শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব-১৯

0
552

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-১৯||

★রাত ১২টা। গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনতেই দৌড় দিলো আরশ। এতক্ষণ অনেক কষ্টে আটকে রেখেছিলো আরশকে সালমা। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ধরে রেখেছিলো। গাড়ির হর্ণের শব্দ কানে আসতেই ‘ফারহিন এসেছে’ বলে আরশ দৌড় দিলো। সালমা ও পিছু পিছু বেরিয়ে গেল। আরশ গেইটের কাছে এসে কোনো গাড়ি দেখতে পেল না। দারোয়ান কে বেচয়েন কন্ঠে প্রশ্ন করলো-
“-ফারহিন আসেনি?
“-না স্যার।
“-হর্ণের শব্দ শুনলাম মনে হলো..?
“-না স্যার, ওটা অন্য গাড়ির।
আরশ আর কথা বাড়ালো না। পিছু ফিরতেই সালমা কে দেখে বলল-
“-মা অনেক্ষণ হলো আমি আর বসে থাকতে পারবোনা। জানিনা কোথায় গেছে।
“-কিন্তু আরশ..
সালমা কিছু বলার আগেই বাজি ফোটার শব্দ কানে এলো। আরশ ত্রস্তনয়নে তাকালো। বাগানের দিক থেকেই এসেছে আওয়াজ। আরশ আর সালমা দুজনেই বাগানের দিকে অগ্রসর হলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে আছে বাগান। আরশ কয়েক পা এগোতেই আরো একটি বাজির শব্দ কানে এলো সাথে সাথেই বাগানের চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল। রঙবেরঙের লাইটের আলোয় ঝলমল করছে বাগান। আরশ চারপাশ দেখে অবাক হয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো একটা গোল টেবিলে অনেক গুলো গিফট বক্স, বেলুন দিয়ে ডেকোরেশন করা হয়েছে। আরশ ব্যাপারটার গভীরতা বোঝার জন্য একটু এগিয়ে গেল। সমস্ত লাইট হুট করেই বন্ধ হয়ে গেল। আরশ থমকে গেল। হঠাৎ একটি মৃদুস্বর কানে এসে পৌঁছালো।
“-হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! হ্যাপি বার্থডে টু ইউ..
আরশ ত্রস্তপদে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে মোমবাতির আলোয় আবছা দৃশ্যমান ফারহিন। ফারহিনের মুখে মোহময়ী হাসি। সাথে সাথেই লাইট জ্বলে উঠলো। চারপাশ দেখে আরশ আবারো চমকালো, থমকালো। সামনেই কেক হাতে ফারহিন দাঁড়িয়ে। ফারহিন কে দেখে আরশ রাজ্যের স্বস্তি ফিরে পেল। মৃদু হেসে এগিয়ে এসে আরশের সামনে দাঁড়ালো ফারহিন-
“-হ্যাপি বার্থডে বাবুর আব্বু।
আরশ চারপাশ দেখে হেসে দিলো। এই প্রথম কেউ তাকে এত ঘটা করে উইশ করেছে। আরশ হাসি আটকাতে ঠোঁট চেপে রইলো। ফারহিন বলল-
“-একটু চিন্তায় ফেলেছি তার জন্য সরি। আমি আসলে চেয়েছিলাম ১২টায় উইশ করতে, তাই..!
“-কীভাবে জানলে?
“-কাবিননামায় লেখা ছিলো।
আরশ হাসলো।
“-হ্যাপি বার্থডে ভাইয়া।
এগিয়ে এসে বলল ফারহানা। হাতে একটা গিফট বক্স।
“-থ্যাংক ইউ।
ফারহানা আর ফারহিন কেক টেবিলে রাখতে চলে গেল। আরশ গিয়ে সালমা কে সালাম করলো। সালমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আরশের কপালে চুমু দিতেই আরশ সালমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, নিষ্পলক সেই চাহনি। সালমা বলল-
“-সমস্ত দুঃখ, দুর্দশা দূর হয়ে যাক। আমার আব্বু আজীবন হাসি খুশি থাকুক এই দোয়াই করি।
“-থ্যাংক ইউ মা।
সালমাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নিলো আরশ।

রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরশ। একটু আগে ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা তার চোখের সামনে ভাসছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালো। দু হাত রেলিংয়ে রেখে ভর দিলো। জীবনে কখনো কেউ তাকে এভাবে উইশ করেনি। তার জন্মদিনের কথা তো কারো মাথায় থাকতো না। আর মনে থাকলেও ছোট্ট একটা উইশেই সব শেষ। আরশ মৃদু হাসছিলো। ফারহিন নেই, ফারহানা আজ রাত থাকবে বলে ফারহানা কে রুম দেখিয়ে দিতে গেছে। হয়তো ওখানে আড্ডাতেও বসেছে। মেয়েটা কখনো আরশ কে বলেনি সে আরশকে ভালোবাসে। অথচ তার প্রতিটা কাজেই ভালোবাসা প্রকাশ পায়। আরশ কি করে থাকবে তাকে ছাড়া? অস্ফুটস্বরে নিজেই নিজেকে বলে উঠল,’তাকে ছাড়া থাকার কথা কল্পনাও করতে পারিনা, অসম্ভব।’
হঠাৎই কেউ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। আরশ দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলো ফারহিন। বিস্ময় নিয়ে ভ্রু কুঁচকাতেই ফারহিন মৃদুহেসে বলল-
“-চমকে গেলেন নাকি?
“-না হঠাৎ এভাবে…
“-কেন ধরতে পারি না?
“-কোনোদিন তো ধরোনি..
“-কোনোদিন ধরিনি বলে সামনেও কখনো ধরবোনা এটা ভাবলেন কি করে?
“-না আমি ভেবেছি..
“-কি ভেবেছেন? অন্য কেউ ধরেছে? অন্য কেউ কেন ধরবে? কি কারণে ধরবে? আমি কি যথেষ্ট নই।
ফারহিনের একসাথে করে বসা এতগুলো প্রশ্ন শুনে লম্বা শ্বাস নিলো আরশ। তারপর বলল-
“-তুমি ছাড়া কেউ নেই, কারো অধিকার নেই। সব তোমার।
আরশের কথা শুনে ফারহিন মৃদু হাসলো। দু হাতে আরশের গলা জড়িয়ে বলল-
“-হ্যাপি বার্থডে, কিছু কথা বলার ছিলো।
“-বলো..
ফারহিনকে দু’হাতে জড়িয়ে বলল আরশ।
“-আপনাকে কখনো বলা হয়নি, বলতে চেয়েও পারিনি। এত তাড়াতাড়ি সব কিছু হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি।
ফারহিন থামলো। নেত্রমনি নত করে নিলো। আরশ অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে সেই মায়াভরা মুখটির দিকে। হুট করেই ফারহিন তাকালো। বলল-
“-আমি আপনাকে ভালোবাসি। প্রথমটা আমার আবেগ ছিলো, কিন্তু আপনি? আপনি আমার ভালোবাসা আরশ। আমি আপনাকে আমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি আপনাকে না পেলে হয়তো মরেই যেতাম। আমি কখনো চাইনা আপনি আমার কাছ থেকে হারিয়ে যান। সবাইকে হারিয়ে বেঁচে থাকা গেলেও আপনাকে হারিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব হবেনা। আমি কি বলছি বুঝতে পারছেন তো আপনি? আমার কথাগুলো অনেকটা এলোমেলো তবে আপনি চাইলে বুঝে নিতে পারবেন। আমার এলোমেলো কথাগুলো প্লিজ বুঝে নিয়েন। আমাকে আজীবন এভাবেই আগলে রাখার অনুরোধ রইলো। আমি আপনাকে ছাড়া মরেও শান্তি পাবো না। কারণ আপনি যখন থেকে এসেছেন আমি একা থাকিনি, একা থাকার একটুও অভ্যাস নেই আমার। আপনি সেটা আমাকে অভ্যাস করতেই দেন নি।

আরশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ফারহিনের চোখ ভর্তি পানি। কথা বলার সময় ঠোঁট আর স্বর দুটোই কাঁপছে। আরশ নিজের হাতের বাধন শক্ত করলো। ফারহিনকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। ফারহিনের কানের পাশে চুল গুজে বলল-
“-বাহ্! আমার বোবা পাখির মুখে বুলি ফুটেছে তাহলে।
বলেই হেসে দিলো। আরশের সাথে ফারহিন ও হেসে দিলো। দুজনেই একে অপরের সাথে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। স্নিগ্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো প্রেমের সুভাস।

★ফারহানার হাত থেকে কফির কাপ মাটিত্র পড়ে ঝংকার তুললো। ফারহানা থরথর করে কাঁপছে। সামনেই বসে থাকা তীব্র ফারহানার ভয় কাটাতে বলল-
“-রিল্যাক্স। আমি জানি এটা মেনে নিতে কষ্ট হবে তোমার, কিন্তু আমি যা বলেছি তা সবই সত্যি।
“-ফারহিন জানে?
কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলো ফারহানা। তীব্র নাবোধক মাথা নাড়ালো। ফারহানা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। তীব্র বলল-
“-আমি ফারহিনের ক্ষতি চাইনা। আমি ভেবেছিলাম আরশ ওকে ভালো রাখবে, আর আরশ যেহেতু ছোট থেকেই একা তাই আমি ভেবেছিলাম ও ওর মর্ম বুঝবে। কিন্তু ও তো ওকে এতিমই করে দিলো। তুমিই ভাবো যে ছেলে নিজের বাবাকে খুন করার মত জঘন্য কাজ করতে পারে ও ফারহিন কে আঘাত করতে দুবার ভাববে না। আমি যে ভুল করেছি আমি তা শুধরে নিতে চাই ফারহানা। তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড তুমি প্লিজ আমাকে হেল্প করো। আমি খালামনি কে বলেছি কিন্তু আরশ খালামনিরও ব্রেইন ওয়াশ করে দিয়েছে যার কারণে তিনি আমার কথা শুনছেই না। এখন তুমি ছাড়া আমার আর কোনো পথ খোলা নেই। তুমি চাইলে পারবে ফারহিন কে সেভ করতে।
“-একটা জায়গায় খটকা আছে।
“-কি?
“-আমার মনে হয়না আরশ ভাইয়া সুস্থ!
তীব্র ভ্রু কুঁচকালো।
“-কেন? এটা কেন মনে হলো তোমার?
“-বিহেভিয়ার এ। একটা কথা আমি আপনাকে বলি আরশ ভাইয়া ফারহিনের সাথে বিয়ের আগে প্রায়ই মিট করতো। আর পূর্বপরিকল্পিত কখনোই ছিলো না। হুট করেই রাস্তায় দেখা হয়ে যেত আর উনি সারাদিন ফারহিন কে সময় দিত। যেকোনো বাহানায়। আপনি জানলে অবাক হবেন বিয়ের পর উনি ফারহিনকে কখনো কোনো রান্নাবান্না, বা তরকারি কাটাকাটি করায়নি। কারণ ফারহিন রক্ত ভয় পায়। আর সবচেয়ে বড় কথা উনি ফারহিনকে নিয়ে অনেক সেনসেটিভ ও পজেসিভ। বিয়ের এই কয়েক মাস উনি ফারহিন কে যেমন সময় দিয়েছে, যেমন যত্ন করেছে ঠিক তেমনই উনি ফারহিনের উপর পূর্ণ অধিকার ফলিয়েছে। আর ফারহিনকে কখনোই কিছুতে জোর করেনি। আমার মনে হয় না উনি ফারহিন কে কোনো আঘাত করবে।

তীব্রের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়ার মত অবস্থা হলো, সে উচ্চস্বরে বলে উঠল-
“-আরে ও মেন্টালি এভনরমাল। ও সবার জন্য হার্মফুল।।যেকোনো মুহুর্তে ফারহিন কেও আঘাত করে বসবে যদি ফারহিন তার কথা একটু অমান্য করে। আঙ্কেলরা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে ছিলো বলে অনেক শত্রু ছিলো তাদের মধ্যেই একজন ফারহিনের উপর অ্যাটাক করে আর সে কারণেই ও তাদের মেরে ফেলে৷ এটা কোনো লজিক নাকি?
“-ভাইয়া! আপনি চাইছেন ফারহিন ওনার সত্যিটা জানুক। ফারহিন কে সত্যি জানাতে হলে এটাও জানাতে হবে ওর বাবা একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী ছিলো। এটা শুনলে ফারহিন কি আসলেই মনের দিক থেকে আস্ত থাকবে? আঙ্কেল ফারহিনের ইমোশন। অনেকটা জুড়ে তিনি আছে, যাকে ও নিজের আদর্শ, বেস্ট বাবা ভেবেছে তার বিরুদ্ধে এসব শুনলে ফারহিন ততটাই ভেঙ্গে পড়বে যতটা না সে আরশ ভাইয়ার কথা শুনে ভেঙ্গে পড়বে। আরশ ভাইয়া তাদের মার্ডার করেছে কারণ তাদের কারণেই ওর উপর অ্যাটাক হচ্ছিলো, আর এর আগেও ফারহিনের উপর অনেক অ্যাটাক হয়েছে। যার কারণে আঙ্কেল ফারহিনকে প্রায় ঘর বন্ধি করে রাখতো। আর নানান মিথ্যে-বানোয়াট ওকে বলে বুঝ দিতো। এসব যখন ফারহিন এই এক কথায় বুঝবে তখন ফারহিন নিজেই ভেতর ভেতর মরে যাবে। ঘৃণা করবে ওর মৃত বাবাকে। কেঁচো তুলতে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে আসবে। আর ফারহিনের এখন প্রেগন্যান্সি চলছে ওর অনেক কম্পলিকেশ আছে। প্রেগন্যান্সির এই সময়ে ফারহিনের এতটা প্রেশার নেওয়া ঠিক হবেনা। তাই আমি চাইনা ফারহিন এই মুহুর্তে এসব জানুক। আমি পারবোনা ভাইয়া সরি।
বলেই ফারহানা উঠে দাঁড়ালো, যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তীব্র আটকালো-
“-ফারহানা প্লিজ আমার কথা শোনো দরকার পরলে আমরা ওকে আঙ্কেলের ম্যাটারটা বলবোনা। ওটা হাইড করবো।
ফারহানা ভ্রু কুঁচকে নিল-
“-প্রত্যেকটা ঘটনার এপিটওপিট হয়। আপনি একটা পিঠ দেখিয়েই আরশ ভাইয়াকে দোষী করতে পারেন না। আর তাছাড়া ফারহিনের সম্পূর্ণ অধিকার আছে হক আছে সবটা জানার।
“-তুমিও আরশের সাইড নিচ্ছো?
বিস্ময় নিয়ে বলল তীব্র।
“-আপনি ভুল বুঝছেন। আমি কারো সাইড নিচ্ছি না। আমি শুধু ফারহিনের কথা ভাবছি। আর আপনি যেটা বলছেন সেটা অন্যায়। এভাবে আঙ্কেলের দোষ হাইড করে আরশ ভাইয়ার ঘাড়ে সম্পুর্ন দোষ চাপাতে পারিনা। কারণ আরশ ভাইয়ার সাথে তাদের আশাকরি কোনো পার্সোনাল শত্রুতা ছিলো না। নাকি এটাও আপনি বানিয়ে দেবেন কোনো একটা বানোয়াট কথা বলে?

তীব্র কিছু বলতে চাওয়ার আগেই ফারহানা বলল-
“-আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আমি আসছি…
ফারহানা ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই তীব্র টেবিলে ঘুষি বসালো।
“-এত অন্যায়! এত অন্যায় করার পরও কেন সবাই ওর সাইড নিচ্ছে? কি আছে যেটা আমি শো করতে পারছিনা..

চলমান….

রি-চেক করিনি! ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
আসসালামু আলাইকুম ♥

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে