#শুভ্র_নীলের_প্রেমপ্রহর
লেখক- এ রহমান
পর্ব ১৫
শরতের নির্মল স্নিগ্ধ কোমল চাঁদের আলো উপরের আকাশের মতো নিচেও দৃশ্যমান। শান্ত নদীর পানিতে যেন আকাশের মেঘ বালিকা নেমে এসেছে। নদীর পানিতে আকাশের মেঘের ভেলা সাথে এক ফালি চাঁদ আর তারার পসরা ভেসে বেড়ানোর প্রতিচ্ছবি দেখেই মনটা ভালো হয়ে গেলো ঈশার। এলোমেলো হাওয়ায় অবাধ্য চুল গুলো উড়ে বেড়াচ্ছে। দুই হাত ব্রিজের রেলিঙ্গে ভর দিয়ে নিচে তাকিয়ে আছে। ঠোটে প্রশস্ত হাসি। তার থেকে একটু দূরে ইভান দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। বাসায় জানিয়ে দিচ্ছে যে তাদের আসতে দেরি হবে। প্রথমে একটু আপত্তি জানালেও পরে ইভান আর ঈশান থাকায় তেমন কোন অসুবিধা হবে না সেটা ভালো করে বুঝিয়ে দেয়ায় আর আপত্তি করেনি কেউ। সোডিয়াম বাতির হলদেটে আলোয় কি অপূর্ব লাগছে ইভান কে। ঈশা মুগ্ধ হয়ে দেখছে তাকে। ইভান পাশ ফিরতেই ঈশার দিকে চোখ পড়ল। ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে আবার নিচে তাকাল। ঠোটের হাসিটা একটুও কমেনি। ইভানের ভারাক্রান্ত মনটা ভালো হয়ে গেলো ঈশাকে হাসতে দেখে। রাত প্রায় ১২ টা বাজে। এদিকটায় তেমন যানবাহন চলাচল এখনও শুরু হয়নি। শহর থেকে একটু দূরে নতুন তৈরি হয়েছে এই ব্রিজটা। আর এতো রাতে এমনিতেই রাস্তা ফাঁকাই থাকে। ওরা কয়েকজন ছাড়া কেউ নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ির দেখা মিলছে। উচ্চ শব্দে হর্ন বাজিয়ে তীব্র গতিতে চলছে। একদিকে ইরিনা আর ইফতি ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। আরেক দিকে ঈশানের হাত ধরে ইলু ব্রিজের রেলিঙ্গে উঠে বসেছে। মাঝে মাঝে পড়ে যাবার ভয়ে চিৎকার করছে। আর ঈশান তার বোনের উপরে খুব বিরক্ত হচ্ছে এটা ভেবে যে ভাইয়ের উপরে তার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস নেই। ঈশা সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। ইভান ঈশার দিকে তাকাল। হলদেটে আলোয় রুপবতির হাসি যেন ঝলমলিয়ে উঠছে। চোখ ধাধিয়ে গেলো তার। ইফতি ইভানের কাছে এসে বলল
–ভাইয়া তুমি ভাবি আপুর কাছে গিয়ে দাড়াও। তোমাদের ফটো তুলব।
ইভান কোন কথা না বলে ঈশার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ঈশা নদীর পানি দেখতেই ব্যস্ত। ইফতি নিজের ক্যামেরা ঠিক করে নিতেই ইভান এক টানে ঈশাকে ঘুরিয়ে দিলো সামনে। হঠাৎ এমন টানে ঈশা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পড়ে যেতে নিলে ইভান তাকে দুই হাতে ধরে নেয়। ঈশা ইভানের বুকের শার্ট খামচে ধরে হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ইভান ঈশাকে দুই হাতে ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষন পরেই ইভান বিরক্তিকর গলায় বলল
–এতক্ষন লাগে? তাড়াতাড়ি কর বলদ।
ইফতি দাত বের করে হেসে বলল
–হয়ে গেছে।
বলেই এক দৌড়ে ইভানের কাছে আসতেই সে ঈশাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সে এখনও ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান ছবিটা দেখে নরম গলায় বলল
–নাইচ। যত্ন করে রেখে দিস।
বলেই একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ইফতি ঈশার কাছে এসে বলল
–তুমি দেখ ভাবি আপু।
ঈশার ছবিটা দেখে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। ইফতি ছবিটা দেখতে দেখতে বলল
–এটা বড় করে ভাইয়ার ঘরে টাঙ্গাব।
ইফতির কথা শুনে ঈশা আবারো হা হয়ে গেলো। নামানো গলায় বলল
–তোর ভাইয়া ঠিকই বলেছে। তুই আসলেই বলদ।
ইফতি ভ্রু কুচকে বলল
–কত রোমান্টিক একটা ছবি তুলে দিলাম। বিনিময়ে বলদ উপাধি পেলাম। হায় ভাগ্য।
ঈশা আশে পাশে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–ছবি তোলার আগে আমাকে বলতে পারিস নি? আমি নিজে নিজে ঠিক হয়ে যেতাম।
ইফতি মিন মিনে গলায় বলল
–বলেছিলাম তো। শোন নি?
ঈশা আর কথা বলল না। সে জানে ইফতির সাথে কথা বলে কোন লাভ নাই। ইভান দূর থেকে তাদের কথা শুনছিল। ঈশার অবস্থা বুঝতে পেরে একটু হাসল। ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। কিন্তু হাসিটা চোখে পড়ল না।
————–
সোজা রাস্তা ধরে সোডিয়াম বাতির আলোয় কয়েকজন যুবক যুবতী হেটে চলেছে নিজেদের গন্তব্যে। এলোমেলো ভাবে হাঁটছে। মাঝে মাঝে থেমে থেমে ব্রিজের উপরে উঠে চিৎকার করছে। আবার কখনও একজন আরেক জনের পিছনে দৌড়ে ধরার চেষ্টা করছে। অবাধ্য মনটার সকল আবদার আজ পুরন করতে ব্যস্ত তারা। ঈশা পিছনে ছিল। ইভান ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিল। হঠাৎ থেমে সামনে তাকিয়েই পিছনে হাত বাড়িয়ে দিলো। ঈশা একটু থেমে গেলো। হাত বাড়ানোর কারন বুঝতে পেরে মুচকি হেসে হাত ধরে ফেলল। ঈশা হাত ধরে তার পাশে দাড়াতেই ইভান হাটার গতি কমিয়ে দিলো। কথা শেষ করে ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে সামনে তাকিয়ে ঈশার হাত শক্ত করে ধরে হাঁটছে। কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে দেখল রিক্সা দাড়িয়ে আছে। ইভান একটু গলা তুলে বলল
–চল রিক্সায় উঠি।
সবাই থেমে গেলো। আবার জোড়া ধরে রিক্সায় উঠল। চলতে লাগল বাড়ির দিকে। কিছুক্ষন থেমে ঈশা মৃদু কণ্ঠে বলল
–কয়টা বাজে?
ইভান যেন কথাটা শুনল না। খানিক্ষন পর মুখ ফিরিয়ে গম্ভির আওয়াজে বলল
–১.৩০।
ঈশা আঁতকে উঠল। এতো রাত পর্যন্ত বাইরে সে! ভাবতেই গায়ে কেমন কাটা দিয়ে উঠল। আচমকা ঠাণ্ডা হাওয়া এসে গায়ে আরও কাপন ধরিয়ে দিলো। ঈশা ওড়নাটা ঠিক করে মেলে পুরো গায়ে জড়িয়ে নিলো। ইভান বুঝতে পারল তার ঠাণ্ডা লাগছে। হুডটা উঠিয়ে দিলো। ঈশা প্রথমে একটু বিরক্ত হলেও পরে মনে মনে খুশি হল। কিছুদুর যেতেই ক্লান্ত ভঙ্গিতে ভয়ে ভয়ে ইভানের ঘাড়ে মাথা রাখল। কিন্তু ইভানের কোন প্রতিক্রিয়া হল না। এমন কি ঈশার দিকে ঘুরেও তাকাল না। ঈশা এতেই খুশি যে তাকে উঠিয়ে দেয় নি। সে আর একটু সুযোগ নিয়ে ইভানের হাত জড়িয়ে ধরল। এবার ইভান ঈশার দিকে ঘুরে তাকাল। খুব শান্ত দৃষ্টিতে। ঈশা ভয় পেয়ে গেলো। কিন্তু ইভানের দৃষ্টি দেখে সস্তি পেল। ইভান সামনে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল
–খারাপ লাগছে?
ঈশা কথাটা শুনে নিজের খুশিটা চেপে রাখতে পারল না। হাসি হাসি মুখেই বলল
–না ভালো লাগছে।
ইভান মুখ ফিরিয়ে মুচকি হাসল। ঈশা সারা রাস্তা ওভাবেই থাকল। রিক্সার ঝাকুনিতে আর ইভানের উষ্ণতায় হালকা তন্দ্রা ভাব এসে গেলো। রিক্সা এসে থামতেই ঈশার তন্দ্রা ঘোর কেটে গেলো। একে একে সব রিক্সা এসে থামল। ঈশা কি ভেবে নিজের ব্যাগে হাতড়াল অনেকটা সময়। কিন্তু কাঙ্খিত জিনিসটা না পেয়ে অসহায়ের মতো মুখ করে বলল
–ইলু আপু আম্মু এতক্ষনে ঘুমিয়ে গেছে। আমার চাবিটাও খুজে পাচ্ছি না। আমি তোমার সাথে যাব।
ইরিনা খুশি হয়ে ঈশার হাত ধরে বলল
–খুব ভালো হইছে। চল একসাথে থাকব সবাই।
ইলু ইরিনার হাত ঈশার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হাসি মুখে বলল
–তোর বর নেই। তোর দায়িত্ব আমি নিতে পারি। কিন্তু এই বিবাহিত মহিলার দায়িত্ব আমি কোনভাবেই নেব না।
মহিলা কথাটা শুনেই ঈশা রেগে গেলো। একটু ঝাঝাল গলায় বলল
–কি বলছ এসব? আমি মহিলা মানে?
ইভান উলটা দিকে ঘুরে দাড়িয়ে মানি ব্যাগ থেকে ইফিতকে বাড়ির চাবি বের করে দিচ্ছিল। ইফতি চাবি নিয়ে উপরে গেলো তালা খুলতে। আর ইভান ওভাবেই দাড়িয়ে থাকল। ইলু ইভানের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল
–তোর জলজ্যান্ত বর নিজে উপস্থিত আছে। আর শশুর বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছিস। সেখানে আমি কি করে তোর দায়িত্ত নেই বল।
ঈশা কথার মানে বুঝতে পেরে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আপত্তি জানাতে প্রস্তুতি নিয়েও লাভ হল না। ইলু দাত কেলিয়ে বলল
–তুমি তোমার বরের সাথে শশুর বাড়িতে যাও। প্রথমবার বলে কথা। নতুন বউ। আমরা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে আসব। প্রমিস। একটুও মিস করার সুযোগ দেব না।
বলেই ইরিনার হাত ধরে টেনে নিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–অল দা বেস্ট ভাইয়া।
ইভান পিছনে ঘুরে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে। সে মাথা ঘুরিয়ে ইরিনা কে নিয়ে চলে গেলো। ইভান সামনে ঘুরে নিশব্দে হেসে ফেলল। ঈশা অপ্রস্তুত হয়ে দাড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। তার ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে দৌড় দিয়ে বাসায় চলে যেতে। কিন্তু সেটারও উপায় নাই। ঈশাকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইভান ঘুরে বলল
–আপনার জন্য কি ইনভাইটেশন কার্ড ছাপাতে হবে?
ঈশা কোন কথা না বলে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। ইভান একটু হেসে তার পিছনে পিছনে গেলো। ভিতরে ঢুকে দেখে সব অন্ধকার। ইফতি নিজের ঘরে চলে গেছে। ঈশা মাঝখানে দাড়িয়ে গেলো। এই বাড়িতে আগেও অনেকবার থেকেছে। কিন্তু এরকম অনুভুতি হয়নি। আর সব সময় ইভানের মায়ের সাথেই থেকেছে। কিন্তু আজ তো উনি ওনার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাহলে কোথায় থাকবে? তার ভাবনার মাঝেই ইভান নিজের দরজার সামনে দাড়িয়ে হেলানি দিয়ে বলল
–কি হল? ওখানে দাড়িয়েই কি রাত পার করে দেয়ার ইচ্ছা আছে নাকি?
ঈশা চমকে উঠল। ঢোক গিলে একটা জোরে শ্বাস টেনে দ্রুত পায়ে ইভানের ঘরের দিকে গেলো। ইভানের পাশ কেটে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো রহস্যময় হাসি। সেই হাসিই যেন ঈশার এতক্ষনের সব তন্দ্রা ভাব কেটে দিলো। ঝরঝরে হয়ে গেলো মস্তিষ্ক। ইভান ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল পা ঝুলিয়ে। ঈশা ব্যাগটা টেবিলে রেখে এদিক সেদিক ঘুরে দেখছে। ইভান মাথাটা একটু তুলে বলল
–ছোট বেলা থেকেই এই ঘরে ঘোরাফেরা করার পরেও কি আজ অপরিচিত মনে হচ্ছে?
ঈশা নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বলল
–না। টায়ার্ড লাগছে। আমি ফ্রেশ হব।
বলেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ইভান উঠে বসলো। ঠোট কামড়ে নিজের চুল ঠিক করতে করতে হাসল। আলমারি থেকে নিজের কাপড় বের করে নিয়ে আবার বিছানায় বসে পড়ল। কিছুক্ষন পর ঈশা ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে এলো। ইভান ঈশার দিকে একবার তাকিয়ে উঠে ওয়াশ রুমে গেলো। পানির আওয়াজ পেয়ে ঈশা ভাবল ইভান গোসল করছে। বের হতে দেরি হবে। তাই ওড়নাটা বিছানার উপরে রেখে চুল গুলো আঁচড়িয়ে বাধতে লাগল। কিন্তু চুল বাধা শেষ হওয়ার আগেই ইভান বের হল। দরজা খুলেই আগে চোখ পড়ল ঈশার দিকে। ঈশা তাড়াতাড়ি করে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিলো। ইভান চোখ নামিয়ে নিলো। এগিয়ে গিয়ে বারান্দার দরজা খুলে তোয়ালে মেলে দিয়ে আবার লাগিয়ে দিলো। ঈশার দিকে তাকাল না। দরজার কাছে গিয়ে মৃদু সরে বলল
–অনেক রাত হয়েছে এখন ঘুমান উচিৎ।
ঈশা কিছু না বুঝেই ইভানের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
–তুমি কোথায় যাচ্ছ?
ঈশার কথা কানে আসতেই ইভানের এতক্ষনের বাধ্য চিন্তারা কেমন অবাধ্য হয়ে উঠল। গোছানো অনুভুতি বর্বর হয়ে গেলো। চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। তারপর নরম গলায় বলল
–বাসায় আব্বু আম্মু আছে। এখানে থাকাটা ঠিক হবে না। আমি ইফতির ঘরে ঘুমাব।
ইভানের কথা বুঝতে পেরে ঈশা সোজা সাপটা উত্তর দিলো
–আমি সেটা বলিনি। কোথায় ঘুমাবে তাই জানতে চাচ্ছিলাম।
ইভান কোন উত্তর না দিয়ে লাইট অফ করে বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষন সোফায় বসে ফোন নিয়ে কাজ করলো। ঈশা শুয়ে পড়ল। বেশ কিছুক্ষন পর ইভান উঠে ইফতির ঘরে যাওয়ার আগে নিজের ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল। ঈশাকে ঘুমাতে দেখে মুচকি হেসে পায়ের কাছে বসে পায়েলটা সাবধানে পরিয়ে দিলো। উঠে মাথার কাছে এসে কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে ফিস ফিস করে বলল
–তুমি নামক অভ্যাসটা বড়ই ভয়ংকর! একবার করে ফেললে এর থেকে যে আর কোনভাবেই আমার নিস্তার নেই। তাই গোছানো অনুভুতি গুলোকে এলোমেলো করতে চাইনা জান।
চলবে………