শূন্যতায় পূর্ণতা পর্ব-০৪

0
656

#শূন্যতায়_পূর্ণতা
#হীর_এহতেশাম

||পর্ব-৪||

★ছাদে বসে আছে ফারহিন। দোলনাতে বসে পছন্দের লেখক হুমায়ুন আহমেদের লেখা ময়ুরাক্ষী উপন্যাসটি পড়ছে। পাশে থাকা চায়ের কাপ তুলে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছে। ঈদুল আজহার ছুটি চলছে কলেজে। বন্ধের সময়টা ফারহিন বই পড়িয়ে কাটিয়ে দেয়। কলেজ বন্ধ দিলো কালই। কলেজে বন্ধের ছুটির নোটিশ মানেই মুক্তির বার্তা। বইয়ের পাতা ওল্টাতেই পাশে কারো আভাস টের পেল ফারহিন। বই থেকে মুখ তুলতেই হাসোজ্জল মুখটি দেখতে পেল। আকাশী রঙের শার্ট, সাদা রঙের প্যান্ট, হাতে কালো রঙের বেল্টের ঘড়ি। এক হাতে দোলনার শেকল ধরে ফারহিনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হাসি মুখে চেয়ে আছে তীব্র। ফারহিন উপর থেকে নিচে একবার দেখে নিলো। ফারহিনের চাহনি দেখে তীব্র ইশারায় ‘কী’ জিজ্ঞেস করলো। ফারহিন বই বন্ধ করে শান্ত কন্ঠে বলল-

“-হঠাৎ এখানে?
“-কেন আসতে পারি না?
“-না কেন? আপনার খালার বাসা আসবেন না কেন?
ফারহিনের মুখে ‘আপনি’ শুনে তীব্র খানিকটা বিব্রত হলো। এক পা দোলনায় তুলে অন্য পা ঝুলিয়ে রেখে ফারহিনের দিকে পুরোপুরি ঘুরে বসলো। বলল-
“-দেখতে এলাম। খালার মেয়ে কেমন আছে!
“-দেখা শেষ? এবার যান!
ফারহিনের এমন নির্লিপ্ত উত্তরে তীব্র বুঝলো ফারহিন অভিমান করেছে। তীব্র বলল-
“-নিচে চলো।
“-কেন? বড়রা কথা বলছে আমি গিয়ে কি করবো?
“-মা আজ কেন এসেছে জানো?
“-কেন?
তীব্র তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদুস্বরে উত্তর দিলো।
“-ফারহিন হাসান কে নিজের ঘরের চিরস্থায়ী সদস্য করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
ফারহিন ভ্রু কুঁচকালো। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। দ্রুত চা গিলে বলল-
“-মানে?
“-মানে ফারহিন হাসান কে মিসেস ফারহিন বানানোর প্রস্তাব।
“-কিন্তু আপনার তো কোনো বড় ভা…..
ফারহিন থেমে গেল। ঠোঁট পরস্পরকে ছেড়ে আলাদা হলো। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তীব্রের দিকে। ফারহিন বলতে চেয়েছিলো ‘আপনার তো কোনো বড় ভাই নেই’ কিন্তু ফারহিন বলল না। ফারহিন বুঝতে পারলো কার জন্য ফারহিন কে চেয়ে বসবে খালামনি। ফারহিনের এমন বিস্ময়ভরা মুখ দেখে তীব্র ঠোঁট চেপে হাসলো, বলল-
“-কী হলো?
ফারহিন থতমত খেল। বলল –
“-কি..কিছু না।
তীব্র তাকিয়ে রইল। শীতল করা চাহনি তার। শান্ত কন্ঠে অনুরোধ করলো-
“-একটু হাসবে?
“-কে..কেন?
“-তোমার গালের টোল টা দেখতে ইচ্ছে করছে।
এমন সরাসরি আবদার তীব্র আগে কখনো করেনি। ফারহিন মুখ ঘুরিয়ে নিলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বলল –
“-নিচে যান। বিরক্ত করবেন না প্লিজ।
“- আমি চলে গেলে একজন মানুষ একা হয়ে পড়বে।
ফারহিন দ্রুত ফিরে তাকালো। চোখ দু’টি জ্বলজ্বল করছে। পানিতে চিকচিক করছে। ভেজা গলায় বলল-
“-আমি অনেক আগেই একা হয়ে পড়েছিলাম। ভুলে যাবেন না আপনি নিজেই আমাকে রিজেক্ট করেছিলেন।
“-তুমি ছোট ছিলে!
“-এক দেড় বছরে খুব একটা বড় হইনি।
“-সেদিনের জন্য সরি।
“-আপনি কেন সরি বলবেন? কোনো দরকার নেই আমি সরি! আমি আপনার যোগ্য নই।
“-মায়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবে?
“-শুধু মায়ের জন্যই এসেছেন জানি। আমি বাবার কথা অমান্য করি না। বাবা যদি রাজি থাকেন তাহলে তো আমি কুমির ভরা খালেও ঝাপ দেব আপনিতো অতি সামান্য বিষয়।
ফারহিন চলে গেল। তীব্র আটকাতে পারলো না। ফারহিনকে বলতে পারলো না প্রত্যাখ্যান এর পর রোজ ফারহিন কে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ফারহিনের মায়ায় পড়ে গেছে সে। পরে মা হুট করেই আবদার করে বসাতে নিজের মনের গোপন কুঠুরি থেকে উচ্চস্বরে ভেসে এলো, আজ সম্মতি না দিলে অন্দরমহলের রাণী কে আজীবনের জন্য হারাবে। ফারহিনের অভিমান করা জায়েজ। তীব্র ভেবেছিলো ফারহিন সেদিন আবেগের বশেই তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে কিন্তু না তীব্র ফারহিনের আবেগ কখনোই ছিলো না। আবেগ হলে এক দেড় বছর আকড়ে ধরে কখনোই থাকতো না। তীব্র ফারহিনের ভালোবাসা তাই হয়তো আজো তীব্র সামনে এলে মনের কথা মনেই ধামাচাপা দেয় এই ভেবে যে তীব্র ফারহিনের মনের ভাষা কখনো বোঝেনি আর বুঝবেও না। দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো তীব্র। পকেটে হাত দিতে সটান হয়ে দাঁড়ালো। হালকা হেসে বলল-
“-মৃত অনুভুতিগুলোকে জাগিয়ে তোলার সময় এসে গেছে। আপনার শূন্যতায় পূর্ণতা দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে। আমি আপনাকে আকড়ে ধরবো। ঠিক অক্টোপাসের মত। আমার নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনাকে কেউ আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবেনা। স্বয়ং আপনিও না।

★ভাইজান! আমার মেয়ে নেই। ফারহিন কে আমি নিজের মেয়ের মত করে রাখবো। আমার ফারহিনকে আমার তীব্রের পাশে দেখতে চাই আমি। আপনি অমত করবেন না।
রাশেদা চৌধুরীর তীব্র অনুরোধ। দিদার হাসান হাসলো। বলল-
“-আমার মেয়ে আর তোমার মেয়ে তফাৎ আছে নাকি আপা? কি চাই বলো?
“-তীব্র আর ফারহিনের বিয়ের ব্যাপারটা..
সালমা আল্লাহ আল্লাহ করছিলো। দিদার হাসান মুখের উপর না করে দিলো বড় বোনের মানসম্মান যে ধুলোই মিশে যাবে তা সালমা জানে। রফিক চৌধুরী হেসে বলল-
“-রাজি হয়ে যাও দিদার। তোমার মেয়ে আমার মেয়ে তফাৎ নেই এই মাত্র বললে। ফারহিন এর উপর ছোট থেকেই কিন্তু আমাদের নজর। মানবতার খাতিরে হলেও রাজি হয়ে যাও।
দিদার হাসান উচ্চস্বরে হাসলো। বলল-
“-আরে ভাই! কি বলছো এসব? যা চাও তাই হবে। আমার মেয়েত জন্য তীব্রের চেয়ে ভালো কেউ হবেও না। আর আমি এমনিতেও ফারহিনের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছিলাম। তাইনা সালমা?
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে প্রশ্ন করলো দিদার হাসান। সালমা অবাক হয়ে গেল। কবে এই ব্যাপারে কথা উঠেছিলো মনে পড়ছেনা, তবুও সবার সামনে স্বামীর মান রাখতে মুখে হাসির রেখা টেনে বলল-
“-হ্যাঁ কালই বলছিলো।
“-তাহলে তো হয়েই গেল। রিং এক্সচেঞ্জ টা তাহলে সেরে ফেলি? একটা ভালো ডেট ফিক্সড করো।
প্রফুল্ল কন্ঠে বললেন রফিক চৌধুরী।
“-আচ্ছা ঠিক আছে তা হবে। আগে মিষ্টি মুখ তো করো তোমরা..
বলেই রফিক চৌধুরীর মুখের সামনে চামচে মিষ্টি নিয়ে তুলে ধরলো।
“-এমনিতে আমি মিষ্টি খুব একটা খাইনা। তবে আজ খেতেই হবে। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা..
হাসি মুখে মিষ্টি খেয়ে নিলেন রফিক চৌধুরী।
সালমা আর রাশেদা পরস্পর আলিঙ্গন করলো। উপর থেকে তীব্র সবটা দেখলো। সবটা ভালোই ভালোই হয়ে গেল। এই ভেবেই শুকরিয়া আদায় করলো সে।

★বইয়ের শেল্ফ গোছানোর কাজে ব্যস্ত ফারহিন। দরজায় হঠাৎ নক পড়াতে ফারহিন জবাব দিলো-
“-আসো! দরজা খোলা আছে।
তীব্র প্রবেশ করলো। লম্বা চুল গুলো পিঠে ছড়িয়ে আছে। বইয়ের তাকে ব্যস্ত হয়ে চলতে থাকা হাতের দিকে তাকালো তীব্র। এগিয়ে গিয়ে ফারহিনের পেছনে দাঁড়ালো। বলল-
“- নিকাহ মুবারক!
রাশভারী কন্ঠস্বরটি কানে পৌঁছাতেই ফারহিনের ব্যস্ত হাত থেমে গেল। দ্রুত পেছনে ফিরতেই তীব্রের মুখোমুখি হলো। একটু পিছিয়ে গেল সে। তীব্রের হাতে মিষ্টির প্লেট। ফারহিন ভ্রু কুঁচকালো-
“-এখানে কি করছেন?
“-তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছি। মিষ্টিমুখ করাতে এসেছি।
“-কিসের মিষ্টি?
“-আমার বিয়ে ফিক্সড হলো যে..
ফারহিন অবাক হলো। সত্যি তার বাবা রাজি হয়ে গেল নাকি? ফারহিন কে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল-
“-আমাকে শুভেচ্ছা জানাবে না?
ফারহিন থতমত খেল। ইতস্তত হয়ে বলল-
“-এসব আবার কোন নাটক! সরুন। বলেই এড়িতে যেতে চাইলেই তীব্র ফারহিনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আটকালো। ফারহিনের শ্বাস প্রশ্বাস দীর্ঘ হলো।
“-কি চাইছেন?
“-মিষ্টিমুখ করাতে চাইছি।
“-আমি মিষ্টি খাই না।
“-আমিতো খাই। আমাকেই খাইয়ে দাও।
ফারহিন বিরক্ত হলো। মানুষটা ইচ্ছে করেই এসব করছে তা বুঝতে পারলো। মৃদুস্বরে বলল-
“-প্লিজ জ্বালাতন করবেন না।
“-করবো না। মিষ্টি খাইয়ে দাও।
ফারহিন বিরক্ত হয়ে একটি মিষ্টির থেকে কিছুটা হাতে নিয়ে তীব্রের মুখের সামনে ধরলো। তীব্র বলল-
“-কংগ্রেচুলেশন বলো?
“-ক.কং..কংগ্রেচুলেশন।
তীব্র মিষ্টি খেয়ে নিলো। ফারহিন হাত সরিয়ে নিতে চাইলে তীব্র হাতের কবজি ধরে ফেলল। আঙুলে লেগে থাকা মিষ্টির রশ চেটেপুটে খেয়ে নিলো। ফারহিন ভ্রু কুঁচকে ছিটকে সরে দাঁড়ালো। হাত জোর করে ছাড়িয়ে নিলো। তেজি কন্ঠে বলল-
“-বেরিয়ে যান। এক্ষুণি যাবেন!!
তীব্র এগিয়ে এলো। বলল–
“-তোমাকে জ্বালাতন করার কোনো কমতি আমি রাখবো না। প্রমিস। বলেই চোখ টিপল তীব্র। ফারহিন থতমত খেল। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তীব্র নাই হয়ে গেল। প্রচন্ড অভিমানে যে ভালোবাসা চাপা পড়েছে তা এত সহজে তীব্র পাবে না। আবেগ বলে যেই ভালোবাসা তীব্র দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো এখন কেন তা পেতে চাইছে? রাগ হলো ফারহিনের, ভীষণ রাগ!

★সিগারেটে আগুন ধরিয়ে তীব্রের দিকে তাকালো আরশ। তীব্র কে প্রচন্ড খুশি দেখাচ্ছে। মুখ থেকে সিগারেট সরিয়ে বলল-
“-এত ফ্রেশ লাগছে, ব্যাপার কি?
“-বিরাট ব্যাপার! আগে মিষ্টি খা।
“-আমি মিষ্টি খাই না।
“-একটু তো খা..
“-আচ্ছা দে। একটু মানে একটু।
“-ওকে।
একটু খানি সন্দেশের টুকরো মুখে দিলো আরশ। তীব্র চঞ্চল গলায় বলল-
“-মা আজকে বিয়ের ডেট ফিক্সড করে এল।
তীব্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“-তোর?
“-হ্যাঁ।
“-একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে গেল না?
“-না রে। আমি ওকে হারাতে চাই না। এবার হারিয়ে ফেললে আর পাবো না।
“-আগে থেকে পছন্দ করতি?
“-ধরে নে তাই।
আরশ অবাক হলো।
“-আমাকে তো কখনো আগে এই ব্যাপারে কিছু বললি না?
“-আমি নিজেই এই ব্যাপারটা বুঝতে সময় লেগেছে। আমি যে ওকে চাই, ওকে ভালোবাসি সেটা বুঝতেই তো আমার এত সময় লেগেছে তাই তোকেও জানাইনি। কীভাবে জানাতাম? নিজেই কনফিউজড ছিলাম।
“-যাক এখন কনফিউশান দূর হলো তো?
“-হ্যাঁ হলো!
“-এদিকে আয়। বলেই আরশ তীব্র কে জড়িয়ে ধরলো। বলল-
“-তোর সুখে কারো নজর না লাগুক।
“-লাগবে না তুই আছিস না?
“-এত ভরসা করতে নেই। এমনও হতে পারে আমারই নজর লেগে গেল।
তীব্র হাসলো। আরশ ও সেই হাসির তালে তাল মিলিয়ে হাসলো। আরশকে হাসতে দেখে তীব্র তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা প্রচুর মায়াবী।

চলমান…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে