও কোনো দুর্ঘটনার শিকার হোক। আর তুই এত কথা বলছিস কেন? না পারলে বলে দে আমি সামলে নেব।
তীব্র বিস্ময়ের চরম শিখরে পৌঁছে গেল। পরপর দুজন মানুষের মৃত্যু, তার মধ্যে আরশের বাবা যে ছাড়া আরশের কেউ নেই তার জন্যও আরশের বিন্দুমাত্র মায়া নেই? আরশ নির্দিয় জানতো তবে এতটা হবে তীব্র কল্পনাও করেনি। আরশকে কিছু না বলে তীব্র যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। যাওয়ার আগে তীব্র কে বলল-
“-তোর মত মানুষ আমি দেখিনি।
“-দেখার আশাও রাখিস না।
শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো আরশ।
★স্যুপ ভর্তি চামচ ফারহিনের মুখের সামনে ধরতেই ফারহিন বলে উঠলো-
“-বাবা আসেনি?
“-জরুরী কাজে একটু দূরে আছে, ফিরলে তবেই আসবে।
ফারহিন অবাক হলো, তার বাবার কাছে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি এমন কাজ হতে পারে? ফারহিন আবারও বলল-
“-আমার চেয়ে জরুরী এমন কি কাজ যার কারণে উনি আমাকে দেখতে এলো না?
“-হবে কোনো জরুরী।
“-না আরশ! আমার বাবা এমন না। আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে, আমার আগে কিছুই না তার কাছে।
“-আমিও তো ভালোবাসি!!
ফারহিনের কথা শেষ হতেই তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল আরশ। ফারহিন ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো-
“-কা..কাকে?
“-তোমাকে। আর কাকে!
“-বাবাকে একটা ফোন করবেন?
“-নেটওয়ার্কের বাহিরে আছে কল যাবেনা ওখানে।
বাটিতে থাকা স্যুপ নাড়তে নাড়তে বলল আরশ।
“-এমন কোথায় গেছে যে নেটওয়ার্কই নেই।
ফারহিনের অস্থিরতা বাড়তে দেখে আরশ বলল-
“-ফারহিন! তুমি পুরোপুরি সুস্থ হওনি। তোমাকে সুস্থ হতে হবে। এখান থেকে বাড়ি ফিরতে হবে। তুমি এই সামান্য বিষয়ে উত্তেজিত হলে চলবে না।
“-কিন্তু আরশ..
“-কোনো কিন্তু না হা করো! আমি নিজের হাতে বানিয়েছি স্যুপ।
ফারহিন বাধ্য মেয়ের মত হা করলো। স্যুপ খেয়ে বলল-
“-রাধতে পারেন নাকি?
“-একটু আধটু! কেন?
“-না দেখে মনে হয় না।
“-আমাকে দেখে অনেক কিছুই মনে হয় না।
ফারহিন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ খেতে লাগলো।আরশ খাওয়াতে খাওয়াতে বলল-
“-এভাবে হুটহাট আর অসুস্থ হয়ে পড়বেনা, কেমন?
“-কেন?
আরশ তাকালো, বাটি রেখে একটু এগিয়ে গিয়ে ফারহিনের ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা স্যুপ মুছে বলল-
“-আমার খারাপ লাগে তাই।
ফারহিন থতমত খেল। বলল-
“-নার্স কে একটু ডেকে দেবেন?
“-কেন?
“-আমার চুলগুলো বেধে দেওয়ার জন্য অনেক বিরক্ত করছে বার বার চোখের উপর চলে আসছে।
“-নার্স লাগবেনা, এদিকে এসো আমি বেধে দিই।
ফারহিন অবাক হলো, বলল-
“-চুল ও বাধতে পারেন?
“-পারি না পারতে কতক্ষণ?
“-না থাক, অযথা টানাটানি করে আমার চুল ছেড়ার দরকার নেই আপনি নার্স কে ডেকে দিন।
“-একটা চুলও ছিড়বে না, প্রমিস।
বলেই চোখ টিপল আরশ। ফারহিন ভ্রু কুঁচকালো। আরশ ফারহিন কে ঘুরিয়ে বসালো। চুল গুলো হাতের মুঠোই নিয়ে বলল-
“-বেশ লম্বা তোমার চুল।
“-সব মায়ের কেরামতি। মাথাভর্তি তেল, রাতে বেধে দেওয়া এসব মায়ের নিত্যদিনের ডিউটি ছিলো। মায়ের হাতের তেলের ম্যাসাজ পেয়ে পেয়েই এই অবস্থা।
আরশ চুপচাপ শুনছিলো। চুলে বিনুনি করতে করতে বলল-
“-ফারহিন?
“-হুম?
“-তোমার চুল অনেক সুন্দর।
“-জানি তো।
“-তবে তোমার চেয়ে না।
ফারহিন চুপ করে গেল। আরশ ফারহিন কে সোজা করে বসিয়ে সামনে এসে বসতেই ফারহিন বলল-
“-আমরা বাড়ি কবে যাবো?
“-কেন?
“-আমার হাসপাতাল পছন্দ না। এখানে থাকতে ভালো লাগছেনা।
“-পরশু।
“-পরশু কেন? কাল কেন না?
“-তুমি অসুস্থ ফারহিন, এত তাড়াতাড়ি রিলিজ দিবেনা।
“-কে বলল, আমিতো ফিট আছি৷ বাসায় রেস্টে থাকবো প্লিজ নিয়ে চলুন।
ফারহিনের করুণ অনুরোধে আরশ রাজি হয়ে গেল বলল-
“-ঠিক আছে, কথা বলে দেখি।
“-ঠিক আছে।
“-এখন ঘুমাও। তোমার একটু ঘুমানো উচিত।
“-আমার ঘুম আসবেনা।
“-আমি একটু বাসায় যাবো ফারহিন, ফ্রেশ হতে হবে। তুমি না ঘুমালে যেতে পারবোনা।
“-কিন্তু আমার যে ঘুম আসছেনা।
অসহায় মুখ করে বলল ফারহিন। আরশ বলল-
“-তাহলে নার্স কে ডেকে দিই?
“-আপনি থাকুন। নার্সের সাথে আমি কিইবা বলবো?
“-আমার সাথে কি বলবে?
“-হাসবেন্ড ওয়াইফের কত কথা থাকে।
নিজের মুখ নিজেই চেপে ধরলো ফারহিন। চরম লজ্জা। আরশ মুচকি হাসলো। বলল-
“-তা শুনি হাসবেন্ড ওয়াইফের সেই ‘কত কথা’ গুলো কি?
ফারহিন লজ্জা পেল। মুখ নিচু করে আছে। আরশ এক দৃষ্টিতে সেই লজ্জামাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা সব পরিস্থিতিতেই আরশ কে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করে।আর আরশ বার বার তার মায়ার তীরে ক্ষত বিক্ষত হয়।
★কাদের শিকদারের মুখের কাফন বেধে দিতে বলে তীব্র। আরশ এখনো আসেনি। আসরের আজান দিবে একটু পরই, এতক্ষণ রাখা ঠিক হচ্ছেনা। মসজিদের ইমাম তাড়া দিচ্ছে। তীব্র বেশ কয়েকবার ফোন করেছে কিন্তু আরশের ফোন বন্ধ। আর উপায় না পেয়ে নিজেই দাফন করার সিদ্ধান্ত নিলো। কাফন পরিয়ে দেওয়ার একটু আগেই তীব্র সবাইকে থামিয়ে দিলো, শেষবারের মত একবার সে দেখতে চায় বলে জানালো। মুখের কাফন সরিয়ে দিতে তীব্রের ভ্রু কুঁচকে গেল। লাশের উপর একটু ঝুকে দেখলো মুখের নিচের অংশে লাল হয়ে আছে। তীব্র ভালোভাবেই তা লক্ষ্য করলো। আইসিইউতে থাকাকালীন এই দাগ তো ছিলো না,তাহলে এখন এই দাগ কোথা থেকে এসেছে? তীব্রের ভাবনায় টান পড়লো ইমামের ডাকে। তীব্র সরে আসলো। কাফন পরিয়ে লাশ খাটিয়ায় তোলা হলো। সবাই খাটিয়ার পায়া ধরার আগেই আরশের বলিষ্ঠ হাত খাটিয়ার এক পায়া আঁকড়ে ধরে। খাটিয়ার পায়া ধরতেই তীব্র স্বস্তি ফিরে পেল। বাকিরাও খাটিয়া তুলে নিলো। আরশ পাথরের ন্যায় চুপ হয়ে আছে।
কবরস্থানে গিয়ে জানালো বাবাকে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর কাছেই কবর দিতে চায় আরশ। এটাই তাত বাবার শেষ ইচ্ছে ছিলো বলে জানিয়েছে। তাই সবাই দিদার হাসানের পাশেই নতুন করে কবর করলো। দাফন শেষে আরশ সবাইকে চলে যেতে বলল। তীব্র থাকতে চাইলে আরশ রাজি হয়নি, কবরস্থানের বাহিরে অপেক্ষা করতে বলল সে। বাধ্য হয়ে তীব্রও সবার সাথে চলে গেল। সবাই চোখের আড়াল হতেই আরশ বসে পড়লো মাটিতে। দুজনের কবরে হাত বুলিয়ে দিলো। তারপর বলল-
“-আমায় ভুল বুঝবেন না! আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন ফারহিন আমার কাছে অনেক ভালো থাকবে। অন্তত আপনার মত, আমার জন্য কেউ তাকে আঘাত করবেনা। আপনাদের পরকালের জীবন সুখকর হোক।
উঠে দাঁড়ালো আরশ। কবরের দিকে একবারও ফিরে তাকালো না। সোজা হেটে চলে এসেছে সে৷ বিন্দুমাত্র আক্ষেপ তার নেই। নেই বাবাকে হারিয়ে ফেলার কোনো আফসোস। কারণ আরশ নিজেই চায়নি সে বেঁচে থাকুক। ফারহিনকে এত কষ্ট দেওয়ার পর অন্তত তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। সে কখনো আরশকে শান্তি দিতে পারেনি তাই আরশের শান্তি নষ্ট করার অধিকারও তার নেই।
কবরস্থান থেকে বের হতেই দেখলো তীব্র দাঁড়িয়ে। তীব্র এগিয়ে এলো। আরশকে বলল-
“-তোকে আঙ্কেলের ব্যাপারে কিছু বলতে চাই, আঙ্কেল…
“-আর নেই! জানি আমি। এই এক কথা আর কত বার বলবি?
“-তোর কি মাথা খারাপ নাকি? তুই এত স্বাভাবিক কীভাবে?
আরশ তীব্রকে পুরো কথা শেষ করতে না দেওয়ায় তীব্রের মেজাজ বিগড়ে যায়,ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো তীব্র।
“-তো কি করবো? আটঘাট বেধে কাঁদতে বসে পড়ি?
“-আমি তোকে তা বলিনি!
“-ফারহিন হসপিটালে একা আমার যেতে হবে।
“-ফারহিন! ফারহিন! ফারহিন, সবসময় এই এক ফারহিন কে নিয়ে কেন পড়ে আছিস তুই? তোর বাবা মারা গেছে আরশ।
“-ওকে নিয়ে পড়ে থাকাটাই স্বাভাবিক নয় কি? আর আমার বাবা মারা গেছে জানি, কিন্তু তুই হয়তো জানিস না ফারহিন অনেক ছোট। সে যদি জানে তার বাবা মারা গেছে তাহলে সে ভেঙ্গে পড়বে। আর আমি তা চাইনা।
আরশের কথায় ধামাচাপা পড়ে গেল তীব্রের উত্তেজনা।
“-আর তোর বাবা যে মারা গেছে?
“-ফারহিনের আগে কিছু না। আমার বাবা হারানোর শোক ও না।
বলেই আরশ গাড়িতে বসে পড়লো। তীব্র আরশের যাওয়া দেখছিলো। আরশের হাবভাব তার কিছুতেই স্বাভাবিক ঠেকছে না। তীব্র এটা অন্তত বুঝেছে কাদের শিকদারের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
চলমান……
||ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ||