#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-১০||
★
“-ফারহিন! তীব্র এসেছে…।
সালমার উচ্চস্বরে ফারহিনকে ডেকে বলা কথাটা ফারহিনের কানে পৌঁছাতেই ফারহিন হাতে থাকা বই রেখে দিয়েছে। উঠে দাঁড়ালো সে। কতদিন আসেনি তীব্র! ফারহিন নিজেও ডাকেনি। নিজের আবেগ,অনুভুতি লুকিয়ে রাখতে গিয়ে নিজেই বার বার হেরে যাচ্ছে। তবুও বিয়ে পর্যন্ত সে এই নাটকটা চালিয়ে যাবে। দ্রুত দৌড়ে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে পরখ করে নিলো। সব ঠিকঠাক! মুখে গম্ভীরভাব এনে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। ফারহিন তীব্রের সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা নিচু করে দুইহাত মুষ্টিবদ্ধ করে কপালের কাছে ধরে রেখেছে সে। ফারহিন এসে দাঁড়াতেই তীব্র মাথা সোজা করলো। ফারহিনের দিকে তাকালো। ধীর গতিতে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফারহিনের মুখপানে। ফারহিনের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। একি হাল চেহারার? চোখের নিচে কালচে দাগ, ফ্যাকাশে মুখ। কোথায় গেল সেই উল্লাস? মানুষটা অসুস্থ নাকি? ফারহিন নিজের আগ্রহ দমাতে পারলো না। অস্থির কন্ঠে প্রশ্ন করেই বসলো-
“-কি হলো? সব ঠিক আছে?
তীব্র তাকিয়ে রইল। আজকেই শেষবারের মত দেখতে এসেছে সে ফারহিন কে। আর ফারহিনকে এভাবে দেখার সু্যোগ হবে না। তাই ফারহিনের কথার জবাব না দিয়ে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো সে। ফারহিন বিরক্ত হলো! বলল-
“-কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি?
“-সব ঠিক আছে। এদিকে আসো।
বলেই ফারহিনের হাত ধরে পাশে বসালো তীব্র নিজেও বসলো..
ফারহিনের হাত নিজের হাতের মুঠোই নিয়ে বলল-
“-আমার উপর রেগে আছো এখনো?
“-কিসের রাগ?
“-কিছুনা, বাদ দাও।
“-আপনি ঠিক আছেন? সুস্থ আছেন?
“-কেন? অসুস্থ মনে হচ্ছে নাকি?
“-চেহারার এই হাল…
“-কী ব্যাপার আজকাল আমায় এত মনোযোগ দিয়ে দেখছো..?
ফারহিন থতমত খেল। হাত ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে সরে বসলো। বলল-
“-এমনিই জিজ্ঞেস করেছি এত গভীরে যাওয়ার কিছু হয়নি।
তীব্র হাসলো। একটু এগিয়ে ফারহিনের হাত মুঠোই তুলে নিলো। মুঠোভর্তি হাতটা মুখের কাছে ঠেকিয়ে ফারহিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে তীব্রের কিন্তু তীব্র কিছুই বলতে পারছেনা। সমস্ত কথা নিজের মনের কুঠুরিতে দাফন করে দিয়েছে সে। ফারহিনকে এত কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলতে হবে তা তীব্র কল্পনাও করেনি। প্রায় অনেক্ষণ বসে থাকার পর তীব্র উঠে দাঁড়াল। বলল-
“-আসি।
ফারহিন চুপ করে রইল। ইচ্ছে করছিলো তীব্র কে আটকে দিতে কিন্তু দিলো না। তীব্রের চলে যাওয়া দেখলো। তীব্র বের হয়ে যেতেই ফারহিন এক দৌড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। তীব্রের গাড়ি যতক্ষণ গেইট থেকে বের হয়ে রাস্তায় না উঠবে ততক্ষণই তাকিয়ে থাকার এই বাজে অভ্যাস টা ফারহিন করে নিয়েছে। তীব্র গাড়িতে বসলো। তীব্র সিটে মাথা এলিয়ে দিলো৷
“-আমি কখনো আর তোমার সামনে আসবো না ফারহিন। তুমি হয়তো এর পরে আমাকে আরো ভুল বুঝবে, ঘৃণা করবে। আমি নিরুপায়। বন্ধুত্বের খাতিরে এইটুকু তো করতেই পারি! আমার আরশ কে পূর্ণ করতে নিজে নাহয় আজীবন অপূর্ণতায় কাটিয়ে দেব তাতে কি যায় আসে?
তীব্র গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেল৷ ফারহিন গাড়িটির দিকে তাকিয়ে রইলো, আনমনে হেসে উঠে বলল-
“-তীব্র চৌধুরী! আর মাত্র দুদিন, তারপর আমি আপনার অনেক কাছে থাকবো। একদম কাছে..
★বর্তমান…
“-তারপর তীব্র বিয়ে করতে এলোই না। নিজের সবচাইতে ভালো এবং কাছের বন্ধুর জন্য নিজের পছন্দ ত্যাগ দিলো।
বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে বলে উঠলো আরশ। হাটতে হাটতে সিগারেট ধরিয়ে বলল-
“-তুই যা করেছিস থ্যাংকস ফর এভ্রিথিং। খুব শীগ্রই ভালো রিপ্লেসমেন্ট পেয়ে যাবি আশা করি। কিন্তু আমি? আমি ফারহিনের রিপ্লেসমেন্ট পেতাম না। এসব বাদ, তোর চ্যাপ্টার ক্লোজড। এখন আমি আর ফারহিন। ফারহিন আর আমি। কিন্তু প্রবলেম হচ্ছে ফারহিন মেইবি একটু স্যাড! কিছু হবে না আমি আছি না? আমি ফারহিনের মন মাইন্ড সব আমার দিকে ঘুরিয়ে নেব। ফারহিন ২৪ ঘন্টা শুধু আমায় নিয়ে ভাববে। আমায় ভালোবাসবে। আমি ছাড়া ফারহিন কাউকে নিয়ে বিন্দু পরিমাণ ভাববেই না।
সিগারেট শেষ করে ফেলে দিলো আরশ৷ তারপর ছাদে রাখা টেবিল থেকে একটি ধারালো ছুরি তুলে নিলো। আরশ আসার সময় নিয়ে এসেছিলো। ছুরির দিকে তাকিয়ে আরশ হাসলো। তারপর নিজের বাম হাত উঁচু করে হাতের দিকে তাকালো। পরক্ষণে কি যেন ভেবে ছুরি বাম হাতে নিয়ে ডান হাত মেলে ধরলো। হাতের দিকে তাকিয়ে বলল-
“-একটু কষ্ট তোমায় পেতে হবে ডিয়ার হ্যান্ড! সরি..
হাতের তালুর মাঝ বরাবর ছুরি বসিয়ে মুষ্টিবদ্ধ করে ছুরিটি চেপে ধরলো আরশ৷ তারপর এক টানে ছুড়িটি বের করে আনলো। অতিরিক্ত ধারালো হওয়ায় হাতের তালু কেটে যায়। মুঠি খুলতেই রক্তের ধারা বইতে রাগলো। তিন ইঞ্চির মত হাতের তালু কেটে গেছে। রক্তাক্ত হাতটি মুষ্টিবদ্ধ করে হাটা দিলো আরশ।
ফারহিন ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। হঠাৎ গলার দিকে নজর পড়তেই ফারহিনের হাতের টাওয়েল পড়ে গেল। গলায় থাকা তীব্রের দেওয়া লকেটটা এখনো আছে। লকেটটি স্পর্শ করলো ফারহিন। চোখ মুহুর্তেই পানিতে ভরে গেল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো-
“-তীব্র!!
ঠাস করে দরজা খোলার শব্দে ফারহিন স্তম্ভিত ফিরে ফেল। দ্রুত পেছনে ফিরতেই দেখলো আরশ। ফারহিন বিরক্ত হলো। ওড়না গায়ে জড়িয়ে বলল-
“-নক করে আসা উচিত ছিল।
“-রাখো তোমার নক। হেল্প মি..
বলেই রক্তাক্ত হাতটা ফারহিনের দিকে এগিয়ে দিলো। ফারহিন হাতের দিকে তাকিয়ে দু কদম পিছিয়ে গেল। আঁতকে উঠলো সে। সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো তার। দ্রুত ঘুরে দাঁড়ালো। আতংকিত কন্ঠে বলল-
“-এসব কি? এতটা হাত কীভাবে কেটেছে?
“-আরে একটা জানলার কাঁচ ভাঙা ছিলো খেয়াল করিনি। হাতে বাজে ভাবে লেগে গেছে।
“-দাঁড়িয়ে না থেকে যান হাতটা ক্লিন করুন।
“-আমি একা কিভাবে করবো? কিছুতো মানবতা দেখাও। তাও আমার ডান হাত..
“-ইয়া আল্লাহ! আমিতো কিছুতেই এটা সহ্য করতে পারবোনা।
“-প্লিজ হেল্প করো..
ফারহিন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। রক্ত দেখে আবারও সে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। আরশ কে বলল-
“-প্লিজ! আপনি হাতটা সরান। আমি রক্ত সইতে পারিনা।
“-তাহলে এভাবেই থাকুক কি আর করা।
“-দাঁড়ান আমি কিছু ভাবি।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফারহিন প্রশ্ন করলো-
“-ফার্স্টএইড বক্স কোথায়?
“-কাবার্ডের প্রথম ড্রয়ারে।
ফারহিন বক্সটা নিয়ে চোখ বন্ধ করে বেডে বসলো। চোখ বন্ধ রেখেই ডাকলো আরশ কে,বলল-
“-এদিকে এসে বসুন।
আরশ বসলো। ফারহিনের দিকে তাকিয়ে রইল। ফারহিন বলল-
“-দেখুন আমি কিন্তু রক্ত সইতে পারিনা। তাই চোখ খোলা পসিবল না। আমি রক্ত দেখলে নির্ঘাত কোনো অঘটন ঘটবে। আপনি প্লিজ আমার ইন্সট্রাকশন ফলো করুন। নাহলে আমায় হেল্প করুন।
“-ঠিক আছে।
অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে কোনো রকম ফারহিন হাতের কাটা জায়গা সেভলন দিয়ে ক্লিন করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আরশ পুরো সময়টা ফারহিনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। নিষ্পলক, স্থির চাহনিতে। ফারহিন মৃদুস্বরে প্রশ্ন করলো-
“-হয়েছে?
“-হুম!
ফারহিন চোখ খুলল। কোনোভাবে আরশের হাত ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
“-প্লিজ এভাবে আর রক্ত টক্ত নিয়ে আমার সামনে আসবেন না। আমি এসব সইতে পারিনা। ওইদিন হসপিটালে দেখেছেন কিভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলাম। আমার অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়।
“-ওকে। তবে আমি তো ইচ্ছে করে করিনি তাইনা..ইচ্ছে করে নিজেকে কে আঘাত করে?
“-তাই নাকি? আপনার হাতে এই যে এত দাগ তা কি সব অনিচ্ছাসত্ত্বে হয়েছে?
হাতের উল্টো পিঠে কাটাদাগ গুলো দেখিয়ে প্রশ্ন করলো ফারহিন। আরশ থতমত খেল, বলল-
“-রাগের মাথায় হয়ে যায়।
“-সামাল দিন। এসব রাগ কোনো কাজের না।
বলেই ফারহিন উঠে দাঁড়ালো। ফার্স্টএইড বক্স রাখার উদ্দেশ্যে অয়া বাড়াতেই থেমে গেল। আরশ যেখানে একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে ফ্লোরে অনেকটা রক্ত পড়ে আছে। ফারহিন তা দেখে আঁতকে উঠলো। হাত থেকে ফার্স্টএইড বক্স পড়ে গেল। ফারহিন এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। প্রচন্ড অস্থিরতা, বুক ব্যাথা, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ফারহিনের চোখের সামনে মুহুর্তেই সব ঝাপসা হয়ে এল। ফারহিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই আরশ এসে আগলে নিলো। সেন্সলেস হয়ে পড়েছে ফারহিন। ফারহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আরশ। ফ্লোরে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে ফারহিনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“-ইচ্ছে করেই ফেলেছিলাম, যাতে তুমি সেন্সলেস হয়ে পড়ো। আর আমি? তোমাকে পুরো রাত নিজের মনভরে দেখতে পারি। তুমি জেগে থাকলে তো তার ব্যাঘাত ঘটাতে তাই…
হাসলো আরশ। ফারহিনকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ফার্স্টএইড বক্স তুলে রেখে দিলো। টিস্যু দিয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে নিলো। রুমের দরজা বন্ধ করে বারান্দার দরজা খুলে দিলো। রুমের জানলা খুলে পর্দা টাঙিয়ে দিলো। রুমের লাইট বন্ধ করে দিলো। ডিল লাইট অন করে দিলো। আবছা লাল আলো পুরো রুম আবৃত করে নিলো। জানলার পর্দা মৃদু উড়ছে। বারান্দা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে। আরশ ফারহিনের পাশে শুয়ে পড়লো। এক পাশ ফিরে শুয়ে বাম হাতের কুনুই বিছানায় রেখে হাতের তালুতে মাথা ঠেকিয়ে ভর দিয়ে এক দৃষ্টিতে ফারহিনের দিকে তাকিয়ে আছে আরশ। ফারহিনের মুখ উপচে পড়া চুল গুলোর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সে। তারপর ডান হাতে তা আলতোভাবে সরিয়ে দিলো। ধীর গতিতে হাত ফারহিনের মুখ থেকে নামিয়ে হাতের উপর রাখলো। হাত তুলে নিজের মুখের কাছে এনে হাতের তালুতে চুমু বসালো আরশ। হাত গালের পাশে চেপে ধরে বলল-
“-সরি! আম’সরি..
মূর্ছিত ফারহিন বুঝতেও পারলো না আরশ তার খুব কাছেই অবস্থান করছে। আরশ ফারহিনের পাশে শুয়ে পড়লো। ফারহিনের দিকে তাকিয়ে বলল-
“-জীবনে প্রথম কোনো জিনিসকে এত যত্ন করছি আমি। জীবনে প্রথমবার কাউকে নিয়ে এত ভেবেছি আমি। জীবনে প্রথমবার কারো মনে সর্বক্ষণ বসবাস করার জন্য নিজেকে আঘাত করেছি আমি। আমি কখনো তোমার সামনে নিজের হিংস্রতা প্রকাশ করবো না। তুমি আমায় খুবই শান্তভাবে পাবে। তবে বিশ্বাস করো, আমার শান্ত রুপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা হিংস্র সত্ত্বাটাও তোমাকে খুব বাজেভাবে ভালোবাসে। তোমার আদর, যত্নের বিন্দুমাত্র ক্রুটি আমি রাখবো না। এই প্রথম আমার নিজেকে একটুও একা মনে হচ্ছে না। আমার একাকিত্বের দিন শেষ!
আরশ উঠে বসলো। বিছানা ছেড়ে নেমে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার খুললো। ড্রয়ার থেকে কিছু ওষুধ বের করে ফারহিনের দিকে তাকালো আর বলল-
“-তোদের ছুটি! তোদের দায়িত্ব শেষ। আমাকে কন্ট্রোল করার মানুষ চলে এসেছে তোদের আর লাগবে না।
বলেই ওষুধ গুলো বিন এ ফেলে দিলো। ফারহিনের পাশে এসে শুয়ে পড়লো আরশ। ফারহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটাকে পুরো জীবন দেখলেও মন ভরবেনা।
চলমান….