শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব-১২

0
576

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১২||

★আইসিইউতে পড়ে আছে ফারহিন। পেটের ডান পাশটায় গভীর ক্ষত হয়েছে। ওটি থেকে আইসিউ তে শিফট করা হলো তাকে। নিথর হয়ে পড়ে আছে ফারহিন। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। সেন্স নিয়ে শঙ্কায় আছে ডাক্তাররা। আইসিইউতে আপাতত কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ডাক্তার। ভিজিটিং টাইম সকাল ১০ঃ০০-১২ঃ০০ টা। আর বিকালে ৪ঃ০০-৬ঃ০০টা। আরশ হাজার বলেও ভেতরে যেতে পারেনি। সবাই আরশকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে বসিয়ে রেখেছে। আইসিইউর দরজায় ছোট্ট লুকিং গ্লাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আরশ। আরশের ক্লান্ত দৃষ্টি ভেতরে শয্যাশায়িনী ফারহিনের দিকে। আরশ ধীর গতিতে গ্লাসে হাত রাখলো। ফারহিন কে সরাসরি ছোঁয়ার অধিকার এই মুহুর্তে তার নেই। আরশ লুকিং গ্লাসে মাথা ঠেকিয়ে দিলো। হঠাৎ কি মনে করে ফারহিনের দিকে তাকালো। আইসিইউর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো আচমকা। আইসিইউতে ডিউটিরত নার্স চমকে গেল। আরশের এহেন কান্ডে বেশ বিরক্ত হলো। বলল-
“-আপনি এই সময়ে কেন এসেছেন? এখন এলাউ করা পসিবল না প্লিজ আপনি বের হয়ে যান।
আরশ নার্সের কথায় একদম চুপ করে রইলো। ধীর গতিতে এগিয়ে গেল ফারহিনের দিকে। চেয়ার টেনে বসার আগেই নার্স আবারও থামালো।
“-আপনি কি কথা শুনছেন না? বেরিয়ে যান! এখন ভিজিটিং টাইম না। প্লিজ রুলস মেইনটেইন করুন।
আরশ দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। চোখ রাঙিয়ে তাকালো নার্সের দিকে। নিজের ঠোঁটের কাছে আঙুল নিয়ে বলল –
“-হুশশশশ! আমার ফারহিন রেস্ট নিচ্ছে একদম বাড়াবাড়ি করবেন না। আর আমি আমার ফারহিনের সাথে কখন দেখা করবো না করবো তা আপনি ডিসাইড করার কে? আমি এখানে আমার ফারহিনকে ট্রিটমেন্ট এর জন্য এডমিট করিয়েছি আপনাদের এসব ফালতু রুলস মেইনটেইন করতে না। সো কিপ কোয়াইট!!

আরশের রক্তবর্ণ চোখের চাহনি দেখে নার্স চুপসে গেল। চুপ করে রইলো। আর কোনো কথা বাড়ালো না সে। আরশ ফারহিনের পাশেই বসে পড়লো। ফারহিনের ক্যানুলা লাগানো হাতটা নিজের হাতের মুঠোই ধরে মুখের কাছে ঠেকালো। জ্বলজ্বল করছে তার অক্ষিজোড়া। নিজেকে আপ্রাণ শান্ত রাখার চেষ্টা করছে সে। ফারহিনের মুখে এখনো সাজ যায়নি, মেয়েটা কতসুন্দর করে সেজেছিলো আর আজকেই এসব..? আরশ ভেজা গলায় বলল-
“-তোমাকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না ফারহিন। কেন হলো? আজ এসব হওয়াটা কি খুব জরুরী ছিলো? কিসের শাস্তি পেলাম আমি? আমিতো তোমাকে ছাড়া কিছু চাইনি তাহলে কেন তুমি এভাবে আমাকে অসহায় করে দিয়ে নিথর হয়ে আছো? আমার কষ্ট, আমার অসহায়ত্ব তোমার অন্তর অবধি পৌঁছাচ্ছে না? আমাকে এভাবে অসহায়ের মত দেখতে ভালো লাগছে? ও চাঁদ, আমার ভেতর পুরো উলোট পালোট হয়ে আছে, তোমার মুখের কথা আমার কর্ণকুহরে না পৌঁছানো অবধি আমার অস্থিরতা, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামবে না।
ফারহিম চুপ! কোনো উত্তর নেই। কীভাবে দেবে সে উত্তর এখনো যে তার সেন্সই ফিরলো না। আরশের চেহারায় হঠাৎ করেই কাঠিন্যেতার আবরণ পড়ে গেল। এলো-মেলো হয়ে উঠলো দৃষ্টি, অস্থির হলো চাহনি। শক্ত কন্ঠে বলল-
“-তোমার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস কার হলো? কার জন্য তোমার এমন অবস্থা হলো? আমি তাকে ক্ষমা করবো না, আরশ শিকদারের জঘন্য রুপের মুখোমুখি হবে সে। তোমার সেন্স ফিরে আসার আগেই আমি তাকে খুঁজে বের করবো। আদারওয়াইজ, আমি তোমাকে আমার এই মুখ দেখাবো না!

★হসপিটালের লিফটের সামনে করিডরে দিদার হাসানের কলার চেপে ধরলো সালমা। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল-
“-কি যেন বলছিলেন? আপনার মেয়েকে সেভ করতেই আপনি তাকে অন্যের হাতে এত তাড়াতাড়ি তুলে দিচ্ছেন তাহলে এসব কি দিদার? আমার মেয়েটা কয়েকঘন্টা যাবত লাশ হয়ে পড়ে আছে আর আপনি কি না এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আফসোস করছেন? এই দিন দেখার বাকি ছিলো দিদার? আপনার জন্য আমার মেয়ে মৃতুশয্যায় পড়ে আছে। আপনি কীভাবে এতটা নির্দয় হলেন দিদার। আমি বার বার বলেছিলাম এই ব্যবসা থেকে সরে আসুন। আজ আমার ফুলের মত মেয়েটা মৃত্যুর দুয়ারে এসে ঠেকেছে।

সালমাকে শান্ত করাতে এগিয়ে গেলেন কাদের শিকদার,
“-শান্ত হোন ভাবি! আমরা কেউই জানতাম না এমন কিছু হবে। আমরা অতি শীগ্রই তা খুঁজে বের করবো!
“-চুপ করুন ভাইসাব। তাকে খুঁজে কি করবেন? আমার মেয়ের যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। নিজের বাবার পাপের ফল সে ভোগ করছে।
দিদার হাসানের কলার ছেড়ে দিয়ে কাদের শিকদারের দিকে তাকিয়ে বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল সালমা।
“-সালমা শান্ত হও। আমি কিছু হতে দেব না।
“-ছোঁবেন না আমায়। আপনার এই পাপী হাতে আমাকে ছোঁবেন না দিদার। আমার মেয়ের এখনো সেন্স ফিরেনি। আমার মেয়েটা কথা বলছেনা। আজ তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহুর্তে সে কি না হসপিটালের বেডে পড়ে আছে? এটা আমি কীভাবে মেনে নেব?
“-ভাবী শান্ত হোন! আমরা সব ঠিক করে নেব, কিছু হবেনা ফারহিনের।
সালমাকে শান্ত করতে বলে উঠলো কাদের শিকদার।
“-ঠিক করে নেবেন? গত ২০ বছর ধরে আপনারা আপনাদের ব্যবসাই বদলাতে পারেন নি আবার আপনারা কি না সব ঠিক করে দেবেন? আপনাদের এই টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতেই আজকে আরশ মা হারা। আর আজ আমার মেয়েটা…
“-সালমা!
অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদুস্বরে ডাকলো দিদার শিকদার।
“-ডাকবেন না আমায়! আপনি আমার নাম মুখে নেবেন না। আপনি আমার কেউ না। আপনি একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী, ইয়াবা ব্যবসায়ীই থেকে গেলেন না হতে পারলেন ভালো বাবা, না হতে পারলেন ভালো স্বামী।

দিদার হাসান মাথা নিচু করে আছে। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে তিনি আজ থেকে ২০ বছর আগে ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেছিলো সবার অগোচরে হয়ে উঠেছি অসীম ক্ষমতার একজন। নিজের এক মাত্র মেয়ের কাছে দিদার কখনোই তার এই কালো ব্যবসার কথা স্বীকার করেন নি। তিনি কখনোই তার মেয়ের সামনে এটা প্রকাশ হতে দেয়নি তিনি অসৎপথেই গড়েছে এত বড় একটা সাম্রাজ্য। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেওয়া ফারহিন এটা কখনোই জানলো না সে একজন ইয়াবা ব্যবসায়ীর মেয়ে। ব্যবসার শত্রুতার রেশ ধরেই দিদার হাসানের শত্রুর অভাব নেই। দিদার হাসান তার মেয়ে, পরিবার কে সবসময় রক্ষা করেছেন। আগলে রেখেছিলেন। নিজের মেয়ের জীবনে এমন কেউ জড়িয়ে যাবে বলে তিনি মেয়েকে কঠোর শাসনের মাঝে মানুষ করেন। যার দরুন ফারহিন কখনো বাহ্যিক কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারেনি। আজীবন ফারহিন জেনেছে তার বাবার এসব অপছন্দ। কিন্তু আসল সত্যিটা কখনোই ফারহিনের সামনে আসেনি হয়তো আসবেও না।

ফ্লোরে বসে পড়েছে সালমা। অঝোরে কাঁদছে মেয়ের জন্য। দিদার হাসান ধীর গতিতে সালমার পাশে বসে পড়লো। সালমাকে শান্ত করার ছোট্ট প্রচেষ্টা চালালো।
“-আমি আমার ভুল বুঝি সালমা। আজ আমার কারণেই আমার মেয়ের এমন দশা। আমার মেয়ের জীবন মরণের প্রশ্ন উঠেছে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যে বা যারা এই কাজ করেছে তাদের আমি ছাড়বো না।
“-তুই ঠিক বলেছিস, অনুষ্ঠানে তুই আর আমি দুজনেই উপস্থিত ছিলাম। আমাদের দুজনের কারো উপর হামলা করতে গিয়েই ফারহিনের উপর পড়েছে। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তোকে আঘাত করতে গিয়ে অন্ধকারে ফারহিনকে আঘাত করে বসলো। আর এই সব পূর্বপরিকল্পিত। পাওয়ার কাট, তারপর এমন অঘটন সব।
দিদার হাসানের চোয়াল শক্ত হয়ে এল। দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন তিনি।বললেন-
“-আমার ফুলের গায়ে যে হাত দিয়েছে আমি তাদের বুঝিয়ে দেব আঘাত করার যন্ত্রণা কতটা প্রখর। ওদের শাস্তি পেতেই হবে।

“-আর যাদের জন্য আমার ফারহিনের এমন অবস্থা আমি তাদেরও ক্ষমা করবো না, ক্ষমা করা আমার রুটিনে পড়ে না।

আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আরশ হাতের মুঠো শক্ত করে বলল। আইসিইউ থেকে বের হয়ে তাদের কাছে আসার সময় আরশ তাদের বলা সব কথা শুনেছে। তারপরই আরশের অস্থির হয়ে থাকা মস্তিষ্ক উথাল-পাথাল ঢেউয়ের ন্যায় আরো বেশি অস্থির হয়ে পড়লো।

★ছুটতে ছুটতে হাসপাতালের করিডরে এসে থামলো তীব্র। ফারহিনের কথা শোনার পর পরই সে হাসপাতালে ছুটে এসেছে। ফারহিনের নাম রিসেপশনিস্ট এর কাছে বলে আইসিইউর দিকে রওনা দিলো সে। আইসিইউর দরজার সামনে এসে সে থেমে গেল। থরথর করে কাঁপছে সে। কাঁপা হাতে আইসিইউর দরজার নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। ধীর পায়ে ফারহিনের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ওর মুখের সাজ দেখে তীব্রের কলিজা মোচড় দিলো। চেয়ার টেনে পাশেই বসে পড়লো। অনেক্ষণযাবত ফারহিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল-
“-তোমার তো এখানে থাকার কথা ছিলো না ফারহিন। এই সাজে আজ তোমার কারো সজ্জিত ঘরে থাকার কথা ছিলো কিন্তু তুমি এখানে এভাবে কেন পড়ে আছো? আমার উপর জমে থাকা রাগ-ক্ষোভ, অভিমান এখনো উগরে দেওয়া বাকি প্রিন্সেস। এভাবেই তুমি পড়ে থাকলে তো হবে না..

তীব্রের ভেতর ভেঙে হাজার টুকরোতে পরিণত হলো। তীব্রের চোখ দুটি প্রচন্ড জ্বালা করছে কিন্তু সে কাঁদছে না। নিজেকে সংযত করে রেখেছে। নিজের সমস্ত আবেগ, সমস্ত কান্না ধামাচাপা দিয়ে আইসিইউ থেকে বের হলো তীব্র। বেশিক্ষণ থাকলে দমবন্ধ হয়ে যাবে তার। অন্তঃকরণে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে বেশিক্ষণ ফারহিনের এমন বিধ্বস্ত অবস্থা দেখলে চোখ থেকেও রক্তক্ষরণ শুরু হবে। তীব্র নিজেই নিজের কপাল চাপড়ালো। মনে মনে একবার নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, ‘ফারহিনকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে ভুল করিনি তো’?

চলমান…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে