#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম
||পর্ব-৫||
★মেহেদী রাঙা একটি হাত আরশের দিকে এগিয়ে দিলো ফারহিন। আরশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে। হাতের দিকে তাকিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ফারহিনকে দেখতে পেল সে। দৃষ্টি স্থির হলো! মোহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বউবেশে দাঁড়িয়ে থাকা নারীটির দিকে। লাল রঙের শাড়ি, মাথায় ঘোমটা, এত ভারী সাজেনি সে। হালকা সাজে অপরুপ লাগছে। ফারহিন কাজল ভর্তি চোখ দিয়ে ইশারা দিলো। যার অর্থ ‘হাতটি ধরো’!!
আরশ ফারহিনকে দেখে ভুলেই গিয়েছিলো যে ফারহিন অনেক্ষণ যাবত হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরশ হাতে থাকা ফোনটা পকেটে রাখলো। ফারহিনের হাত ধরার জন্য হাত বাড়াতেই সেই হাত অন্য কারো হাতের মুঠোই চলে গেল। আরশ মানুষটির চেহারা তো দেখতে পেল না তবে পিঠের দিকটা আরশ দেখলো। মানুষটি ফারহিনকে পুরো আড়াল করে নিয়েছে। আরশের অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো। আরশ মৃদুস্বরে ডাকলো, ‘ফারহিন, ফারহিন’!
ফারহিন কোনো জবাব দিলো না। সামনে থাকা মানুষটি ফারহিন কে নিয়ে ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে। দুজনে হাত ধরে আছে। আরশ শেষ বারের মত গগন কাঁপানো কন্ঠস্বরে ডাকলো, ‘ফারহিন’!
দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসলো আরশ। নিশ্বাস নিতে প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে বেড সাইড টেবিলে রাখা পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়ালো কিন্তু গ্লাস খালি। আরশ গ্লাস তুলে আছাড় দিলো। উঠে দাঁড়ালো, স্বপ্ন দেখেছে সে, ভয়ংকর স্বপ্ন! ফারহিন কখনো অন্য কারো হতে পারেনা। ফারহিন কখনো তাকে ছেড়ে চলে যাবেনা কারণ আরশের কাছে ফারহিন ছাড়া আর কেউ যে নেই। ফারহিন চলে গেলে আরশ একা হয়ে যাবে, আর ফারহিন আরশকে কখনো একা করে দেবে না। অস্থির হয়ে উঠলো সে। ঘামছে, প্রচুর বাজে ভাবে ঘামছে। হৃদপিণ্ড মাত্রাতিরিক্ত ভাবে লাফাচ্ছে। সহ্য হচ্ছেনা। এক হাতে বুকের বা পাশ চেপে ধরলো আরশ। নিজেকে শান্ত করতে দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকলো। ঝর্ণার হাতল ঘুরিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দিলো। ওয়াশরুমের ফ্লোরেই বসে পড়লো। ঝর্ণার নিচে আরশ চুপচাপ বসে রইলো। তাকে শান্ত হতে হবে, এতটা অস্থির সে হতে পারবেনা। সামান্য একটা স্বপ্নে তো আরো না।
★একটি প্রশ্ন করে চুপচাপ স্বামীর সামনে বসে আছে সালমা। সালমা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে দিদাত হাসান কখন উত্তর দেবে। দিদার হাসান সালমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বলল-
“-এসব প্রশ্ন করার সময় এখন না।
“-কেন না? আপনি আমাকে আজীবন বলে এসেছেন ফারহিন কে নিজের কাছ ছাড়া করবেন না। আর এখন হুট করেই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলেন? মতলব টা কি?
“-মতলব কিছু না। খারাপ কারো নজর পড়ার আগে তাকে তার যোগ্য স্থানে বসাতে চাইছি।
“-আপনার মেয়ে বলে কথা খারাপ লোকের নজর তো পড়বেই।
“-তুমি সবসময় এমন অশুভ কথা বার্তা কেন বলো? মাঝে মাঝে মনে হয় ফারহিন আমার একার মেয়ে!
“-আপনি ঠিকই বলেছেন ফারহিন আপনার একার মেয়ে। আমিতো নামমাত্র মা। তার কোনো কিছুতে আপনি কখনো আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি।
দিদার হাসান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলো, সালমা আবারও বলে উঠলো-
“-নিজের মেয়েকে আপনি খারাপ লোকের কাছ থেকে বাঁচাতে চাইছেন ব্যাপারটা এমন না। আপনি আপনার মেয়েকে আপনার কাছ থেকেই বাঁচাতে চাইছেন।
“-সালমা!! উচ্চস্বরে বলে উঠলো দিদার হাসান।
“-একদম চেঁচাবেন না। মেয়ে জেগে আছে ভুলে যাবেন না। আর তাছাড়া আমি ভুল কি বলেছি? আপনি যা করেছেন বা করছেন তাতে আপনার মেয়ের উপর খারাপ লোকের নজর তো পড়বেই।
“-আমি ওর ভালোর জন্যই করেছি। ওকে সুন্দর একটা জীবন দিতেই!
“-তাই নাকি? যারা মধ্যবিত্ত তাদের সন্তানরা কি জীবনযাপন করে না? করে, কিন্তু আপনি শুধু সুন্দর জীবনযাপন চান নি। আপনি রাজকীয় জীবন চেয়েছেন। যেটা আমি অন্তত চাইনি দিদার। সারাক্ষণ আমার এটা চিন্তা থাকে কখন মেয়েটা সব জেনে যাবে আর আমাদের ভুল বুঝে বসবে। নিজের বাবাকে যে নিজের আদর্শ ভাবে সেই আদর্শের এমন বিদঘুটে রুপ কেউ মেনে নিতে পারবে না।
“-আমার মেয়ে জানবে না। কিছুদিন পরই তাকে আমি তার যোগ্য স্থানে প্রেরণ করে দেব।
“-অদ্ভুত! আপনি আপনার জায়গা থেকে বিন্দুমাত্র নড়তে রাজি না।
“-তুমি বুঝবে না।
“-একটা কথা মাথায় রাখবেন, সত্য চাপা থাকে না।
দিদার হাসান হাসলো। তাচ্ছিল্যের হাসি! বলল-
“-যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর।
“-আপ….
সালমা কিছু বলার আগেই দরজায় নক পড়ে। নিজেকে সংযত করে নিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে জবাব দিলো-
“-এসো!
“-মা তুমি এখানে আমি পুরো বাড়ি খুঁজছি।
রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল ফারহিন।
“-বলো কি বলবে?
“-ফারহানা এসেছে। আমি একটু বের হবো। ও পার্লার যাবে শপিং যাবে। ওর সাথে যাই?
“-যাও। নিজের জন্য কিছু কিনে নিও আর পার্লার থেকে তুমি একটু ফেসিয়াল যা যা লাগে করিয়ে নিও।
মৃদু হেসে বলল দিদার হাসান। সালমা অবাক হলো। মেয়েকে কলেজ ছাড়া কোথাও যাওয়ার অনুমতি যেই মানুষ দেয় না সে আজ এভাবে.. কিছু বলার নেই তার। স্বামীর কর্মকাণ্ডে বিরক্ত সে, প্রচুর বিরক্ত।
“-কি ব্যাপার বাপি হঠাৎ এত আদর সমাদর?
“-তোমাকে কি আমি আদর করি না প্রিন্সেস?
“-না তেমন না। কিন্তু পারমিশন দিলে যে?
“-সামনে তোমার আকদ না? তাই এইটুকু তো করতেই পারি। যাও নিজের ইচ্ছে মত ঘুরে এসো, হ্যাভ এ গুড ডে।
“-থ্যাংক ইউ বাপি।
ফারহিন বেরিয়ে গেল। সালমা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্বামীর দিকে। দিদার হাসান বলল-
“-আমাকে দেখার সময় অনেক পাবে। মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি নাও আপাতত।
“-অবিশ্বাস্য!! বলেই সালমা বেরিয়ে গেল। দিদার হাসান তাকিয়ে রইলো। এই মানুষটার অভিমান গেল না। অভিমান বিন্দুমাত্র কমলো না।
★অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলো আরশ। কালো শার্ট, অ্যাশ রঙের প্যান্ট, অ্যাশ রঙের ব্লেজার। হাতে কালো চেইনের ঘড়ি। ল্যাপটপের ব্যাগ হাতে নিয়ে অন্য হাতে কালো রঙের কোটটি ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
কাদের শিকদার ড্রয়িংরুমে বসে ছিলেন। আরশকে নামতে দেখে উঠে দাঁড়ালো-
“-গুড মর্নিং!
“-গুড মর্নিং।
“-এসো নাস্তা করবে..
“-উহু! আমি অফিসে করে নেব তুমি খেয়ে নিও।
“-এত তাড়া কিসের?
“-মিটিং আছে বাবা, এমনিতেই লেট আমি।
“-আচ্ছা তাড়াতাড়ি এসো আজ। তোমার দিদার আঙ্কেল ইনভাইট করেছে।
আরশ তাকালো।
“-কিসের ইনভাইটেশন?
“-সামনেই ফারহিনের আকদ। সেই কারণেই ছোট খাটো পার্টি।
ধপ করে আরশের হাতে থাকা ল্যাপটপের ব্যাগ পড়ে গেল। আরশ বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। ফারহিনের বিয়ে? আরশের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। কাদের শিকদার অবাক হলেন।
“-কি হলো?
আরশ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। কাদের শিকদার আবারো ডাকলেন-
“-আরশ! তুমি ঠিক আছো?
“-হ্যা.. হ্যাঁ আম.. আমি ঠিক আছি।
“-কি হলো তোমার?
“-কিছু না। আমি লেট হচ্ছি। বলেই ব্যাগ তুলে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো আরশ। দ্রুত গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। ড্রাইভার ছাড়াই বেরিয়ে পড়লো আজ। প্রচন্ড স্পীডে বাতাসের গতিতে আরশ বেরিয়ে গেল।
ট্রাফিক জ্যাম পড়লো। আরশ স্টিয়ারিং এ মাথা ঠেকিয়ে আছে। এসব কি শুনলো? কিসের বিয়ে? বিয়েতো ফারহিন করতে পারবেনা। স্টিয়ারিং এ প্রচন্ড জোরে ঘুষি বসালো আরশ। হঠাৎ হাসির শব্দ কানে এলো। বাহিরে তাকাতেই দেখলো পাশেই ফারহিনের গাড়ি৷ আরশ সোজা হয়ে বসলো। ফারহিন আইসক্রিম নিয়ে কাড়াকাড়ি তে মত্ত। ফারহানা আর সে দুজনেই দুষ্টুমি করছে। আরশ সিটে মাথা এলিয়ে দিলো। গাড়ির গ্লাস তুলে দিলো। ফারহিনের দিকে তাকিয়ে রইল। অসহায়, মায়াভরা দৃষ্টিতে ফারহিনের হাসোজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আগেই বাবার বলা কথাটা মনে পড়লো আরশের। আরশ গাড়ির গ্লাসেই ঘুষি বসালো। রেগে গেল মুহুর্তেই। কপালের পাশের রগ দুটি ফুলে উঠেছে। হাতের মুঠো শক্ত হলো। জ্যাম ছুটতেই ফারহিনের গাড়ি বেরিয়ে গেল। আরশ তাকিয়ে রইলো। গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রচন্ড দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ফারহিনের গাড়িকে ধাক্কা দিলো।
আচমকা টাল সামলাতে না পেরে ফারহিনের গাড়ি ধাক্কা খেল ওভারব্রিজ এর নিচের দেওয়ালে। সামনের সিটের সাথে ফারহিন ধাক্কা খেল। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা পেল দুজনেই। ড্রাইভার দ্রুত বেরিয়ে গেল। গাড়ির ফ্রন্ট সাইড বাজে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাড়ি হয়তো এই মুহুর্তে আর স্টার্ট নিবে না। এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু হতে পারতো, এই ভেবে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো ফারহিন। হঠাৎ একটি গাড়ি থামলো। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো আরশ। ড্রাইভারের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। তাদের কথা ফারহিন শুনতে পারছে না।
“-আপনি ঠিক আছেন?
“-জি ঠিক আছি।
“-এমন বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট হলো কি করে? ইশ! গাড়ির তো বেহাল দশা।
আরশ আফসোস করলো। গাড়ির ড্রাইভারের ঠোঁট ফেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। আরশ দ্রুত গাড়ি থেকে পানির বোতল নিয়ে ড্রাইভারের দিকে এগিয়ে দিলো।
“-আপনি একটু রিল্যাক্স হোন।
“-ধন্যবাদ।
“-এসব কি করে হলো?
“-কোনো গাড়ি ধাক্কা দিয়েছিলো হয়তো..
“-একি আপনি দেখেন নি কোন গাড়ি ধাক্কা দিলো?
“-না খেয়াল করিনি।
“-আচ্ছা যাইহোক। বড় বিপদ হয়নি এটাই লাখ লাখ শুকরিয়া।
ফারহিন বেরিয়ে গেল। আরশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আরশ ফারহিন কে দেখে চমকানোর ভান করলো-
“-তুমি?
“-আপনি এখানে কি করছেন?
“-অফিস যাচ্ছিলাম, গাড়ি তোমার জানতাম না। ড্রাইভার আর গাড়ির বেহাল দশা দেখেই এলাম। তুমি কোথাও যাচ্ছিলে নাকি?
“-একটু শপিং যাবো। এখন হয়তো আর যাওয়া হবেনা।
গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল ফারহিন। আরশ বলল-
“-আমার সাথে চলো। আমিও শপিংই যাচ্ছি।
ফারহিন একবার আরশকে দেখে নিলো। বলল-
“-এই গেট আপ এ শপিং? মনে হচ্ছে না।
“-আমি অলওয়েজ এমনই থাকি। চলো!
“-কিন্তু,
“-আরে কোনো কিন্তু না। একদিক দিয়ে তুমি আমার রিলেটিভ তো হেল্প করতেই পারি। এসো!
“-যাবো এক শর্তে।
“-কি শর্ত? ভ্রু কুঁচকালো আরশ।
“-বাবাকে এই ঘটনার কথা বলবেন না। উনি একটু বেশিই পজেসিভ আমায় নিয়ে।
আরশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল বলল-
“-ঠিক আছে। চলো এবার।
ফারহানা বেরিয়ে এলো। ফারহানা কে দেখে আরশ হাসি মুখে বলল-
“-হাই, কেমন আছো?
“-ভালো ভাইয়া! আপনি কেমন আছেন?
“-অনেক ভালো। তোমরা গাড়িতে বসো আমি আসছি।
ফারহিন আর ফারহানা গাড়িতে বসলো। আরশ ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে। ফারহানা তাকিয়ে রইল। ফারহিনকে বলল-
“-ভাইয়াটা অনেক ভালো তাইনা?
“-হুম! অনেক।
আরশ গাড়িতে বসেও গাড়ি স্টার্ট দিলো না। বলল-
“-দুজন থেকে একজন সামনে এসো।
“-কেন ভাইয়া? ফারহানা প্রশ্ন করলো!
“-আমায় লোকে ড্রাইভার ভাববে তাই।
“-তুই যা। আমি এখানে আছি। বলতেই ফারহানা কে থামালো আরশ, বলল-
“-তুমি আসো।
“-না ভাইয়া আমি এখানেই ঠিক আছি। ফারহিন যা..
ফারহিন বেরিয়ে সামনে বসলো। আরশ তাকালো।
“-কি হলো? আরশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো ফারহিন..
“-সিটবেল্ট! ইশারায় বলল আরশ।
ফারহিন সিটবেল্ট বেধে নিলো। আরশ মুচকি হেসে সানগ্লাস পরে নিলো। ফারহিন আরশের হাসি দেখলো কিন্তু হাসির অর্থ বুঝলো না। বাহিরের দিকে তাকালো সে…
চলমান….
||ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।